সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪২
জাওয়াদ জামী
” তাহমিদ, আমাকে বলবি কি কুহু কোথায় গেছে? তুইও কিছু বলছিস না। আবার কুহুকে ফোন করলে মেয়েটাও কিছু বলছে না। একটা মাসের বেশি সময় ধরে মেয়েটা বাসায় নেই। ওর জন্য সবাই চিন্তা করছে। তোর চাচ্চুও বারবার জিজ্ঞেস করছে কুহুর কথা। আমি তাকে কোন জবাবই দিতে পারছি না। তোর বাবা বিরক্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করাই ছেড়ে দিয়েছে। কি চলছে তোদের মধ্যে? ঝগড়া করেছিস দু’জন? আমাকে বল, বাবা। ও কোথায় আছে, কেমন আছে কিচ্ছু জানতে পারছি না। ” উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন তাহমিনা আক্তার।
” তোমার কি মনে হয় কুহু ঝগড়া করার মেয়ে? ও কি আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে? কুহু যেখানে আছে ভালো আছে , মা। একমাস যখন ধৈর্য্য ধরেছ, তখন আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধর। কুহু চলে আসবে এরই মধ্যে। তখন ওর কাছ থেকে জানতে পারবে, এতদিন কোথায় ছিল। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলব , মা। বাবাকে বুঝিয়ে বলব। ” মায়ের উৎকণ্ঠা দেখে হাসলো তাহমিদ। মাকে বোঝানোর চেষ্টা করল।
” মেয়েটা বাসায় না আসা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনা আমি। ওকে ছাড়া বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাপ , আমাকে একটা কথা বল, মেয়েটা ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছে তো? পড়াশোনা হচ্ছে ওর ? ” তাহমিনা আক্তার কুহুর খোঁজ পেতে মরিয়া।
” মা , ও ঠিকমতই খাওয়াদাওয়া করছে। যদিওবা পড়াশোনা একটু কমই হচ্ছে। তবে ও সেটা পুষিয়ে নিতে পারবে । এবার নিচে চল তো। ক্ষুধা লেগেছে আমার। খেতে দাও আমাকে। ”
” আগে বলবি না তোর ক্ষুধা লেগেছে? তাড়াতাড়ি নিচে চল। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আফরোজা , এই বেয়াদব কে জিজ্ঞেস কর, কুহু মা কোথায় আছে? কতদিন হয়ে গেছে কুহু মা বাড়িতে নেই। ও কি করেছে মেয়েটার সঙ্গে, সেটা জিজ্ঞেস কর। ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন স্ত্রীকে বললেন। পরিবারের সকলে একসঙ্গে খেতে বসেছেন। সুযোগ বুঝেই ভদ্রলোক কুহুর কথা তুললেন।
” তাহমিদ , আমিও জানতে চাই , কুহু কোথায় গেছে? তুমি আমাদের কিছু বলছ না , আবার কুহুও প্রশ্নটা বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে । এভাবে আমাদের অন্ধকারে রেখো না। ” সাবির আহমেদ রাশেদীন এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন।
” কুহু একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাহিরে গেছে। বাহিরে গেছে মানে ঢাকার বাহিরে গেছে। আমিই ওকে পাঠিয়েছি । আর কিছুদিনের মধ্যেই ও বাসায় ফিরবে। এর বেশি কিছুই বলতে পারব না আমি। ”
” তা পারবে কেন ? আমরা কি এই পরিবারের কেউ , নাকি তোমার কেউ? তুমি নিজেই সর্বেসর্বা হয়ে বসে আছ । আমাদের পাত্তা দেয়ার সময় কোথায় তোমার! কতদিন হয়ে গেছে বাড়ির বউ বাড়িতে নেই। সে কোথায় আছে সেটাও জানি না। বাবা-মা হারা মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে নিয়াজকে মুখ দেখাতে পারব আমরা? কি জবাব দেব নিয়াজকে? ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন খেঁকিয়ে উঠলেন।
