হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৫
Tahrim Muntahana
গমগমে পরিবেশ! উপস্থিত সবার চোখে মুখে অবাকতার রেশ এখনো কাটেনি। দুর্লভ কিছু হুট করে দেখলে যেমন বাকহারা হয়ে যায়, ড্রয়িং রুমে থাকা সকলেও তেমন বাকহারা। পরিচিত মেয়েটাকে হুট করে এমন রূপে দেখবে কেউ কি ভেবেছিল? মনিরা তখনো আরাফের কলার ধরেই ছিল। আরাফ! সে তো এখন পর্যন্ত কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। সে তার ভাই কে কেন মারবে? এই কথাটির উত্তর হাজার খুঁজেও পেল না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে, বরাবরের মতোই ফলাফল শূন্য। হ্যা এটা ঠিক তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট ছিল না, মায়া ছিল না, না ছিল ভালোবাসা; এটাও তো ঠিক কোনো কারণ ও ছিল না খু*ন করার। তাহলে?
অবাকতার রেশ কাটিয়ে আরাফ আশেপাশে একপলক তাকায়। সবার চোখেই সন্দেহ। ঢোক গিলে সে, মনিরা যে সবার সামনে এমন সিনক্রিয়েট করবে সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। অন্য কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল। নিজেকে শক্ত করে কলার ধরে রাখা হাতে হাত রাখলো। ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে উঠলো,
~ আর ইউ ম্যাড ভাবী? কি বলছো তুমি নিজে বুঝতে পারছো? আমার ভাইয়া কে আমি কেন মারবো?
~ তুই মেরেছিস, তুই ই মেরেছিস। তোদের মধ্যে কখনো মিল ছিল? ছিল না, রেষারেষি হতো। তোর এত ক্ষোভ ছিল যে মানুষ টাকে এভাবে মেরে ফেললি!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মিহির হাত ধরে আফরা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মুখই কিছুটা হা হয়ে আছে। মিহি একপলক মা কে দেখছে, আরেক পলক আফরা’র দিকে তাকাচ্ছে। আফরা’ই বা কি বলবে? সে তো মনিরা’র অভিনয়ে নিজেই শকড! অফিসার নোমান কিছুটা দূর থেকেই ব্যাপার টা দেখছে। এতক্ষণ এমন শান্ত পরিবেশে ঠিক মজা পাচ্ছিল না, তবে এখন মনে হচ্ছে তার আশা’র চেয়েও একটু বেশীই মজা অপেক্ষা করছে। ঠোঁট এলিয়ে হাসে সে, কিছু একটা ভেবে মিহির দিকে এগিয়ে যায়। মিহি কে নিজের কাছে টেনে আদুরে ভঙ্গিমায় বললো,
~ পপকর্ন আছে মা? মজা বেশ হবে। তুমি আর আমি ওই সোফাটাই বসে পুরো সিনেমা আই মিন ঘটনা টা দেখবো! চাইলে মিস আফরা আপনিও যোগ হতে পারেন। আই ডন্ট মাইন্ড!
নোমান কে আসতে দেখেই আফরা’র মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। কথাটা শুনে গম্ভীর মুখশ্রীটা আরেকটু গম্ভীর হয়ে যায়। গাম্ভীর্য পূর্ণ গলায় বললো,
~ আপনার চাকরি টা এখনো কেন আছে আমি বুঝতে পারছি না। এরকম সুবিধাবাদী অফিসার দিয়ে সরকার ঘাস কাটা ছাড়া আর কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না!
~ ঘাস কাটাতেও পরিশ্রম কত জানেন? রোদ নেই, বৃষ্টি নেই ঘাস কাটতেই হবে। না কাটলে ওই যে গৃহপালিত মিষ্টি গোবর প্রদানকারী অবলা প্রাণী আই মিন গরু খেতে পারবে না। খেতে না পেলে শরীর হবে না, বড় হবে না। আর বড় না হলে বাজারে দাম থাকবে না!
কথাগুলোর মিনিং আফরা সাথে সাথে বুঝলো না, নোমান যখন মুচকি হেসে আবার নিজের জায়গায় বসেছে ঠিক তখনই হুট করে আফরা’র মাথায় এলো সুবিধাবাদী অফিসার অত্যন্ত চালাক। কি সুন্দর করে তার জবাব দিয়ে দিল। পুলিশের কাজ কত পরিশ্রম, কত কত কেস, কত কত রহস্য। ঝড় বৃষ্টি দোহাই দিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে তাদের চলে না। রাত তিনটে তেও যদি ফোন আসে, আরামের ঘুম ছেড়ে দৌড়াতে হয়। আর এমন সরকারী সার্ভিস পেতে জনগণের তো একটু এন্টারটেইন করতেই হবে। নাহলে কাজে তো একঘেয়েমি চলে আসবে। সরকার দুর্বল ভেবে আমলেই নিবে না!
