সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৪
জাওয়াদ জামী
” তোমার শুভ বুদ্ধির উদয় হতে দেখে সত্যিই খুশি হয়েছি আমরা। নিজের সন্তানকে ভুল পথে যেতে দেখলে, ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেখলে প্রত্যেক পিতামাতারই কষ্ট হয়। আমারও হয়েছিল। মা হিসেবে নিজেকে জঘন্য মনে হয়েছিল । আজ আবার তোমাকে নতুন রূপে দেখে আমি ভিষণ খুশি হয়েছি। আশা করব ভবিষ্যতেও নিজের এই বদলটা ধরে রাখবে। ” আয়েশা সালেহা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।
” দোয়া করবেন আম্মা , এভাবেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকতে পারি। দৃষ্টির বড়মা কিংবা শ্বাশুড়ি নয় বরং যেন ওর মা হয়ে উঠতে পারি সেই দোয়াই করবেন। ছেলে, বউমা, নাতি-নাতনি দিয়ে আমার সংসার যেন পরিপূর্ণ হয় এই দোয়াই চাই আমি। ”
” দোয়া করি সুখী হও। পূর্বের সকল অন্যায়ের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে মোনাজাতে বেশি বেশি কান্নাকাটি করবে । মনে রেখ , তিনি অতি দয়ালু। ”
” জ্বি, আম্মা। ”
” কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাও, রাখী। নিহান এখান থেকেই অফিস করবে। কুহু নেই তাই বাড়ির সবারই মন খারাপ। দৃষ্টি থাকলে আমাদের ভালো লাগবে। ” আফরোজা নাজনীন ননদকে প্রস্তাব দিলেন।
” এবার থাকতে পারব না , ভাবী। নিহানকে ছুটি নিতে বলেছি। ওদেরকে নিয়ে গ্রামে যাব। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকতে তাদের জন্য তো কিছুই করিনি। অনেক পাপ জমেছে। আর সেই পাপমোচন তো আমাকেই করতে হবে। নিহানের আব্বুকে বলেছি , আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশের সবজি ক্ষেতে একটা মসজিদ তৈরী করতে। সাথে মাদ্রাসাও থাকবে। তবে তার আগে কয়েকটা মাদ্রাসা, এতিমখানার ছেলেমেয়েদের একবেলা পেটপুরে খাওয়াব। কুরআন খতম দিতে বলব। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির জন্য দোয়া খায়েরের ব্যবস্থা করব। তোমাদেরকে ফোন করলে তোমরা যেও কিন্তু। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাখীর কথা শুনে রাশেদীন বাড়ির সকলেই ভিষণ অবাক হলেন। রাখীর এহেন পরিবর্তন দেখে তাদের চোখ কপালে উঠেছে। তবে প্রত্যেকে আনন্দও পাচ্ছেন। রাখীর মত নাক উঁচু মহিলাকে বদলাতে দেখে কার না ভালো লাগবে?
” আমরা সবাই যেতে পারব কিনা জানি না। তবে তাহমিদ-কুহু অবশ্যই যাবে। যদি ততদিনে কুহু বাসায় আসে। ”
” কুহু গেছে কোথায় , ভাবী? আর আসবেই বা কবে? ”
” সেটা শুধুমাত্র তাহমিদই জানে। এবার ওঠ। টেবিলে খাবার দিয়েছে। সবাই খেয়ে নেবে চল। ”
” বড় বউমা , তোমার শ্বশুরের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আমাকে ফোন করেছিল গতরাতে । তারা গতবার এসে সিক্তাকে দেখে গিয়েছিল । ওর নাম আসাদ। আসাদের ছেলে এবার কুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে ঢুকেছে। আসাদ ওর ছেলের জন্য সিক্তাকে পছন্দ করেছে। তোমরা চাইলে এখানে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব রাখবে তোমাদের কাছে। ” বড় ছেলের বউকে বললেন আয়েশা সালেহা।
আয়েশা সালেহার কথা শুনে সিক্তার মাথা ঘুরে উঠল। ওরা সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তখনই দিদুন কথাটা তুললেন।
” আপনার ছেলেরা বাসায় আসুক, আম্মা। মেয়ে তো শুধু আমার একার নয়। তাই আমি কিছুই বলতে পারব না। তবে আসাদের ছেলেটা বেশ স্মার্ট আর ভদ্রও। আমার কাছে ছেলেটাকে ভালোই লাগে। আপনার ছেলে আসলে বলে দেখেন, সে কি বলে। এছাড়া তাহমিদের মতামতও নিতে হবে। ”
