সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩০
জাওয়াদ জামী
রাশেদীন বাড়ির ছাদে যেন মিলন মেলা বসেছে। আফরোজা নাজনীন ও তার জায়েরা মিলে সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে নিচে চলে গেছেন। দিদুনও কিছুক্ষণ ছাদে ছিলেন, এরপর তিনি বাচ্চাদের আনন্দ করতে বলে নিচে চলে যান।
” এদিকে আয়। ” নিহান দৃষ্টির হাত ধরে ওকে নিয়ে গেল ছাদের দক্ষিণ দিকে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে বড় একটা কাঁঠাল চাঁপার গাছ আছে। নিহানের পছন্দের ফুলের একটা কাঁঠাল চাঁপা। রাতের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁঠাল চাঁপার সুবাস। গাছ ভর্তি ফুল দেখে মনে হচ্ছে, কোন রমনী গা ভর্তি গয়নায় সেজেছে।
দৃষ্টি এর আগেও ছাদে এসেছে। কাঁঠাল চাঁপা ফুটতে দেখেছে। ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়েছে কাঁঠাল চাঁপার সুবাস। তাই নিহানের ডাকে সায় জানালো। দক্ষিণ প্রান্তে এসে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিল। ওর চোখেমুখে প্রশান্তির ছায়া। নিহান ওর রমনীকে দু-চোখ ভরে দেখছে। এই মেয়েটিকে কবে ভালোবেসেছে সেটা নিহানের জানা নেই। ও শুধু জানে, এই মেয়েটিকে ছাড়া ও শূন্য। একটু ঝুঁকে নিহান এক থোকা ফুল ছিঁড়ে গেঁথে দিল দৃষ্টির বেণিতে। ঘোর লাগা গলায় আবৃত্তি করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” রাতের আকাশে ভেসে বেড়ায় ভালোবাসার গান,
কাঁঠাল চাঁপার ঘ্রানে বিমোহিত প্রান।
হলুদ ফুলেরা ফিসফিসিয়ে বলে-
ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, নয়নের অতলে।
তোকে পেলে ভালোবাসা আরও হয় গভীর
ফুলের ঘ্রানে বাজে প্রেমের বীণা,
এই আকাশ জানে, চাঁদও ডেকে কয়,
তারার আলোয় লেখা শুধু তোরই নাম,
তুই সেই চিরচেনা, চিরনবীনা।
তোর প্রেমের বেদীতে এই মন সঁপিলাম। ”
নিহান আবৃত্তি শেষ করলেও দৃষ্টি নির্বাক চেয়ে রয় তার পানে। আবেশে শরীর কাঁপছে। ওর বলার ভাষা নেই। ওকে নিয়ে কেউ কবিতা লিখবে সেটা কস্মিনকালেও ভাবেনি দৃষ্টি।
” ভালো লাগেনি? ” দৃষ্টিকে নীরব থাকতে দেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল নিহান।
” এতটাই ভালো লেগেছে যে আমি বলার জন্য কোন কথাই খুঁজে পাচ্ছিনা। ” কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিল দৃষ্টি। আজ ওর কান্না পাচ্ছে। বাবা-মার মৃত্যুর এত কান্না আর কখনোই পায়নি।
” একদম না। কাঁদতে পারবিনা তুই। তোর চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারিনা। আমি তোর হাসিমাখা মুখে সুখ খুঁজে বেড়াই। তোর অশ্রুভরা আঁখি আমার যাতনা বাড়ায়। ”
” ঠিক আছে কাঁদবনা। তবে তোমাকে প্রমিজ করতে হবে, আজকের পর থেকে প্রতিদিন আমার জন্য কবিতা লিখবে। আমি শুনতে চাই। আবেশে ভাসতে চাই তোমার কণ্ঠের যাদুতে । ”
” এই রে , প্রতিদিন কবিতা লিখব কিভাবে! আমি কি কবি নাকি? মাফ কর, বউ। বড়জোর সপ্তাহে দুইদিন তোর জন্য কবিতা লিখতে পারি। ”
” উঁহু , কোন অযুহাত শুনবনা আমি। প্রতিদিন কবিতা আমার চাই-ই চাই। আমার জন্য প্রয়োজনে তোমাকে কবিই হতে হবে। ”
দৃষ্টির জিদের কাছে হার মেনে ওকে প্রতিদিন নতুন কবিতা শোনাতে রাজি হয় নিহান । নিহানের প্রতিশ্রুতি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল দৃষ্টি। ও আনন্দে নিহানের গলা জড়িয়ে ধরল।
” ওদিকে কি দেখছ? বড় বোন হয়ে ছোট বোনের রোমাঞ্চ দেখতে লজ্জা করছেনা তোমার? ”