” কুল, সিনিয়র, কুল। উত্তেজিত হয়ো না। উত্তেজনা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। তোমাদের বাড়ির বউ সহিসালামতেই আছে। কারোও কাছে কোনপ্রকার জবাবদিহি করতে হবে না তোমাকে। চিন্তার কোনো কারন নেই। তুমি সব সময়ই এই পরিবারের মস্তক ছিলে, আছ, এবং থাকবে। তাই তোমাকে পাত্তা না দেয়ার কোন কারনই নেই। তুমি যদি নিজেকে পরিবারের লেজ ভেবে নিজে নিজেই কষ্ট পাও, সেক্ষেত্রে আমরা কি করতে পারি! ” তাহমিদ চাচ্চুকে খেপিয়ে দেয়ার সুযোগ ছাড়ল না।
” শুনেছ আফরোজা , এই খাঁটি বেয়াদব কি বলছে? মস্তক , লেজ! আরও দাও আস্কারা, আরও মাথায় তোল এই খাঁটি বেয়াদবকে। এখন তো নিজের বউকে লুকিয়ে রেখেছে। এরপর যখন তোমাদেরকে লুকিয়ে রাখবে, তখন বুঝবে কেন আমি এর ওপর এত চিৎকার চেঁচামেচি করতাম। ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন রাগে কাঁপছেন।
” তুমি শান্ত হও। তাহমিদ বাচ্চা নয়। যথেষ্ট বুদ্ধি ওর আছে। ও যা করছে নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই করছে। ও যখন আর কয়েকটা দিন সময় চাচ্ছে, তখন সময় নিক না। এরপর কুহু ফিরে আসলেই সবকিছু খোলাসা হয়ে যাবে। আর তখন তাহমিদকে যা বলার বলো তাই এখনই এত চিন্তা করে শরীর খারাপ করো না। ” আফরোজা নাজনীন স্বামীকে শান্ত করার জন্য বললেন।
” তাহমিদ , ভাইয়া কিন্তু ভুল কিছুই বলছে না। বউমা কোথায় গেছে সেটা জানার অধিকার আমাদের আছে বলেই মনে করি। তুমি আমাদের কিছু জানাচ্ছো না এটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে তুমি ভাইয়াকে এভাবে বিরক্ত করতে পারো না। তোমার কাছে এমন আচরণ আশা করি না আমি। ভবিষ্যতে ভাইয়াকে কিছু বলার আগে, আমার কথাটা স্মরণ করো। যাইহোক বউমা ভালোয় ভালোয় বাসায় ফিরে আসুক, এটাই চাই। কিন্তু সেটা যেন খুব তাড়াতাড়িই ঘটে। ” সাবির আহমেদ রাশেদীন ছেলেকে সাবধান করে দিলেন।
” সাবির , তুমি তাহমিদের সঙ্গে এভাবে কথা বলছ কেন? ও কি কোন অন্যায় করেছে ? নিজের চাচ্চুর সঙ্গে কথা বলছে ও। বাহিরের কারও সঙ্গে কি দুষ্টুমি করছে ? তুমি বাবা হয়ে যদি এমন কথা বলো , তবে ছেলেটা কষ্ট পাবে না! তাহমিদ , তুই খেয়ে নে, বাপ। আজ রাত থেকেই তোর খাবার তোর রুমে পাঠিয়ে দেব। এরা তোকে এখানে শান্তিতে খেতে দেবে না। ” আফরোজা নাজনীন একটু রেগেই গেলেন।
” ঠিক আছে , বড়মা। তুমি ছাড়া আমার কষ্ট কেউই বোঝে না। অবশ্য মা-ও বোঝে একটু একটু। ” তাহমিদ বোকা বোকা চেহারায় বলল।
তাহমিদের মুখভঙ্গি দেখে হাসলেন আফরোজা নাজনীন।
” ছাড়ো না। রান্না করতে হবে তো। সকাল দশটা বাজে অথচ সকালের খাবারই তৈরী করতে পারলাম না। এভাবে চেপে ধরে থাকলে রান্না করব কখন বলতো? ” দৃষ্টি নিহানের কাছ থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করছে।
” লাভ নেই। বারোটার আগে তোকে ছাড়ছি না। সারা সপ্তাহ থেকে অফিস করে, ছুটির দিনে বউকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতেই পারি। এতে তোর এত সমস্যা কেন? ক্ষুধা লাগলে ফ্রিজ থেকে ফল, মিষ্টি বের করে খাবি। আমি মসজিদে যাওয়ার পর রান্না শুরু করবি। এখন চুপচাপ শুয়ে থাক। বিরক্ত করিস না। আদর করতে সমস্যা হচ্ছে। ” নিহান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল দৃষ্টিকে।
