সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৬
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
জামশেদের শরীর কদিন ধরেই বেশ খারাপ। প্রেশার বাড়ছে,কমছে। ভালো ডাক্তার দেখানো জরুরি। আগে হলে এতক্ষণে বিভূঁইয়ে উড়াল দিতেন। কিন্তু ছেলের এই অবস্থায় আজকাল কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।
তারওপর সম্প্রতি একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তায় একশা তিনি। আজ নাহিদের বিয়ে। তাও সুদূর গাজীপুরের কোনো এক ক্লাবে। সেই আবার গাজীপুর! আবার ওই অভিশপ্ত জায়গা!
ওখানে গিয়ে ছেলেটা পারবে তো নিজেকে সামলাতে? মনের প্রশ্ন জামশেদ চেপে রাখতে পারলেন না। দোনামনা কাটিয়ে বললেন,
“ আরেকবার ভেবে নাও নাহিদ, পারবে তো?”
শেরওয়ানি পরা ছেলেটা চমৎকার করে হাসল। দৃঢ় চিত্তে বলল,
“ অবশ্যই পারব আঙ্কেল। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
পাশ থেকে মিরাজ বলল,
“ আঙ্কেল আমরা সবাই আছি। বিট্টুর কোনো অসুবিধে হতেই দেবো না। আপনি আর ভাববেন না তো!”
“ ভাবছি কী আর এমনি এমনি? যা যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে। সেই একই জায়গায় গিয়ে আবার কিছু করে না বসে।”
স্বীয় হাতটা বাড়িয়ে ভদ্রলোকের হাতের ওপর রাখল নাহিদ।
চোখেমুখে আশ্বাসের বন্যা লুটিয়ে বলল,
“ আমরা আছি আঙ্কেল। বিট্টুকে নিয়ে এই লড়াই শুধু আপনার একার নয়,আমাদের সবার। দেখবেন ও ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জামশেদ কিছু বললেন না। এত মানুষের আত্মবিশ্বাস দেখে হয়ত ভরসা পেলেন একটু!
লুৎফা নাস্তা দিয়ে গেলেন। তার কিছু সময় পরেই নিচে নামল তীব্র। মাথার অগোছালো চুল, মুখের বড়ো বড়ো দাঁড়ি গুলো একইরকম আছে।
কিন্তু বড়ো অনীচ্ছায় একটা ভালো শার্ট পরেছে আজ।
হাতের ঘড়িটায় তাকিয়ে এক চোট শ্বাস ফেললেন জামশেদ। ক বছর আগেও ছেলেটার বসন-ভূষণ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছিল তার। আর এখন?
যাক! শূন্য থেকে শুরু হচ্ছে এই অনেক।
বন্ধুকে দেখেই খাবার ফেলে উঠে এলো সবাই।
নাহিদের হাস্যোজ্জল আদলে তারার মেলা বসেছে। ওষ্ঠপুটে বিজয়ী হাসি টেনে বলল,
“ চল!”
তীব্র সবাইকে দেখল এক বার। বিয়েতে যাওয়া নিয়ে প্রফুল্ল প্রত্যেকে!
এই যে সক্কাল সক্কাল আরমানও হাজির হয়ে গেছে।
তীব্রর হুট করে শাফিনকে মনে পড়ল। সেই কলেজ থেকে পরিচয় দুজনের। ওইদিনের ঘটনার পর মিরাজরা তার কাছে হত্যে দিয়ে রইলেও,শাফিনের দেখা মেলেনি। তীব্রকে খুন করতে চাইছিল শোনার পর বাকিরাও ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ও তো তা চায়নি। শাফিনের সঙ্গে বাকিদের বন্ধুত্বে ভাঙন আসুক, এমনটা তীব্র চাইতে পারে? ও
খুব আস্তে শুধাল,
“ শাফিন যাবে ন…
নাহিদ মুখ শক্ত করল নিমিষে। মাঝপথেই বলে দিলো,
“ ও গোল্লায় যাক,তুই আয় তো।”
তীব্রর বাহু টেনে হাঁটা ধরল সে। মিনমিনে ছেলেটা আচমকা কেমন ভারিক্কী হয়ে গেল!
জামশেদের থেকে বিদায় নিয়ে একে একে বাড়ি ছাড়ল সবাই। ভদ্রলোক ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেললেন।
তীব্রর মুখে শাফিনের নাম শুনে যেটুকু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল এক্ষুনি, মুহুর্তে থামল তা।
মিরাজ,আরমান পাশাপাশি হাঁটছে। সময় কাটিয়ে ফিসফিস করল আরমান,
“ শাফিনের ব্যাপারটা বিট্টু জানে না,তাই না?”
মিরাজ বলল,
“ না। আমরা কেউ বলিনি। আর অন্য কোথাও থেকে যে খবর পাবে,সেই উপায় আছে? ফোনটা তো সুইচড অফ করে ফেলে রাখে সারাদিন।”
“ বলে দেব আমি?”
ও চোখ প্রকট করল।
“ না,মাথা গেছে তোর? আঙ্কেল কড়া করে মানা করে দিয়েছেন।
আর এমনিতেও যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে। শাফিনের এই শাস্তিই প্রাপ্য!
বিট্টুর নিজেদের লোকের বেলায় খুব দয়া। শয়তানটা থানায় শুনলেই ঠিক ছাড়াতে চলে যাবে। দরকার নেই।”
“ ওর মা আমাকে ফোন করেছিলেন। খুব কান্নাকাটি করছেন। বলছেন,বিট্টুকে একবার জানাতে।”
“ চেপে যা। বিট্টুর কানেও এসব দেয়ার দরকার নেই। কত বড়ো জানোয়ার হলে বন্ধু হয়ে বন্ধুকে খুন করতে চায়! তাও শালার এক মেয়ের জন্যে!
আমিতো এখনো ভাবতে পারছি না, এতদিন ধরে ওই ক্রিমিনাল আমাদের বন্ধু সেজেছিল? আঁতে ঘা পড়লে আমাদের ক্ষতি করতো না তার কি গ্যারান্টি?”
আরমান ঘাড় দোলায়। কথায় সম্মতি,
“ ঠিকই বলেছিস। আমি নিজেও শোনার পর বিশ্বাস করতে পারিনি। শাফিনের ঘাড়ে যে কোন ভূত চেপেছিল! আপাতত জেল খাটুক কিছুদিন,পরে দেখা যাবে। কী বলিস?”
“ হ্যাঁ।”
মুশফিক সামনে ছিল। পেছন ফিরে গলা তুলে বলল,
“ এই তোরা এত ফুসুরফুসুর করছিস কী নিয়ে? ছেলেমেয়ে বিয়ে দিচ্ছিস হ্যাঁ? আয় তাড়াতাড়ি!”
দুজন থতমত খেয়ে পায়ের গতি বাড়াল। সবাই মিলে আনন্দ চিত্তে গাড়িতে বসল তারপর । কতদিন পর সেই একইসাথে একটা সফরে যাচ্ছে ওরা!
নাহিদ বিয়ের আয়োজন করে ভালোই করেছে। দেরিতে হলেও আবার আগের মতো বিট্টুর সঙ্গ পাচ্ছে সবাই! এবার শুধু বিট্টু একটু একটু করে স্বাভাবিক হোক,আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই।
গাজীপুরের একটা কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বিশালাকার বিল্ডিংয়ের থার্ড ফ্লোর ভরতি মানুষে। খাবার-দাবারের এলাহি কাণ্ড নিয়ে আয়েশার দিন যাচ্ছে ব্যস্ততায়।
তারওপর ছেলেপেলে নেই। একটা বয়ষ্কা মানুষ কি আর অত দিক ছুটতে পারে?
নূহার ফুপা,মামা এরা টুকটাক তদারকি করলেও নিজেদের মতো তো আর হয় না।
সেই নূহার জন্মদিনের পর আজ আবার একটা বড়ো অনুষ্ঠান হচ্ছে ওনাদের। আয়েশার এখন খুব করে পুষ্পিতাকে মনে পড়ছে। সেবার মেয়েটা প্রত্যেকটা কাজ কী দারণ যত্ন নিয়ে করেছিল।
কত আনন্দ,কত ছোটাছুটি!
ও থাকাকালীন ঘরের কাজবাজ নিয়েও আয়েশাকে কক্ষনো ভাবতে হয়নি।
ইস! নূহা আর পুষ্পিতা কত ভালো বন্ধু ছিল,তা ওনার চেয়ে বেশি কে জানে! সেই বন্ধুর আজ বিয়ে হচ্ছে অথচ পুষ্পিতা নেই।
আয়েশা অদূরে দাঁড়িয়েই মেয়ের দিকে চাইলেন। নূহা সেন্টারের স্টেজে বসে। কনে সাজে কী যে চমৎকার লাগছে দেখতে!
হেসে হেসে ছবি তুললেও,মেয়ের ভেতরের কষ্ট বুঝতে পারেন আয়েশা। এমন কোনো দিন,এমন কোনো মুহুর্ত নেই, যখন নূহা পুষ্পিতাকে মনে করেনি!
ভদ্রমহিলা চোখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর নজর বোলালেন গেটের দিকটায়। বরযাত্রী চলে এলো! কিন্তু বর নাহিদের খবর নেই। সে তীব্রকে সাথে নিয়ে একসঙ্গে আসবে।
প্রায় নয়টা বাজতে চলল,কতক্ষণ লাগবে আর?
গাড়িতে বসতে যাওয়ার আগে, নাহিদের ফোন টুং করে বাজে। পকেট হাতিয়ে মুঠোফোনটা সামনে আনল সে। নূহার ম্যাসেজ।
“ ভাইয়া আসছেন?”
নাহিদের চোখেমুখে স্ফূর্তি।
“ হ্যাঁ। তোমার সাজগোজ শেষ?”
“ সে তো অনেক আগেই শেষ। আমি অলরেডি স্টেজে বসে আছি জনাব। আপনাদের কতক্ষণ লাগবে?”
“ জ্যাম না থাকলে এক ঘন্টা।”
“ তাড়াতাড়ি আসবেন।”
“ সবাই কি অধৈর্য হয়ে পড়ছে?”
“ সবাই নয়,আমি অধৈর্য।”
নাহিদ হাসল।
লিখে পাঠাল।
“ তাহলে আমার অবস্থাটা ভাবো! কোনোদিন যাকে কাজল পরতেও দেখিনি,তাকে আজ বউ সাজে দেখব। মুগ্ধতায় আমি মরে না গেলে হোলো!”
নূহা লজ্জা পেলো। ধ্বক করে কাঁপল প্রেমিকা সুলভ রুগ্ন বুক। তড়িঘড়ি করে রেখে দিলো ফোনটা। তার মেক আপে ঢাকা আরক্ত মুখখানা চকচক করছে কুণ্ঠায়।
হঠাৎ চোখ পড়ল অদূরের সালমার ওপর। মেহমানদের আসনে বসে তিনি। নিষ্পলক নয়ন মেলে এদিকেই দেখছেন।
চোখের ভেতর অদ্ভুত কথা, অন্যরকম কিছু। নূহা ঠোঁট মেলে হাসল।
উত্তরে প্রৌঢ়াও হাসলেন।
অথচ লম্বা শ্বাসে বুকের ওঠানামাটুকু স্পষ্ট দেখতে পেল নূহা। তার
সুশ্রী মুখখানায় অচিরেই কালো মেঘ জমল। আজ ওর জীবনের সবথেকে বড়ো দিন,বড়ো উৎসব, কিন্তু পুষ্পিতা নেই।
নূহা পোড়া শ্বাস ফেলল। জীবন কি আশ্চর্য রহস্যে বোনা। এই বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিল নূহা। পুষ্পিতা আর ও একইসাথে বউ সাজবে। তীব্র,নাহিদ দুজন ক্লাবে ঢুকবে পা মিলিয়ে। আজও তো হবে এরকম । সেই একইসাথে আসছে ওরা। শুধু, শুধু মাঝে পুষ্পিতাটা নেই।
প্রহসনের এক ধাক্কায় সবকিছু দেয়ালের মতো গুড়িয়ে গেছে। সম্পর্ক, স্বপ্ন সবটা এক লহমায় চুরমার! ভাগ্য এত নির্মম না হলেও তো পারতো,তাই না!
সালমা বেগম আজকে সকালেই এসেছেন এখানে। না, বিয়ে খেতে নয়। এসেছেন কিছু বিশেষ কাজে। কথা ছিল বাসা থেকেই ফেরত যাওয়ার। কিন্তু আয়েশা জোরাজোরি করে সেন্টার অবধি নিয়ে এলেন।
যদিও হাজারবার বলে কয়ে তারপর আনা। ওনারাও তো এখন আর ঢাকায় থাকেন না। খোরশেদের সিলেটে বদলি হয়েছে সে অনেকদিনের ব্যাপার।
ভাগ্যক্রমে আজ রাস্তায় জ্যাম বেশি নেই। ঘন্টার পরপর
গাজীপুরের চৌকাঠ ছোঁয়া গেছে। সেই ব্রিজ পার হতে হতেই অবিন্যস্ত তীব্র খেই হারাল মনের। খিচে রাখা অন্তরে স্পষ্ট ধরা দিলো সেসব পুরোনো মধুময় স্মৃতি।
একদিন এই পথ দিয়ে ঢুকেছিল কোনো মুগ্ধতার নেশায়। কাউকে পাওয়ার আশায়। । এই মফস্বলের রাস্তার প্রতিটা বাঁকে লুকিয়ে সেই কথা। কিন্তু এখন?
সেই বিশ্বাসঘাতক এখন অন্য কারো বউ। এতদিনে তো বাচ্চাকাচ্চার মাও হওয়ার কথা।
তীব্রর বুক ভেঙে এলো। পুষ্পিতা যদি অন্য কারো বউ হয়,ওর শরীরে সেই অন্য পুরুষের স্পর্শ।
যে মেয়েটাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিল ওর,সেই মেয়ের চোখ-ঠোঁট সব ঐ অন্যের দখলে?
হৃদয় ক্ষয়ে যাওয়া ব্যথাতেও নীরস হাসল সে। যে হাসিতে প্রান নেই। মায়া নেই। না আছে সজীব রোদের চিহ্ন। গাড়ি যখন ব্রেক কষল জোরে, ধ্যান ছুটল তার।
সামনে এত এত হল্লা হল্লি, রংবেরঙের প্যান্ডেল, সুসজ্জিত গেট। অথচ তীব্রর চোখে কিচ্ছুটি পড়ল না। অবসন্ন নজর গেঁথে রাখল বহুদূরের ঐ পথটায়। ক বছর আগে এই রাস্তা ওর সুখের সঙ্গী ছিল। আর এখন? এখন সেথায় পোড়া গন্ধ ছাড়া কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না।
তীব্র আজ একটা ফাঁপা কালো দাগের মতো। যার ভেতরটা ফুলে আছে নিদারুণ মর্মে,অসহ্য পীড়ায়। এই গাজীপুর তো তারই সাক্ষী! ও সবটা দেখেছে। তীব্রর প্রেমের শুরু থেকে শেষ। একটা সুখের উপাখ্যান কীভাবে রচিত হতে হতেও ধ্বংস হয়ে যায়, সবটুকু জ্বালার প্রত্যক্ষদর্শী এই মফস্বল।
তীব্রর বুকের পাঁজরে টান পড়ল ফের। যন্ত্রণার ঘায়ে খোচা দেয়া দাগ বসল সবেগে। তপ্ত যাতনার উদ্দাম নৃত্যে জ্বলে গেল বিলাই চোখ।
অথচ বরাবরের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটা। শক্ত চিবুক পোক্ত দেখাল আরো। যে মেয়ের আদ্যপ্রান্ত ছলনায় মোড়ানো,তাকে ভেবে ও কেন কষ্ট পাবে? পাবে না। কক্ষনো না।
তীব্রর পর বাকিরা নামে। নাহিদ আড়চোখে চাইল। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল ধীরে।
ওদের বিয়ের আয়োজন করার কথা ছিল বাড়িতেই। কিন্তু তীব্র ফ্ল্যাটে গেলে হয়ত নিয়ন্ত্রণহীন হোতো! পুষ্পিতাকে মনে করে গুমড়ে উঠত আরো।
সেই আতঙ্কে নূহার সাথে মিলে সেন্টারের ব্যাপারটা ঠিক করেছে।
এজন্যেই তো জামশেদকে অত আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা গুলো বলতে পেরেছিল নাহিদ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাও ভুল হয়েছে। বিয়ে বোধ হয় ঢাকায় হলে বেশি ভালো হতো।
বিট্টুটা কেমন কাঠ মুখে দাঁড়িয়ে। এই শুকনো চেহারাও দেখতে হোতো না তখন। একে শাফিন, দুইয়ে পুষ্পিতা। দুই কালসাপ মিলে ছোবলে ছোবলে ছেলেটাকে পুরো নীল বানিয়ে ফেলল!
তীব্র কি বেঁচে আছে এখন? দেহে প্রাণ থাকলেই কি তাকে বেঁচে থাকা বলে!
মিরাজ পিঠে হাত রাখতেই নড়ে উঠল সে। ফিরে চাইলে বলল,
“ চল।”
ও মাথা নাড়ে। এগোয় এক পা। পরপর থেমে যায়। বুক ভরে মৃদূ শ্বাস টানে। ব্যাপারটা হয়ত বুঝল মুশফিক। মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
“ সব ভুলে যা, বিট্টু। এই মুহুর্তে ভাব,আমরা আর বিয়ে বাড়ি ছাড়া তোর জীবনে কিচ্ছু নেই।”
তীব্র হাস্যহীন। অনড় চাউনীতে ঠোঁটদুটো দুলল শুধু,
“ এক আকাশ বিশালতা নিয়ে যাকে ভালোবেসেছিলাম, তাকে ভুলে যাওয়া যদি এত সহজ হোতো, কবেই ভুলে যেতাম।”
ওরা কেউ কিছু বলল না। বলবে কী করে? রিক্ত ভাণ্ডারে যুতসই শব্দ থাকলে তো!
নাহিদ প্রসঙ্গ পাল্টাল। তীব্রর বাহু ধরে বলল,
“ আয়,ভেতরে যাই।”
সেন্টারের ভেতরে গিজগিজে মানুষ দেখে তীব্রর মাথা ধরে গেল। আজকাল লোকজন,ভিড়ভাট্টা সহ্য হতে চায় না। নাহিদ কোনার একটা টেবিল দেখিয়ে বলল,
“ ওখানে বসি চল।”
আরমান বলল,
“ বসি মানে? তুই না বিয়ের বর। তোর তো এ সময় স্টেজে থাকার কথা।”
“ আরে ধুর! ওসব পরে হবে। চল তো তোরা।”
সেন্টারে সে কী বড়ো আয়োজন!
চারদিকে লাইট,গান বাজনা, বিয়ের রোশনাই সব যেন টগবগ করছে।
এর মধ্যে অন্তঃপটে এক নিকষ কালো অন্ধকার ঠেসে হাজির হয়েছে তীব্র। অবচেতন মনে জেঁকে বসেছে সুপ্ত কোনো আশা। শত হোক বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে। হয়ত একটা পোড়া মুখ এখানে থাকলেও থাকতে পারে!
যে মুখ দেখে তীব্রর একদিন পৃথিবী বদলে গেল। যে চোখের চাউনী পালটেছিল তার বুকের গতি! যে ঠোঁটের কাঁপন দেখে তীব্রর নয়ন মুঁদে ছিল হাজারখানেক শান্তির ঝর্ণায়।
কিন্তু না, খুঁজে খুঁজেও ঐ মুখের দেখা মেলেনি। তবে স্টেজ থেকে হাওয়ার বেগে নেমে এলো নূহা। ছুটে আসার তোড়ে শরীরের গয়না গুলো ঝনঝন করে ওঠে। মেয়েটা ঠিক তীব্রর সামনে এসে থামল। আনন্দের বদলে দু চোখে ছেঁয়ে গেল প্রখর বিস্ময়ের রেখায়।
তীব্রর সাথে ওর শেষ কবে দেখা হয়েছিল মনে নেই। ওর তো ঢাকায় যাওয়া হয় না। তীব্রও গাজীপুরে আসে না। নিজের ফোনটাও ব্যবহার করে না যে খবর নেবে কেউ। যে মানুষটাকে একদিন বেশভূষার সৌন্দর্যে এক চুল খামতি নূহা দেখেনি,আজ তার এই দশায় বুক মুচড়ে উঠল তার।
কিন্তু মেয়েটা বুঝতে দিলো না আজও। কণ্ঠে স্ফূর্তি এনে বলল,
“ কেমন আছেন,ভাইয়া? আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”
“ না। তুমি কেমন আছো?”
“আমি ভালো আছি। আপনাকে দেখে তো আরো বেশি ভালো লাগছে। বিয়ের শেষ অবধি থাকবেন কিন্তু। হুট করে চলে যাবেন না তো?”
শেষ প্রশ্নটা বড়ো মায়া নিয়ে করল সে। কিন্তু তীব্রর কাছে তো উত্তর নেই। এখানকার বাতাসে অদ্ভুত বিষ মিশে বোধ হয়। নাহলে ওর এমন শ্বাসরুদ্ধকর দশা হবে কেন? যেখানে এক মুহুর্ত থাকার ইচ্ছে বিরল,সেখানে বিয়ে শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা সম্ভব?
এই গাজীপুর তীব্রর গলায় আটকে থাকা কাঁটার মতো। শরীরের রন্ধ্রে থাকা ব্যথার মতো।
ওর মনোযোগ ঘুরল মিরাজের কথায়। তার হাতে গিফ্টের বড়ো বাক্স। নূহার দিকে এগিয়ে দিলো সেটা।
কণ্ঠে হইহই ভাব,
“ বিয়ের অনেক অনেক শুভেচ্ছা, ভাবি। এটা আমাদের তরফ থেকে সামান্য উপহার।”
“ এসবের কী দরকার ছিল,ভাইয়া?”
“ নাহিদ আমাদের এত প্রিয় বন্ধু। ওর বিয়েতে এসব কিছুই না। নিন,অনেকক্ষণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাত ব্যথা হয়ে গেছে!”
