সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৪
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
❝ আবার গাঙে আসবে জোয়ার,
দুলবে তরী রঙ্গে।
সেই তরীতে হয়ত কেহ,
থাকবে তোমার সঙ্গে।
প’ড়বে মনে সে কোন রাতে,
এক তরীতে ছিলেম সাথে,
এমনি গাঙে ছিল জোয়ার,
নদীর দু’ধার এমনি আঁধার,
তেমনি তরী ছুটবে।
বুঝবে সেদিন বুঝবে!❞
( কাজী নজরুল ইসলাম)
তারপর!
তারপর একটা লম্বা সময় কাটল। হামাগুড়ি দিতে দিতে একেক করে বদল হলো ঋতুরা!
এর মাঝে দুই বসন্ত কেটেছে। বছর দুয়েক পার করে ক্যালেন্ডারের পাতা তিনের ঘরে এখন।
আর এই দু বছরে পালটে গেছে অনেক কিছু । প্রকৃতির পাখায় চড়ে একেকটি মানুষের বেঁচে থাকার কারণেও এসেছে দীর্ঘ বদল।
তবে বাড্ডা আগের মতোই । ধূসর ধুলো,শালিকের ডাকাডাকি,মোড়ের ওপর গিজগিজে চায়ের দোকান, এপাশের মেইন রোডে বড়ো বড়ো শপিংমল গুলো এখনও একইরকম শির তুলে দাঁড়িয়ে।
ব্যস্ত দিনের মতোই হাতের গতি বাড়ালেন করিম। দুধ চায়ে চামচ নাড়ার বেলায় আঙুল গুলো কাঁপল কিছুটা।
ওপাশের অধৈর্য লোক মুখ খুলল তখনই,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ একটা চা বানাতে এতক্ষণ লাগে?”
রুষ্ট স্বরে করিম মিইয়ে গেলেন। গামছা তুলে মুখটা মুছে নেমে এলেন দোকান হতে। গরম কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“ভাই, ন্যান!”
মানুষটা হাত বাড়িয়ে চা নিলো।
কালো আস্তরণে মাখোমাখো ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিলো ভেতরের উষ্ণ জলে। মাঝে
বিলাতি নয়ন জোড়া তুলে এক পল দেখল করিম কে।
শুধাল
“ কিছু বলবি?”
ভদ্রলোক নড়ে ওঠেন। মাথা নাড়েন ত্রস্ত,
“ না।”
“ তাহলে সংয়ের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর সামনে থেকে।”
এক ধমকে করিমের বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। চটজলদি হাঁটা ধরেন।
পথে থেমে, ঘুরে চান আবার। ঐ যে কাঠের বেঞ্চের ওপর পায়ের ওপর পা তুলে যে ছেলেটা চা খাচ্ছে? যার বাম হাতের সিগারেট হতে ভকভক করে ধোঁয়া উড়ছে হাওয়ায়?
এই ছেলেটাকে করিমের কাছে জগতের সবথেকে বড়ো গোলকধাঁধা মনে হয়।
যার অতীতের দুটো রূপই তিনি দেখেছিলেন। একটা ভালো,একটা খারাপ! কিন্তু এখনকারটা? এটার কোনো সংজ্ঞাই নেই। কী অগোছালো,এলোমেলো একটা মানুষ!
মাথার সোনালী চুল মরা পাতার মতো ফ্যাকাশে। কিংবা জ্বলন্ত ভাটায় পুড়তে থাকা ইটের রং! যার দৈর্ঘ্যে চোখ ঢেকে যাওয়ার যোগাড়।
যেন বহুদিন ওই চুল তেলের স্বাদ পায়নি। ফরসা মুখ ভরতি দাঁড়ি-গোফ গুলো গলা অবধি ঝুলছে। কতদিন সেলুন চোখে দেখেনি ওরা?
গায়ের শার্টটা দ্যাখো,যেন বড্ড অনীহায় পরা। অর্ধেক বোতাম খোলা। হাঁ করে বুক চেয়ে আছে বাইরে। বিলাতি নয়নের গোড়ায় প্রদীপের তলার মতো অন্ধকার।
করিমের ভীষণ মায়া হলো। কয়েক মাস আগেও যে ছেলে ঝকঝকে শার্ট-প্যান্ট ইন করে এসে করিমের চোখে তাক লাগিয়ে দিলো! সে ছেলের হঠাৎ এমন পাগলের দশা কেন?
