সুগন্ধি ফুল পর্ব ১২
জান্নাত সুলতানা
“দেবরের সাথে এত বছর ধরে বিয়ে ছাড়া সংসার করে যাচ্ছো, মা?”
উপরোক্ত বাক্যটি কানে আসতেই নীলিমা বেগম চমকে উঠলেন। কিছুটা কাঁপলেনও বটে। মাথা উঁচু করে সামনে তাকালেন। মেহনূরকে দেখে চোখ দুটো আঁতঙ্কে বড় বড় হয়ে গেল। আঁতকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেহনূরের চোখে, মুখে ঘৃণা স্পষ্ট। তেতো স্বরে মেহনূর পুনরায় প্রশ্ন করে উঠল,
“আমার বাবা কোথায়, মা?”
নীলিমা বেগম ভয়ে জবাব দিতে পারলেন না। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে মেহনূরের দিকে ছুটে আসলেন। মেহনূরের হাত ধরে রুমের বাইরে টেনে নিয়ে আসলেন। মেহনূর হেচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কঠিন বাক্যে বলে উঠল,
“হাত ছাড়ো, মা। তুমি আমাকে ছোঁবে না।”
নীলিমা বেগমের গাল বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েকে এবার কি উত্তর দিবেন তিনি? মেহনূর এবার ঘৃণার বাক্যে বলে উঠল,
“ তুমি কি সত্যিই আমাদের মা? আমাদের মা হয়ে নিজের গায়ে এত বড় কলঙ্ক মাখলে কেন? লজ্জা করল না তোমার? আমাদের এত বাজে ভাবে ঠকালে? ছিহ, মা? আমার তো তোমাকে মা বলতেও ঘৃণা করছে।”
নীলিমা বেগম শব্দ করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন,
“আমি তোদের ঠকাইনি, মা। আমি নিজেই বাজে ভাবে ঠকে গেছি।”
মেহনূর ধমকে উঠল। চিৎকার করে বলল,
“নাটক বন্ধ করো, মা। আমি এক্ষুনি গিয়ে আপুকে সবটা বলে দিব। আজ, এক্ষুনি আমি আর আপু এই বাড়ি ছেড়ে, তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। ভুলে যাব আমাদের মা বেঁচে আছেন। সব ভুলে যাব। শুধু যাওয়ার আগে একটা সত্যি জানতে চাই।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নীলিমা বেগম প্রশ্নোত্তর চোখে তাকাতেই মেহনূর প্রশ্ন করল,
“শুধু বলো আমাদের বাবা কে? সে কি বেঁচে আছে?বলো, মা।”
নীলিমা বেগম এবার উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লেন। কান্নারত বাক্যেই বলে উঠলেন,
“আমি জানিনা, মা। কিচ্ছু জানিনা।”
মেহনূর রাগে ফেটে পড়ল। বলল,
“ঠিক আছে তোমার জানা লাগবে না। আমরা নিজেরাই জেনে নিব। আমাদের বাবা যদি বেঁচে থাকে তাহলে আমরা ঠিক খুঁজে নিব।”
বলেই রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তৎক্ষনাৎ নীলিমা বেগম পেছন ডেকে উঠল। শান্ত, শীতল বাক্যে বলতে লাগলেন,
“আবির আর সাবির আইডেন্টিক্যাল টুইনস।”
এইটুকু বলে সামান্য থামলেন। মেহনূর চমকাল৷ পেছন ঘুরে তাকাল৷ নীলিমা বেগম পুনরায় বলতে লাগলেন,
“ মেহরিশ তখন ৫ বছরের৷ আর তুই তখন সবে মাত্র এক বছরের। মেহরিশ সবে মাত্র তখন স্কুলের গন্ডিতে পা রেখেছে। স্কুলের প্রথমদিন আমি আর তোর বাবা মিলে খুব শখ করে মেহরিশকে তৈরি করে দিয়েছিলাম। তারপর তোর বাবার মেহরিশকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল। পথিমধ্যে একটা এক্সিডেন্টে আমার জীবনটাই সম্পূর্ণ উলোটপালোট হয়ে গেল।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মেহনূর দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। শরীর ভার হয়ে আসছে। কোন সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাল জীবন! নীলিমা বেগম পুনরায় বলা শুরু করলেন,
“মেহরিশ বেঁচে গেলেও আবিরকে বাঁচানো গেলো না।এক্সিডেন্টে আবিরের মুখটা এত বাজে ভাবে ক্ষত হয়ে পড়েছিল রাস্তায় যে কেউ তাকাতেই ভয় পাচ্ছিল। আবির স্পট ডেড হয়ে যায়। মেহরিশের মাথায় আঘাত লাগে, দুইদিন পর মেয়েটার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু মেয়েটা ওর ছোটবেলা হারিয়ে ফেলল। ভুলে গেল সব কিছু। স্বামী হারানোর শোকে কাঁদার সময়টুকু আমি পাইনি। মেয়েকে বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল মেহরিশকে কোনোরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে রাখা যাবে না। তবে মেয়েটা সব ভুলে গেলেও বাবাকে ভুলল না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শুধু বাবাকে দেখতে চাইল। কিন্তু আমি তোর বাবাকে কোথায় পাব? সাবির সে সময় আমার সঙ্গ দিল। মেহরিশ একমাত্র সাবিরের ছায়াতলেই থাকতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হলো। মাস খানেক এভাবেই কাটল। বাড়ির গুরুজনরা মেহরিশের অবস্থা দেখে সাবিরের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগল। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি ছিলাম না। সাবিরও কেন যেন রাজি হয়ে গেল। সবার জোরাজুরিতে আমিও…।”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। তার আগেই মেহনূর তাচ্ছিল্যের বাক্যে বলে উঠল,
“সবার জোরাজুরিতে তুমিও আর না করতে পারলে না। বিয়ে করে নিলে নিজের দেবরকে, তাইনা মা?”
