স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১০

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১০
সানজিদা আক্তার মুন্নী

সময় এখন সকাল প্রায় পনে দশটার কাছাকাছি। গত রাতে একটু হালকা ওপর ঝাপসা বৃষ্টির দেখা মিলেছিল। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় ধরা গিয়েছিল সকালে হবে হয়তো কিন্তু তা আর হয়নি। ফজরের খানিকক্ষণ থেকেই বৃষ্টি থেমে গেছে। সূর্য উঠেছে তার তেজি রশ্মি নিয়েই। এ কদিন রোদ প্রচণ্ডরকম থাকলেও হওয়া বাতাস ছিল না তেমন একটা। কিন্তু আজ ভিন্নতার দেখা মেলল, যেমন প্রখর রোদ আছে তেমন হাওয়া বাতাসও আছে তাই গরমটা একটু কম লাগছে। নাজহা রান্নাঘরে সবজি কাটছিল তখন বিবিজান বলে ওঠেন তৌসিরকে ডেকে দিতে বেলা বেশ হয়েছে। নাজহা বিবিজানের কথায় এসেছে রুমে ওকে উঠাতে।

আরো তিন বার ডেকে গেছে কিন্তু তৌসির উঠেনি। ডাকলে উল্টো খবিসের মতো অমৃত বাণী নিক্ষেপ করে মুখ হতে। নাজহা ঘরে এসে দেখে তৌসির এবার পেট উল্টে বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে, লুঙ্গি হাঁটুর কিছুটা নিচে উঠে গেছে। এতে ওর সাদা লোমযুক্ত পাদ্বয় স্পষ্ট নাজহার নজরে। নাজহা এক পলক তাকিয়ে দ্বিতীয় বার সাহস করে না থাকাতে পা থেকে সরিয়ে দ্রুত পায়ে তৌসিরের মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওকে ডাক দেয়, “এই যে আপনি কি উঠবেন না?
তৌসির ঘুমিয়ে থাকলেও ভেতর সজাগ, খুব ঘুম পাচ্ছে কিন্তু ঠিকমতো ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে পারছে না। একটু ঘুম লাগলেই নাজহা এসে শুরু করে মাছির মতো ভ্যানভ্যান। তৌসির যে অবস্থায় শুয়ে ছিলো ওভাবেই থেকেই তন্দ্রাচ্ছন্ন সুরে বলে, “এই সিনাল তোর কিতা হইছে লো? ঘুমাইতে দেস না ক্যান?, এমন বৈরীগিরি করতাছোস ক্যান।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাজহা তৌসিরের কথায় রেগে যাওয়ার কথা, কিন্তু রাগটা ঠিক ভর করে না, আর কীই বা করবে রেগে। এমন বাণী ওর শুনতেই হবে। ও এবার কষাঘাতের গলায় বলে তৌসিরকে উদ্দেশ্য করে, “বিবিজান বলেছেন আপনি ঘুম থেকে এবার না উঠলে আপনার লুঙ্গি এক টানে খুলে নিতে।”
নাজহার মুখের বাণী তৌসিরের কানে পৌঁছাতেই ও আলস্যমাখা কণ্ঠে বলে ওঠে, “ছিঃ ছিঃ, কিসব বেইজ্জতি কথাবার্তা কস বেটি সুন্দর কইরা ক।”
নাজহা বিষাদঘন ঝাঁজালো সুরে বলে, “আমি বলিনি, আপনার বিবিজান বলেছেন উঠুন এখন। বেলা দশটা বেজে গেল।”

কিন্তু তৌসির ওর একটা কথাও কানে নেয় না, সেই আগের মতো শুয়ে থাকে। এই মাইয়াটা বড্ড জ্বালায় ওকে। সবকিছুতে হিংসে করে, একটু ঘুমাতেও দেখতে পারে না। বিয়ে করে করে বউ না, বিপদ নিয়ে আসলো। এই জন্য হয়তো কিছু মানুষ বলে বিয়ে করাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। তৌসির অলস অলস কণ্ঠস্বরে ধারণ করে, “সাউয়ার সাউয়ার করিস না তো বেহেদায়ত মহিলা, একটু ঘুমাইতে দে।
নাজহার এবার রাগ উঠছে, ভীষণ রাগ উঠছে, উঠারই তো কথা, অসভ্য পুরুষ একটা। নাজহা এবার তীব্র রাগমাখা কণ্ঠে বলে, “দেখুন আমি বিরক্ত, আমি খুবই বিরক্ত আপনার এসব ফালতু কর্মে। তাই তাড়াতাড়ি উঠুন।
তৌসির শুনে না, ও কপাল কুচকে ঘুমালো সুরে বলে ওঠে, “কাউয়ার মতো এমন প্যানপ্যান করিস না লো, নয়তো কাশেমপুরের কবরস্থান রাইখা আসমু গিয়া এখন।

“আপনি উঠবেন নাকি আমি আপনার ওপর পানি ঢালব কোনটা?”
“আমি উঠতাম না কইছি তো উঠতাম না, এবার তুই যে সাউয়া করার কইরা নে।”
নাজহা এবার হাত বাড়িয়ে খাটপাশে ওপরে এক গ্লাস পানি রাখা ছিল, ওটা নিয়ে দাঁত চেপে তৌসিরের ওপর ছুঁড়ে মারে। তৌসিরকে মনে মনে বাঘের মতো ভয় পেলেও এই এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসে নাজহা। তৌসির তো ঘুমের তালে নাজহার কথায় এত পাত্তা দেয়নি, কিন্তু এখন চোখ-মুখ-কানে পানি প্রবেশ করতেই এক লাফে উঠে বসে। উঠে নিজের গায়ের দিকে তাকায়, টুপটুপিয়ে পানি পড়ছে। বিছানাও কিছুটা ভিজে গেছে। সেদিনও এমন করেছে এই বেয়াদব মহিলা, আজও এমন করলো। তৌসিরের মন তো চাইতেছে চটকনা মেরে নাক-মুখ সমান করে দিতে, কিন্তু না, চিত্ত রাগে ফেটে পড়লেও কিছু করা যাবে না।