প্রৌঢ়ার বুকখানা আক্ষেপে ছেঁয়ে যায়। বিরস চিত্তে মাথা নাড়লেন দুপাশে। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলো ছিনিমিনি খেলার জন্যে নিজের জীবনটাকেই বেছে নেয় কেন?
নেশা-ভাং করে করে কী অবস্থা একেকটার। যার বাপ মন্ত্রী,তার তো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না। বরং ভবিষ্যতের উজ্জ্বলতা তার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকে।
অথচ এই ছেলে নিজের হাতে নিজের সব কিছু কেমন ধ্বংস করে দিচ্ছে!
করিম যতটা সময় নিয়ে তীব্রকে দেখলেন,অতক্ষণে ছেলেটা একবারও এদিকে ফেরেনি। তার নিখুঁত মনোযোগ চায়ের কাপে। মুখ খুললও আচমকা। চৈত্রের ন্যায় রুক্ষ গলায় বলল,
“ তোর চোখ দুটো মনে হয় গেলে দেয়ার সময় এসেছে করিম! যখনই দেখি হাঁ করে চেয়ে থাকিস।”
ভদ্রলোক থতমত খান। ভয়ডরে কাত হয়ে ছুটে ঢোকেন দোকানে।
তীব্র মুহুর্তেই একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা ধরাল। নাক মুখ ভরিয়ে দিলো সাদাটে ধোঁয়ার কবলে। সুন্দর মুখায়বে রাজ্যের শ্রান্তি। ক্লান্তিতে বিষণ্ণ চোখে সামান্য চপলতা নেই। অযত্নে,অবহেলায় ওদের শূন্য আকাশে ফেলে রাখল সে। মাথার ওপরের
এই সীমানা বরাবর শুধু একটা কাকই উড়ছে ।
কিছু সময় কাটল! তবুও আশেপাশে কোনো পাখির দেখা নেই। একাকীত্বে ডুবে থাকা
কাকটার সাথে তীব্রর যেন আহামরি মিল।
আশেপাশে এত মানুষ! এত লোক! কিন্তু ও,ওতো একইরকম একা।
তার চিন্তার মাঝেই ক জোড়া অস্থির পা এসে থামল সেখানে। চোখ সরিয়ে ওদের ওপর ফেলল তীব্র।
অল্পবয়সী ছেলে সব। ইউনিভার্সিটিও পাশ করেনি হয়ত। পেছনের কয়েকটার তো ঠিক করে দাঁড়িও ওঠেনি। অথচ,ঠিক মাস্তানির স্বাদ নিতে এসেছে।
হাঁপাচ্ছে ওরা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে কেউ কেউ। তার মধ্যে দুটি মুখ পরিচিত তীব্রর। বাকিদের নামও ঠিক করে জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি। সাব্বির আর রুবায়েত,ওরাই সব সামলায়।
সাব্বির দলা মোছা করা কতগুলো টাকা এগিয়ে দিলো। খুব আনন্দ নিয়ে জানাল,
“ পুরো দোকান সাবাড় করে এগুলোই পেলাম, ভাই। ব্যাটার আজ ইনকাম ভালো না!”
তীব্র টাকাগুলো দেখল এক বার। বড়ো শান্ত চোখের ভাষা। অনীহ চিত্তে আদেশ করল
“ তোরা ভাগ করে নে!”
“ কেন ভাই? আপনি নেবে…”
তীব্র চাইতেই ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মাথা নেড়ে বলে,
“ আচ্ছা আমরাই নেই।”
পেছনের ছেলেরা বেজায় খুশি! ভাগে তাহলে বেশি পাওয়া যাবে।
সাব্বির টাকা গুলো বুকপকেটে রাখে। পরে যার পাওনা তাকে বুঝিয়ে দেয়া যাবে।
রুবায়েত বলল,
“ বিট্টু ভাই, ঐ যে সুবাস্তুর সামনে মানে এই পাড়ে যে নতুন শোরুমটা বসাইল,ওই ব্যাডা তো অনুমতি নিলো না।”
তীব্র ভ্রু গোছাল,
“ নেয়নি?”