আফরা’র খুব হাসি পেল। হাসিটা লুকিয়ে রাখা মুশকিল। তবে এখানে হাসলে যে ঘোর বিপদ। আশেপাশের মানুষ হয়তো এখনই শোলে চড়াবে। হাসলো, তবে নিশব্দে আড়ালে। অফিসার নোমান কোণা চোখে হাসিটা পরখ করেও নিল। সকল এন্টাইটেইন যেন সে পেয়ে গেছে, নিজ আসন থেকে উঠে আরাফের সামনে গিয়ে বললো,
~ উনি যা বলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার কোনো জবাব আছে?
আরাফ মাথা তুললো, নোমান কে দেখেই মনিরা কলার ছেড়ে দিয়েছে। তবে চোখের জল এখনো দৃশ্যমান দু নয়নে। আরাফ নোমানের হাত ধরে বললো,
~ এই মহিলা আমাকে ফাঁসাতে চাইছে স্যার। আমি কেন আমার ভাই কে মারবো? আমাদের রক্ত তো একই। নিজ রক্তকে কেউ এভাবে মারতে পারে? আমি সত্যিই মারিনি, আমি তো নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না এমন একটা কাজ কে করলো? আর এই মহিলা কি জানতো আমাদের দুভাইয়ের মধ্যে কত মিল ছিল? জানতো না, কারণ এই মহিলা আমাদের সংসার কে আপন করতে পারেনি। ভাইয়ার সাথেও ভালো ছিলনা, আমি প্রায় ই ঝগড়ার আওয়াজ শোনতাম। এমনকি দু দিন আগেও কি নিয়ে যেন ঝগড়া হচ্ছিলো। আমার তো মনে হচ্ছে এই মহিলাই আমার ভাই কে মেরেছে।
গুছানো কথাগুলো একটানা শেষ করেই আরাফ হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। পরপর কয়েকবার নাকের পাটা ফুলিয়ে শ্বাস নিলো, মুখ হা করে শ্বাস ফেললো। বুকটা কেমন পটলা মাছের মতো উঠানামা করছে। বর্তমানে এই বুকটাই যে কত ভয়, তা একমাত্র সেই জানে। এতক্ষণ নিশ্চুপ সবকিছু দেখছিলেন আশরাফ উদ্দিন। বড় ছেলে কে হারিয়ে অনেকটা অচেতনের মতোই ছিলেন এতক্ষণ। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। এখন আর না বলে পারলেন না। এক ছেলে কে হারিয়েছে ঠিক, তবে আরেক ছেলে কে তো বিনা দোষে এত বড় শাস্তি পেতে দিতে পারেন না। নরম সুরে ছেলের কথায় তাল মিলিয়ে বললেন,
~ আমার ছেলে ঠিক বলেছে। এই মেয়ের চরিত্র ভালো না। আমার ছেলেকে সুখ দিতে পারেনি, অশান্তি হতো প্রতিদিন। শেষ মেষ আমার ছেলেকেই কেড়ে নিলো।
এতক্ষণ যারা আরাফের দিকে ঘৃণ্য, সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল; তারাই এখন মনিরার দিকে তাদের সন্দেহ দৃষ্টি তাক করে আছে। এদের আর কাজ নেই! তবে মনিরা কে এদের দুজনের কথায় বিচলিত হতে দেখা গেল না। বরং খেলা টা জমে গেল বলে তার চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো। এরা তাকে দোষ দিলেই তো সে পাল্টা দোষ দিতে পারে প্রমাণ সাপেক্ষে!
অফিসার নোমানের দিকে শিতল দৃষ্টি তাক করে বললো,
~ আপনি তো একজন পুলিশ অফিসার। আপনার পরিধি বিশাল। কার চরিত্র কেমন বের করা তো আপনার কাছে কঠিন কিছু না? দশ বছরের সাংসারিক জীবনে দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরে পা দিই নি, স্বামীর অবাধ্য হয় নি; বিনিময়ে এদের লা* থি উ* ষ্টাই খেয়েছি। যে যেভাবে পারে সেভাবেই ব্যবহার করে গেছে। এতিম মেয়ে, করার ছিল না তো কিছু। সব কিছু সহ্য করে গেছি, একমাত্র কারণ আতিকুর। ওর ভালোবাসা আমাকে এদের কথা শুনেও এ সংসারে টিকিয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এরা নরপশু’রা শেষমেষ তাও কেড়ে নিলো। এখন আমাকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই। কেউ নিজ ইচ্ছায় নিশ্চয়ই নিজের খারাপ চাইবে না?
