সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ২৬

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ২৬
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

শাফিন বুকে হাত চেপে খুকখুক করে কাশছে। হতভম্ব তীব্র,স্তব্ধতায় তখনো ধাতস্থ হতে পারেনি। শাফিন তার প্রিয় বন্ধুদের একজন। ওকে এই সময় ,এইখানে সে আশা করেনি। দুঃস্বপ্নেও না। বাকরুদ্ধতায় তীব্রর জ্বিভ থেকে একটা শব্দও ফুটছে না । আচমকা খেয়াল পড়ল ঘরে থাকা বাকীদের দিকে। তুরন্ত, মুঠো হতে খসে পড়ল হকিস্টিক। হতবিহ্বলতায় ঠিকড়ে এলো আওয়াজ,

“ তোরা?”
মিরাজ,আরমান, মুশফিক ঠায় দাঁড়িয়ে। মেঝেতে অবহেলায় পড়ে থাকা তাস, ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। বদ্ধ কক্ষে গুমোট বাতাবরণ। ওরা একে-অন্যের সাথে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। শুষ্ক আদল ফ্যাকাশে বেশ। তীব্রর নিশ্চল চাউনী দপ করে জ্বলে উঠল আবার। আক্রোশে চৌচির হলো মস্তক। একবার শাফিন কে দেখল,একবার ওদের। পরপরই
হুঙ্কার ছুড়ল ক্ষুব্ধ গলায় ,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ এর মানে তোরা আমার ভিতু মেয়েকে বিরক্ত করছিলি? এত সাহস তোদের কে দিয়েছে?”
“ কে দিয়েছে” কথাটায় উচ্চতার সমস্ত ধাপ পেরিয়ে গেল আওয়াজ। যার প্রতিধ্বনি বসল ঘরের সমগ্র দেওয়ালে। নিশ্চুপ,নিস্তব্ধ রজনীতে এমন বহ্নিতে ঘেরা চক্ষু। সাথে জোরালো স্বরে গায়ে কাঁটা ফুটবে কারো। একইরকম ঘাবড়ে যাওয়ার কথা ছিল ওদের। ভয়ে নিজেদের হয়ে সাফাই গাওয়ার বদলে,আচমকা চেঁচিয়ে উঠল ওরা।
সুর তুলল আনন্দ নিয়ে…

“ বিট্টুউউউউউউ!”
কিছু বোঝার আগেই সব কটা ছুটে এলো ঝড়ের মতোন। অতগুলো হাত একসঙ্গে হুড়মুড় করে জাপটে ধরল তীব্রকে। ছেলেটা ভরকে গেল,হকচকাল। পোক্ত মানবের চাওনি নির্বোধের মতোন দেখালো আজ। মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে। হ্যাঁ ভাসছেই তো। মিরাজ আর আরমান তাকে রীতিমতো উঠিয়ে নিয়েছে হাতে৷ তীব্রর সব কিছু গুলিয়ে গেল। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে শাফিন। বুকে হাত ঘষছে ছেলেটা। প্রকান্ড লাথি খেয়ে তার আধমরা দশা। মিরাজ, মুশফিক, আরমান, হইহই করা আনন্দ শেষে তীব্রকে নামালো।
মুশফিক হাসি হাসি মুখে বলল,

“ বিট্টু! কেমন আছিস বল। কত মাস পর দেখা রে ভাই। একদম ভুলে গেছিস আমাদের তাই না? যাস না কেন বাড্ডাতে?”
মিরাজের কণ্ঠে অভিমান। বলল,
“ কেন যাবে? আমরা কি ওর কিছু হই? সে এখন ভীতু মেয়েতে মজেছে। আমাদের কথা আর মনে থাকলে তো!
তীব্র ভ্রু গোটাল। আগের মতো ফেঁপে উঠল শিরা। রেগেমেগে বলল,

“ ইয়ার্কি মারছিস আমার সাথে? তোদের মনে হয় আমি এখন তোদের ইয়ার্কি সহ্য করার অবস্থায় আছি?”
“ সরি ভাই! তুই এই মুহূর্তে খুব রেগে আছিস জানি।
কিন্তু আমরা যে তোকে দেখে কতটা খুশি হয়েছি সেটা তো চেপে রাখতে পারছি না।”
বলতে বলতে কাঁধে হাত রাখল শাফিন। ত্রস্ত সেটাকে ছিটকে সরিয়ে দিলো তীব্র। উলটে থাবা বসাল তার টিশার্টের কলারে। দাঁত চেপে বলল,

“ পুষ্পিতাকে কেন বিরক্ত করছিলি? তোরা জানিস না আমি ওকে পছন্দ করি?”
বন্ধুর তেজে দগদগে কণ্ঠে,আর লালচে মুখায়বেও শাফিনের হাবভাব পাল্টালো না। আগের মতোই নরম ভাবে বলল,
“ জানি তো। জানি বলেই না করেছি।”
তীব্র তাজ্জব হয়।
“ মানে?”

বাঁধন শিথিল হতেই পোশাকের অংশটুকু ছাড়িয়ে নিলো শাফিন। অনন্য হেসে বলল,
“ বলব।
বোস না প্লিজ! “
তীব্রর খসখসে হাতটা নিজেই টেনে এনে সোফায় বসাল সে। হাতল, পাশের জায়গায় ঝটপট বসে পড়ল বাকীরা। তীব্র মাস্কটা এক টানে খুলে ফেলল। কণ্ঠে একইরকম ক্রোধ নিয়ে বলল,
“ আমি এখানে তোদের সঙ্গে আড্ডা মারতে আসিনি। একদম এসব পিরিত দেখাবি না আমায়।”
মিরাজ বলল,

“ আহহা সেতো আমরা জানি। তুই যে আমাদের একেকটাকে ঠেঙিয়ে হাসপাতালে পাঠাতে এসেছিলি,এই কথাটা তুই না বললেও আমরা বুঝি। এতদিনে তোকে এইটুকু চিনব না?”
মুশফিক বলল,