” কিসের মতামত, বড়মা? ” তাহমিদ মেডিকেল থেকে সবেমাত্র বাসায় ঢুকেছে। তখনই বড়মার শেষের কথা ওর কানে যেতেই জিজ্ঞেস করল।
” আম্মা সিক্তার বিয়ের ব্যপারে কথা বললেন। তোর আসাদ চাচা তার ছেলের জন্য সিক্তাকে পছন্দ করেছে। তুই কি বলিস? ”
” আমি আর কি বলব! সিক্ত বড় হয়েছে , বিয়ে তো দিতে হবে। ভালো ছেলে পাওয়া গেলে দেরি করার দরকার কি ? ”
এবার সিক্তার মনে হচ্ছে পায়ের নিচে মাটি নেই । ভাইয়া এসব কি বলছে? শরীর কাঁপছে মেয়েটার।
” দাদু ভাই, তুমি আসাদের ছেলেকে চেনো তো? ছেলেটাকে আমার কিন্তু বেশ লাগে। আর তাছাড়া আসাদও খুব আশা করে আছে। ”
” খুব ভালো করেই চিনি। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কও ভালো। ছেলে হিসেবেও আয়মান যথেষ্ট ভালো। আর আমাদের বংশের ছেলেরা যে খারাপ হবে না, এটা কিন্তু জানা কথা। ”
” আজকে বাসায় সবাই আসুক। সবার সঙ্গে কথা বলব। আমারও আসাদের ছেলেকে পছন্দ। সিক্তা আমার আদরের নাতনী। ওকে তো আর যার তার হাতে তুলে দেয়া যায় না। বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকবে, এর থেকে আর আনন্দের বিষয় কি হতে পারে? ”
” সিনিয়র রাশেদীনের সঙ্গে কথা বলে দেখো। সে কি বলে সেটা শুনে নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিও। ”
সিক্তার কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে প্রানপনে কান্না লুকানোর চেষ্টা করল। এই মুহূর্তে সবকিছু আনান ভাইয়াকে জানাতে হবে।
” সাবির , তুমি কি বল? আম্মাও চাচ্ছেন আসাদের সঙ্গে আত্নীয়তা করতে। আমি সুপ্তি, দ্যুতির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে একটু আগেই। ওরাও অমত করেনি। কি করব বলতো? ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন তার ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন।
” তুমি কি চাও, ভাইয়া? আমাদের চাওয়াতে কিছুই হবে না। তোমার সিদ্ধান্তেই হবে সবকিছু। ”
” আমার বড় দুই মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তোমাদের সিদ্ধান্ত যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি ছোট মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে। এবারেও তোমাদের মতমতকে প্রাধান্য দেব আমি। তাছাড়া তোমার একটা বেয়াদব ছেলে আছে। তার মতামতও জানা দরকার। কোথায় সে? তাকে ডাকো। ”
” কাকে ডাকার কথা বলছ , সিনিয়র? এই বাড়িতে বেয়াদব নামের কেউই থাকে না ৷ এই বাড়ির সকলেই আমার মত ভদ্রসভ্য। ” সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বড় চাচাকে খোঁচা মারল তাহমিদ।
” সাবির , এ নাকি ভদ্রসভ্য! আমরা সবাই নাকি ওর মত! নিজেকে ফেরেশতা মনে করে তোমার ছেলে। অথচ আস্ত একটা বেয়াদব সে। খাঁটি বেয়াদব যাকে বলে। কোন ভেজাল নেই। একেবারে নির্ভেজাল বেয়াদব। ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন ফুঁসে উঠলেন।
” আহ্ সিনিয়র , আমি নির্ভেজাল বেয়াদব মানেই বংশের জীন শরীরে বহন করছি। এভাবে নিজেকে উন্মোচিত না করলেই কি নয় ? আমি জানি, তোমার জীন আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কিলবিল করছে। ” তাহমিদ বড় চাচার দিকে তাকিয়ে মারফতি হাসি দিল।
” শুনেছ সাবির, তোমার ছেলের কথা? আমি নাকি বেয়াদব! তা-ও আবার নির্ভেজাল! এটাকে আমার সামনে থেকে সরতে বলো । নিকুচি করেছি আমার জীনের। প্রয়োজনে আমি আমার বংশের জীন নিজের শরীর থেকে বের করে ফেলব । তবুও আমি নিজের সঙ্গে এই বেয়াদবের কোন সম্পর্ক মানব না। ”