নূহা হাসল। দুহাতে আগলে ধরল বাক্সটাকে। ওদের কথা বলার মাঝেই আয়েশা এসে দাঁড়ালেন। চোখেমুখে অপার বিস্ময় নিয়ে তীব্রকে দেখলেন কয়েক পল। মিহি আর্তনাদ করে বললেন,
“ তীব্র! এ কী অবস্থা তোমার?
এত শুকিয়ে গিয়…”
নিচ থেকে মায়ের হাতটা চেপে ধরল নূহা। প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল,
“ এসব কথা এখন থাক আম্মু । ওনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন! কাউকে বলো না একটু ঠান্ডা কিছু দিয়ে যেতে।”
আয়েশার যেন টনক নড়ল। ভুলেই গেছিলেন তীব্র এখন আর সেই তীব্র নেই। মাথা নাড়লেন গতিতে।
“ হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি! তীব্র, তোমরা বসো। আমি এক্ষুনি আসছি!’’
আয়েশা ভীষণ ব্যস্ত ভাব করে অন্যদিকে গেলেন। সামনে থেকে সরতেই,
তীব্রর নজর পড়ল মুখোমুখি চেনা কারোর ওপর। চোখে চোখ পড়তেই যেন থতমত খেলেন রমণী। অস্বস্তির পাহাড় নিয়ে নজর সরালেন দ্রুত।
তীব্র চেয়েই রইল। পূর্ণ সতর্ক সেই চোখ। সালমা মাথার ঘোমটা টানলেন আরেকটু! শেষে দুম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন কোথাও।
তীব্রর চাউনী অনুসরণ করে সবটা দেখল নূহা। নিজেই বলল,
“ ওনাকে আমরাই ডেকে এনেছি। আসতে চাননি,তাও অনেক বলে কয়ে আনা। আসলে,এ মাসেই আমরা ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিচ্ছি তো!”
তীব্র ভ্রু গোছাল,
“ কেন?”
নূহা হাসল।
“ আর কতদিন অন্যের ফ্ল্যাটে থাকব, ভাইয়া? তাছাড়া আম্মুও রাজি নন এখানে থাকতে।”
নাহিদ বলল,
“ নূহা আমাকে বলেছিল তোকে জানানোর কথা। মানে তুই-ই তো ফ্ল্যাটটা..”
পথিমধ্যেই তীব্র শক্ত গলায় বলল,
“ আমি জেনে কী করব? কাউকে একবার দিয়ে দেয়া জিনিসের ওপর আমি কখনো দ্বিতীয় বার ফিরি না।”
“ আমিও ওকে সেটাই বলেছিলাম। যাকে ভালোবেসে দান করেছিলি সেতো আর এটার মর্ম বুঝল না। স্বার্থপর মেয়ে কোথাকার! অথচ দেখতে কী ভোলাভালা,কে বুঝবে ভেতরে কী?”
নূহা শক্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ করল,
“ না। পুষ্পিতা স্বার্থপর নয়। তুমি আবার ওর নামে এসব বলছো নাহিদ? আমি তোমাকে বারণ করি…
বলতে বলতে ওর চোখ পড়ল তীব্রর দিকে। সরু চোখমুখ দেখে নূহার অভিব্যক্তি পালটে যায়। চড়া কণ্ঠ মুহুর্তে মিনমিন করে বলে,
“ আসলে,আসলে পুষ্পিতা তো আমার ছোটোবেলার বন্ধু। ওর নামে কেউ খারাপ কিছু বললে আমি এখনো নিতে পারি না।”
নাহিদ দমল না। পালটা উত্তর দিলো,
“ তোমার বন্ধুকে সামান্য স্বার্থপর বলায় এত রেগে গেলে? আর সে যে আমার বন্ধুর এই অবস্থা করে গেছে সেটা কিছু না?”
নূহা জবাব দিতে চাইল,এর আগেই থামিয়ে দিলো মুশফিক।
“ আরে তোরা বিয়ের দিনেও ঝগড়া করছিস? মানুষ কী ভাববে? যা হয়েছে,হয়ে গেছে। ছাড় না।”
নাহিদ শ্বাস নিলো। বলল,
“ সব কথা বাদ। এখন আইনত যেহেতু এই ফ্ল্যাটের মালিক পুষ্পিতা, সেই ঠিক করুক ওর ফ্ল্যাট ও কী করবে!”
মিরাজ শুধাল,
“ শোনার পর সে কিছু বলেছে?”
নূহা জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। বলল,
“ জানি না। আমার সাথে তো যোগাযোগ নেই। সালমা আন্টি জানিয়েছেন বোধ হয়! এত ব্যস্ততার মধ্যে শোনা হয়নি৷ বিয়ে শেষে জেনে নেব। আর আন্টি এখানে আসার আগে বলেই দিয়েছিলেন,উনি এলে পুষ্পিতাকে নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। তাই এসব নিয়ে আমিও আর ঘাটিনি!”
নূহা দেখল তীব্র এখনও ভ্রু কুঁচকে চেয়ে। যাতে কিছু বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা! মেয়েটা অপ্রতিভ হলো। টেনেহিঁচড়ে হেসে বলল,
“ এভাবে কী দেখছেন, ভাইয়া?”
তীব্র অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ছোটো করে বলে,
“ কিছু না।”
তক্ষুনি স্টেজে বর-কনের ডাক পড়ল। আত্মীয়রা সবাই ছবি তুলতে চাইছেন।
নাহিদ প্রস্তাব রাখল,
“ বিট্টু চল ছবি তুলি!”
“ তোরা যা।”
ছেলেটা একটু মন খারাপ করলেও গাঁইগুঁই করল না। তীব্র যে এখানে এসেছে এই ঢের! নূহা আগে আগে চলে গেল। ও রওনা করল বাকিদের নিয়ে।
তীব্র তখন একা। চুপচাপ গিয়ে একটা টেবিল বেছে বসল সে। মাথা নুইয়ে থম ধরে থাকল কিছুক্ষণ। পুষ্পিতা,পুষ্পিতার নাম সব কিছু থেকে যত পালাতে চায়,তত সামনে আসে কেন?
ও চায় না ঐ মেয়েকে মনে করতে। কেন চাইবে?
ওর ভালোবাসায় তো কোনো খাদ ছিল না। কাঙালের মতো নিজের সবটা লুটিয়ে ঐ মেয়েকে ভালোবেসেছিল তীব্র। যে বিশ্বাসের যোগ্য নয়,তাকে জায়গা দিয়েছিল বুকে। তীব্রর ফের অতীত মনে পড়ল। পুষ্পিতার ছুটে এসে জড়িয়ে ধরার চিত্র ভাসল চোখের কোণায়। নয়ন জলে উপচে পরা মায়াবিনীর অতলে এতটা বেইমানি পোষা ছিল? যে মেয়েকে তীব্র কোনোদিন একটু উঁচু আওয়াজে কথা বলতে শোনেনি,রেগে গিয়ে আঘাত করে কাউকে কিছু বলতে দেখেনি,ঐ ফুলের মতো নির্মল মেয়ের ভেতর এতটা প্রতারণা! এতটা!
কিছু মুহুর্ত কাটল তারপর । আচমকা একটা হাট্টাগোট্টা ছেলে দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলে,
“ বিট্টু ভাইয়া না?”
তীব্র চোখ তুলে চাইল। কিশোরের পানে চেয়ে ভাঁজ বসল কপালে।
“ কে?”
“ আমি রাহাত।”
নাম বলে
আলোর মতো হাসল ছেলেটা। তীব্র বিস্ময় নিয়ে আপাদমস্তক দেখল তার।
আড়াই বছরের বেশি সময়ে, শরীরী গড়ন বদলে গেছে বেশ! লম্বা হয়েছে, হালকা দাঁড়ি উঠেছে মুখে। কলেজে পড়ার দিন সন্নিকটে প্রায়। গলার স্বর সেই আগের মতো তুলতুলে নেই।
তীব্র
পাশের চেয়ার দেখিয়ে বলল
“ বোসো।”
ঝটপট বসল রাহাত। চোখেমুখে আনন্দের সীমা নেই। খুশিতে হৈচৈ বাঁধিয়ে বলল,
“ আপনার সাথে দেখা হবে আমি তো ভাবতেই পারিনি। কী যে ভালো লাগছে! জানেন,আমি আমার নতুন স্কুলে গিয়েও আপনার কথা সবার কাছে বলেছি!”
তীব্র হাসল না বোধ হয়। মুখের পেশি একইরকম টানটান দেখাল। যে বছর তার জীবন থেকে সুখ খুইয়ে যায়? সে বছরেই খোরশেদ পরিবার নিয়ে সিলেট বদলি হন। আর সেটাও তীব্র সিঙ্গাপুর থেকে আসার আগে।
সুস্থ হওয়ার পর তীব্র কি বসেছিল? হদিস নেওয়ার তাগিদে ঠিকই পৌঁছে গেছিল সেথায়। পাছে,পুষ্পিতা ওখানে থাকে! একবার ওই মেয়ের মুখোমুখি হওয়া যে তীব্রর ভীষণ প্রয়োজন।
কিন্তু পায়নি। তীব্র সবরকম সোর্স লাগিয়ে খবর নিয়েছিল,যে বিল্ডিংয়ে রাহাতরা নতুন ভাড়া উঠেছে? সেখানে পুষ্পিতার চিহ্নও নেই।
“ কী ভাবছেন?”
তীব্র মাথা নাড়ল। বোঝাল,কিছু না। ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ অনেক বড়ো হয়ে গেছো। আমি কিন্তু প্রথমে চিনতে পারিনি।”
“ আপনাকেও একদম চেনা যাচ্ছিল না। আমি তাও বুঝেছি কীভাবে জানেন? ওই ভাইয়াদের দেখে,আর আপনার হাঁটাচলা দেখে। অনেকক্ষণ ধরেই দূর থেকে খেয়াল করছিলাম তো!”
তীব্রর অন্তঃপটে উশখুশের চাপ বাড়ল হঠাৎ। প্রবল ঘৃণা,বিতৃষ্ণায় নিঃশেষ হওয়া সত্ত্বেও জ্বিভ খসে বেরিয়ে এলো,
“ পুষ..পুষ্পিতার কী খবর ?
আই মিন,ওর বরের কী নাম?”
রাহাতের হাসিটা ঝট করে মুছে গেল অমনি। চোর চোর দীর্ঘ ছাপ বসল মুখে। আমতাআমতা করে বলল,
“ ভা..ভালো।”
তীব্রর সন্দেহ হলো। সতর্ক কণ্ঠে বলল,
“ তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো?”
“ না মানে…”
তীব্র তড়িৎ বাহু চেপে ধরল ওর। গলার জোর বাড়িয়ে বলল,
“ কী হয়েছে? বলো আমাকে,তুমি কি কিছু জানো?”
রাহাত ঢোক গিলে চারদিকে দেখল। ভয়ে ভয়ে খুঁজল মাকে। কণ্ঠে ত্রাস,
“ আম্মু বলেছিল এখানে এসে চুপ করে থাকতে। এসব বললে মেরেই ফেলবে।”
তীব্রর আগ্রহ বাড়ল। প্রগাঢ় হলো সন্দিহান চাউনী। আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ ভয় পেও না। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। কী হয়েছে! পুষ্পিতা কোথায়?”
রাহাত খুব মন খারাপ নিয়ে বলল,
“ আমি জানি না। আপুর সাথে আমাদের যোগাযোগ হয় না।”
তীব্র যেন আকাশ থেকে পড়ল।
কপাল গুটিয়ে গেল তড়িৎ।
“ যোগাযোগ হয় না?
কেন?”
“ জানি না। আম্মু করতে দেন না। আমিতো শেষ আপুকে হাসপাতালে দেখেছিলাম। সেই যে আপনাদের এক্সিডেন্ট হলো? তার পরেরদিন আপুকে এখানকার হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বাবা এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
আর আম্মু ফিরলেন কিছুদিন পর। আমিতো ছোটো, তাই আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমার সামনে কখনো কিছু আলোচনাও করেনি। তবে একদিন জিজ্ঞেস করলে আম্মু বললেন,ছোটাপুর বিয়ে হয়ে গেছে।
আর তারপর তো আম্মু আমাকে বোর্ডিং-এ দিয়ে দেন। ওখানকার নিয়ম,পড়াশোনা সব কিছুর এত্ত প্রেশার! আমি আর বাইরের কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারিনি। তবে আপুকে আমার এখনো খুব মনে পড়ে জানেন?”
রাহাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু
আশ্চর্য বনে চেয়ে রইল তীব্র।
কথাগুলোয় কেমন গুলিয়ে গেল সব! নূহা যে বলেছিল পুষ্পিতাকে ওর মণি বাসায় নিয়ে গেছে। তাহলে রাহাত বলছে কেন শেষ হাসপাতালে দেখেছিল?
আর বিয়ে? বিয়ের কথা রাহাত জানে না কেন?
পুষ্পিতার স্বামী,শ্বশুর বাড়ি এসবই বা চেনে না কেন?
ওর মা কেন পুষ্পিতার সাথে কাউকে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না!
তীব্র উদ্বীগ্ন হলো ফিরতি প্রশ্ন ছুড়তে,পূর্বেই পকেট হতে রাহাতের স্মার্টফোন বাজে। বের করে স্ক্রিনে চোখ বোলায় সে। ব্যস্ত হয়ে বলে,
“ আমার দাদু ফোন করেছেন। আম্মুকে দিয়ে আসি।”
“ এটা কার ফোন?”
“ এমনিতে আম্মুর। কিন্তু আমার কাছেই থাকে। আম্মুর আরেকটা আলাদা ফোন আছে। স্মার্টফোনে তেমন একটা কম্ফোর্টেবল না তো,তাই। আমি যাই হ্যাঁ?”
রাহাত উঠে,ছুটে গেল। রেখে গেল বিভ্রমে লুটপাট হওয়া তীব্রকে।
পুষ্পিতার কথা রাহাত কিছু জানেনা,এখানেই যেন সব প্রশ্ন,সব কথা এসে জট পাঁকিয়ে যাচ্ছে। সময় শেষে তীব্রর মনে হলো,কেউ একজন মিথ্যে বলছে ওকে। কিন্তু কে? নূহা!
হতে পারে নূহা পুরো সত্যি বলেনি।
তীব্রর কানে বাজল নাহিদের কথায় নূহার বিরোধাভাসের দৃশ্য। কেমন জোর গলায় বলল,
“ না,পুষ্পিতা স্বার্থপর নয়।”
পরপর মাথা নাড়ল সে। না না নূহা কেন মিথ্যে বলবে? যে মেয়ে ওর আসল পরিচয় জেনেও কাউকে বলেনি,সে এত বড়ো একটা ইস্যু নিয়ে মিথ্যে বলবে না।
তাহলে কে মিথ্যে বলছে? রাহাত! হয়ত সে মায়ের শেখানো বুলিই আওড়ে দিয়ে গেল! কিন্তু মুখ দেখে তো মনে হয়নি মিথ্যে বলেছে।
নাকি অন্য কেউ মিথ্যে বলছে এখানে?
তীব্রর ভেতরটা অজানা এক ত্রাসে ছটফট করে উঠল। মাথার নিউরন গুলো দাপিয়ে বেড়াল ক্রমশ।
সালমা কথা শেষ করলেন। ফিরে চাইতেই নূহা সামনে এসে দাঁড়ায়। ওকে দেখে হাসলেন তিনি।
“ বিয়ের কনে এখানে? কিছু বলবি?”
“ খেয়েছ তুমি?”
“ না,আসলে ভাবলাম আয়েশা আপার সাথেই বসব।”
“ আঙ্কেল,মিথিলা আপু কেউ এলো না যে!”
“ তোর আঙ্কেলের যা ব্যস্ততা! আর মিথিলাটাও বিয়ের পর কোথাও যেতে চায় না!”
নূহা মুচকি হেসে বলল,
“ আপু ভালো আছে এখন?”
সালমা হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
“ হ্যাঁ । মেয়েটা খুব বদলে গেছে জানিস? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এখন। রোজা রাখে! সেই জিন্স টপস পরা মেয়েটা মাথায় ঘোমটা ছাড়া কোথাও বের হয় না। নতুন করে আবার পড়াশোনা ধরেছে। ওর শ্বশুর বাড়ি তো আমাদের বাসা থেকে কাছেই একদম। প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে দেখা করতে আসে।”
নূহা হাসল। স্বস্তি পেলো মিথিলার কথা জেনে। সেদিন নাহিদের জবাবগুলো হয়ত একটু বেশিই বুকে বিঁধিয়ে নিয়েছিল। এতটা পরিবর্তন কি সেজন্যেই?
কথা বলার মাঝে ওপাশ হতে ডাকল নাহিদ,
“ নূহা,এদিকে এসো।”
সাড়া দিতে চপল পায়ে ছুটল তরুণী। সালমা ঠায় দাঁড়িয়ে তখনো। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন দেখছে। বড়ো তীক্ষ্ণ সেই তাকানো!
ভদ্রমহিলা চারপাশে চাইলেন।
হাতের ছোট্টো বাটন ফোনটা ভাইব্রেটের শব্দ তুলল সহসা। ত্রস্ত কিছু সচেতন হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ফের চারপাশ দেখে রওনা করলেন কোথাও।
সালমা নিরিবিলি এক কোনায় এসে থেমেছেন।
আওয়াজ ভীষণ নিচু। খুব আস্তে আস্তে বলছেন,
“ জ্বর এসেছে? এ বাবা! এখন আবার জ্বর! ওষুধ খেয়েছিস? ঠিক আছে,ঠিক আছে আমি কালই আসব।”
একটু থেমে বললেন,
“ কথা বলবি? কিন্তু ও যা ব্যস্ত! এ ডাকছে,ও ডাকছে। আমার সাথেও দু মিনিট কথা বলার সময় পাচ্ছে না। তারওপর এত মানুষ এখানে! ফোন টোন কোথায় রেখেছে কে জানে! আমি পরে কথা বলিয়ে দেবো,কেমন? হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ, সব ছবি দেখাব।
আর তুই এত কথা না বলে বিশ্রাম নে তো। আমি কালই আসছি!”
সালমা লাইন কেটে আবার ভিড়ভাট্টায় ফিরলেন। অথচ পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা চওড়া দেহটা তার নজরেই পড়েনি।
তীব্রর ঈগল চোখ গুটিয়ে বসেছে। ভেতরটা ধ্বক ধ্বক করছে দুরূহ সংকেতের তোড়ে। সে শক্ত হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর চট করে এদিক-ওদিক দেখল। দূরের রাহাতকে হাত তুলে ডাকতেই দৌড়ে এলো সে।
“ হ্যাঁ ভাইয়া?”
“ একটা কাজ করতে বললে,পারবে?”
ভাবনাচিন্তা ছাড়াই মাথা নাড়ল রাহাত। যে লোকটা ওর এত্ত পছন্দের সে কাজ দিলে পারবে না?
তীব্র সাথে সাথেই বলল,
“ তোমার মায়ের হাতের ফোনটা আমার চাই।”
রাহাত চমকায়। কিছু বলতে নিলে তীব্র আটকে দিলো পরের কথায়,
“ যাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্য। ”
“ কিন্তু আম্মু ওটা কাছ ছাড়া করেন না। আমি চাইলে দেবে না, বকবে।”
“ কিছু একটা করে নিয়ে এসো। প্লিজ রাহাত,ফর মি! প্লিজ?”
তীব্রর চোখে অনুনয়। কথাতেও তাই। এত দাপুটে মানুষের এত নরম অনুরোধ রাহাত ফেলতে পারে?
দ্বিধাদ্বন্দ্ব চেপে মাথা ঝাঁকায় সে।
প্রখর চিন্তায় ডুবে পা বাড়ায় ওদিকে।
ততক্ষণে স্টেজে বিয়ে পড়ানোর পালা শুরু হয়েছে।
কাজী সাহেব উঠতেই গোটা কয়েক অতিথি মিলে জায়গা ঘিরে ফেললেন। পেছনের শেষ সাড়ির চেয়ারটায় সবে বসেছেন
সালমা।
মুঠোফোন কাঁধ ব্যাগে ভরতেই, রাহাত থামল স্থানে।
কী করে যে ফোনটা হাতাবে! একদিন এমনি ধরেছিল,তাতেই যা বকা বকেছিল আম্মু।
কী এক মুসিবতে পড়ল শেষমেশ।
হঠাৎ চোখ গেল আয়েশা স্টেজ থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছেন। তৎপর একটা বুদ্ধি পেলো রাহাত।
হন্তদন্ত পায়ে এসে দাঁড়াল মায়ের সামনে। কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ আম্মু তুমি এখানে বসে আছো? ওদিকে আয়েশা আন্টি ওয়াশরুমের ওখানটায় একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। এরকম হলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটু গিয়ে সামলাও ওনাকে।”
সালমা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন।
“ সে কী! আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”
“ যাও যাও,তাড়াতাড়ি যাও।”
সালমা অতশত ভাবলেন না। ব্যাগ-ট্যাগ ফেলে ছুটলেন সে পথে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা ছো মেরে নিয়েই উড়াল দিলো রাহাত।
তীব্র আঙুলে কপাল ঘষতে ঘষতে পায়চারি করছিল। থামল ওকে দেখে।
“ পেয়েছ?”
রাহাত ফোন বাড়িয়ে দেয়। বুকে ঘন শ্বাস।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৫
“ মিথ্যে বলে সরিয়েছি। জানতে পারলে আমার পিঠের ছাল তুলে ফেলবে। কিন্তু এটা দিয়ে আপনি কী করবেন?”
তীব্র কথা খরচ করল না। শশব্যস্ত ফোন নিয়েই সাথে সাথে কল লিস্টে ঢুকল। সবার ওপর জ্বলজ্বল করছে একটা আনসেভ নম্বর। যে নম্বর সে চেনে না। অথচ অহেতুক কেমন শুকিয়ে এলো গলবিল। মরুর চেয়েও ভয়ানক চিড় ধরল বুকে। তীব্র কম্পিত আঙুল চালিয়ে কল দিলো নম্বরটায়। রিং হতেই, ফোন কানে গুঁজল। কল রিসিভ হলো সেকেন্ড কয়েক পর।
হাওয়ার তালে দুলতে দুলতে ভেসে এলো সেই রিনরিনে স্বর,
“ হ্যাঁ মণি,বলো!”