“ না,ভাই।”
“ নেয়নি যখন, নিতে হবে না। কাল গিয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বলবি। যদি আপোস করে, মালকড়িতে ঝামেলা মেটায়, ভালো। না করলে ম্যানেজারের হাত-পা তো আছে। বাকিটা আমি দেখে নেবো।”
সানন্দে মাথা ঝাঁকাল রুবায়েত। কথাটা একদম তার মনের মতো।
এতদিনে একটা জব্বর ইনকামের পথ খুলেছে । বিট্টু ভাই ইজ ব্যাক! এখন আর হাতখরচে টানাটানি হয় না। আগের মতো মানিব্যাগ ফুলে থাকে। ও যখনই খবর পেলো ভাই আবার এলাকায় আসবেন- বসবেন,এক দণ্ডও দেরি করেনি। হুলস্থূল বাধিয়ে দলে ভিড়েছে।
রুবায়েত মন দিয়ে চাইল, ভাই আগের মতো সব সময় এখানেই থাকুক। গাজীপুরের ভূতটা যখন একবার নেমে গেছে,কস্মিনকালেও আর না উঠুক।
পাড়ার গার্লস কলেজ ছুটি হয়েছে।
ঘন্টার শব্দ পেতেই ওরা নড়েচড়ে উঠল। দোকানের ছাউনী ফেলে, গিয়ে দাঁড়াল রাস্তার অভিমুখে। কলেজ পড়ুয়া মেয়েগুলোর দিকে সঙ্কোচশূন্য ছুড়ে দিলো কিছু কুৎসিত বাক্যবাণ।
সেসব শুনে কখনো চোখ খিঁচে নিলেন করিম। কখনো লজ্জায় মাথা নামিয়ে রাখলেন। নরক যন্ত্রণা আবার শুরু হয়েছে। ক্ষমতা থাকলে সবকটাকে লাত্থি মেরে মাটিতে পিষে ফেলতেন । এসব ছেলে যে কোনো মায়ের পেট থেকে বেরিয়েছিল,ভাবতেই আশ্চর্য হন তিনি।
কিন্তু বেঞ্চে বসা তীব্রর, তাতে সামান্যও হেলদোল নেই। একটা আস্ত সিগারেটের প্যাকেট ওখানে বসেই শেষ করার যুদ্ধে নামল সে। তামাকের জ্বালাতনে ভেতরের হৃদয়টা আস্ত আছে তো? নাকি জ্বলে গেছে পুরো! তীব্র প্রশ্ন করল নিজেকে। সিগারেটের মাথাটা তুলে চোখের সামনে ঘোরাল। মনে হলো এই আগুনের ফুলকি বড্ড নাজুক,কারো প্রতারণার কাছে। ভালোবাসার ছলনায় যে একবার ঝলসে যায়,তাকে নতুন করে কোনো আগুন পোড়াতে পারে?
তার এই নির্লিপ্ততা দেখে রাগ হয় করিমের।
সেই আগের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি! এখন সাব্বিরের দল।
আগে ছিল মিরাজদের। এই তো, এতটুকু তফাত।
তবে ঐ ছেলেগুলো এখন আর এখানে আসে না।
সে না আসুক,তীব্রর এই রং-ঢংয়ের মানে বুঝে পান না করিম। সেই আগের মতোই যদি সব কিছু হবে,তাহলে মাঝখানে এসে গ্যাং তুলে দেয়ার নাটক করেছিল কেন?
তার সামনেই সাঙ্গপাঙ্গদের হুকুম করেছিল কেন,যেন আর কখনো মেয়েদের বিরক্ত না করে!
যত্তসব!