তৌসির উঠে নিজের পা দুটি আগলা করে সামনের দিকে প্রসারিত করে বসে, দুই হাতে দুই দিকের বিছানার চাদর খাবলে ধরে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ে যাতে রাগটা একটু হলেও কমে। নাজহা ঠাঁই দাঁড়িয়ে তৌসিরের ওপর চোখ বুলাচ্ছে। এখন হয়তো ওকে দু-একটা থাপ্পড় নিশ্চয় মারবেই এই বিষয়ে নাজহা নিশ্চিত, কিন্তু তারপরও সরছে না, কারণ ভয় পেলেই ভয়ে দৌড়ায় আর না পেলে ভয়কে জয় করা সম্ভব হয়। তাই সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা হবার হবে, পিছু হটা যাবে না। তৌসির মুখ তুলে নাজহার ন্যায় তাকায়, হাত দিয়ে তো কিছু করতে পারবে না কিন্তু মুখ দিয়ে তো দু-একটা অমৃত বাণী শুনানই যায়। তৌসির কঠোর চোখে ওর ন্যায় তাকালেও মুহূর্তেই সেই কঠোরতায় এক গুচ্ছ নিমেষভরা মায়া ভর করে। ভর যে করবেই, মায়া লাগতে যে বাধ্য, এই মেয়েটার মুখখানা যে শুধু মায়ার জন্যই বরাদ্দ। নাজহার কালচে সবুজ পান্না নয়না দুটোর ন্যায় তাকিয়ে কঠিন কিছু বলা তৌসিরের জন্য বড্ড কষ্টদায়ক, কিছু ভেতর থেকে বের হয়ই না যে কিছু বলবে। বলার ভাষাটুকুই স্বল্পসময়ের জন্য কোথাও একটা লুকিয়ে যায় বোধহয়। নয়তো কিছু একটা বলতে পারতো, এই সবুজচিত্রা নয়নার মহের সামনে যে সব বিষাক্ততা চাপা পড়ে যায়। তৌসির এত মহের আবেশে ডুবেও বলে ওঠে, “মানুষ বিয়া কইরা আনে ঘরে বউ, আর আমি আনছি এক আখেরি গজব গাদ্দারনি।”

নাজহা ভুরু কুঁচকায় ভেবেছিল তৌসির ওকে হয়তো মারবে কিন্তু না, তৌসির তেমন কিছু করলো না। কিন্তু কেন করলো না? হয়তো কোনো কারণ আছে, নয়তো ছাড় দেওয়ার মানুষ আর মায়া করার মানুষ তৌসির নয়। নাজহা হাতের গ্লাসটা খাটপাশের উপর রাখতে রাখতে বলে, “বিছানার যাজিম ছাদে মেলে দিয়েন, চা খেয়ে এসে।”
তৌসির ওর কথায় ওর মুখ পানে তীক্ষ্ণ চোখে চায়। কত্ত বড় সাহস! এই শয়তান্নি ভিজালো নিজের ঝাল ঝাড়তে, আর এখন ওকে অর্ডার করছে নিয়ে শুকাতে! এই মাইয়া তো শেখ হাসিনার চেয়েও ভয়াবহ। আগে ভাবতো শেখের মাইয়াই হয়তো এই দেশে সবচেয়ে ভয়াবহ মহিলা ছিল, কিন্তু এখন তো ওর ধারণাটা পাল্টি খেয়ে গেল। এ ভেবে তৌসির নাজহাকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ওঠে, “আগে ভাবতাম এই দেশে হয়তো শেখের মাইয়াই ছিল একমাত্র ভয়ংকর ঝিজ, কিন্তু তালুকদার মাইয়া তুমি তো দেখি তার থাইকাও বিশ গুণ আগাইয়া।”
নাজহা তৌসিরের কথায় তীক্ষ্ণ সুরে বলে, “আমি কি করলাম?”
তৌসির নাজহার এ কথার জবাব না দিয়ে হাই দিতে দিতে বলে, “তোর দাদারে আইয়া কইস, ছাদে নিয়া দিতে। আমি পারতাম লো সিনাল এসব করতে?”

“কেন? আমার দাদা কি বিছানায় ঘুমান যে উনি দিবেন?”
“তো আমার নানা কি এটা ভিজাইছে? যে আমি গিয়া এই কইলজ্জা পুড়া রোদের মধ্যে ছাদে উঠতাম?”
নাজহা তৌসিরের কথায় মেজাজ দেখিয়ে বলে, “আচ্ছা তাইলে দিয়েন না। বিছানায়, না আমি থাকি, আর না আমার দাদা। তাই, ঠেকা আমার পড়ে নাই।”
এ বলে নাজহা একটু দূরে সরে বিছানার কোণে রাখা কাঁথাটা ভাঁজ করতে থাকে। তৌসির কাঁথা উড়ায়নি কিন্তু অগোছালো ঠিকই করেছে। অশান্তির উপরে অশান্তি। কিন্তু ওর এই দূরে সরে যাওয়া তৌসিরের ঠিক পছন্দ হয় না, তাই কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে নাজহাকে ডাক দেয়, “নাজহা, এদিকে একটু আও তো।”
নাজহা ভুরু কুঁচকে বলে, “কেন?”
“আও না, একটা কথা কইতাম।”

নাজহা কাঁথা রেখে তৌসিরের দিকে তাকায়। মনে হয় তৌসির কিছু বলবে, কিন্তু কি বলবে তাই কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে গিয়ে তৌসিরের পাশে দাঁড়ায়। ও দাঁড়াতেই তৌসির স্বল্প সময় চুপটি করে ওর ন্যায় চেয়ে রয়, তারপর আচমকা হাত বাড়িয়ে এক টানে নিজের উরুর উপর নাজহাকে টেনে নিয়ে বসায়। নাজহার শরীরটা বেশ পাতলা তাই একটানেই নিজের এতটা কাছে টেনে নিয়েছে। নাজহার দম বেরিয়ে আসার উপক্রম, চোখ বড় বড় করে সামনে তাকিয়ে রয়। তৌসির এক হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে, অন্য হাতে ওর কাঁধে হাত রাখে। নাজহার চিত্ত ফাটতে শুরু করে বিষাক্ততায়, এই ছোঁয়া ওর কাছে বিষের সমতুল্য। নাজহা ঘাবড়ে যায়, কি ঠিক করতে যাচ্ছে তৌসির বোঝা কষ্ট সাধ্য হয়ে যাচ্ছে নাজহার পক্ষে। তৌসির নাজহার কৃষ্ণনয়নের ন্যায় চোরা দৃষ্টি একনজর তাকায়। দেখতে পায় নাজহা এদিকে-ওদিকে মিছিমিছি তাকাচ্ছে আতঙ্কে। তৌসির ওর হরিণনয়নে এই আতঙ্ক দেখে সল্পাংশ সময় নাজহার তপস্বীর মুখপানেই চেয়ে থাকে, তবে তৌসিরের এই চাহনির ফাঁকে একচিলতে কিঞ্চিৎ হাসি লুকিয়ে রয় বটে। তৌসির নাজহার কাঁধ থেকে হাত তুলে ঘাড় পেছিয়ে ধরে।