” বাবা , তোমার বিগ ব্রাদারকে শান্ত হতে বল। বড়মা , ঠান্ডা পানি ঢালো ভদ্রলোকের মাথায়। বেচারা এই বয়সে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চায়। সো স্যাড। ” তাহমিদ বড় চাচার পাশে বসে হাঁই তুলল।
” আফরোজা , এই নির্ভেজাল বেয়াদবকে আমার পাশে থেকে সরে বসতে বল। একে আমার সহ্য হচ্ছে না। ” খেঁকিয়ে উঠলেন সাদিক আহমেদ রাশেদীন।
” তাহমিদ , তুমি ভাইয়ার পাশ থেকে সরে বস। আজকে আবারও বলছি , তুমি ভাইয়ার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে না। তুমি কিন্তু আর ছোট নেই যে সব সময় ভাইয়া৷ সঙ্গে বেয়াদবি করবে। ” সাবির আহমেদ রাশেদীন ছেলেকে সাবধান করে দিলেন।
” বাবা কিসের যেন আলাপ করছিলে তোমরা? ভদ্রসভ্য সিনিয়র ভদ্রলোক আমাকে ডাকতে বলেছিল বোধহয় ? যাক বেয়াদব হলেও গুরুত্ব কমে যায়নি বলেই আমি খুশি। এবার বল কেন ডেকেছিলে আমাকে। ” ভাব নিয়ে কথাগুলো বলল তাহমিদ।
তাহমিদের কথা শুনে সাদিক আহমেদ রাশেদীনের রাগ হলেও তিনি নিজের রাগকে সংবরণ করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন ,
” সিক্তার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আসাদের ছেলেকে আম্মার পছন্দ। তুমি কি বলো? ”
” শুধু দিদুনের পছন্দ হলেই হবে না। তোমার, বড়মার দু’জনেরই পছন্দ হতে হবে। আমার সিক্তার মতামত নেয়াও জরুরী। বিয়েটা ওর হবে, ও সংসার করবে। তাই ওর পছন্দেরও গুরুত্ব দিতে হবে। তুমি কি বলো, সিনিয়র? আয়মানকে তোমার পছন্দ? ”
” খারাপ লাগে না আয়মানকে। খুব স্মার্ট একটা ছেলে সে। উচ্চশিক্ষিত সে। আমারই বংশের ছেলে। খারাপ লাগার কি আছে! ”
” কেন আনান কি স্মার্ট নয়? ওর বংশ কি ভালো নয়? আনানও ঢাবিতে পড়ছে। ও কম কিসে? ”
তাহমিদের প্রশ্নে ওর দিকে চার ভাই-ই তাকালেন। তাকালেন তাহমিদের চাচীরাও। তাহমিদ কি বলতে চাচ্ছে , সেটা তাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
” তাহমিদ , এর মধ্যে আনানের কথা আসছে কেন, বাপ? সিক্তার বিয়ের কথা বলছি আমরা। ” আফরোজা নাজনীন অবাক হয়ে বললেন।
” আমিও সিক্তার বিয়ের কথাই বলছি , বড়মা। আনান কি পাত্র হিসেবে অযোগ্য? হ্যাঁ অথবা না একটা উত্তর চাই আমি তোমাদের কাছে। সবার কাছেই জানতে চাই। ” তাহমিদ একে একে সবার দিকে তাকালো।
” আনানকে আমার খুব কাছের কেউ বলেই মনে হয়। মাঝেমধ্যে আফসোস হয় আনানকে পেটে ধরতে পারিনি বলে। তুই যদি সিক্তার জন্য আনানকে পছন্দ করে থাকিস, তবে আমার উত্তর হবে, হ্যাঁ। আফরোজা নাজনীন হাসিমুখে বললেন।
” আমিও বলব, হ্যাঁ। আনান ছেলে হিসেবে পারফেক্ট। ” তাহমিনা আক্তার হাসছেন।
” আনান এই বাড়ির ছোট জামাই হলে মন্দ হবে না। খাঁটি সোনা ও। ” নাজমা আক্তারও গর্বভরে বললেন।
” আমিও বলছি, আনানকেই চাই সিক্তার পাশে। ” এবার বললেন শাহনাজ পারভীন।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৩
স্ত্রীদের কথা শুনে সাদিক আহমেদরা চার ভাই সত্যিই অবাক হয়েছেন। তারা সবাই জানেন৷, আনানকে এই বাড়ির প্রত্যেকেই ভালোবাসে। কিন্তু তাই বলে সিক্তার সঙ্গে আনানের বিয়ের ব্যাপারে একবাক্যে সবাই রাজি হয়ে যাবে, এটা তারা কেউই ভাবেননি। যেহেতু বাড়ির বউরা রাজি সেহেতু তারা কেউই অমত করবেন না। কারন আনান তাদের ভাগ্নে। তারা ভালোভাবেই চেনেন, জানেন আনানকে। চার ভাই ইশারায় তাদের সম্মতি জানালেন।
” আফরোজা , আম্মাকে নিয়ে এস। আম্মার মতামত জানতে পারলেই আমরা নিয়াজের সঙ্গে কথা