তবে দু বছর কেন,তীব্র যখন যাই করুক তার আক্রোশ কখনো করিমের ওপর পড়েনি। ওনার হাতের চায়ে যে দারুণ স্বাদ? তীব্রর তা মনঃপুত হওয়ায় ভদ্রলোক জোর বাঁচা বেঁচেছেন। কিন্তু বাকিরা আর বাঁচেনি। আজ দেড় বছর ধরে সেই আগের মতো সহ্য করে যাচ্ছে।
বরং প্রকাণ্ড হয়েছে বিট্টুর জ্বালাতন। আগে তো মাসে চাঁদা নিতো! এখন মন মাফিক। একটা হ্যাঁ- তে না,আর ব্যস!
ভাঙাভাঙি শুরু।
সেদিন তো একটাকে মেরে নাকটাই থেতলে দিলো!
তারওপর এই নতুন ছেলেপেলে গুলো তো অতিমাত্রায় অসভ্য! মেয়েদের যেসব নোংরা ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে,যে জঘন্য ভাষায় উত্যক্ত করে করিমেরই রাগে মাথা ফুলে যায়। সেখানে
বিট্টু এসব নিয়ে কিচ্ছু বলে না। শুধু তার
মতের বাইরে গেলে,হিতের বিপরীত হলে কখনো ফুঁসে ওঠে! হাত চালায়! অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। এইত,এসব এখন রোজকার রুটিন। অবশ্য করিম তো বহু আগে থেকেই অভ্যস্ত,এ আর নতুন কী!
সাব্বিররা কাজে বহাল। এসব ইভটিজিং-এর চক্করে ভালো দক্ষ তারা। যদিও বা আগে শাফিনদের জন্যে সুযোগ পেতো না। এখন নেই বলে সুবিধে হয়েছে।
তীব্রর ওদিকে চোখ নেই,মনও নেই হয়ত। প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা এখনো তার ঠোঁটের ভাঁজে আটকে। একটা বেসামাল নদী হঠাৎ মৃত হলে যেমন শান্ত হয়ে যায়? অমন নিশ্চুপ বসেছিল সে।
যেখানে জোয়ার নেই,ভাটা আসে না। না কোনো ঢেউ এসে বোঝায়,এখানে প্রানের সঞ্চার আদৌ আছে।
সেসময় একটা রিকশা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। একটা বিশালাকার মাইক ঝোলানো পেছনে।
কোনো এক কোম্পানির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে,সম্মিলিত নারী-পুরুষ কণ্ঠে। বিজ্ঞাপন শেষ হয়! কণ্ঠ দুটো থামে। পরপরই বেজে ওঠে চির-পরিচিত গান,যা শুনে চুপচাপ তীব্র নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল।
“ কিউনকি তুমহিহো,আব তুমহিহো,
জিন্দেগী আব তুমহিহো…
চ্যানভি,মেরা দারদভি,
মেরি আশিকী আভ তুমহিহো…”
তীব্র ঢোক গিলল। সিগারেটে টান বসানো পোক্ত হাতটা শিথিল হলো একটু।
বুকের ঠিক বা পাশে যে হৃদয় বিবশ পড়েছিল? যেখানে মস্ত এক ঘা হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে? সেখান বরাবর সুচের মাথা দিয়ে কেউ খোঁচা বসাল যেন।
ঘোলা চোখে কিছু তিক্ত অতীত ছবির মতো ভাসে। সুশ্রী আননের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছলনারা নিনাদ তুলে দেয়।
তীব্রর পাণ্ডুর মুখখানা শক্ত হয়ে গেল। ডাকল রুষ্ট স্বরে,
“ এই দাঁড়া!”
সাব্বিররা তটস্থ চোখে চাইল। রিকশাচালক শোনেননি।
চলে যাচ্ছিলেন। তীব্র ওনাকে ডাকছে বুঝতেই হাঁক ছুড়ল সমস্বরে,
“ ওই ওই দাঁড়া,ভাই ডাকে..”
চালক থামলেন। চাইলেন ঘুরে।
গলার পানি শুকিয়ে গেল তীব্রকে উঠে আসতে দেখে। এই এলাকায় যাতায়াত ওনার,একে না চিনে উপায় আছে!
শশব্যস্ত নেমে দাঁড়ালেন তিনি।
তীব্র এগিয়ে এলো লম্বা পায়ে। বেচারা মুখ খোলার সময়ও পেলো না,ঝড়ের মতো চড়ের তোপে মুখ থুবড়ে পড়ল নিচে ।
আচমকা হামলায় রুহুটা এসে লটকে থাকল গলায়। গালে হাত দিয়ে ফিরল গোলাকার চোখে।
তীব্র হাতের ইশারায় বলল,
“ ওঠ!”
কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। গলায় ঝোলানো গামছার দু মাথা মুহুর্তে টেনে ধরল তীব্র।
নরম কাপড়টা ক্রস শেপ হলো। কিন্তু তীব্রর ধরার ধরণে ফাঁসির দড়ির ন্যায় চাপ বসাল গলায়। রিকশাচালক ভয়ডরে রক্তশূন্য! ত্রাসে ছটফটিয়ে বলেন,
“ আমি কিছু কইরছি ভাই?”
তীব্র ধমকে বলল,
“ এই গান বাজালি কেন? অন্য গান ছিল না? কেন বাজালি?”
“ ভাই, আমি তো গান ঠিক করিনাই। এক স্যারে টাকা দিয়া কইছিল এলাকা চক্কর দিতে। আমি তো আমি…”
তীব্র মটমট করে বলল,
“ বিশ্লেষণ চাইনি। দোষ করেছিস,শাস্তি ভোগ কর। এই,ওর রিকশা ভাঙ।”
বলতে দেরি, সাব্বিরদের রিকশার ওপর হামলে পড়তে দেরি হলো না। খোলা রাস্তায় হুড টেনে কাত করে ফেলতেই,
লোকটা ত্রস্ত তীব্রর পা চেপে ধরলেন। আর্তনাদ করে বললেন,
“ ভাই আল্লাহর দোহাই এমন কইরেন না। এডা দিয়া আমি সংসার চালাই। আমার ছোডো পোলাপাইন আছে। এডা ভাংলে আমার জরিমানা দেওন লাগব। ভাই আমি অল্প কয়টাকা কামাই করি! ভাই!”
নিরেট মানব শুনলো না। উলটে ঝাড়া মারল পা-টা। তোপে পড়ে গেলেন ভদ্রলোক। তীব্র তর্জন দিলো চড়া ভাষায়,
“ আরেকটা টাটু শব্দ করলে, বিষয়টা আর রিকশায় আটকে থাকবে না। তোর শরীরের ওপর দিয়ে যাবে। কোনটা ভালো?”
প্রশ্নের সাথে ভ্রু উঁচাল সে।
লোকটি অসহায়!
প্রতিবাদের সাধ্য তার নেই। ভয়ে চুপ করে গেলেও,ছলছল জল কোটরে পরিষ্কার মাথা তুলল।
সেই জল তীব্রকে এক ফোঁটাও ছুঁতে পারেনি। নিরুদ্বেগ ছেলেটা আবার ফিরে গেল জায়গায়।
চোখের সামনে চূর্ণ হওয়া রিকশা, কেঁদে ভাসানো এক নিরূপায় মানুষ ছাপিয়ে খুব আরাম করে বসল সে।
সাদাটে চোখ ফেলে রাখল মাটিতে। মনের কিছু ক্লেশ উগড়ে দিলো
শক্ত চিবুকে,
“ আমি খারাপ ছিলাম,আরও বেশি খারাপ হবো। ভালো মানুষ, ভালো কাজ তোর ওসব লেকচার ভুলে গেছি আমি।
শুধু ভুলিনি তোর প্রতারণা। একবার ভাগ্য তোকে আমার সামনে এনে দাঁড় করাক পুষ্পিতা, শুধু একবার।”
তীব্র হাত মুঠো করে। দৃষ্টির ভাঁজে ক্রোধের পরিচ্ছন্ন লেলিহান শিখা। যার দাউদাউ অনল কাউকে পুড়িয়ে অঙ্গার করার ইচ্ছে। যতটা যন্ত্রণায় পুড়ছে সে? তার চেয়েও শতোধিক যন্ত্রণা ফিরিয়ে দেয়ার প্রয়াস।
দূর থেকে এতক্ষণ সবটা দেখল হাফিজ। মুঠোফোনের শব্দে সরিয়ে আনল নজর। পকেট থেকে বের করে,
কানে গুঁজে বলল,
“ জি, স্যার। আমি এখানেই আছি। জি,ছোটো স্যার আমার সামনেই।
“ আজকে এখন অবধি দুটো দোকান আর একজনের রিকশা ভাঙতে দেখলাম। আমি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি,স্যার। আপনি একদম চিন্তা করবেন না!”
লাইন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জামশেদ। মন খারাপ করে ডুব দিলেন ফাইলে। তবে, মনোযোগ এলো না। হতাশা,নিরাশা জট পাঁকিয়ে গোটা মাথা কিনে নিলো।
তার ছেলে আগেও বখাটে ছিল। সেই ক্লাস নাইন থেকে একরোখা, চলাফেরায় উগ্র।
এখন আবার সেপথেই ফিরেছে। কিন্তু এতটা কষ্ট,এতটা আফসোস জামশেদের কোনোদিন হয়নি। যে
ছেলে কিছু মাস আগেও ভালো হতে চেয়েছে। বুক চিতিয়ে বলেছে আর কোনো উল্টোপাল্টা কাজে নিজেকে জড়াবে না। কোথাকার এক মেয়ের জন্যে তার এমন করুণ পরিনতি,কোন বাবাই বা মেনে নিতে পারে?
ওই মেয়ে কেনই বা এসেছিল,আর কেনই বা চলে গেল এমন?
যে কঠিন প্রস্থানে তার ছেলেটা নিজ সত্ত্বাকে হারিয়ে পুরো এলোমেলো হয়ে গেল।
ভদ্রলোকের মর্মপীড়া বাড়ল বাড়ি ঢোকার পরপরই। আজ একটু দেরি হয়েছে আসতে। ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে তখন।
লুৎফা এখনও ঠায় বসে সোফাতে। ওনাকে দেখেই ছুটে এলেন কাছে।
“ তোমার সাথে বিট্টুর কথা হয়েছে?”
স্ত্রীর চোখমুখ দেখেই জামশেদ ঘটনা বুঝে ফেললেন।
এক পল দেওয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললেন,
“ এখনো ফেরেনি?”
শুকনো মুখে মাথা নাড়লেন তিনি।
“ ফোনও নেয়না। একটা খোঁজ যে নেবো তারও কোনো উপায় নেই। যা অবস্থা ওর,কোথায় গেছে!”
“ এত প্যানিক কোরো না। দেখছি…”
জামশেদ ফোন তুললেন কাউকে কল করতে, তক্ষুনি ঘরে ঢুকলো তীব্র। উসকোখুসকো
চুলের তোড়ে চোখের পাতা ঢাকা। দাঁড়ি গুলো যেন বটগাছের ঝুড়ি।
গলার কাছে শার্ট ভিজে চুপচুপে। দীর্ঘ কদমের কী টলমল দশা!
জামশেদের চোখের পর্দায় পুরোনো দৃশ্যপট চড়াও হয়। অবিকল সেই আগের বিট্টু! কিন্তু আজ রাগের বদলে কষ্ট হলো তার। ভীষণ কষ্ট!
তীব্র পড়তে নিলে দৌড়ে গেলেন কাছে। ধরতে চাইলে ও বাধ সাধল।
কণ্ঠে মদ্যকের ঢল,
“ পড়ব না। অভ্যেস হয়ে গেছে।”
একটু এঁকেবেঁকে গেলেও,তীব্র সোজা স্বীয় ঘরের পথেই চলল।
সেদিক চেয়ে চেয়ে চোখ ভরে উঠল লূৎফার।
প্রথমদিন কলেজ জয়েনিং এর জন্যে নিজেকে পরিপাটি করে নিচে নামা তীব্রর সেই রূপ হুট করে ভেসে উঠল সামনে।
উদ্বীগ্ন চিত্তে এগোতে নিলেই,জামশেদ থামিয়ে দেন।
“ যেও না। ওকে ওর মতো থাকতে দাও।”
লূৎফা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
“ চোখের সামনে ছেলেটা একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা মা-বাবা হয়ে কি কিছুই করতে পারব না?”
জামশেদের কাছে কোনো উত্তর নেই। মুখায়বে এক ছটাক ব্যর্থতার চিহ্ন ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা গেল না।
তীব্র উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। গাট্টাগোট্টা শরীরটা একটু শুকিয়েছে। রক্তাভ চোখে পৃথিবীর ঘুম। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। তারওপর মদের তিক্ত স্বাদে সব কেমন গোল হয়ে ঘুরছে।
ঝাপসা,ভেজা নয়ন মেলে রুমের চারদিক দেখল সে। নেশায় ডুবুডুবু চোখের সামনে আচমকা এক রূপসী এসে দাঁড়াল। ঝিনুকের ফাঁক হতে যেমন মুক্তো বেরিয়ে আসে? অমন চিরল দাঁত নিয়ে হাসল সে।
বিদ্রুপের হাসি। কথার সুরে তুচ্ছতাচ্ছিল্য,
“ আহারে,আপনার দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না। একটা মেয়ের শোকে আপনার এমন অবস্থা? দেখে তো করুণায় আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে!”
তীব্র দাঁত পিষল। পাথুরে চিবুক মটমট করল খই ভাজা তাওয়ার মতোন।
মাথার বালিশটা ছুড়ে মারল সেই বিম্বের গায়ে। রোষে চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ আবার এসেছিস? চলে যা! তোর মুখ দেখতে চাই না আমি। যা!”
তার চিৎকার পৌঁছে গেল বসার ঘরেও। সেথায় থাকা বৃদ্ধ মানুষ দুটির বুক মুচড়ে উঠল বেদনায়। লুৎফার কান্না বাড়ে। মাত্রা ছাড়ায়। তীব্র মারাত্মক হ্যালুসিনেশনে ভোগে। প্রায়ই চিৎকার করে। কাউকে ধমকায়। গালি দেয়। অস্থির হয়ে বলে,
“ আমি তোকে ঘৃনা করি! আর আসবি না এখানে।”
লুৎফা জানেন এসব ও কাকে বলে। এটুকু বোঝার ক্ষমতা ওনার আছে। ঠোঁট ভেঙে চোখের জলে গাল-গলা ভাসালেন তিনি। বিড়বিড় করে বললেন,
“ আমার ছেলেটাকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিয়ে, ঐ মেয়ের কোনোদিন ভালো হবে না। অভিশাপ দিলাম আমি,কোনোদিন সুখী হবে না তুমি,পুষ্পিতা!”
মিরাজদের একটা গোল বৈঠক বসেছে। যেখানে সদ্য যোগ দিয়েছে হাফিজ। বয়সে সে ওদের কাছাকাছি প্রায়। আর মেলামেশাটা শুরু তীব্র-পুষ্পিতার ঘটনা থেকেই।
হাজিফ জামশেদের এসিস্ট্যান্ট। অথচ ভদ্রলোক ওকে দিনের অর্ধেক সময়ে তীব্রর দায়িত্বে রেখে দেন।
ছেলেটা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। একটা সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো একান্ত প্রয়োজন। অথচ
‘’ চলো, ডাক্তারের কাছে যাই!’’ আজ অবধি মুখ ফুটে প্রস্তাবখানা কেউ রাখতে পারেনি। কোথায় কী করে বসে,ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না বলেই হাফিজকে তদারকিতে রাখেন।
হাফিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুখ কালো করে বলল,
“ কী যে বলি আপনাদের! আসলে আমার কাছে বলার মতো তেমন কথা নেই। ছোটো স্যারের কন্ডিশান দিন দিন এত খারাপ হচ্ছে! ওনাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না। কখনো কথাও হয়নি। কিন্তু তাও ওনাকে দেখে আমার কষ্ট হয়। দুঃখ লাগে! আপনাদের মতো আমিও একটা মিরাকলের আশায় চেয়ে থাকি।”
বাকি বুক গুলো থেকে পোড়া দীর্ঘশ্বাস বেরোলো।
মুশফিক বলল,
“ আমাদেরও হাত-পা বাঁধা। বিট্টুটা আমাদের দেখলেই এত রেগে যায়! নাহিদ ছাড়া কেউই ওর কাছে ঘেষতে পারছি না। আঙ্কেলও তো আমাদের কড়া করে বারণ করে দিলেন। পাছে,উত্তেজিত হলে যদি ওর কোনো ক্ষতি হয়!”