নাজহার গালে নিজের গাল চেপে নাজহার নাসিকায় নিজের নাসিকা ঠেকিয়ে জোরে শ্বাস ছাড়ে। নাজহার সারা দেহখানা পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে যা এই কাণ্ডে। ওর ভিতরখানা ছ্যাঁকা খেয়ে গেছে ভয়, কষ্ট আর বিতৃষ্ণায়। নাজহা এই মুহূর্তে অনুভব করছে এক ছিন্নভিন্ন শূন্যতা, যা ভয় আর ঘেন্নায় ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে। তৌসিরের ভেজা গাল আর ধারালো দাড়ির স্পর্শে বুক চিঁড়ে যাচ্ছে সাথে লেগে আছে ঘেন্নার বিষ। তৌসিরের খুচাখুচা দাড়িগুলো ওর নরম গালে কাঁটার মতো বিঁধছে। নাজহা চোখ বুঁজে নেয় ভয়ে। ওর শক্তি নেই তৌসিরকে সরানোর, আর না আছে ইচ্ছে, কারণ নাজহা জানে তৌসির আজ নয়তো কাল নিজের অধিকারটুকু ঠিকই নিয়ে নেবে। এটা তো ওর অধিকার, এটা তো ওরই হক। এটা বোঝার পরও, জানার পরও গা-ঘিনঘিনে অনুভব হচ্ছে কেন ওর? চোখ বুজলেই তালহা ভাইয়ের স্নিগ্ধ মুখশ্রী ভেসে ওঠছে। দম গলার কাছে এসে আটকে গেছে এই মুহূর্তে। তৌসির ওকে ছাড়ছেই না, উল্টো ওর ঠোঁটের কোণে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে মৃদু স্পর্শে। নাজহা নিম্ন সুরে বলে, “আমায় ছাড়ুন তৌসির, ভালো লাগে না এসব।”

তৌসির ওর কথায় চাপা হেসে ফিসফিসিয়ে বলে, “আমার ছোঁয়া ভালো লাগে না?”
নাজহা তৌসিরের কথায় চোখ বুজে উত্তর দেয়, “ভারী ঘেন্না লাগে।”
তৌসির নাজহার মুখের বাণী শুনে খানিকটা ছ্যাতে যায়। নাজহার গালে আরো শক্ত করে নিজের গাল চেপে ধরে রুক্ষ সুরে বলে, “তাহলে যার ছোঁয়া ভালো লাগে তার গেছে হাঙ্গা বইতে, আমার গেছে বইলি ক্যান?”
নাজহা তৌসিরের কথায় ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তৌসিরের চোখে চোখ রেখে বলে, “আমার নিজ ইচ্ছেয় কিছু হয়নি।”

তৌসির নাজহার কথায় ওর দিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকে আড়চোখে, তারপর মৃদু হেসে নাজহার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “এত ফ্যাতফ্যাত করিও না, নয়তো কেটে পিসপিস কইরা এক পিস সুরমা নদীতে, এক পিস কুশিয়ারায় আর আরেক পিস দিমু ভাসাইয়া যাদুকাটায়।”
নাজহা তৌসিরের কথায় আর একটা বাণীও অপচয় করে না, তৌসিরের কাছ থেকে সরে যাওয়ার জন্য উদিত হয়। কিন্তু তৌসির ওকে যেতে দেয়, ওর কোমর জড়িয়ে শক্ত করে বসিয়ে বলে, “এমন কৈ মাছের তো ছটফট করো। ক্যান? কৈ মাছ খাই নাকি বেশি?”
নাজহা দাঁত চেপে বলে, “আমাকে ছাড়ুন।”

“তুমি একটু বসো, কিছু দরকারি কথা কইতাম।”
“আমি শুনতে ইচ্ছুক নই।”
“আমি কইছি, শুনবি তার মানে শুনবি, এত এক্সট্রা কথা কস ক্যান?”
“আমার মুখ আমি বলব, তাতে আপনার কি?”
“যখন থাপ্পড়াইয়া মুখ কান ফাটাইয়া নিমু, তখন বুঝবি আমার কি।”
“অতিরিক্ত বলে ফেলেছেন, কিন্তু…
“বালগিরি তইয়া আমি যে সাউয়া কইতাছি, এইডা হুন।”

নাজহা চুপ হয়ে যায়। তৌসির এবার বলে, “তুমি দেখতাছি সবসময় ফ্যান ছাইড়া রাখো। শুনোও, এভাবে রাখলে ফ্যানের রেগুলেটর চইল্লা যায়, তাড়াতাড়ি ফ্যান নষ্ট হইয়া যায়। যখন রুমে থাকবা না, তখন যেনো ফ্যান বন্ধ থাকে। যখন বাথরুমে যাইবা, তখন বন্ধ কইরা যাইবা। যখন বেলকনিতে যাইবা, বন্ধ কইরা যাইবা। একটানা ফ্যান লাইট বেশি সময় জ্বালাইয়া রাখবা না, বুঝলা?”

নাজহা তৌসিরের কথাগুলো শুনে তবে এক কান দিয়ে ঢুকায়, অন্যকান দিয়ে বের করে উওর দিকে উড়িয়ে দেয়। তৌসির নিষেধ করছে না এসব করতে? এখন আরো বেশি করে করবে, যা তৌসির না করবে তা একশোবার করবে। তবে এই মুহুর্তে নাজহার আরেকটা কথা মনে পড়ে যায় সকালে যখন ও রান্নাঘরে গিয়েছিল, তখন বিবিজান কথায় কথায় ওকে খুচা দিয়ে বলেছিলেন, “বুঝলে নাজহা, চিংড়িতে যতই লবণ মাখাইনা ক্যান, কাঁচা গন্ধটা কিন্তু মাথায় উঠবেই!” এটা উনি ওকেই খুঁচা মেরে বলেছেন। এটা তৌসিরকে জানানো উচিত, কেন ওকে খুচা মারবেন?
নাজহা মুখ তুলে তৌসিরের শুষ্ক চোখে তৌসিরের ন্যায় তাকায়, কারণ ও জানে ওর এই চাহনিতে তৌসিরের অন্তর গলে না পড়লেও নরম ঠিকই হবে। নাজহা হালকা মাথা কাত করে আলতো সুরে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, একটা কথা বলি, শুনবেন?”