বলেই হাসল খানিকটা। নীলিমা বেগম চুপ রইলেন৷ খানিক থেমে পুনরায় বলে উঠলেন,
“সাবিরকে বিয়ে করেছিলাম ঠিকই কিন্তু কখনো মানতে পারিনি। বিয়ের পর থেকেই সাবির আমাকে নিয়ে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেল। ভাইকে হারানোর শোক ভুলে আমাকে ভোগ করার উন্মাদনায় মেতে উঠল। বশ করতে না পেরে জোর খাটানো শুরু করল। যখন জোরটাও আমার কাছে হেরে গেল তখন জানতে পারলাম এক কঠিন সত্য। আমার আবির বেঁচে আছে। সুস্থ আছে। সেদিনের এক্সিডেন্টটা সাবির করিয়েছিল। সব কিছু জেনেও আমি সবাইকে সবটা জানাতে পারিনি। সাবিরের কথার অবাধ্য হলে প্রতিমুহূর্তে আমাকে হুমকির সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। বলতে পারিস আবিরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমার এই মিথ্যে সংসার।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই মেহনূর তাচ্ছিল্যের বাক্যে বলল,
“তুমি সম্পূর্ণটাই মিথ্যে, মা। তুমি কি এসব বলে নিজেকে অসহায় প্রকাশ করলে? বাট স্যরি, আমার তোমাকে কোনোভাবে অসহায় মনে হয়নি। তুমি বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাবার ছোট ভাইয়ের সাথে সংসার পেতেছো, তার মেয়েদের মিথ্যে শিখিয়ে বড় করেছ___এসব শুনলে বাবার বেঁচে থাকার স্বাধ থাকবে? তুমি অন্যায় জেনেও প্রতিবাদ করোনি। এসব থেকে বাঁচার কোনো স্টেপ নেওনি। তারমানে তুমিও সমান দোষী। তুমিও অপরাধী।”
নীলিমা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। মেহনূর যা বলছে ঠিক বলছে। কি উত্তর দিবেন তিনি? মেহনূর এবার একটু ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা মা, চাচি কোথায় ছিল? সুহা আপু কোথায়, মা?”
নীলিমা বেগম শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
“ সুহা খেলতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়, একমাত্র মেয়েকে হারানোর কষ্ট মোহিমা সহ্য করতে পারেনি। হার্ট অ্যাটাক করে চলে গেল।”
মেহনূর এবার প্রশ্ন করল,
“এই ঘটনার কতদিন পর বাবা মা°রা যায়?”
“মাস খানেক।”
মেহনূর এবার কঠিন বাক্যে আওড়াতে লাগল,
“আমি বিশ্বাস করিনা তোমার কথা। তোমরা তো বলেছিলে ওরা নাকি একটা এক্সিডেন্টে মা°রা গেছে। তাহলে আজ কেন আবার অন্য কথা বলছো? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এসব তোমাদের সাজানো নাটক। তোমার আর চাচ্চুর মধ্যে আগের থেকেই কিছু ছিল। নয়তো দেখো চাচিমা, সুহা আপু আবার আমার বাবা আর আপুও? শুধুই কাকতালীয় নাকি চক্রান্ত?”
নীলিমা বেগম শিউরে উঠলেন। আর্তনাদ করে বললেন,
“কি বলছিস তুই?”