কানের কাছে ফিসফিসানি শুনে চমকে উঠল কুহু। পাশে তাকাতেই দেখল তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে। কুহু কপাল কুঁচকে তাহমিদের কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছে। ও আবার কার রোমাঞ্চ দেখছে? ও তো মুগ্ধ নয়নে গাছ ভর্তি কাঁঠাল চাঁপার সৌন্দর্য দেখছিল ৷ চিন্তার মাঝেই কুহুর চোখ গেল ছাদের দক্ষিণ দিকে। সেখানে নিহান আর দৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে। এবার তাহমিদের কথার মানে বুঝতে পারল কুহু। ও লজ্জা পেল ভিষণ। লজ্জা ঢাকতেই বলল,
” মোটেওনা। আমি অন্য কোন দিকেই তাকাইনি। আমিতো ফুলগুলো দেখছিলাম। আগে কখনোই কাঁঠালচাঁপা স্বচক্ষে দেখিনি। গল্প, কবিতায় এর বর্ণনা শুনেছি। ”
” ওহ , আচ্ছা। আমিতো ভাবলাম , ওদের রোমাঞ্চ দেখে তোমারও রোমাঞ্চের সাধ হয়েছে। সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। দিলে তো আমার মনটা ভেঙে? আমার কথার সাথে সায় মেলালে কি এমন ক্ষতি হতো? ”
” ছিহ্ কি অশ্লীল কথাবার্তা। ওরা এসব কথা শুনলে কি ভাববে। সরে দাঁড়ান, আমি সিক্তার কাছে যাব। ” তাহমিদকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে তাহমিদ ওকে বাঁধা দেয়।
” কি দরকার , তোমার মত আনরোমান্টিক, রসকষহীন মেয়ের ওদের গিয়ে? তুমি যাওয়া মানেই ওদের আড্ডার চৌদ্দটা বাজবে। নিজেও আনন্দ করবেনা , আবার ওদেরও আনন্দ করতে দেবেনা। তারচেয়ে বরং আমারই বারোটা বাজাও। আমিই যেহেতু ইচ্ছাকৃতভাবে তোমার মত নিরানন্দ মেয়ের মায়ায় জড়িয়েছি , সেহেতু বারোটা আমারই বাজুক। অবশ্য এই বারোটা বাজায়ও সুখ আছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ওর চারপাশে তাকাল। না কেউ তাহমিদের কথাগুলো শোনেনি।
” আর একটাও আজেবাজে কথা বললে, আমি এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাব। আর কোনদিনও এই বাসায় আসবনা। আপনি কেন বোঝেননা, বড়মা এসব জানতে পারলে বিষয়টাকে সহজভাবে নেবেনা, এসবের প্রভাব দৃষ্টির ওপরও পরবে ? ”
” আমি এক কথা বারবার বলতে পছন্দ করিনা। আগেও তোমাকে বলেছি , সংসার করব আমরা দু’জন। এরমধ্যে অন্য কাউকে টানবেনা তুমি। অন্য কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছা আমি দেখতে যাবোনা। তারপরও তুমি ফুপুকে টানছ আমাদের দু’জনের মধ্যে। বিষয়টা আমার জন্য বিরক্তিকর। আচ্ছা, ঠিক আছে ফুপুকে নিয়েই যখন তোমার এত ভয়, তখন একটা পারমানেন্ট ব্যবস্থা করতেই হচ্ছে। ওয়েট , আজকের পর থেকে আর তোমাকে ভয় পেতে হবেনা। আজকেই তোমাকে বিয়ে করব আমি। ”
” আপনি এমন করেন কেন? আমার বিষয়টা কেন বুঝতে চান না? ” কুহুর গলায় ঝড়ল অনুনয়।
” বোঝ ঠ্যালা। আমি তোমার সঙ্গে কথা বললেও দোষ , আবার বিয়ের কথা বললেও দোষ! কি করলে তোমার মন পাব , সেটা দয়া করে বলবে কি? ” তাহমিদও অসহায়ভাবে জিজ্ঞেস করল।
” কিছুই করতে হবেনা আপনাকে। আপনি শুধু বুঝেশুনে কথা বলবেন , তাহলেই হবে। ”
” কিহ্ ! আমি বুঝেশুনে কথা বলিনা ! তুমি মেয়ে, আমাকে চিনলেনা। তোমার আশেপাশে সব সময় থাকি বলে আমাকে আর পাঁচজন লাফাঙ্গা ছেলের মত ভাবছ তুমি? তুমি ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে বোধহয় কখনোই এত কথা বলিনি। তোমাকে ভালোবাসি জন্যই এসব করি। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ভড়কে গেল। কুহু বুঝতে পারছে , তাহমিদ ওর কথা শুনে কষ্ট পেয়েছে । কুহু এবার কি করবে ?