মুহুর্তের মধ্যে এত নরম বদল দেখে খানিকটা চমকে তাকায় তৌসির, ভুরু কুচকে বলে, “শুনবো, বলো।”
নাজহা অনুমতি পেয়ে মনে মনে হালকা খুশি হয়ে স্নিগ্ধ সুরে বলে, “সকাল বেলা বিবিজান আমায় বললেন, ‘বুঝলে নাজহা, চিংড়িতে যতই লবণ মাখাইনা ক্যান, কাঁচা গন্ধটা কিন্তু মাথায় উঠবেই!’ আচ্ছা, এর মানে কি তৌসির? আমি ঠিক বুঝলাম না, এটাকি খারাপ কিছু নাকি উনি মজা করলেন?”
তৌসির নাজহার কথায় ঠিক কি উত্তর দিবে বুঝে পায় না। ওর বিবিজান নিশ্চয়ই নাজহাকে খুচা দিয়ে বলেছেন, এখন কি বলবে এর উত্তরে? তাই তৌসির ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এর উত্তরে কিছু বলছো?”
নাজহা দু-দিকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আমি বুঝিনি, বিধায় শুধু মেকি হেসে মাথা নাড়িয়েছি।”

নাজহার এই তরল আচরণটা অতলান্ত মনে ধরে। তৌসির নিজ অনিচ্ছায় মৃদু হেসে নাজহার মাথা আলতো করে নিজের বক্ষে জড়িয়ে ধরে। নাজহাও আর বিপত্তি করে না। ও নিজের ডান বাড়িয়ে তৌসিরের পিঠে একেক করে আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে খাবলে ধরতে থাকে। তৌসিরের বুকে মুখ গুঁজে ঠোঁট টেনে এক শয়তানি হাসি ধরে রাখে। এটা সহজ ভাষায় বলতে গেলে তৌসিরকে কান পড়া দিচ্ছে নাজহা। সেটা হলে সেটাই দিচ্ছে। তৌসির বিয়ে করে এনেছে ওকে, অন্য কেউ নয়, তাই অন্য কারো অধিকারও নেই ওকে খুচা মেরে কথা বলার। ওর দায়িত্ব ছিল তৌসিরের কানে পৌঁছে দেওয়া, আর তা সুন্দর মতোই করে নিয়েছে। এবার বাকিটা তৌসিরের হাতে।এটা ভেবে নাজহা তৌসিরের পিঠের অংশের শার্টটা খাবলে ধরে। এই বুকে মাথা গুজার ইচ্ছে ওর নেই, কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করছে ওকে এটা করতে। তৌসিরের গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যেতে শুরু করে। বুক ধড়ফড় করছে নাজহার এই স্পর্শে। তৌসির কাপা হাতে নাজহার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আর কেউ কিছু বললে তুমি আমায় আইসা বইলো, আমি দেইখা নিবো। আর বিবিজান কি বলেছেন, আমিও বুঝিনি, তাই জিজ্ঞেস কইরা তোমাকে জানাইমু নে।”

নাজহা মৃদু সুরে বলে, “আচ্ছা।”
বলে তৌসিরের থেকে সরে গিয়ে উঠে দাড়িয়ে ওড়না ঠিক করতে করতে বলে, “আপনি নিচে যান, আমি এটা গুছিয়ে আসছি।”
তৌসির ওর কথায় মাথা নাড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। ঘুম আর বউয়ের মায়া কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়, লুঙ্গি ঠিক করতে করতে। তৌসির করিডরে এসে ঘুমালো চোখে চারপাশে তাকায়, আর এক চিলতে হাসে। তৌসির ঠিকই ধরে নিয়েছে নাজহার চালাকি, যে মেয়ে দুনিয়া ভেজে খাইতে পারে, সে নাকি এই সামান্য কথা বুঝবে না? তা কি আবার হয় নাকি? তৌসির ঠোঁট চেপে হাসে, এটা ভেবে, যে যাই হোক, নাজহা ওকে বলেছে, তো আর বউরা তো এমনি অভিযোগ করে। কিন্তু ও বিবিজানকে জিজ্ঞেস করবে না। ও চায় না জিজ্ঞেস করতে। যদি জিজ্ঞেস করে, তবে ওর যে বিবিজান নাজহা কে উনি দু চোখে দেখতে পারবেন না, আর পরে। তাই এটা আপদেতো বাদ। নাজহাকে কিছু একটা বলে বুঝিয়ে নিবে।

তৌসির দাড়িয়ে আছে, তখনই পিছন থেকে ওর বাবা বলে ওঠেন, “কি রে, ইজ্জত মাল দিছে?”
তৌসির বাবার গলা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলে, “দিছে আব্বা, হালা ইজ্জত বেইজ্জত হইয়া দিছে।”
ওর বাবা এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলেন, “দিলেই হইলো।
তা, সাংসারিক জীবন কেমন যাচ্ছে?”
তৌসির উনার কথায় চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে, “আর কি, সংসার আব্বা? তোমার মা-য় আমার বউরে খালি খুচা মাইরা কথা কয়, আমার বউ আবার সবকিছু বুঝে না। পরে আইসা আমারে জিজ্ঞেস করে, ‘এটার মানে কি, ওটার মানে কি, আজ জিজ্ঞেস করতাছে চিংড়িতে যতই লবণ মাখাইনা ক্যান, কাঁচা গন্ধটা কিন্তু মাথায় উঠবেই!’ এইডার মানে কি? এটা নাকি ওরে বিবিজান কইছেন।”

ওর বাবা এটা শুনে ভারি শ্বাস ছেড়ে বলেন, “কি কইতাম কতো এখন। আইচ্ছা, আমি কলে কৌশলে আম্মারে কইমু নে, এসব না করতে। মাইয়া ডা অনেক ছোট।”
তৌসির মাথা নাড়িয়ে বলে, “তোমার ইচ্ছা কইলে কইও, নাইলে আমার বউ আমার মগজ খাইয়া নিব।”
এ বলে বাপ-ছেলে সামনে আগাতে থাকে, নিচে যাওয়ার জন্য।