“ তবে ভাই তোর সাহসের ওপর আমি আবারও ফিদা হয়ে গেলাম। এখানে কারা থাকে,তারা কেমন,কজন আছে কিচ্ছু না জেনে একা একা পেটাতে চলে এলি? তোর বুকের পাটা তো ৫৬ ইঞ্চি না। ৫৬ দুগুণে ১১২ ইঞ্চি।”
তীব্র দাঁড়িয়ে গেল। রাগে চেঁচিয়ে উঠল ফের,
“ নাটক মারাও আমার সাথে? একদম মুখ খারাপ করাবি না। আমার প্রশ্নের উত্তর দে আগে। তোরা এখানে কেন? কী চাই তোদের?”
শাফিন ওকে শান্ত করতে বলল,

“ বিট্টু, বিট্টু একটু ঠান্ডা হ দোস্ত। আমরা সবটা বলছি তোকে। মাথা ঠান্ডা কর। বোস প্লিজ। আর এখন অনেক রাত,এই মাঝরাতে এভাবে চিৎকার করলে তো তোর ভিতু মেয়েও শুনে ফেলবে।”
এ যাত্রায় নিভে এলো সে। জেদ গিলে দাঁত চেপে বসল আবার। তাও পুরূ কণ্ঠে বলল,
“ তুই না ভারত ছিলি? দেশে এলি কবে? না কি যাসই নি?”
“ বলব রে ভাই বলব। একটু তো জিরিয়ে নে। আমাদেরকে পেটানোর জন্য কত প্ল্যান করে এসেছিস, মাথাটাকে একটু রেস্ট দে এবার।”
তীব্র হুশিয়ারি দিলো,

“ তোদের ফাজলামোর মুডে আমি নেই । রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আর তোরা আছিস তোদের বা**র রসের কথা নিয়ে? যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দে ।”
শাফিন বলল,
“ আচ্ছা আচ্ছা দিচ্ছি। আমি দেশে এসেছি প্রায় সপ্তাহখানেক হবে। তবে এখানে এসেছি কাল রাতে।”
তীব্র কপাল কোঁচকাল,
“ মানে? সাতদিন হয়েছে দেশে এসেছিস,অথচ আমি জানি না? আর এখানে তোদের কী কাজ?”
ও মুখ ভার করে বলল,

“ কী করে জানাব তোকে? তোর কি এখন আমাদের জন্যে সময় আছে? একটা মেয়ে পেয়ে আমার বন্ধু দিন-দুনিয়া এমন ভাবে ভুলেছে, বন্ধু কবে দেশে এলো, কী করল কিচ্ছু জানে না। তুই আমার একটা খোঁজ পর্যন্ত নিসনি বিট্টু।”
তীব্র চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। প্রয়াস চালাল রাগ আটকাতে। তার বন্ধু মহল পুষ্পিতাকে এমন নোংরা চিঠি পাঠিয়েছে কথাটা মনে করলেও আগুন জ্বলছে মাথায়।
“ আমি খোঁজ নিইনি বলে ভিতু মেয়ের পেছনে পড়েছিলি?”
আরমান জ্বিভ কাটে। মিরাজ শশব্যস্ত সাফাই দেয়,

“ এই না না, ওটাতো আমরা অন্য একটা কারণে করেছিলাম।”
মুশফিকের কণ্ঠে বিরক্তি। বলল,
“ আমি জানতাম বিট্টু রেগে যাবে। এজন্য এই প্লানে আমি থাকতে চাইনি। তোদের সব কটার জন্য এখন আমিও মার খাব।”
শিশুর মতো ঠোঁট ওল্টায় সে।
তীব্র সরু চোখে চাইল,
“কীসের প্ল্যান?”
ফের মুখ দেখাদেখি করল ওরা। মিরাজ মিনসে কণ্ঠে জানাল,

“ আসলে হয়েছে কি, তোকে ছাড়া আমাদের বাড্ডা তে একটুও মন টিকছিলো না। তাই জন্য সবাই মিলে এখানে এসে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। মানে আমরা চেয়েছিলাম এমন কিছু করব যাতে তুই খুব চমকে যাবি, শক খাবি। কিন্তু কিছুতেই কিছু পাচ্ছিলাম না জানিস। আবার একটু অভিমানও হচ্ছিল,এখানে আসার পর শেষ দুটো মাস তুই তেমন যোগাযোগই করছিলি না বলে।

তাই ভাবলাম, এক ঢিলে দুই পাখি মারব। মানে এমন কিছু করব,যাতে তোকে একটা ছোট্টো পানিশ করা হবে,আবার ওই সারপ্রাইজ দেয়াও হবে। কিন্তু মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসছিল না। এরপর হঠাৎ করে ভাবলাম যদি পুষ্পিতাকে একটু বিরক্ত করার নাটক করি, তুই তো রেগেমেগে মারতে আসবি, কনফার্ম। এসে যদি দেখিস, আমরা এখানে তখন তোর ভরকে যাওয়া চেহারা দেখেই আমরা মজা নেব ভেবে। সেজন্য কাল যখন ওদের বাসায় তোকে আর নাহিদকে এক নজর দেখলাম,সেই সুযোগ টা আর হাতছাড়া করিনি।”

তীব্রর তপ্ত চোখ দেখে ঢোক গিলল মিরাজ। বলল,
“ সত্যি বলছি। যা করেছি তোকে ভালোবেসে। এর মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।”
সাথে গলার কাছটা খামচে ধরল ও। তার দেখাদেখি বাকীরাও ধরল। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসল শাফিন।
তীব্র নিরুত্তর। বসে বসে কামরার চারপাশটা দেখল একবার। কয়েকটা এলোমেলো রাখা পানির বোতল, সিগারেটের ছাই ভরা এস্ট্রে, দরজার পেছনের হ্যাঙারে ঝোলানো শার্ট, এক কোণায় রাখা তিনটে লাগেজ। আর ফ্লোরে বিছানো একটা চওড়া বিছানা। সাথে কয়েকটা প্লেট বাটি ছাড়া তেমন কিচ্ছু নেই এখানে। খায় কোথায় এগুলো? বাইরে থেকে অর্ডার করে করে আনে?

