সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৩
জাওয়াদ জামী
” তমাপু , পাগলের ডক্টর দেখতে কিন্তু হেব্বি। তোমার কি কপাই মাইরি! এত সুন্দর একটা রসগোল্লার মত জামাই পেয়েছ। পাগলের ডক্টরকে দেখলেই মনে হয় টুপ করে খেয়ে ফেলি। ” দৃষ্টি তমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল।
দৃষ্টির কথা শুনে তমা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। এতটুকু মেয়ে যে এমন পাকামো কথা বলতে পারে সেটা দৃষ্টিকে না দেখলে বুঝত না তমা।
” দৃষ্টি ! তুমি কি সত্যিই কুহুর বোন ? আমাদের কুহু কিন্তু এভাবে কথা বলে না। ও এভাবে কথা বলতেই পারে না । নিহান জানে , ওর বউ আরেকজনের দিকে নজর দিয়েছে ? ” তমাও দৃষ্টির মতই ফিসফিসিয়ে বলল।
” নাহ্ জানে না। আর ওকে জানানোর ইচ্ছেও নেই আমার। ও জানলে আমাকে এখান থেকে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে। তুমিও ওকে কিছু বলো না কিন্তু। তবে তমাপু , তোমার জামাই কিন্তু সত্যিই কিউটের ডিব্বা । রসগোল্লাটাকে চোখে চোখে রেখ কিন্তু । শাঁকচুন্নিরা যেন নজর না দেয় , সেজন্য নজর টিপ পরিয়ে দিও তার কপালে। ” দৃষ্টি দুষ্টুমি করে বলল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” ইতোমধ্যেই শাঁকচুন্নি নজর দিয়ে ফেলেছে । এবার আমি কি করব বল ? শাঁকচুন্নিকে নাকানিচুাবানী খাওয়াব নাকি ডক্টরকে নজর টিপ পরিয়ে দেব? ” তমাও দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করল।
তমার কথা শুনে দৃষ্টি বিষম খেল। ও এদিকওদিক তাকাল। দেখল কেউ ওদের কথা শুনছে কি না।
” আরে তমাপু , আমি কিন্তু তোমার ডক্টরের বেয়ান। আমি তার সঙ্গে ইক্টু মজা করতেই পারি। তাই বলে তুমি আমাকে শাঁকচুন্নি বলতে পার না। এটা অন্যায়। আমার লাল্টুমুল্টু নিহাইন্না যদি শোনে তুমি আমাকে শাঁকচুন্নি বলেছ , তবে সে কিন্তু মাইণ্ড খাবে । তাই তাড়াতাড়ি উইথড্র ইওর কথা। কুইক কর। ”
দৃষ্টির কথা শুনে হেসে ফেলল তমা । মেয়েটা সত্যিই ভিষণ কিউট। তমা আদর করে দৃষ্টির গাল টেনে দিল।
” কুহু , অবশেষে তুমি আসলে! সেই কখন থেকে আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি । ” কুহুকে বাসায় ঢুকতে দেখে তমা হাসিমুখে কথাগুলো বলল।
” কেমন আছ, তমাপু ? আমাদের ফারজাহ সোনা কোথায় ? আর এই যে ডক্টর স্যার , দুইদিন আপনার চেম্বারে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে । চেম্বারের সামনে রোগীর লম্বা লাইন দেখে আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম , বেশি দিন আপনাকে সুস্থ দেখতে পারব না আমরা। ” কুহু বাসায় ঢুকেই তমার কাছে গেল। তবে তমাকে জড়িয়ে ধরে ফারদিনের সঙ্গে খুনসুটিতে মাতল।
” তুমি মেডিকেলে গিয়েছিলে ? ফোন দাওনি কেন? ”
” ঐ যে রোগীর লম্বা লাইন দেখে সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। তো এবার বলুন কেমন আছেন? ”
” দেখতেই পাচ্ছ পাগল হইনি। তারমানে সুস্থই আছি। ”
ফারদিনের জবাব শুনে সবাই হেসে উঠল।
” কুহু , তুই আমাকে এভাবে ভুলে গেলি ? তুই না বন্ধু ছিলি ? কিন্তু সেই তুইই আমাকে ভুলে গেলি! কতবার তোকে বাসায় ডাকলাম, কিন্তু তুই গেলি না। আবার আজকে আমাদের আসবার কথা শুনে তুই পালিয়ে গেলি। এটা তুই করতে পারলি? তুই বদলে গেছিস বুঝলি? ” সকলের হাসি থামলে সিক্তা বলে উঠল। ও মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছে। ও চাচ্ছে কুহুকে ভয় দেখাতে।
কিন্তু কুহু তো সিক্তার কথায় ভয় পেলই না। উল্টো ও সিক্তাকে খোঁচাতে চাইল।
” সত্যিই তো আমি বদলে গেছি ! ননদের আসবার কথা শুনে আমি বাসা থেকে পালিয়ে গেছি । আসলে কি জানিস , ননদকে ভাবীরা সত্যিই ভয় পায়? তুই আমার ননদ না হলে বোন হলে ভালো হত। তাহলে অন্তত তোর আসবার কথা শুনে ভয় পেতাম না । ”
সিক্তা হতভম্ব হয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না কুহুর কথাগুলো। তবে কি কুহু ওকে সত্যিই ভয় পায়? কিন্তু সিক্তা তো কুহুকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। তাহলে কুহু এমনটা বলল কেন?
” কুহু , তুই আমার সঙ্গে মজা করছিস তাই-না? আমি জানি তুই আমাকে কতটা ভালোবাসিস। তুই কখনোই আমাকে ভয় কিংবা অবহেলা করতেই পারিস না। আমার ভাইয়া তেমন হিংসুটে মেয়েকে বিয়েই করতে পারে না। ”
সিক্তার চুপসানো মুখ দেখে হাসি পেল কুহুর। ও সিক্তার কথার উত্তর না দিয়ে হাসল। এদিকে বেচারি সিক্তা কুহুর হাসি দেখে ফুঁপিয়ে উঠল।
” এই আপু , ভাইয়া কি সত্যিই বাসায় আসছে ! রাত দশটার আগে যেই মানুষ বাসায় ঢোকে না , সে আজকে হঠাৎ করেই দুপুর তিনটায় বাসায় আসছে। ঘটনা কি বল তো? ”
দুপুরে খাবার পর মেয়েরা নিচতলার বেলকনিতে আড্ডা দিচ্ছে। গল্পের ফাঁকে কুহু তাহমিদকে ফোন দিয়েছিল। আর সেখান থেকেই দৃষ্টি জানতে পেরেছে , আর কিছুক্ষণের মধ্যে তাহমিদ বাসায় আসছে।
” ঘটনা কিছুই নয় । আজকে বাসায় ভদ্রলোকের কাছের মানুষজন বেড়াতে এসেছে , তাই চেম্বারে ভদ্রলোকের মন বসছে না। দৃষ্টি , নিহান ভাইয়া তো সন্ধ্যায় আসবে নাকি? তুই ভাইয়াকে আসতে বলেছিস? ”
” বলেছি। অফিস থেকে সোজা এদিকেই রওনা দেবে তোমার ভাইয়া। ”
” কুহু , ভাইয়া বোধহয় এসে গেছে । গেট খোলার শব্দ পেলাম । ”
সিক্তার কথা শুনে কুহু গেটের দিকে তাকাল। তাহমিদের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে দেখে বিষাদের হাসি ফুটল মেয়েটার ঠোঁটে।
” কি ব্যাপার তাহমিদ , আমাদের সবাইকে হঠাৎ ড্রয়িংরুমে জড়ো করলে কেন? অনেকদিন পর আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় এসেছ সেটা দেখে ভালোই লাগছে। একদিন অন্তত রেস্ট নেয়ার সুযোগ পাচ্ছ। কিন্তু তুমি সেটা না করে আমাদেরকে এখানে ডেকেছ। কেন? ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন আজ ঠান্ডা মেজাজেই জিজ্ঞেস করলেন।
” কাজ আছে , সিনিয়র । এবং কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো তোমাদের চার ভাইকে আজ বাসায় থাকতে বলতাম না। এতক্ষণ যখন ধৈর্য্য ধরেছ , আর কয়েকটা মিনিট ধৈর্য্য ধর । একটু পরই তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে । কুহু , তুমি মা-বড়মা সবাইকে ডেকে নিয়ে এস। দিদুনকেও এখানে আসতে বল। ”
ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলেই তাহমিদের কথা শুনে অবাক হয়। তারা বুঝতে পারছে না তাহমিদ কি করতে চাইছে। কুহু তাহমিদের কথামত সবাইকে ডাকতে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হল । সবার চোখেই প্রশ্নবোধক চাহনি । একমাত্র কুহুই স্বাভাবিকভাবে বসে আছে ।
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে কুহু এগিয়ে গেল দরজার দিকে ।
তাহমিনা আক্তারের বুকের ভেতর কেমন যেন করছে। তিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না
তার মন বলছে , আজ বোধহয় কোন অঘটন ঘটবে । এমন মনে হচ্ছে কেন তার? তিনি নিজেকেই শুধালেন। কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না।
কুহু দরজা খুলে দিল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে একটুও চমকাল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সরে দাঁড়িয়ে আগন্তুককে ভেতরে ঢুকতে দিল।
অনেকগুলো বছর পর তাওহীদকে দেখে তাহমিনা আক্তারের চোখের পানি বাঁধ মানল না। তিনি জায়গায় বসেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তিনি ভাবতেও পারেননি এই জীবনে আর কখনো এই বেইমান ছেলেটাকে দেখতে পাবেন।
সাদিক আহমেদ রাশেদীন তাকালেন সাবির আহমেদ রাশেদীনের দিকে। সাবির আহমেদ রাশেদীন তার ছেলেকে দেখে রাগে ফুঁসছেন।
তমা চমকে উঠে দাঁড়াল। এতগুলো বছর পর এ কাকে দেখছে ও! হঠাৎই মাথা ঘুরে উঠল তমার। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে। ও দু’হাতে মাথার দুপাশ চেপে ধরল। অস্থির ভাবে এদিক-ওদিক তাকাল। চোখের সামনে অতীতের কিছু দুঃসহ স্মৃতি ভেসে উঠল। আত্নীয়-স্বজন , পাড়া-প্রতিবেশীর কটুকথা , ব্যঙ্গের হাসি সবকিছু জ্বলজ্বল করে ভেসে বেড়াতে শুরু করল। মস্তিস্কের ভেতর তোলপাড় শুরু হল। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকা ওর জন্য কঠিন হয়ে পরেছে।
ফারদিন এতক্ষণ নীরবে সকলে প্রতিক্রিয়া দেখছিল। কিন্তু তমার অস্বাভাবিকতা চোখে পরতেই সে এক লাফে গিয়ে দাঁড়াল তমার পাশে। মেয়েটাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরল। সে ভুলে গেছে, এখানে গুরুজনেরাও আছেন। আজকের আগে ফারদিন কখনোই তমার এতটা কাছে আসেনি। ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরেনি। তবে সে বুঝতে পারছে না , তমা হঠাৎ করেই এমন করছে কেন? আর এই ভদ্রলোকই বা কে? ইনাকে দেখে এই বাড়ির প্রত্যেকের চেহারা থমথমে হয়ে গেল কেন?
” তমা , এমন করছ কেন ? কষ্ট হচ্ছে তোমার? মাথা ব্যথা করছে? আমাকে বল তোমার কি হয়েছে? ” ফারদিন ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইল।
” রিল্যাক্স তমাপু , এভাবে রিয়্যাক্ট করছ কেন? একজন বেইমানকে দেখে এতটা উতলা হওয়ার কি আছে ! তুমি শুকরিয়া আদায় কর, তোমার পাশে তোমার হাসবেন্ড আছে । যে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তোমার পাশে থেকেছে । আজও এই পরিস্থিতিতে প্রথমেই সে তোমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তোমার হাত শক্ত করে ধরেছে। জীবনে আর কি চাই তোমার ? কিন্তু আজ তুমি এই মানুষটাকে চিন্তায় ফেলে একজন বেইমানের জন্য চোখে পানি ফেলছ ? যে বেইমান একদিন তোমার এক আকাশ ভালোবাসা পায়ে মাড়িয়ে অন্যের হাত ধরেছিল , সেই বেইমানকে এখনও মনে রেখেছ তুমি ! এটা তোমার কাছে আশা করিনি , তমাপু। ” তাহমিদ নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলল।
তাহমিদের কথা শুনে ফারদিন যা বোঝার বুঝে নিল। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তাওহীদের দিকে। লম্বাচওড়া গড়নের এই সুর্দশন পুরুষটি যে কারও নজর কেড়ে নিতে সক্ষম । ফারদিন তাকে দেখে বুঝে গেল , তমা কেন তাকে এতটা ভালোবাসত। তবে সে এখনও তমাকে ছাড়ল না। বরং আগের থেকেও শক্ত করে তমাকে ধরে রাখল।
তমা তাহমিদের কথা শোনামাত্রই চমকে তাকাল ফারদিনের দিকে। এই মানুষটা সব সময় চেষ্টা করেছে ওকে সুস্থ করতে। আজ-অব্দি সে তমার ওপর স্বামীর অধিকার খাটাতে চেষ্টা করেনি। তমার সকল কাজে সে নীরবে উৎসাহ দিয়েছে । তমার অনেক ভুলভাল কাজ হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। একটাবারের জন্যও বলেনি , তমা তুমি কেন এত ভুল কর ? বরং তমার সব সময় মনে হত , সে যেন চায় তমা ভুল করুক। সে কখনোই তমার অতীত নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সব সময় তমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। অথচ আজ ও সেই মানুষটার সামনেই নিজের জঘন্য অতীতকে দেখে কাঁদছে! নিজের এমন নীচ কাজের জন্য লজ্জা পেল তমা। নিজের অজান্তেই দু’হাতে আঁকড়ে ধরল ফারদিনের টি-শার্ট। মিশে যেতে চাইল ফারদিনের বুকের ভেতর।
তমাকে নিজের খুব কাছে আবিষ্কার করে হাসল ফারদিন। নাহ্ ভুল মানুষকে সে গ্রহন করেনি। সঠিক মানুষটাই এসেছে তার জীবনে।
” তুমি ? হঠাৎ এত বছর পর উদয় হলে যে ? কি দেখতে এসেছ ? তোমাকে ছাড়া আমরা ভালো নেই এমনটাই দেখতে চেয়েছিলে বুঝি ? সেটা যদি ভেবে থাক , তবে তোমার ভাবনা ভুল। তোমাকে ছাড়াই আমরা দিব্যি আছি । এবং খুব ভাল আছি । আমাদের সংসারটা এখন আগের থেকেও বেশি পরিপূর্ণ । একজনের শূন্যতা আমরা আরও কয়েকজনকে দিয়ে পূর্ণ করেছি। কখনো আমরা ভুল করেও ভাবি না , অতীতে কেউ আমাদের শূন্য করে চলে গিয়েছিল। ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন কাটকাট গলায় বললেন।
” চাচ্চু , আমি ভুল করেছি। আর শাস্তিও পেয়েছি নিজের ভুলের। ভিকা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার সন্তানকে হত্যা করেছে সে। সন্তানের কথা আমাকে জানতেও দেয়নি সে। সকল ভুলের শাস্তি আমি তিলে তিলে ভোগ করছি।
” ডুকরে কেঁদে উঠল তাওহীদ।
” এসব কথা আমাদের শোনাতে এতদূর এসেছ ? তুমি ভেবেছ আমরা এসব শুনলে আবেগে পরে তোমাকে মেনে নেব ? ভুল ভেবেছ তুমি । তবে এ একথা সত্যি একটা অনাগত প্রাণ অকালেই ঝরে গেছে শুনে আমার খারাপ লাগছে। আমার মনে হয় , খরবটা শুনে সবাই কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সেই অযুহাতে তুমি এই বাড়িতে ঠাঁই পাবে না এটা নিশ্চিত থাক। যে তুমি একদিন আমাদের এই বাড়িটাকে ‘ পাগলাগারদ ‘ বলে ব্যাঙ্গ করেছিলে, আজ তোমার কষ্টের দিনে এই পাগলাগারদেই ছুটে এসেছ দেখে অবাক হচ্ছি। দুনিয়ার হাজারো দর্শনীয় স্থান রেখে শেষে অবশেষে তুমি এই পাগলাগারদেই ছুটে এলে ! তুমি ভীষণ স্বার্থপর একটা ছেলে এটা কি জানো? ” সাবির আহমেদ রাশেদীন গর্জে উঠলেন।
বাবার রাগ দেখে তাওহীদ অবাক হল না। এটা তো হওয়ারই ছিল। তার নিজের করা ভুলের কাছে এই রাগটুকু খুবই সামান্য। তবে হাল ছাড়ল না তাওহীদ। শেষ চেষ্টা করেই গেল।
” মা , তুমি চাইলে সবকিছু ঠিক করে দিতে পার। তুমি তো মা। আর কোন মা-ই সন্তানের কষ্ট সইতে পারে না। সন্তানের চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। আমি জানি তুমিও পারবে না। আমাকে ক্ষমা করে দাও , মা। তোমাদের মাঝে আমাকে একটু ঠাঁই দাও। আমি জানি , সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও , তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না। ”
” আজকেও তুই আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে চাচ্ছিস! তুই আমাকে আর কত আঘাত দিবি ? আরও কতবার আমাকে ভেঙেচুরে দুঃখের সাগরে ভাসাবি? বদল তো সবারই হয় , কিন্তু তোর নির্দয় ক’জন হয় বলতে পারিস? একটা সময় তুই আমাকে তোর প্রয়োজনের হাতিয়ার বানিয়ে রেখেছিলি বলে এখনও কি মনে করিস , আমি আগের মতই তোর সেই হাতিয়ার হয়েই আছি? ভুলে যা সেসব দিনগুলোর কথা । যেদিন তুই আমাকে বলেছিলি , আমি একজন স্বার্থপর মা, যে নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারে, আমি নিজের বোন আর তার পরিবার ছাড়া কিছুই বুঝিনা , একজন আজ্ঞাবহ , মেরুদন্ডহীন স্ত্রী আমি , এই বাড়ির কাজের মেয়ে আমি , আমি আসলে কারও মা হওয়ার যোগ্যই নই , এই বাড়ির প্রত্যেকে তোর খারাপ চায় , তোর বাবা একজন স্ত্রৈণ , এই বাড়ির প্রত্যেক পুরুষই তাদের স্ত্রীদের আঁচলের নিচে থাকে । সেদিনই আমি তোকে মন থেকে ঝেরে ফেলে দিয়েছি । ভুলে গেছি তাওহীদ নামে আমার কোন ছেলে ছিল । তাই তোর কোন আকুতিই আমার মন গলাতে পারবে না । তুই যেভাবে এখানে এসেছিস, সেভাবেই তোকে ফিরে যেতে হবে। আজ অনেকগুলো বছর পর আমি আমার বড় বোনকে ফিরে পেয়েছি। যে তমা তোর দেয়া আঘাত সইতে না পেরে পাগল হয়ে গিয়েছিল, সেই মেয়েটা আজ সুস্থ হয়েছে , একটা সুখের সংসার হয়েছে ওর। আজ তোকে গ্রহণ করে আমি ওদেরকে আরেকবার আঘাত করতে পারি না । পেয়েছিস আমার উত্তর? এবার যেতে পারিস। ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫২
তাওহীদ এবার তাকাল তমার দিকে । মেয়েটাকে ওর স্বামী বুকের ভেতর শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন তার হাতের বাঁধন আলগা হলেই , ও পালিয়ে যাবে । আজ অনেক বছর পর তমার মায়াবী মুখটা দেখে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল তাওহীদ । একটা সময় ও নিজের স্বার্থে এই মেয়েটাকে আঘাত দিয়েছিল। মেয়েটা সেদিন কত অনুনয় করেছিল আজীবন ওর হয়ে থাকবার জন্য। কিন্তু তাওহীদের পাষাণ হৃদয়ে পৌঁছায়নি তমার অনুনয়। সে নিঃদ্বিধায় বলেছিল, তমা তার যোগ্য নয়। তার সোসাইটিতেও তমা অযোগ্য বলেই বিবেচিত হবে। আজ সেই মেয়েটাই পরম প্রশান্তিতে। অনেক বুকে মাথা রেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তাওহীদ।