সময় এখন দুপুর গড়িয়ে এগারোটায়। চারপাশে উত্তপ্ত রোদের দাপট, মনে হচ্ছে আগুনের হাতছানি ছড়িয়ে আছে বাতাসে। ইদানীং গরমের খামখেয়ালি খেয়াল থামতেই জানে না মনে হয় একটানা দগ্ধ করছে ভূমি ও মানুষকে। আকাশের কোণে কোথাও নেই মেঘের আভাস, নেই শীতল বৃষ্টির সান্ত্বনা শুধু অনাবৃষ্টির বিরামহীন তাপে ক্লান্ত পৃথিবী হা-হুতাশ করছে।গরম আর গরম। ‎এই গরম সহ্য করতে না পেরে রুদ্র এসে ডুব দিচ্ছে শিকদার বাড়ির বড় পুকুরে। বড় পুকুরের পানি বেশ ঠান্ডা, মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় একদম নিমিষেই। ইজ্জত আলীর ওখান থেকে মাল নিয়ে আসার পথে গোসল দিয়েছিল একবার নদীতে, এখন আবার দিচ্ছে, মনে শান্তি মিলছে না ঠিক।হঠাৎ পুকুরের পাড় থেকে কেউ বলে ওঠে, “রুদ্র ভাই তোমার লুঙ্গি।”

রুদ্র কণ্ঠটা শুনে পাড়ের দিকে তাকায়, দেখে সিমরান দাঁড়িয়ে আছে। সিমরান তৌসিরের সেজো চাচা তিহান শিকদারের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটা দেখতে বড্ড মায়াবী, গায়ের রঙ একটু চাপা হলেও মুখের গড়ন বেশ সুন্দর। রুদ্রের মনের কুঠিরে মাঝেমধ্যেই এই মায়াবী মুখখানা উঁকি ঝুঁকি দেয়, তবে রুদ্র এই উঁকিঝুঁকিকে ততটা পাত্তা দেয় না। রুদ্র সিমরানকে দেখে বলে, “কি রে?, তুই এন্যা কি করস? আমি তো মিহুল রে কইছি লুঙ্গি দিতে।”
সিমরান লুঙ্গিটা কাপড় রাখার বাঁশে রাখতে রাখতে বলে, “আমি আইতে চাইছি নাকি, মিহুল পাঠাইলো। ও খেলায় যাইব।”
রুদ্র ওর কথা ভুরু কুঁচকে বলে, “একটা যুবতী মাইয়া হইয়া একজন যুবক গোসল করছে, তার মধ্যে তুই কোন বিবেকে আইলি?”
সিমরান চলে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে যায়, ঘাড় ফিরিয়ে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি নিজেরে যুবক দাবি করেন?”

“হ করি ক্যান, তোর কোনো সন্দেহ?”
বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, বয়স ত্রিশের উপরে, তাই কথা একটু সাবধানে কন।”
রুদ্র পানি থেকে উঠে সিঁড়িতে বসতে বসতে বলে, “যখন আইছিস, তাইলে এদিকে আয়, আমার পিঠে দুইটা ঘষা মার গা ঘষানোর জাল দিয়া।”
সিমরান দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে জালে সাবান নিয়ে। এক হাত রাখে রুদ্রের কাঁধে, অন্য হাতে পিঠে ঘষে দেয়। রুদ্র চোখ বুজে নিয়ে বলে, “তা সিমরান, বাড়িতে দেখলাম ঘটক আইলো তোর বিয়্যার লাইগা, নাকি?”
সিমরান রুদ্রের কথায় মেকি হেসে উত্তর দেয়, “কি যে কন রুদ্র ভাই, আমার মতো কাইল্লা মাইয়ারে আর কে বিয়া করবো যে বিয়া লাগবো?”
রুদ্রের খুব খারাপ লাগে সিমরানের নিজের প্রতি নিজের এমন উপহাস দেখে। রুদ্র কড়া গলায় বলে ওঠে, “দূর, এমনে কইস না। তোর গায়ের রঙ একটু চাপা, কিন্তু তোর মতো সুন্দর গড়নের মায়াবী মাইয়া আছে নাকি এ দুনিয়ায় দুইটা?”

সিমরানের হাত থেমে যায় রুদ্রের কথাটা শুনে। সিমরান মুচকি হেসে বলে, “মানুষ তো আর গড়ন দেখে না রুদ্র ভাই, সেই ঘুইরা-ফিইরা সাদা রঙই দেখে।”
রুদ্র আলতো সুরে বলে, “না রে বোকা, এমন না। কেউ কেউ চেহারার মায়াটাও খুঁজে, দেখে, অনুভব করে, অতঃপর ভালোবাসে।”
রুদ্রের কথায় সিমরান চুপ করে যায়। রুদ্র ভাইয়ের সাথে কথায় পারা মুশকিলের কাজ। সিমরান কেন, ওর নানা কবর থেকে ওঠে এসেও পারবেনা ওর সাথে কথায়। কাজে পারদর্শী না হলেও ভালোমতে কথায় এক্কেরে একশোতে কোটি। সিমরান কিছু সময় চুপ থেকে এবার আবদার এঁটে বসে, “রুদ্র ভাই, আমি আপনার পিঠ ঘষে দিলাম, আপনি এর বদলে আমায় শাপলার ব্যাট এনে দিবেন বিকালে।”
রুদ্র ওর কথায় বলে, “বিকালে পারতাম না তোর লাইগা গোসল কইরা গিয়া এখন আবার ভিজতামনি হাঁটু পানিতে নামিয়া। কাল আনবনে কতটা।”

“আইচ্ছা।”
এ বলে সিমরান জাল রেখে হাত ধুয়ে নিয়ে বলে, “আমি যাই!”
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে বলে, “যা।”
সিমরান চলে যেতে নেয়, তখনই রুদ্র পিছন থেকে ডেকে বলে, “এ সিমরান, নয়া ভাবি কেমন রে, মানে ভাবমূর্তি আরকি?”
সিমরানকে নাজহার কথা জিজ্ঞেস করায়, ও হতাশার সুরে বলে, “কেমন জানি রুদ্র ভাই, খুব কম কথা বলেন, কাজ ছাড়া একটা শব্দও ব্যয় করেন না, একদম চুপচাপ।”
রুদ্র ভেলকি মেরে বলে, “ব্যয় করব ক্যান? তৌসিরের বউ বইল্লা কথা না।”
সিমরান আলতো হেসে ওঠে রুদ্রের কথায়, তারপর বলে, “হয়েছে, আপনি এবার তাড়াতাড়ি উঠে আসেন। বড় ভাইজান অপেক্ষা করতাছে, ভাত খাইব বইল্লা।”
এ বলে সিমরান চলে যায়। সিমরানের যাওয়ার পানে স্বপ্নাবিষ্ট চোখ তাকিয়ে রুদ্র শুধু একটা আকাশচুম্বী হাসি দেয়।

রাত দশটার কাছাকাছি খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে এই খানিক্ষণ আগে শিকদার বাড়িতে। নাজহা এখন নিজেদের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ফুর-ফুরে হওয়া বইছে চারদিকে বেশ ভালোই লাগছে। বারান্দা ওর প্রিয় জায়গা হোক তা যেকোনো স্থানের। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে নিজের ভেতরে থাকা যত না বলা কথা, যত অভিযোগ, যত কষ্ট সব বলছে রবকে। বারবার আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের না বলা, নিজেকে না বলা কথাগুলো চোখের অসহায় দৃষ্টিতে রবকে বলার যে শান্তি তা মহা অমৃতেরও ঊর্ধ্বে। ও সূরা বাকরায় পড়েছিল নিশ্চয়ই আমি তোমার আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখাকে লক্ষ্য করি। নাজহা যেদিন থেকে পড়েছিল, সেদিন থেকে হতাশ হলে, কষ্টে বিধ্বস্ত হলে আকাশ পানে চেয়েই নিজের ভেতরকার অশান্তি দূর করে।

তৌসিরের করা অমানবিক বিষয়গুলো নাজহাকে নিদারুণ যন্ত্রণায় পুড়ায়। ভাবতে ভাবতেই হতাশায় মরায়, চিত্ত ফেটে যায় শূন্যতার আগুনে যে কি করে আস্ত একটা জীবন পার করবে এই অমানুষের সাথে? যার কিনা কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই, যার প্রধান কাজ পয়সা বাঁচানো। যে নিকৃষ্টতার অতল গহ্বরে লুকিয়ে থাকা শয়তানি আত্মা। নাজহার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নাহ, এভাবে থাকা যায় না। এই মানুষের সাথে আর যাই হোক সংসার হয় না। এটা তো অন্যায়। নাজহার সাথে তো খুব অন্যায় হচ্ছে, কিভাবে ও এমন মানুষের সাথে গোটা জীবন থাকবে? আচ্ছা, নাজহার কি এখানে থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত? কোথায় যাবে? বাড়িতে? নাহ, ওই বাড়িতে নাজহা আর কখনোই যাবে না। যে বাড়ির লোকজন ওকে পণ্যরূপে বিলিয়েছে, একজন অমানুষের হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের কাছে আর যাওয়া যায় না। তাহলে কি ইংল্যান্ড যাবে? ও চাইলে পারবে যেতে। মাকে যদি একবার বলে “তুমি আমায় এখান থেকে নিয়ে যাও” তবে মাসখানেকের ভেতর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কারণ ওর মা সেখানকার একজন বড় বিজনেসউওম্যান, তার কাছে এগুলো পানি ভাত। কিন্তু নাজহা বলতে পারবে না। মাকে যে ঘৃণা করে, বড্ড ঘৃণা করে ও। ছোটবেলায় যখন ওকে ছেড়ে ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সে থেকে আর কোনো সাক্ষাৎ, কোনো কথা তাদের মধ্যে হয়নি। মা’কে শেষ কথাটা বলেছিল ছোট্ট নাজহা, “তুমি যেও না আম্মু, তুমি চলে গেলে আমার কি হবে?”

সেদিন নাজহার এই কথায় কোনো রাগ ছিল না, ছিল আক্ষেপ আর আকুতি। কিন্তু ওর এই অসহায় আকুতি ওর মা শুনেননি, তিনি চলে গিয়েছিলেন নিজ গন্তব্যে। তারপর হতে আর মা বলতে কেউ আছে পৃথিবীতে, নাজহা ভুলতে চেষ্টা করছে। তবে ভুলার চেষ্টা করলেই কি আর ভুলা যায়? মাঝেমধ্যে সেই ঠিক মনে পড়েই যায়, মা তো নারীর টান বলে কথা। যখন মনে পড়ে তখন ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। মনে হয় কেউ অন্তরটা টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এ খণ্ডখানিক ভাবনা মস্তিষ্কে আঁটতেই নাজহার চোখের কোণে বিন্দু পরিমাণ জল জমে, কিন্তু তা গড়ায় না। কান্নায় নাজহা অভ্যস্ত নয়। নাজহা মানে জীবন, মানেই বাস্তবতা। আর বাস্তবতা কখনোই সুখের হয় না, তা সবসময় কিছুটা দুঃখ, কিছুটা আনন্দ আর তিক্ততাই নিয়ে আয়োজিত। এই পৃথিবী সুখের জন্য বরাদ্দ না এটা কেবল একটা যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দুনিয়া সেই জায়গা, যেখানে আদম আঃ কে শাস্তির জন্য পাঠানো হয়েছিল। তাহলে এই জায়গায় আমরা কিভাবে সুখ চেয়ে বসি? সুখ বলতে কিছু নেই, নিজের মনকে বুঝাতে পারলেই ফিতনাহীনে বাঁচা যায়, ব্যাস, এতটুকুই। এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে একটা আওয়াজ নাজহার কানে ভেসে ওঠে,“কিতা লো তালুকদারের মাইয়া, জ্বীন ট্বীন ঘাড়ে তোলার শখ হইছে নাকি তোমার?”

তৌসিরের কথাখানি শুনে গায়ে ফুসকা পড়ার মতো একটা অনুভূতি হয় নাজহার। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না, চুপচাপ বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এই লোকের সাথে যতটুকু কম কথা বলা যায় ততটুকুই কল্যাণজনক নিজের জন্য। তৌসির নাজহা চুপ থাকতে ভুরু কুঁচকায়, মাইয়াডার কি হইলো? সারাদিন তো ফ্যাত ফ্যাত করে, কিন্তু আজ কথার উত্তর দিল না যে? সভ্য জ্বিন-ট্বিন ভর করলো নাকি আবার? তৌসিরের মোটেই পছন্দ হলো না এমন নীরবতা। এই নীরবতা বিরক্তিকর তৌসিরের জন্য। সত্য অর্থে তৌসিরের নাজহার সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে, কথায় কথায় ওকে রাগিয়ে দেওয়া, ওর রাগ দেখা এগুলো অভ্যাসের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে ইদানীং। তৌসির মেকি হেসে নাজহার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, কিছুটা দূরত্ব নিয়েই দাঁড়ায়, কাছে দাঁড়ালো না, পরে না বেইজ্জত কইরা দেয় তাই বেইজ্জত হওয়ার চেয়ে ইজ্জত নিয়ে বাঁচাটাই উত্তম। তৌসির কিছু সময় চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয় একেবারে সাধু বাচ্চার মতো। কিন্তু সাধু তমকা তো আর তৌসিরের সাথে যায় না, তাই মাথাটা কাত করে নাজহার ন্যায় তাকায়, নাজহার ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করে ভালো নাকি খারাপ নাকি মধ্যম। কিন্তু নাহ, তৌসির বুঝতে পারে না, ওর ভাবমূর্তিটা। কোনো হালার পুতের মুখ থেকে একখণ্ড গান শুনেছিল, “মেয়েদের মন বুঝা নয়রে নয় সোজা।” যখন শুনেছিল তখন বোঝেনি, এই গানের মর্ম।