ফোস করে শ্বাস ফেলল তীব্র। মিরাজ কে সে চেনে। গোটা বন্ধুদেরই তো আগাগোড়া জানা। ওরা এমন কিছু করার কথাও নয়,যাতে সে রেগে উল্টোপাল্টা ঘটায়। সব মিলিয়ে ক্ষণিকের বিভ্রান্তিটুকু উবে গেল এবার। অতীষ্ঠ ভঙ্গিতে বলল,
“ সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য এরকম জঘন্য প্ল্যান কারো মাথাতে আসতে পারে! এত গবেট কেন তোরা?”
মুশফিকও স্বায় মেলায়,

“ আসলেই গবেট। কসম ভাই এসব বিরক্ত-টিরক্ত কিছু করতেই চাইনি আমি। এই মিরাজ আর আরমানই জোর করেছে। তবে আমি শুধু ঢিল ছুড়ে মেরেছি। তুইতো জানিস আমার নিশানা কত পাকা! আর ওদের সব গান-টান শুনিয়েছে এই দুটোতে। তুই ভুল বুঝিস না। তুই হলি আমাদের জানের বন্ধু, তোর যেটা অপছন্দ সেটা আমরা করতে পারি?এটাও করতাম না। ওই শুধু তোকে এখানে আনার জন্যই…”

তীব্রর রাগ-ক্ষোভ আর টেকেনি। বরং হাসি পেলো। সব গুলো মাস খানেক ধরে তার নাকের ডগায় একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে,আর সে কিছু জানতেই পারল না? জানার চেষ্টাও করেনি অবশ্য। পুষ্পিতা আর নিজের শিক্ষক সত্ত্বা জিইয়ে রাখতে এমন ডুবে ছিল,অন্য দিকে নজর ফেলার সময় কোথায়!
তাহলে এজন্যেই দুবার বাড্ডা গিয়ে একটাকেও পায়নি। সাব্বিরদের যে বলে গেছিল, জরুরি কাজের কথা? এই তবে জরুরি কাজের নমুনা!
তক্ষুণি হতাশ শ্বাস ফেলল শাফিন। আহত কণ্ঠে বলল,

“ আর আমি তো কিছু না করেই লাথি খেলাম। এখানে এলামই কাল রাতে। আর আজকেই লাথি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানানো হলো। অবশ্য এর থেকে ভালো অভ্যর্থনা বিট্টু মাস্তান দিতে পারে?”
পরপরই মুখ কালো করে বলল,

“ আমাদের দেখে তুই খুশি হোসনি বিট্টু?”
তীব্রর সব ক্ষোভ শেষ। উধাও অযাচিত ক্রোধ। বন্ধুদের দেখে খুশি হওয়ার সত্যিটা ঠোঁট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো এখন। উঠে এসেই জড়িয়ে ধরল শাফিনকে। বাকীদের ঠোঁটযুগলে ফোয়ারা ছুটল হাসির। স্বস্তিতে লুটপাট হলো বক্ষ। যাক! বিট্টুটা ভুল বোঝেনি তাহলে। তীব্র ওদের উদ্দেশ্যে হাত বাড়াল তখনই। অমনি একেকটা ছুটে এসে যে যার মতো জাপটে ধরল ওকে। পাঁচ বন্ধুর মিলনের উল্লাস ভেসে বেড়াল হাওয়ায়। সকলের সাথে তাল মিলিয়ে হইহই করল বাড়ি-ঘর।
তীব্র সরে এসে শুধাল,

“ আন্টি কেমন আছে?”
শাফিন হৃষ্ট চিত্তে বলল,
“ আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো। ওদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এত দারুণ না! অপারেশনের পরেই মা ফিট। ও হ্যাঁ, আসার সময় আমাকে বারবার বলেছে তোকে সাথে নিয়ে যেতে। হাসপাতালে বসে প্রাণভরে দোয়াও করেছে জানিস। কতবার কল করেছিলাম, ধরলিই না।”

“ সময় পাইনি। আজকাল ফোন কোথায় রাখি সেটাই খেয়াল থাকে না। আর জানিসই তো মন্ত্রীমশাইকে। প্রত্যেকটা দিন ফোন করে নতুন নতুন কাজ দেয়৷ ডেকে পাঠায়। কিছুটা ওনার যন্ত্রণাতেই সাইলেন্ট করে রাখি।”
“ কিন্তু নাহিদ গোরুটাও তো ধরে না। ওটা কী করে?”
তীব্র আবার জায়গায় গিয়ে বসল।
জিজ্ঞেস করল প্রথমে,

“ সিগারেট আছে?”
ব্যস্ত ভঙ্গিতে সিগারেট,লাইটার এনে সব একসাথে এগিয়ে দিলো আরমান।
ও ঠোঁটে গুঁজে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে জানাল,
“ সে আজকাল আমার থেকেও ব্যস্ত থাকে। চাকরি খুঁজছে। এত বার বললাম আমি ব্যবস্থা করে দেই শুনলো না। তারওপর আবার আমাকে পড়াতেও হয়।”
সহসা হোচট খেলো ওরা। বুঝতে না পেরে বলল,

“ তোকে পড়াতে হয় মানে?”
তীব্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বিরক্ত কণ্ঠে জানাল,
“ আর বলিস না তো। বা* ছোট থেকে পড়াশোনাতে মনোযোগ না দিয়ে যে কী ভুল করেছি! লেকচারার হওয়া কি মুখের কথা? নিজেকে জানতে হয়, তারপর অন্যদেরকে শোনাতে হয়। সেজন্য রোজ রাতে নাহিদ যেটা দেখিয়ে দেয়, পরেরদিন আমি সেগুলোই গিয়ে পড়াই। তারপরেও ভয়ে থাকি,সিলেবাসের বাইরে না কেউ প্রশ্ন করে ফেলে। তাহলে তো হাঁ করে চেয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকবে না।”

ওরা বিমুঢ় হয়ে আবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
শাফিন বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ বিট্টু মাস্তান এখন ভয়েও থাকে? আবার পড়াশোনাও করে? বাপ্রেহ বাপ! অবশ্য ওদের কাছে শুনেছিলাম তোর এই হঠাৎ লেকচারার হওয়ার কথা। তখন যতটা না অবাক হয়েছি এখন তো অবাকের চোটে আমার মাথা ঘুরছে।”
তীব্র একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এটুকুতে শাফিনের মাথা ঘুরছে। তাহলে তার যে রাতারাতি কত পরিবর্তন এসেছে, সেসব জানলে কী করবে?
মুশফিক তুলল ভিন্ন কথা। খুব গুরুতর কণ্ঠে বলল,

“ ওসব বাদ। আচ্ছা বিট্টু, তুই না কি সাব্বিরকে ফোন করে চাঁদা তুলতে মানা করে দিয়েছিস?”
তীব্র সোজাসাপটা জবাব দিলো,
“ শুরু চাঁদা নয় তো৷ দলবল নিয়ে ওখানে বসতেও মানা করেছি।”
শাফিন উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
“ কিন্তু কেন? এত বছরে পুরোনো জায়গা আমাদের। কত মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে নিজেদের জায়গা বানিয়েছিস তুই । হুট করে সবকিছু কেন উঠিয়ে ফেলতে বললি?”
আরমান বলল,

“ এর আগে নাকি গিয়ে বলে এসেছে মেয়েদের দেখলে টিজ না করতে। সেটা বল!”
তীব্র বলল,
“ বলার দরকার নাই। আমার কাজ আমার মাথায় আছে। আর যা করেছি বুঝে-শুনেই। কারণ ছাড়া আমি কোনও কাজ করি, কখনো দেখেছিস?”
তার একেকটি রহস্য মোড়া কথায় চারজন তলিয়ে গেল বিভ্রমে। কিছু বুঝতে না পেরে, বোকা বোকা চোখে চেয়ে রইল কেবল।
তীব্র নিজেই বলল,

“ আমি আর এসব গুণ্ডামিতে নেই। চাঁদা তোলা তো দূর, অহেতুক কারো গায়ে টোকাও দেব না। বিট্টু মাস্তানের গ্যাং বাড্ডা থেকে বরাবরের মতো তুলে ফেলেছি।”
প্রত্যেকে কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে পড়ল। ফ্যালফ্যালে বিস্ময় সমেত চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরপরই ধড়ফড় করে পাশে বসল এসে। মিরাজ মুখ খুলল আগে। কণ্ঠে অবিশ্বাস,
“ কী বলছিস?
তুই না বলেছিলি মানুষকে ভয় দেখাতে,তাদের চোখে তোর জন্য ভয় দেখতে তোর ভালো লাগে? আনন্দ হয়? তাহলে হঠাৎ কী হলো?”
তীব্রর চাউনী নরম হলো।
অন্যরকম শোনালো ভরাট স্বর,বলল,

“ না। মানুষকে ভয় দেখিয়ে যে আনন্দ তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ ওদের মুখে হাসি ফোটানোয়। বিপদে ফেলার চেয়ে,বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ানোতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগা।
যখন কাউকে একটু সাহায্য করবি? তখন যেভাবে দোয়া করবে ওরা,দেখবি তোর দুনিয়াটাই বদলে গেছে। তুই ভেতরে যাই হোস,কোনো একটা মানুষের কাছে নিজেকে ভালো মানুষ বানানোতে যে সুখ,সেসব অন্য কিচ্ছুতে নেই।”

কথার পিঠে ওদের শব্দভাণ্ডার ফুরাল। হতবিহবলতায় কিছুই বলতে পারছে না। এতগুলো বছর যে বিট্টুকে চিনে এসেছে,দেখে এসেছে,এ যেন সে নয়। দুজনের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাত।
তীব্র ফের বলল,
“ আমি এই চার মাস ভীতু মেয়ের সাথে থেকে দেখেছি, পৃথিবীটা না অন্যরকম সুন্দর! প্রথমবার আমি কাউকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি জানিস? প্রথমবার মায়ের মত কেউ আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছে। প্রথম কারো ঠোঁটে আমার জন্য হাসি দেখেছি। সেদিনই ঠিক করে নিয়েছি,ওসব আর নয়। আমি আর বিট্টু মাস্তান হতে চাই না। ভদ্র-সভ্য লেকচারার তীব্র রেজাটাই আমার বেশি পছন্দ।”
আরমান হড়বড় করে বলল,

“ কিন্তু চাঁদাবাজি তুলে দিলে আমরা খাব কি? হাত খরচ চালাবো কি দিয়ে? নাইট ক্লাবে যাব কিভাবে?”
তীব্র সূচালো চোখে চাইল,
“ কেন? হাত-পা নেই তোর? কাজ করে খাবি। আরেকজন কষ্ট করে রোজগার করে,সেটা লুটিয়ে নেয়ার থেকে নিজে পরিশ্রম করে দ্যাখ। নিজেকেই নিজের সম্মান করতে ইচ্ছে করবে।
এইতো, গর চার মাস চাকরি করছি। হাত পেতে বেতন নিচ্ছি প্রতিবার। অন্যরকম একটা মজা এতে। আমার মনে হয়, এই মজা তোদেরও পাওয়া উচিত।”
শাফিন তুচ্ছ হেসে মাথা নাড়ল দুপাশে। বলল,

“ বিট্টু তুই কি ভুলে গেছিস আমি চাকরির চেষ্টা করে তারপরেই এই মাস্তানিতে এসেছিলাম? এখনকার যুগে চাকরি এতো সোজা না রে। আবার আমাদের তো ব্যাক আপও নেই।”
মিরাজও সমান মুখ কালো করে বলল, ‘“ সেইতো। আমার সার্টিফিকেটের যে দশা! চাকরিটা দেবে কোন পাগলে?”
তীব্রকে বিচলিত দেখা গেল না। ধীরস্থির জানাল,

“ তোরা চেষ্টা কর। ইন্টারভিউ অবধি তোদের দায়িত্ব। এরপর কাজ পাবি না পাবি সেটা আমি দেখে নেব। চাকরি নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। ওসবের জন্য মন্ত্রী মশাই আছে তো।”
মনের মতো সমাধান পেয়ে ওরা খুশি হয়ে গেল। একে একে উচ্ছ্বলতা ভিড়ল নিভে থাকা চেহারায়।
তবে এতটা সময় পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল মুশফিক। বৃদ্ধিমান ছেলেটা সুক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ্য করছিল তীব্রকে। এবার এসে কাছে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলে,

“ বিট্টু! তোর কি মনে হয় না,ওই মেয়েটার প্রতি তুই একটু বেশিই ডুবে যাচ্ছিস?”
তীব্র আজকে মিথ্যে বলল না। ইগো বজায় রাখতে কোনো রকম ভণিতাও করেনি। সোজাসুজি জানাল,
“ যাচ্ছি না। গিয়েছি। আমি ওকে ভালোবাসি।”
মুশফিক চমকে তাকায়। একই রকম থমকে থাকে সকলে। সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,
“ কীইইই?”
আরমান অধৈর্য হয়ে বলল,
“ আর ওই মেয়েটা? ও তোকে ভালোবাসে?”
এ যাত্রায় হতাশ ছাপ বসল তার সুতনু আদলে। তেমনি নিরাশ কণ্ঠস্বর,
“ না। কিছু তো বলিইনি।”
মুশফিক বলল,
“ এখনো না? কবে বলবি তবে?”

“ জানি না। যখন মনে হতো ওকে পছন্দ করি, ততদিন সবকিছু গুছিয়ে করেছি। প্ল্যানের বাইরে কিচ্ছু হয়নি। অথচ যবে থেকে নিশ্চিত হলাম ওকে ভালোবাসি, তবে থেকে ওকে দেখলেই আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আমার মধ্যে নেই। এজন্য কিছু চেয়েও করতে পারছি না। তাড়াহুড়োতে সব হাতছাড়া হয় যদি?”
সে বলল,

“ হাতছাড়া? কী যে বলিস বিট্টু। তুই হলি তীব্র রেজা তালুকদার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জামশেদ আঙ্কেলের ছেলে। নিজেরও তো নাম-ডাক আছে। তোর নজরে যেটা পড়বে সেটা হাতছাড়া হতে পারে কখনো?”
তীব্র বিদ্রুপ হেসে বলল,
“ যে নাম ডাকের কথা বলছিস,ওসব শুনলে প্রেম যেটুকু হওয়ার সেটুকুও হবে না।”
মিরাজ যুক্তি দেয়,
“ তাও ভাই। যাই বলিস তুই, ওই মেয়ে যা ভিতু! মনে নেই শাফিনের হাতে ছুড়ি দেখেই কেমন অজ্ঞান হয়ে গেছিল? তুই এতো কষ্ট না করে, একটা কষে ধমক দে। ধমকও লাগবে না। দেখবি তোর একটা চোখ রাঙানিতেই পুষ্পিতা ভয়ে প্রেমে পড়ে যাবে।”

বোকা বোকা কথাটায় ফিক করে হেসে ফেলল আরমান। তীব্র নিজেও বিরক্ত হলো। শাফিন বলল,
“ চোখ রাঙানি নয়,আসলে ও যেটা বোঝাতে চাইছে সেটা হলো, তোর পাওয়ার আছে বিট্টু। তারওপর মেয়েটা এতিম। পেছনে মাথা তোলার মতো আত্মীয়-স্বজন কেউই নেই। ওকে কাছে টানতে তো তোর দু সেকেন্ডও লাগার কথা না।”
তীব্র নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ ঠান্ডা চোখে শাফিনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। ছেলেটা অস্বস্তিতে ভুগে বলল,
“ না মানে তোর ভালোর জন্যে বলেছি।”
তীব্রর দড় কণ্ঠের সুদৃঢ় জবাব আসে,

“ ফুল কখনও বজ্রপাতে ফোটে শুনেছিস? শুনিসনি। কারণ ফুল ফোটে মালির যত্নে। পুষ্পিতা আমার কাছে ফুল । ভীষণ কোমল,সুন্দর একটি ফুল। যে ফুলে পাওয়ার খাটিয়ে মুষড়ে দেয়ার মতো ভুল তো দূর,জোরাজুরির একটা আঁচও লাগাব না আমি। যত্ন করব। ভীষণ যত্ন। সেই সাথে পৃথিবীর সবটুকু নিবেশন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখব আমার বুকের মধ্যে।”
মারকূটে তীব্রর মুখে আচমকা এই প্রেমিকসুলভ কাব্য! সবার
যুক্তিতর্ক হারিয়ে যায়। তবে বিস্তর হাসল শাফিন। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে বলল,

“ বাবাহ! শেষমেষ আমাদের বন্ধুটা প্রেমে পড়েছে তাহলে। যাক, খুব করে চাইছিলাম কেউ একজন আসুক। এই যে তোর মেয়েদের প্রতি চূড়ান্ত অনীহা ছিল,কাটিয়ে দিক সেটা। দেরীতে এলেও,এসেছে তো। যার জন্য বিট্টু মাস্তান রীতিমতো লেকচারার বনে গেল, সে মেয়ে কিন্তু তোর থেকেও পাওয়ারফুল রে বিট্টু। সাবধান!
সবার হাসির মাঝে ভাবনায় বুঁদ হলো তীব্র। তারপর আচমকাই গম্ভীরতার ছাপ বসল আননে। ফট করে প্রশ্ন ছুড়ল,
“ তোরা এখান থেকে কবে যাচ্ছিস?”
হাসিহাসি মুখগুলো চুপসে এলো অমনি।
মুশফিক মিনসে কণ্ঠে বলল,
“ কেন? থাকি না কদিন।”
তীব্র চড়া কন্ঠে বলে,