” ওকে, বলবনা আর কিছু তোমাকে। তবে সেটা সবার সামনে। লোকচক্ষুর আড়ালে কথা বলতে নিশ্চয়ই অসুবিধা নেই ? এবার থেকে সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করব। তখন নিশ্চয়ই তুমি আমার দোষ ধরতে পারবেনা। ” কুহুর চিন্তায় পানি ঢেলে বলল তাহমিদ।
তাহমিদের এবারের কথাগুলো শুনে কুহু কপাল চাপড়ালো। এ কাকে নিয়ে চিন্তা করছিল এতক্ষণ? এই মুহূর্তে এই লোকটাকে দেখলে কে বলবে, সে একজন ডক্টর ।
” জনসম্মুখে হোক আর লোকচক্ষুর আড়ালে হোক, আপনি সব সময় চুপ থাকবেন। সরুন দেখি , আমি ওদের কাছে গিয়ে দেখি ওদের কিছু লাগবে কিনা । ” তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে সিক্তার কাছে গেল কুহু।
কুহুর এমন রণচণ্ডী রূপ দেখে কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল তাহমিদ। এই মেয়ে প্রথমবারের মত এমন একটা সাহসী কাজ করল, যেটা ওর চরিত্রের সঙ্গে যায়না।
সিক্তার পিঠে ঝুপ করে কিছু একটা পরতেই চমকে পেছনে তাকাল। ছাদের মেঝেতে বেলি ফুলের মালা দেখে ওর ঠোঁটে ফুটল সুখের হাসি। আঁড়চোখে তাকাল আনানের দিকে । আনান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে । হাসছে মিটিমিটি। সিক্তা মালাটা তুলে নিয়ে নাকে ঠেকিয়ে বুক ভরে সুবাস নিল। আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়াল মালায়। আনান সেটা দেখে হেসে হাত রাখল বুকের বা পাশে।
” সিক্তাপু , বেলি ফুলের মালা কোথায় পেলে ? আমাকে দাওনা খোঁপায় দেব। ” সিক্তার হাতে মালা দেখে সোহা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল।
” মাফ কর আমাকে । প্রয়োজনে কালকে তোকে দশটা মালা কিনে দেব। তবু এটা তোকে দেবোনা। আর তোর চুল এতটাও বড় নয় যে খোঁপায় ফুলের মালা দিতে হবে। আগে বড় হ। তোর চুল বড় হোক তারপর খোঁপায় মালা দেয়ার চিন্তা করিস। ”
” তুমি দিনদিন কিপ্টে হয়ে যাচ্ছ , আপু । সেদিনও তোমার কাছে কতগুলো মালা দেখলাম। চাইলাম। কিন্তু দিলেনা । তোমার কাছে দামী কিছুই চাইনি। সামান্য ফুলের মালা চাইলাম, তা-ও দাওনা। ”
” তোর কাছে এগুলোকে সামনের মনে হতেই পারে । কিন্তু আমার কাছে এগুলো অমূল্য। পৃথিবীর যে-কোন কিছুর থেকেও মূল্যবান। ”
” বাব্বাহ্ ! আপু , তুমি কেমন কাব্য করে কথা বলছ ! দিনদিন তুমি রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছ । ঘটনা কি বলতো? ”
” সোহা , তুই যেন কোন ক্লাসে পড়িস? ”
” ওমা! এটা কি প্রশ্ন করলে ! আমি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আপু, তোমার মাথাটা গেছে নাকি? ”
” তোর এই বয়সে আমি বড় আপুদের সঙ্গে এভাবে কথা বলার সাহস পেতামনা । আর তুই কেমন নির্দিধায় আমাকে বড়দের মত প্রশ্ন করছিস! মুখে লাগাম দে বুঝলি? নয়তো চাচীকে বলে আচ্ছামত ধোলাই খাইয়ে নেব। ”
সিক্তার কথা শুনে সোহা মুখ কালো করল। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা সিক্তাপু ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলল।
” কি হয়েছে রে তোদের? একজন মুখ প্যাঁচার মত করে রেখেছিস , আবার আরেকজন পণ্ডিতের মত ভাব ধরে আছিস। ঘটনা কি? ” আনান সিক্তা আর সোহার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল।
” দেখোনা ভাইয়া , আপুর কাছ থেকে একটা জিনিস চাইলাম , কিন্তু আপু দিতে চাচ্ছেনা। ”
” কি রে সিক্ত, ছোটবোন একটা জিনিস চেয়েছে আর তুই ওকে না করে দিয়েছিস? এটা কিন্তু অন্যায়। বেচারি একটা জিনিস চেয়েছে ওকে দিলে কি হয়? ”
আনানের কথা শুনে সিক্তা ওর দিকে কটমট করে তাকালো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
” ভাআআআইয়া , সোহা এই মালাটা চেয়েছে । তোমার কি মনে হয়, মালাটা ওকে আমি দেব? ”
সিক্তার কথা শুনে আনানের মুখখানা চুপসে গেল। আমতাআমতা করে বলল ,
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৯
” সোহা , তুই কেন সামান্য ফুলের মালা চাইবি? তুই সিক্তর কাছ থেকে ওর পছন্দের ড্রেস চাইবি, ওর দামী জুতা চাইবি , ওর সাজার যন্ত্রপাতি চাইবি। সেগুলো না চেয়ে তুই ওর কলিজায় তীর মারতে চাইছিস কেন? তুই ওর কাছে ওর পছন্দের ড্রেস চেয়ে দেখ , ও এখনই দিয়ে দেবে। তাইনা রে, সিক্ত? ”
আনানের মুখভঙ্গি দেখে সিক্তার হাসি পায়। ও হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে।