সুগন্ধি ফুল ২ পর্ব ৫
জান্নাত সুলতানা
-“রুমে কেনো ডেকে নিয়ে এসছেন?”
ফিজা যেনো কিছু টা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো। আবরাজ একটা লাগেজ নামিয়েছে। ফিজা অবাক হয় সেটা দেখে। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি আজ চলে যাচ্ছেন?”
-“হাঁ। আমরা চলে যাচ্ছি।”
-“কোথায়?”
-“কোথায় যেতে চাও বলো। কোথায় গিয়ে বাসর করলে তুমি খুশি হবে?”
ফিজার চোখ গুলো অটোমেটিক ভাবে বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। লজ্জায় অস্বস্তি মূহুর্তের মধ্যে ঘিরে ধরলো মেয়ে টাকে। আবরাজ বউয়ের লজ্জা মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“ব্যাস আর একটা দিন। দেখবে লজ্জা তোমার কোথায় লুকয়।”
ফিজা বিরক্ত হলো। খুব বিরক্ত করছে তাকে এই পুরুষ। না জানি একা তাকে কত কী সহ্য করতে হবে৷ ওয়াশ রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ পেছন থেকে ওর বাহু টেনে ধরলো। বললো,
-“আজ একটাও কিস হয় নি জান।”
তো? ফিজার ইচ্ছে করলো আবরাজ খানের নাক ফাটিয়ে দিতে। গত পরশুদিন থেকে শুরু হয়েছে জ্বালানো। ফিজা বিরক্তিকর স্বরে আওড়াল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-“তো?”
-“বিয়ের পর প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর বউ কে চুমু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, সুগন্ধি ফুল।”
ফিজার কান গুলো গরম হয়ে এলো। ও মুখ টা কঠিন করে ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য ফের পা ফেলতে আবরাজ আবারও আঁটকে নিলো ওকে। হেঁচকা টানে নিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে নিলো।
পুরুষালী ওষ্ঠদ্বয়ের সংঘর্ষে ফিজা ফুঁপিয়ে উঠলো। আবরাজ বউয়ের অধর জোড়া কয়েক সেকেন্ড এর জন্য ছাড়লো। স্লো ভয়সে বললো,
-“একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও জান।”
ভেজা চোখে ফিজা একপলক তাকালো আবরাজের মুখের দিকে পরপরই সেই সুযোগ ও হারালো। আবরাজ নিজের ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে আবারও চেপে ধরলো বউয়ের ওষ্ঠদ্বয়। কত সময় ধরে সেই ভালোবাসা নামক যন্ত্রণা আবরাজ বহমান রাখলো সেই হিসাব কষতে পারে না ফিজা।
সন্ধ্যার আগে আগে আবরাজ বউয়ের লাগেজ নিজে গুছিয়ে নিলো। ফিজার মা বোন কে ডেকে নিয়েছেন খান বাড়িতে। ওরা সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। গন্তব্যে পৌঁছাতে ওদের সময় লাগলো দশ ঘন্টার বেশি সময়। ফ্লাইট থেকে নেমে ফিজা আশ্চর্য হলো। দেশের আবরাজ খান আর এখনকার আবরাজ খানের মধ্যে পেলো আকাশপাতাল পার্থক্য। তবুও সে নিজের বিস্ময় চেপে রাখলো।
গাড়িতে চড়ে বসার পর এক এক করে সামনে পেছনে পাঁচ টা গাড়ি চলতে শুরু করলো। মার্সিডিজটার কালো শরীর ঝকঝকে রোদে চকচক করছিল। গাড়ির ভিতরে একটা নীরব শান্তি। শুধু হালকা বাজছিল রেডিওতে পেছনের দশকের কোনো জার্মান জ্যাজ।
আবরাজ ড্রাইভিং সিটে বসে নিঃশব্দে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ডানে বাঁকে গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে সবুজে মোড়া পাহাড়ের পথ। ফিজা জানালার পাশে মাথা হেলিয়ে বাইরে তাকিয়ে। গাড়ির জানালায় হাত রেখে সে আঙুল দিয়ে আবছা মেঘের ছবি আঁকছিল।
তবে মনে হাজার টা প্রশ্ন।