“একদম না। তোদের নিয়ে বিন্দুমাত্র রিস্ক নেব না আমি। এখানে থাকলে কোনো না কোনো গণ্ডগোল তো নিশ্চিত ঘটাবি।”
মিরাজ ব্যস্ত যুক্তি দিলো,
“ বিশ্বাস কর। আমরা এরকম কিচ্ছু করব না। তুই ভালো হয়ে গেছিস না? এবার আমরাও হব। এই তো এখানে এক মাস এসেছি। কোন মেয়েকে বিরক্ত করিনি। আর বিরক্ত করবো কি ভাই, আমরা তো বাইরেই বের হইনি। খাবার-দাবার সব অনলাইনে আনিয়েছি। আর বাড়তি যা লাগতো ওই দারোয়ানের ছোট ছেলেটাকে দিয়ে আনাতাম।”
তীব্র ভ্রু উঁচাল,

“ তা কদিন বসে বসে খাবি এভাবে? বের হতে হবে না? তখন তো অকাজ ঠিকই করবি”
আরমান বলল,
“ বসে খাব না তো। আমরাও চাকরি করব। তুই আঙ্কেলকে দিয়ে সুপারিশ করালেই তো চাকরি কনফার্ম হবে তাই না? আর দ্যাখ ভাই,চাকরিতে ঢুকলে অফিসের অত খাটাখাটুনি তে দম ফেলব? না মেয়ে দেখে টিজ করব?”
শাফিন বলল,

“ আমি তো এখানে থাকতে পারব না। মা আর বোনুকে দেখার জন্য আমি ছাড়া তো কেউ নেই। তবে ওরা থাকুক না বিট্টু। এইবারের মতো বিশ্বাস কর বেচারাদের। তোকে ছাড়া আসলেই আমাদের ভালো লাগে না । ওরা থাকলে আমিও মাঝেমধ্যে আসব। সেই কবে থেকে সবাই একসাথে চলছি। প্লিজ তাড়িয়ে দিস না।”
মুশফিকের কণ্ঠেও অনুরোধ,
“ আমরা প্রমিস করছি, এমন কিছু করবো না যাতে তোর অসুবিধা হয়।”
“ হ্যাঁ কিছু করব না।”
এতজন, এতবার করে বলায় তীব্র দমে এলো। মুখের ওপর মানা করতে মায়াও হলো বটে।
তবে সতর্ক করল কড়া গলায়,
“ কথাগুলো যেন মনে থাকে ।”

ফ্ল্যাটে আসার চার মাস। অথচ এই প্রথম ছাদে এলো নাহিদ। আহামরি সুন্দর বলতে এখানে কিছু নেই। বরং এপাশ-ওপাশ টাঙানো দড়িগুলো মাথার ওপর ঝুলছে। এক কোণে কয়েকটা নয়নতারা গাছের চারা
,আর বিশাল বড়ো একটি ট্যাংকি ছাড়া বাকী সব ফাঁকা। অথচ ঠান্ডা হাওয়ায় মন জুড়িয়ে গেল ওর। শ্বাস টানল লম্বা করে। শান্ত ভোর। মৃদুমন্দ আলোর ছটা আসছে। ছোটো ছোটো পাখিদের দল নীড় ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে গগণে।
নাহিদ চারদিকে দেখছে। মন টিকছিল না ঘরে। বিট্টুটাও নেই৷ এত ভোরে কোথায় যে গেল! গেল তো গেল,ওকে সঙ্গে নিলেও তো পারতো।

হঠাৎ ডানে ফিরতেই, খেয়াল পড়ল রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে নূহা। পিঠ ফেরানো ওদিকে। কানে ফোন। ক্লান্তহীন বকবক আর কণ্ঠ শুনেই চিনে ফেলল নাহিদ। প্রথমে অবাক হলো। এই ভোরে এই মেয়ে এখানে?
পরপরই ঠোঁটে হাসি টেনে এগিয়ে গেল কাছে। কিছু বলতে যাবে,পূর্বেই ওপাশ হতে নূহার কর্কশ বাক্য ভেসে আসে। খুব রেগে রেগে কথা বলছে মেয়েটা। অমনি হাঁ-টুকু গিলে নিলো নাহিদ। সজাগ কানে স্পষ্ট রূপে বাড়ি খেল নূহার সবকটা কথা। নিরন্তর ঝাড়ি মারছে কাউকে।

মেয়েলী কণ্ঠে কী তেজ! নাহিদের দূর্বল বুকে বজ্রের ন্যায় আঘাত হানে সেসব। এমন ধমকে-ধামকে কথা বলতে কোনো মেয়ে মানুষকে আজ অবধি দেখেনি সে। মেয়েরা হবে মোমের মতো নরম। যেমন কোমল মন, তেমন কোমল চালচলন থাকবে এদের। তা না,এই মেয়েকে দেখো।
নির্ঘাত আয়েশা আন্টি জন্মের সময় মুখে মধু দেয়নি।
তক্ষুণি ঘুরে চাইল নূহা। চিন্তায় মশগুল নাহিদকে আচমকা দেখে,চমকে উঠল একদম। শঙ্কায়-আতঙ্কে চ্যাঁচালো,

“ ও মাগো!”
কিন্তু ভিতু নাহিদের ভয় লাগেনি আজ। বরং অবাক চোখে চেয়ে রইল সে। চঞ্চল নজর আটকে গেল নূহার চোখের ওপর।
বিস্মিত হয়ে বলল,
“ আপনি কাঁদছেন মিস নূহা?”
হুটহাট ব্যাপারটায় মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। চট করে ঘুরে গেল আবার। চোখ মুছতে মুছতে বলল,
“ না, কাঁদব কেন?”
মুচকি হাসল নাহিদ।
“ আপনার ভাষ্যমতে আমি ঢেঁড়স হতে পারি, কিন্তু কেউ কাঁদছে কী না সেটা বুঝব না? অতটাও আহাম্মক আমি নই।”

নূহা ফিরল ভেজা নয়নে। অথচ খ্যাক করে বলল,
“ বুঝলে বুঝেছেন। কী করব এখন? নাচব?”
নাহিদ স্ফূর্ত চিত্তে বলল,
“ আপনি নাচতেও পারেন না কি? ওয়াও, কত গুণ আপনার!”
নূহা ভ্যাবাচেকা খেল। আগের চাইতেও ভয়ানক খ্যাপে বলল,
“ এই আপনার সমস্যা কী হ্যাঁ ? আমি একটু শান্তিমতো কাঁদছি সেখানেও এসে জ্বালাচ্ছেন!”
“ ইয়ে মানে আমি তো কিছু করিনি। রেগে যাচ্ছেন কেন?”
“ রাগব না কেন? সম্বল বলতে আমার আছেই তো এই একটা জিনিস।”

বলতে বলতে নাক টানল নূহা। কিন্তু হাসি পায় ওর। মেয়েটা সব সময় বিট্টুর মতো মেজাজ দেখায়। অথচ কাঁদতে দেখল আজ প্রথম বার। বাহ, কাঁদলে একেবারে বাচ্চা বাচ্চা লাগে তো।
ভাবনা কাটল নূহার দুঃখী কণ্ঠ শুনে। সে নিজে নিজেই প্রলাপ ধরেছে,
“ এই দুনিয়ার সবাই স্বার্থপর। সবার বিপদে আমাকে খাটায়। অথচ আমার বিপদে একটা কাউকে পাশে পাচ্ছি না।”

নাহিদ গলা খাঁকারি দিলো। জ্বিভখানা উশখুশ করছে কথার পেছনের কারণ জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু বিধিবাম,মেয়ে যা রাগী! ফের চেতে যায় যদি? কিন্তু কৌতূহল কি আর থামে?
রয়েসয়ে শুধাল,
“ আপনার কী কিছু হয়েছে মিস নূহা?”
নূহা চোখ তুলল একবার। কান্নায় ফুলতে থাকা ঠোঁট চেপে চুপটি করে রইল। পুষ্পিতার মতোন নিজেও আজ,মস্তক নুইয়ে নিলো গলায়।
নাহিদ নরম কণ্ঠে বলল,

“ মিস নূহা, আমি আপনার খারাপ চাইব না। মানুষটা আমি যে মোটামুটি ভালো সে নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝেছেন? তা আপনার সমস্যাটা কি বলা যাবে আমাকে?”
এমন মধুর স্বরে নিবেদন কেউ করেছে কখনো? করলেও হয়ত এরূপ কলকণ্ঠের ন্যায় কানে লাগেনি নূহার। মেয়েটার পাথুরে মন গলল। থেমে থেমে বলল,
“ তেমন আহামরি ব্যাপার নয়।

আসলে কিছু এসাইনমেন্ট বাকী আছে আমার। কাল জমা করতে হবে। কিন্তু সাবজেক্টটাতে আমি এত কাচা! কোত্থেকে কী করব কিচ্ছু বুঝতেই পারছি না। কতজনকে ফোন করলাম হেল্প করতে,কেউ গায়েই মাখছে না। বারবার বলছে আমরাও করিনি। যতই বলুক,আমি জানি ওদের টা ওদের ঠিকই করা শেষ। শুধু আমাকে সাহায্য করবে না দেখেই বাহানা দিচ্ছে। কাল ঠিক সময় মতো শো করবে ম্যামের সামনে। এই এসাইনমেন্ট করতে না পারলে এক্সামের সময় নম্বর বাদ যাবে। আমি যে কী করি এখন!”
নাহিদ বলল,

“ পুষ্পিতার থেকে তো হেল্প নিতে পারেন।”
নূহা বড়ো নিরুপায় চোখে চাইল।
“ কী করে নেব? আমাদের প্রাইভেটের সিস্টেম তো ওদের সাথে মিলছে না।”
“ ও আচ্ছা।”
তারপর নিম্নোষ্ঠ কামড়ে চিন্তায় ডুবে গেল নাহিদ। নূহা নিজেই বলল,

“ আচ্ছা তীব্র স্যার কোথায়? ওনাকে খুঁজেছিলাম,পাইনি। উনি থাকলেও কিছু হেল্প নেয়া যেত।”
এইবার চমকে উঠল ছেলেটা। চোখ তুলল গোল গোল ভাবে। এই রে! বিট্টুর থেকে সাহায্য? ওটা তো এসবের কিচ্ছু জানে না। এই চ্যাপ্টারে আসেইতোনি।
আমতা-আমতা করল,
“ আসলে ওর কিছু কাজ পড়ে গেছে। রাতে আসবে। বা নাও আসতে পারে।”
নূহা মুখ কালো করে বলল,
“ ও। আমার সাথে সব সময় এমন হয় জানেন? কখনো কেউ পাশে থাকে না। আর পুষ্পিতাটা পাশে থাকতে চাইলেও,বেচারির উপায় থাকে না। আমার শুধু কান্না পাচ্ছে এখন! ”
নাহিদের এতো মায়া হলো! মেয়েটার কাঁদো কাঁদো মুখখানা দাগ কাটল বুকে। আচ্ছা,সে নিজেও তো ইকোনমিকসের ছাত্র। সিজিপিএও ভালো ছিল। একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? যদি মেয়েটার কোনো উপকার হয়!
হেসে বলল,

“ কে বলল কেউ পাশে থাকে না? এই যে আমি, আমি আছি তো। পাঁচ ফুট এগার ইঞ্চির ছেলেটাকে আপনার চোখে পড়ছে না মিস নূহা?”
ও বুঝতে না পেরে বলল,
“ কী বলছেন বলুন তো!”
নাহিদ বলল,
“ আসুন আমার সাথে।”
“ কোথায় যাব?”
“ ঘরে। চাইলে আপনাদের ঘরেও বসা যায়।”
নূহা বিভ্রান্ত,