তবে আজ বুঝলো বটে এই গানের মর্মখানি। মাইয়া মাইনষের মন আর মুড বুঝা বেশ কঠিন একখানা কর্ম। অল্প সময় চেয়ে থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, তারপর আকাশ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে, “তুমি বড়ই স্বার্থপর তালুকদারের মাইয়া, দুঃখ-দরদ নাই বিন্দু পরিমাণও তোমার ভেত্তরে।”
নাজহা নিজের বিরুদ্ধে এমন অসহ্য বাণী শুনে থমকায় সামান্য। তৌসিরের তো মানব নাকি, ওকে দুঃখ-দরদ শেখাচ্ছে? নাহ, এবার আর মানা যায় না, কিছু না বললে নিজেকে অপমান করা হবে। যে আস্ত মানুষ কুপিয়ে হাত লাল করে সে দুঃখ-দরদ শেখাচ্ছে? নাজহা হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে তৌসিরের দিকে দুর্ভেদ্য চোখে চেয়ে বলে, “আপনার সাথে আমি কি করেছি যে এমন কারণহীন কথা ফরমাচ্ছেন?”

তৌসির আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একনজর প্রণয়াভিভূত নয়নে তাকায় নাজহার শোধাময় মুখপানে। একনজর তাকিয়ে ঠিক চোখের পলক সরাতে পারে না বিধায়, ওর পানে চেয়ে থেকেই মৃদু সুরে ধারণ করে, “এই যে আইজ সকালে আমি ক্লান্তিতে মাছের মতো হুতিয়া বিছানায় ছটফট করলাম, সামনে থাইকাও তো একবার জিগাইলা না কি হইছে আফনার?”

নাজহা তৌসিরের কথায় যৎকিঞ্চিৎ হাসে, যদিও উক্ত কথাটা হাসির নয়। তবে নাজহার কাছে তা তাচ্ছিল্যকর একটা কথা যার কোনো ভিত্তি নেই। ও খেয়ে আর কোনো কাজ পাচ্ছে না যে ওকে এসব জিজ্ঞেস করবে। নাজহা সবসময় টাশ টাশ উত্তর দিতে অভ্যস্ত, তাই অভ্যাস মতো আকাশের ন্যায় তাকিয়ে-ই চটজলদি উত্তর দেয়, “আপনি ছটফট কেন? যদি মরেও যান আমি নিজ ইচ্ছেয় আপনার লাশেও চোখ বুলাবো না, জিজ্ঞেস করা তো অনেক দূরের বিষয়।”
নাজহার কথাটা শুনে প্রথমে খারাপ লাগে না, কিন্তু যখন দ্বিতীয়বার ওর কথাটা ভালোভাবে বুঝে তখনই কেমন লাগে তৌসরের প্রাণকেন্দ্রে। নাজহা ওকে পছন্দ করে না। তৌসিরও তো ওকে পছন্দ করে না, কিন্তু তাই বলে এভাবে এত কঠিন কথা বলা যায় নাকি? হয়তো যায়, তাই তো নাজহা টাশ করে এই বাণী বুনে নিলো। তৌসির ওর কথায় ম্লান হেসে বলে, “লাশ দেখবা কি? দেখা গেলো লাশই পাইলা না!”

নাজহা ওর কথায় শক্ত গলায় বলে, “না পাওয়াই ভালো। পেলে দেখা গেলো আপনাদের মতো মানুষের জন্য দোয়া দরুদ, সিন্নি, কতকি করতে হয়। এগুলোর যোগ্য তো আপনারা না, তাই লাশ না পেলে আরো ভালো।”
তৌসির দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বলে ওঠে, “একটা হাছা কথা কই তালুকদারের মাইয়া, শুনবা?”
“বলুন।”
“তোমারেও আমার একটুও পছন্দ না, তোমারে দেখলেই বিষ-বিষ লাগে। মন চায় ধরে তোমায় ইচ্ছামতো কয়েক কুপ দেই।”
তৌসিরের কথায় নাজহা থমকায় না, কারণ ও জানে এটা ভালো করেই। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে তাচ্ছিল্যপূর্ণ চোখে তৌসিরের ন্যায় খানিকক্ষণ তাকিয়ে রয়, তারপর বলে, “তাহলে কুপান, আমি তো আপনার কেনা পণ্য। যা ইচ্ছে করতে পারবেন, অভিযোগ করব না।”

নাজহার এই অসহায় কথাটা ঠিক যেন মানতে পারে না তৌসির। কেমন জানি লাগে, তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আজ এত নরম ফ্যাত ফ্যাত করছো না ক্যান? লাং এর কথা মনে-টনে পড়লো নাকি?”
লাং শব্দ শুনেই নাজহার মগজ ফাটতে শুরু করে। এই সব বাজে ইঙ্গিতের কথাবার্তা নাজহার শুনলেই গায়ে ফুসকুড়ি পড়ে। বিষাক্ত চোখে তৌসিরের দিকে তাকায়, ওর নাসিকার ঢগায় মুহূর্তেই একগুচ্ছ রাগ জমে। ফ্যাত করে বলে ওঠে, “নিজের নিকৃষ্ট ভাবনা আর জবান সামলে রাখুন!”
তৌসির ওর কথায় তীক্ষ্ণ চোখে ওর ন্যায় চায়। মনে মনে বুনে, এই তো চইল্লা আইছে আমার নাগিন নিজের আসল রূপে। তৌসির গাছাড়া ভাবে নিয়ে বলে, “সে আমি সামলাই রাখি, কিন্তু তোমার সামনে আইলেই বেসামাল হইয়া যায়, এতে আমার কোনো দোষ নাই।”