দৃষ্টি বুঝল এই লোকটার হাত থেকে বারোটার আগে ওর মুক্তি নেই। তাই মটকা মেরে শুয়ে থাকল। তবে তার মেয়াদ বেশিক্ষণ ছিল না। তার আগেই বেজে উঠল কলিংবেল। কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই দৃষ্টি নিহানের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। নিহানের মুখটা দেখার মত হয়েছে।
” এইবার ছাড়বে তো নাকি ? কে এসেছে দেখতে হবে না? ”
” যা দেখ গিয়ে। ” দৃষ্টিকে অনেক কষ্টে ছেড়ে দিয়ে বলল নিহান।
দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেল দৃষ্টি। সামনে দাঁড়ানো বড়মাকে দেখে ওর বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। বড়মার চেহারার হাল এমন হয়েছে কেন? চোখের নিচে কালি পরেছে , শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তার চোখমুখ জুড়ে বিরাজ করছে শুধুই হতাশা আর লজ্জা।
” বড়মা , তুমি এসেছ! এসো, ভেতরে এসো। একাই এসেছ তুমি? চাচা আসেনি? ” দৃষ্টি রাখী আক্তারকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসলো।
” নিহান কোথায় , দৃষ্টি? ওকে ডাকলে আমার সামনে আসবে না? ” ভেতরে ঢুকে দৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করল রাখী।
” কেনো আসবে না! সে তোমার ছেলে নয়? তার প্রতি তোমার অধিকার নেই? ডাকো তাকে। দেখি সে কেমন না এসে থাকতে পারে। সে যদি না আসে, তবে তোমার সঙ্গে আমি নাটোর চলে যাব। ”
দৃষ্টির কথায় কিছু একটা ছিল। যেটা বুঝতে পেরে উচ্ছ্বসিত হল রাখীর অন্তর। খুশিতে চোখের কোনে পানি জমল। এই মেয়েটাকে সে নিহানের জীবন থেকে সরাতে চেয়েছিল? কারনে-অকারনে অপমান করত? মেয়েটাকে কষ্ট দেয়ার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিল রাখী। চোখ মুছে, সাহস সঞ্চার করে নিহানকে ডাকল,
” নিহান , কোথায় তুই, আব্বা? দেখ তোর পাপী আম্মু এসেছে। ”
” আম্মুর গলা শুনলাম মনে হয়! ”
নিহান ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। দ্বিধার দোলাচালে দুলছে ওর মন। মা-ই যদি হয় তবে কি ওর বাহিরে যাওয়া উচিত? ওর মনের এক অংশ বলছে , যাওয়া উচিত। মা ডাকছে আর সন্তান তার কাছে যাবে না, এটা হতে পারে না। কিন্তু মনের আরেক অংশে অভিমান জন্মেছে । সে বলছে , কেন যাবি তুই বাহিরে? তোর মা তোর দৃষ্টিকে কম অপমান করেনি। ওদের তিন ভাইবোনকে কম কষ্ট দেয়নি। শুরু হলো নিহানের পরীক্ষা।
” আমি জানতাম , নিহান আসবে না। ও আমাকে কোনদিনও ক্ষমা করবে না। ” কথাগুলো বলে রাখী হুহু করে কেঁদে উঠল।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪১
দৃষ্টি বেডরুমের দরজার দিকে চাতকিনীর ন্যায় চেয়ে আছে। ও মনেপ্রাণে চাইছে, নিহান ভাইয়া একবার বেরিয়ে আসুক। মা-ছেলের মান-অভিমানের পালা ঘুচাক। কিন্তু নিহান ভাইয়া যে আসছে না! কেন? নিহান ভাইয়া, কেন? এত রাগ কেন তোমার? দৃষ্টি সিদ্ধান্ত নিল, ও রুম থেকে নিহানকে জোর করে বের করবে। পা বাড়াল বেডরুমের দিকে। কিন্তু দুই ধাপ এগিয়েই থেমে গেল। নিহান বেরিয়ে এসেছে।
” আম্মু , তুমি? ”
নিহানকে দেখে রাখী দৌড়ে গেল ছেলের দিকে।