মেহনূর চিৎকার করে বলে উঠল,
“ঠিক বলছি, মা। আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা। তুমি একজন জঘন্য স্ত্রী। জঘন্য মা। আমি তো সব সত্যি খুঁজে বের করবই। বাবা যদি বেঁচে থাকে তাহলে বাবাকেও খুঁজে বের করব। সাবির মির্জাকেও ফাসির দড়িতে ঝুলাব। সাথে তোমাকেও…।”
বলেই মেহনূর আর সেখানে দাঁড়াল না। ছুটে বেরিয়ে গেল। নীলিমা বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
একটা পার্কে সায়রের পাশাপাশি বসে আছে মেহরিশ। আনায়া সায়রের বুকে। শীতের বিকেলে হিম শীতল বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা মন্দ লাগছে না। মুহূর্তটাও সুন্দর। সুন্দর মুহূর্তে মেহরিশ প্রশ্ন করল,
“সায়র, আমি আপনাকে কিছু ব্যাপার শেয়ার করতে চাই।”
সায়র শান্ত বাক্যে বলল,
“মন খুলে মনের কথা শেয়ার করুন, মেহরিশ। আপনার সুখ, দুঃখের গল্প শোনার জন্যই তো সায়র আজীবন রাজি।”
মেহরিশ হাসল। বলে উঠল,
“আমার কেন মনে হয় আমার আশেপাশের সব মিথ্যা, সব ঘোলাটে? কেন মনে আমার মা, বাবা মিথ্যা? আমার কাছ থেকে কিছু লুকানো হচ্ছে, সায়র। কিন্তু কি? কোন অজানা সত্য আমি জানিনা। এসব প্রশ্ন প্রতিদিন আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আমাকে একমাত্র আপনি সাহায্য করতে পারেন, সায়র।”
সায়র হাফ ছাড়ল। মনে মনে বলে উঠল,
“আমি আপনার জীবনের সেই অজানা সত্যগুলো জানি, মেহরিশ। কিন্তু এখনো আপনাকে বলার সময় আসেনি।”
সায়রকে চুপ থাকতে দেখে মেহরিশ আলতো করে হাত রাখল সায়রের কাঁধে। অতঃপর বলল,
“কিছু ভাবছেন?”
সায়র প্রসঙ্গ মুহূর্তেই পাল্টে ফেলল। হাসি মুখে বলে উঠল,
“ভাবছি তো শুধু আপনাকে।”
মেহরিশ হেসে ফেলল। বলল,
“ফাজিল ব্যাটা ছেলে।”
সায়র মুখ ভার করে বলল,
“আমি তো ব্যাটা ছেলেই, আমি কি মেয়ে ছেলে নাকি? অবশ্য, এখন নিজেকে মেয়ে ছেলেই মনে হয়। বিয়ে করেও বউয়ের মধু খাওয়া হলো না।”
মেহরিশ জিভে কামর দিয়ে সাথে সাথে সায়রের মুখ চেপে ধরল, ফিসফিস করে বলল,
“আমরা এখন বাড়ির বাইরে।”
সায়র মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলল। ঠোঁট উল্টে বলল,
“তো কি হয়েছে? এখন বাইরে আছি, বউ রাজি থাকলে বাসায় গিয়ে মধু খেয়ে আসব।”
মেহরিশ জোরে হেসে ফেলল। বলে উঠল,
“আপনি তো ঠোঁট কা°টা হয়ে যাচ্ছে বেশ।”
সায়র উত্তরে বলল,
“মেহরিশ, আনায়ার একা একা ভালো লাগছে না। ওর একটা খেলার সাথী দরকার। চলুন না, আনায়ার একটা ভাই আনার ব্যবস্থা করি।”
মেহরিশ এবার লজ্জা পেল। লাজুক হেসে বলে উঠল,
“ঠিক আছে, আপনার প্রস্তাবটা ভেবে দেখব।”
বলেই উঠে দাঁড়াল। সামনে হাঁটা শুরু করল। সায়রও হেসে ফেলল। আনায়ার গালে খুশিতে চুমু খেল। আনায়াও সায়রের গালে চুমু খেতে ভুলল না।
সুগন্ধি ফুল পর্ব ১১
“আবির যদি বেঁচে যায় তাহলে আমার এতদিনের সাজানো সব কিছু ভেস্তে যাবে।”
সাবির রুমের এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারি করছে। কিছুতেই মাথায় খেলছে না এখন কি করবে? পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল। নিজে নিজে বলে উঠল,
“আচ্ছা পুরো মির্জা পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিলে কেমন হয়? না থাকবে বাশ আর না বাজবে বাঁশি।”
অতঃপর কোনো একজনকে ফোন করে সবটা জানাল৷ ফোন কেটে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলে উঠল,
“আজ রাতে মির্জা বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলবে৷ মেহরিশ, মেহনূর, সায়র, আর ছোট্ট আনায়ার পুড়ে যাওয়া ছাঁই দিয়ে আমি গোসল করে নিজেকে শান্ত করব।”