মিরাজ বলল,
“ সেই! নাহলে প্রানের বন্ধুকে ছেড়ে এতগুলো দিন দূরে আছি। আমাদেরও কি ভালো লাগে এসব? সেই আড্ডা,সেই টং-য়ের চা, সব কত মিস করি জানেন!”
“ সত্যি ভাই! বিট্টুটা কেমন হয়ে গেল দ্যাখ! এক সময় চাইতাম ও প্রেমে পড়ুক। মেয়েদের প্রতি যে অনীহা ছিল সেটা কেটে যাক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওসব মেয়েছেলে না এলেই ভালো হোতো!”
শাফিনের চেহারায় রাগ। কথাতেও তাই। বলল,
“ আমি যদি ওই মেয়েকে সামনে পাই কখনো, একেবারে গলা টিপে দেব। দেখিস!”
হাফিজ চুপ করে রইল। তার মুগ্ধ চোখ সবার দিকে। মিরাজ,মুশফিক,আরমান শাফিন প্রত্যেকে এখন স্বীয় কর্মজীবনে ব্যস্ত।
কিন্তু অফিসটা শেষ করেই তার কাছে নিয়ম করে হাজিরা দিয়ে যায় শুধু একটা কারণে, বিট্টুর খোঁজ । কেমন আছে,কী করছে সব কবিতার মতো স্পষ্ট জানা চাই। কাছে ঘিষতে না পারুক খবর তো শুনছে, এতেই শান্তি।
হাফিজ আলগোছে মৃদূ হাসল। তীব্র নামের ছেলেটার কপালের কথা সে জানে না। শুধু জানে,
জীবনে এরকম কিছু বন্ধু থাকা চাই। নাহলে রসকষহীনতার মাঝেও একটু ভালো ভাবে বেঁচে থাকার আসল স্বাদ কোথায়?
বান্দরবান!
সবুজে ঢাকা পাহাড়, উন্মত্ত জলপ্রপাত সাথে ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর মানুষগুলো মিলিয়ে এ এক অভূতপূর্ব জায়গা। নীলাচলের বুক ছিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন পাহাড়,যেন সৌন্দর্যের আলিঙ্গনে তৈরি। মাথার ওপর দিগন্তের বিস্তৃত ঢাল,অদূরের শিল্পীর টানে আঁকা ছবির মতো নদী পেরিয়ে কেবলই ভোরের সূর্য উঠল। রবির কোল ঘেঁষে লুটিয়ে পড়া আলোয় একটু একটু করে রূপ খুলল প্রকৃতির।
ছোট্ট টিলা থেকে ভেসে আসা টুংটুং শব্দে
মৃদূমন্দ পবন মুখরিত! সেখানে বসে
পিয়ানোর ফল বোর্ডে আঙুল চালাতে ব্যস্ত এক তরুণী। মাথার বিনুনিটা পিঠ ছড়িয়ে কোমরে এসে নেমেছে। সকালের রোদের মতো নির্মল,পবিত্র মুখায়বে মলনিতা ভীষণ!
শুষ্ক ঠোঁট যেন সাক্ষী, মেয়েটা বহু দিন হাসেনি!
চোখ বুজে পিয়ানোয় গানের সুরের তুলছে সে। হঠাৎ মৃগনয়নের কার্নিশ ছুঁয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে কপোলে এসে পড়ল।
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৩
সেসময় খোলা কাঠের দোরে দুটো টোকা দিলো কেউ একজন। শশকের ন্যায় গতিতে চোখ মুছল মেয়েটা। থেমে,পেছন ফিরতেই চৌকাঠে দাঁড়ানো যুবক চমৎকার করে হাসল।
মুঠোভরতি এক ঝাঁক জারবেরা নিয়ে ঢুকল ভেতরে।
পিয়ানোর ওপর তাজা ফুল রেখে পূর্ণ নয়ন মেলল সুরূপা সেই মেয়েতে। ঠোঁটে নির্ভেজাল হাসি নিয়ে জানাল,
“ হ্যাপি এনিভার্সারি,পুষ্পিতা!”