গাড়ি গুলো ধীরে ধীরে একটা পুরনো গেটের সামনে থামে। লোহার গেট খুলে যায় অটো সেন্সরে। ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বড়ো বাড়ি টার সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো।
একটা প্রশান্ত এলাকা। চারপাশে সবুজ গাছগাছালি, টানা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন ডুপ্লেক্স বাড়ি টা। আধুনিক জার্মান স্থাপত্য আর ঐতিহ্যের মিশেলে তৈরি। বাইরের দেয়ালগুলো ধবধবে অফ-হোয়াইট। তার মাঝে ছড়িয়ে আছে ধূসর পাথরের নকশা। ছাদটা টাইলসের তৈরি, গাঢ় লালচে-বাদামি রঙের, ক্লাসিক ইউরোপিয়ান লুকে।
বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট কিন্তু পরিপাটি গার্ডেন, ছাঁটা ঘাস, গোলাপি-সাদা রঙের হাইড্রেঞ্জিয়া ফুল ফুটে আছে। মাঝখানে পাথরের পথ বেয়ে হাঁটলে ডাবল উঁচু কাঠের দরজার কাছে পৌঁছানো যায়। দরজার দুই পাশে বড় বড় কাচের জানালা। ভেতর থেকে ঝুলছে শীতল টোনের পর্দা।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো রঙের, মার্সিডিজ-বেঞ্জ জি-ক্লাস SUV আর তার পাশে একটা হালকা ধূসর আউডি এ৭ স্পোর্টব্যাক। যেনো গ্যারেজের বদলে গাড়িগুলোই বাড়ির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। এর সাথে রাখা হয় বাকি গাড়ি গুলো। ফিজার হাত ধরে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো আবরাজ। জন নামের একজন কে নিয়ে ফের সাইডে চলে গেলো।
ফিজা বাড়ি টা দৃষ্টি বুলিয়ে দেখতে লাগলো।
বাড়িটা দুটো তলায় ভাগ করা। নিচতলায় বিশাল একটি ড্রইংরুম। উঁচু ছাদ। কাঠের ছাঁট বসানো ফ্লোরিং। মার্বেল টপ কফি টেবিল আর একটা ম্যাট কালার্ড লেদার সোফা। দেয়ালে আধুনিক আর্ট আর একটা বিশাল ফ্রেমে বাঁধানো পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ।
দক্ষিণ দিকে দেখা যাচ্ছে একটা ফায়ারপ্লেসে আর সেখান থেকে বসে দেয়াল ভেদ করে দেখা যাচ্ছে বিশাল এক সুইমিং পুল। একটা ওপেন কিচেনও আছে নিচতলায়। স্লেট-গ্রে মডুলার কেবিনেট, ইন্ডাকশন চুলা, আর কাচের ডাইনিং টেবিলের চারপাশে সাদা চেয়ার।
-“সুগন্ধি ফুল!”
-“বাড়ি টা আপনার?”
-“না বিয়ের পর বউ নিয়ে থাকার জন্য আমার আব্বাজানের থেকে গিফট পেয়েছি।”
ফিজার ভ্রু কুঁচকে আসে। নিজের বাবা-র থেকে বউ নিয়ে থাকার জন্য গিফট! আশ্চর্যের ঘটনা।
লাগেজ গুলো জন ওপর তুলছে তখন। ছেলে টা হ্যাংলা সুন্দর। চেহারায় কিছু টা বিদেশি ছাপ রয়েছে। সে হাসছে। ফিজা সেই হাসির উৎস খুঁজে পেলো না। তাই আবরাজের পেছন পেছন কিচেনে গেলো। আবরাজ কফি বানাচ্ছে। ফিজা সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। কফি বানিয়ে নিয়ে আবরাজ একটা বউ কে দিলো তো একটা নিজে নিয়ে ওপরের দিকে হাঁটা শুরু করে ফিজা কে বললো,
-“কাম উইথ মি।”
উপরতলায় রয়েছে তিনটা বেডরুম। মাস্টার বেডরুমটা খুবই রুচিশীল। মিনিমাল ডিজাইন, কিন্তু রুচির ঘনত্বে পূর্ণ। বড় জানালায় সাদা পর্দা। জানালার ওপাশে দূরের সবুজ টিলা দেখা যায়। অ্যাটাচড ওয়াক-ইন ক্লোজেট আর মার্বেল বাথরুমে জ্যাকুজি বসানো।
বাড়ির পেছনে একটা কাঠের ডেক, যেখানে সানসেটের সময় চেয়ার পেতে বসে কফি খাওয়া যাবে। পেছনের দিকটা আধা-প্রাইভেট। বড় একটা গেটেড বাউন্ডারিতে মোড়ানো। যেনো শহরের ভেতর নিজের একটা শান্ত দ্বীপ। জানালার পাশ থেকে সরে এসে ফিজা আবরাজ কে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেউ থাকে না এখানে?”