“আপনার এই জবান একদিন পচে গলে পড়বে, যে অবস্থার কথাবার্তা আপনার।”
নাজহার এই অভিশাপমূলক কথায় বড্ড বিরক্ত হয় তৌসির। গাদ্দারের মতো একখানা কথা কইলো এই মাইয়া। তৌসির তিক্ত সুরে বলে ওঠে, “ডাকাইতের ঘরে ডাকাইতে! তুই দেখতাছি বাপ-চাচার মতো গাদ্দারিতে উস্তাদ। জামাইরে এমন অভিশাপ দেছ, গজব পড়ব তোর এই ঠ্যাটা পড়া জবানে!”
নাজহা দাঁত চেপে তৌসিরের কথার পিঠে বলে, “আগে যদি জানতাম এতটা খারাপ আপনি, তাহলে আপনার নামে কবুল না পড়ে বিষ খেতাম।”

তৌসিরও কি কম যায় নাকি! ও সোজা উত্তর শোধায়, “আগে খাস নাই, তাইলে এখন খা। দিতাম আইন্না বিষ?”
নাজহা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না, বারান্দা থেকে চলে আসে। এখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। যাওয়ার তবে বলে যায়, “ছিঃ ছিঃ, এত মুনাফিক, এত মুনাফিক।”
নাজহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তৌসির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কুত্তার বাইচ্ছা, কুত্তার মতো ঘেউ ঘেউ না কইরা, সাপের মতো ফ্যাত ফ্যাত করে ক্যান?”
এ বলে চারপাশে বিরক্ত নিয়ে একপলক চোখ বুলায়, তারপর নিজেও রুমে যায়, এখানে থেকেই বা কি করবে।

তৌসির ঘুমিয়ে আছে নিচে পাটিতে। ওর বাহুতেই এলোমেলো চুলে শুয়ে আছে নাজহা। হাজার বার বললেও নাজহা বিছানায় যাবে না। ওর কথা, প্রথম দিন যখন নিচে ঘুমানোর কথা বলছেন, তাহলে নিচেই ঘুমাবো। তৌসির কি আর করবে? ও কি কখনো পারবে নাজহার ঘাড়ত্যাড়ামির সাথে? না, তা কখনোই পারা সম্ভব নয়। তৌসিরের নানা কবর থেকে উঠে এসে তর্কে পারবেন না।আর তৌসিরের পক্ষে পারা তা তো অনেক দূরের বিষয় । তাই নিজেও নিচে চলে এসেছে। নাজহা কে নিজের বক্ষে টেনে নিয়ে বেদম ঘুমে তলিয়েছে। নাজহাও ঘুমাচ্ছে, সাথে ওর বিড়ালগুলোও আছে, ওদের আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, পেট উল্টে শুয়ে। তৌসিরের সারাটা শরীর ব্যাথা করে নিচে ঘুমালে। কিন্তু নাজহার ঘন কেশতরঙ্গে নাক মুখ ডুবিয়ে ঘুমানোর লোভ যে সামলাতে ব্যার্থ ও। তাই তো এত কষ্টের সহিত নাজহার পাশেই থাকে।

নাজহার চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘুমালে মনে হয় এটাই অমৃত নিদ্রা। তৌসির গভীর ঘুমে ডুবে থাকলেও ওর ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত জাগরণে তাড়িত আছে এখন। হঠাৎই কানে আছড়ে পড়ে এক ঝনঝন শব্দ, নূপুরের ঠনঠন ধ্বনি। মনে হয় কেউ অদৃশ্য পায়ে ওর মাথার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি পায়ের শব্দ মনে হচ্ছে মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি, অশরীরী নৃত্যের মন্দ্রস্বর। সপ্নে অচানক ওর চোখের সামনে উন্মোচিত হয় এক ভয়াবহ দৃশ্যপট। আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে চারদিক। শিখার লেলিহান জিহ্বা আকাশ ছুঁতে চাইছে, বাতাসও হয়তো কাঁপছে দগ্ধ মাংসের করুণ গন্ধে। সেই অগ্নির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক নারী, নগ্ন, অর্ধজলন্ত দেহ, দগ্ধ চামড়ার গন্ধে চারদিক ভারী হয়ে উঠেছে। সেই নারী আর্তচিৎকার করছে, কিন্তু এই চিৎকার মানুষের কম মৃত আত্মাদের কবরফাটা হাহাকার মনে হচ্ছে বেশি ।
তার পাশেই এক অর্ধবয়স্কা নারীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের অমানবিক হাত। সেই নারীর বুকফাটা কান্না আকাশকে ফাটিয়ে দিতে চাইছে, কিন্তু আগুনের শব্দে তা গিলে খাচ্ছে শূন্যতা। লুটেরা দানবেরা তার ইজ্জত ছিঁড়ে খাচ্ছে শকুনের মতো, রক্ত ঝরছে মাটিতে, আবার সেই রক্ত মিশে যাচ্ছে অগ্নির তীব্রতায়।

সবকিছু মিলে এক শয়তানি রঙে রঞ্জিত হচ্ছে দিগন্ত। তবে এই চিৎকারগুলো কখনো তামিলের অচেনা সুরে, আবার হঠাৎ বাংলার কান্নায় রূপ নিচ্ছে। ভাষা বদলাচ্ছে, অথচ যন্ত্রণা একই, রক্ত, আগুন আর ধর্ষিত আত্মার হাহাকার। শব্দগুলো মিশে যাচ্ছে মৃত্যুর গর্জনে, মনে হচ্ছে পৃথিবী ভেঙে পড়ছে ঐ মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ৯

তৌসিরের নিদ্রিত বুক হু-হু করে ওঠে। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কপাল কুঁচকে রয়।, শ্বাস আটকে গেছে গলায়। স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা গুলিয়ে যাচ্ছে , মনে হয় তৌসিরও এই দগ্ধ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। রক্ত, আগুন, আর্তনাদ, সব মিলিয়ে চারপাশ এক শয়তানি মহাযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। এই সপ্ন বারংবার তৌসির কে এসে দেখা দেয়।এ সপ্ন তৌসিরের কাছে কোনো স্বপ্ন নয়, বরং মনে হয় ওর জাহান্নামের দরজা হঠাৎ খুলে গিয়ে ওকে নিজের ভেতর গিলে নিচ্ছে।

স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here