“ আমি কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
“ আহহা,আসুন তো। এলেই সব বুঝবেন।”
চপল পায়ে সিঁড়ির দিকে রওনা করল নাহিদ। নূহা বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, পিছু নিলো তার।
যেতে যেতে ভাবল,তার কান্নাকাটির সময় যদি মজা-ফজা করে? একেবারে হাতুড়ি দিয়ে মেরে, মাথার ঘিলু আলাদা করে ফেলবে।

সকাল নয়টা!
পুষ্পিতা তৈরি হয়ে বেরিয়েছে কেবল। অথচ চঞ্চল চোখ বারবার ঘুরপাক খায় তীব্রদের বন্ধ দরজার ওপর। প্রতিদিন সে বের হওয়া মাত্রই স্যারকে দেখা যায়,আজ নেই কেন?
পুষ্পিতা ওদিকে চেয়ে চেয়েই এগোচ্ছিল সামনে । সিড়িতে এক পা রাখতে রাখতেও তীব্রদের দরজা খুলল না। কেন যেন আহত হলো মেয়েটা। স্যার কি আজ যাবেন না?
নিরাশ বদনে সামনে ফিরল,সহসা ছ্যাৎ করে উঠল বক্ষপট। চোখের নিকটেই দাঁড়িয়ে তীব্র।
অমনি ত্রাসে পিছিয়ে যায় সে। মৃগনেত্র হকচকানোয় বৃহৎ দেখায় আরও। তীব্র ভ্রু উঁচাল,

“ কাউকে খুঁজছো?”
পুষ্পিতা জোরে জোরে।
মাথা ঝাঁকাল। বোঝাল, খুঁজছে না।
তীব্র ঘাড় নাড়ে। শিষ্টের মতো
একদিকে সরে দাঁড়ায়। চোখের ইশারায় পথ দেখাল,
“ যাও তবে।”
গুটি গুটি কদম বাড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করল পুষ্পিতা। অথচ মনে হচ্ছে, এ যেন কটা সিঁড়ি নয়। সাত সমুদ্র,তেরো নদীর পথ। ফুরাচ্ছেই না।
তীব্র তখন সিঁড়ির হাতলে পিঠ লেপ্টে দাঁড়িয়ে । ডান পা-টা এলবো করে ভাঙা। সিঁড়ির জায়গা মোটামুটি সরু। বলবাণ পুরুষটির সামনে থেকে যেতে হলেও,বুকের সাথে শরীর মিশবে ওর। পুষ্পিতা একটু এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের কোণা দিয়ে চাইতেই, ডান ভ্রু নাঁচাল তীব্র। কণ্ঠে প্রহসন,

“ কী, যেতে ইচ্ছে করছে না?”
ও মিনমিন করে বলল,
“ না মানে আপনি আরেকটু সরলে…”
“ কোথায় সরব? হাতল সহ নিচে পড়ে যাব?”
পুষ্পিতা উদ্বেগ নিয়ে মাথা নাড়ল ফের৷ সরাসরি নজর তীব্রর সাদা মুখে মিলতেই, আগের মতো চোখ নামাল। নির্লজ্জ্বের মতো কালকের সব কথা মাথার কোষে দপদপ করছে কেমন। কপালের টিপ ঠিক করে দেয়ার দৃশ্যেই, একই রকম ছলকে উঠছে বুক।
ভীষণ লজ্জায় গাট হয়ে তৎপর পালাতে চাইল সে। কিন্তু না,পা দুটোতে তুষারের ধ্বস নেমেছে যেন। ওরা বেহায়ার মতো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছে।
পুষ্পিতার সব মিলিয়ে হাসফাস লাগে। বেড়ে আসে উচাটন।

তার কুণ্ঠিত আনন জুড়ে তীব্রর দুষ্টু আঁখির বিচরণ। এমন নিষ্পলক চেয়ে থাকার মাঝেও যে কী সুখ! এমন সুখ তো ও ছাড়বে না। চোখের সঙ্গে সঙ্গে উন্মত্ত বক্ষভাগও জুড়িয়ে আসে হিমে। অমন দাঁড়িয়েই অনুভূতির ফেঁপে ওঠা পরিষ্কার টের পাচ্ছে তীব্র। এই মেয়েকে দেখলেই এতো শান্তি,ছুঁলে কী হবে?
“ কী ব্যাপার, দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও।”
নিম্নভার কণ্ঠের নির্দেশে, পুষ্পিতা জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। বলতেও পারছে না,এভাবে গেলে আপনার বুকের সাথে স্পর্শ লাগবে তো। লাজলজ্জা ভুলে ওসব বলা যায় না কি!
মেয়েটা বিলম্ব নিয়ে আত্মস্থ করল নিজেকে। পা বাড়াবে,আচমকা প্রশ্ন ছুড়ল তীব্র,

“ রোদ সুন্দর না বৃষ্টি?”
পুষ্পিতা তব্দা খায়। দাঁড়ায় ফটাফট।
“ জি?”
তীব্রর কণ্ঠ তরল,
জিজ্ঞেস করল একই ভাবে,
“রোদ সুন্দর না বৃষ্টি?”
এই সময় এমন প্রশ্ন আশা করেনি সে। কিছুটা মাথার ওপর দিয়েও গেল। ভদ্রতায় তবুও জবাব দিলো নিভু স্বরে,
“ বৃ..বৃষ্টি!”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ২৫

কথায় দাঁড়িও পরেনি, হুট করেই এগিয়ে আসে তীব্র। আকষ্মিকতায় পুষ্পিতার গতর জমে গেল। বরফ বনে রইল শান্ত মেয়ের সকল অস্থিরতা। পিঠ ঠেসল দেওয়ালে।
ও বলল,
“ আমার কাছে কী সুন্দর, জানো?”
পুষ্পিতা ঢোক গিলল। বেগ পুহিয়ে ঠোঁট নড়ল জিজ্ঞাসায়,
“ ককী?”
তীব্রর নজর সুনয়নার ঠাড় অক্ষি দুটোয়।
কণ্ঠ খাদে নিয়ে বলল,
“ তুমি!”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ২৭