-“না। আজ থেকে আমরা থাকবো।”
-“আমি যে শুনলাম আপনার ভাই আপনার সাথে থাকে।”
-“আব্রাহাম এখন বার্লিন শহর থাকে। আর আমরা এখন ফ্রেইবুর্গ রয়েছি। আব্রাহাম এবং আমি ফ্রাইবুর্গ ইউনিভার্সিটি থেকে স্টাডি কমপ্লিট করেছি।”
-“ওহ আচ্ছা।”
-“ও কাল দেখা করতে আসবে আমাদের সাথে।”
কথা বলতে বলতে আবরাজ নিজের পোশাক পরিবর্তন করে নিলো। সকাল দশ টা এখন। ওরা সকালের ব্রেকফাস্ট প্ল্যানে করে ছিলো। তাই ফিজার শরীর বিছানা পেয়ে আরাম করতে চাইলো।
আবরাজ ওর গায়ে কম্ফর্টার জড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
ফিজার যখন ঘুম ভাঙে তখন পেট জ্বলছে ক্ষুধায়। শোয়া থেকে ওঠে আশেপাশে দেখে বুঝতে পারলো সময় টা সন্ধ্যায় কিংবা তার আগে পরে হতে পারে। রুমে লাইট অন করে ফ্রেশ হতে গেলো সে। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে ও আবরাজ খানের অস্তিত্বের দেখা পেলো না। রান্না ঘরে গিয়ে পুরো রান্না ঘর খুঁজে একটা স্যুপের প্যাকেট পেলো। ক্ষুধার তোপে সেটাই রান্না ঘরে খেতে লাগলো। সময় অনেকক্ষণ অতিবাহিত হলো কিন্তু তবুও আবরাজের পাত্তা নেই।
ফোন বের করে সোফায় বসে যখন মাসেজে করবে তখনই হুট করে আবরাজ সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। গায়ে একটা লম্বা ওভার কোট। কালো জুতো, ড্রেসআপ কেমন অদ্ভুত লাগলো। ফিজা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। আবরাজ এসে ওর পাশ ঘেঁষে বসলো। ফিজা সাথে সাথে শরীর থেকে সিগারেটের গন্ধ পেয়ে নাকমুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
-“বিড়ির গন্ধ।”
-“এটা সিগারেটের গন্ধ সুগন্ধি ফুল। নট অ বিড়ির গন্ধ।”
আবরাজ গম্ভীর স্বরে বললো। ফিজা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আবরাজের মুখের দিকে। আবরাজ আচমকাই ওর দিকে ঝুঁকে এলো। ওর গলা টা চেপে ধরে মুখ টা এগিয়ে আনলো নিজের দিকে। থুতনিতে আলগোছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
সুগন্ধি ফুল ২ পর্ব ৪
-“চলো রেডি হবে। আমরা একটা পার্টিতে যাচ্ছি।”
অদ্ভুত মানুষ সারাদিন কোথায় ছিলো? আর এসেছে পর একবার ও তো জানতে চাইলো না ও কিছু খেয়েছে কি-না। ফিজার অল্প অভিমান হলো। যা আবরাজ খান নামক পুরুষ টের ও পেলো না। সুতরাং এই অভিমানের কোনো ভিত্তি নেই।