সদ্য স্বামী হারা মেয়েটার কথা যেন পুরো বাড়ি স্তব্দ করে দিলো। আবেগপ্রবণ মানুষ মেয়েটার ভবিষ্যত ভেবে চোখের জল ফেলতেও ভুললেন না। অফিসার নোমান মনিরা’র কথাগুলো যত্ন নিয়ে শুনলেন। আশরাফ উদ্দিন এবার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নোমান হেসে জবাব দিল,
~ আমি এখানে আসার আগেই কার চরিত্র কেমন যাচাই করেই এসেছি। সেসবে না এগোয়, মিসেস মনিরা আপনার অভিযোগের সাপেক্ষে কোনো প্রমাণ আছে? আইন সন্দেহের দৃষ্টিতে হাত কড়া পড়ায় ঠিকই তবে শাস্তি দেয় না।
~ খু*নের সময় আমি থাকলে নিশ্চয়ই নিজেকে বিধবা হতে দিতাম না। সরাসরি কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই তবে আপনাকে এমন কিছু দেখাতে পারি যার ফলে আপনিও বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন ভাই হয়ে ভাইয়ের কতবড় শত্রু!
মনিরা নিজের ঘরে ছুটে যায়। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে বলে রেখে দেওয়া প্রমাণ গুলো আজই কেমন তাকে সাহায্য করছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসে। নোমানের হাতে কয়েকটা ছবি তুলে দিতেই নোমান তীক্ষ্ম চোখে তা দেখে। একবার মনিরা’র দিকে তাকায়, আরেকবার আরাফের দিকে। তার এক ছুটে আরাফের চোখের সামনে ছবি গুলো ধরে বলে উঠে,
~ এগুলো কি? ভাইয়ের বউকে ধর্ষণের চেষ্টা? এতবড় দোষ করে আপনি বড় বড় কথা বলছেন কি করে? আর আপনি মি আশরাফ উদ্দিন শুনেছি আরেকটা বিয়ে করেছেন ছোট মেয়ে দেখে। এবার তো সবটা ক্লিয়ার হয়ে গেল মিসেস মনিরা এ বাড়িতে কতটা সেইফ ছিল! এর পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবেন?
আফরা’র শাশুড়ি এতক্ষণ অজ্ঞান ছিলেন, তাকে নিজের ঘরেই শুয়িয়ে রাখা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরতেই বাইরের চেঁচামেচি কানে এসে বারি খায়। তার বুঝতে বাকি থাকে না কি হচ্ছে! এক ছুটে বাইরে বের হয়। নোমানের কথা শেষ হতেই বলে উঠে,
~ আমার বউমা নির্দোষ, দিনের পর দিন মেয়েটার উপর এরা বাপ ছেলে অত্যাচার করে গেছে। আমি কিছু বললেই আমাকে ঘরে আটকে রাখতো। সেদিন ও এই কুলা*ঙ্গার আমাকে ঘরে আটকে রেখেছিল। আফরা মেয়েটা না আসলে তো মনিরা ধর্ষিতা হয়ে যেত। তখন কার কাছে বিচার চাইতাম?
পালাক্রমে রূপ বদল হচ্ছে বাড়ির, বাড়ির মানুষের। আফরা নিজের নাম শুনে একটু ভড়কেই গেছে, নোমানের দৃষ্টি যে তার উপরেই পড়েছে। নিজেকে ঠিক করে বললো,
~ আমি সেদিন মিহিকে পড়াতে এসেছিলাম, ভেতর থেকে আপুর কান্নার আওয়াজ শুনে রান্না ঘরের খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই এই বদমাশ টাকে দেখতে পাই আপুর সাথে জোর করছে। আমার তেমন সামর্থ্য ছিল না এই লোকের সাথে ফাইট করবো। একবার ভয় পেয়ে চলে যেতেও চেয়েছিলাম তবে বিবেক বাঁধা দিয়েছে। সাহস করে কলিং বেল চাপতেই এই লোকটা নিজের কাজে সফল হতে পারে নি। আমি আতিকুর স্যার কে পুরো ঘটনাটাই জানাই। স্যার তো এত রেগে গিয়েছিল, মনে হলো এই লোককে পেলে মে* রেই ফেলবে। তার পরেই শুনি এই লোক কে কেউ মে* রে ফেলতে চেয়েছিল, বাম হাত কেটে দিয়েছে। আমার তো এখন মনে হচ্ছে স্যার ই রাগের বশে এমন করেছে। আর এই লোক হয়তো বুঝতে পেরেছিল, তাই আক্রোশ মেটাতে নিজের ভাইকেই মে*রে ফেলেছে। সবটাই আমার দেখা-অদেখা কিছু সাক্ষ্য। আপনি তদন্ত করে দেখবেন।
ভাবালেশ কথা গুলো বলে থামলো আফরা। এখানেই প্রায় সবটুকুই সত্য। আতিকুর কে সেদিনের ঘটনা সে জানিয়েছিল, মনিরা’র আড়ালেই। রেগেও গিয়েছিল আতিকুর। সে তো ভেবেও ছিল আরাফের এমন অবস্থা আতিকুর ই করেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্য কেউ! আরাফের পক্ষে এক হাত দিয়ে শক্তিশালী এক পুলিশ অফিসার কে মারা সম্ভব নয়। তবে সে পরের টুকু নিজের সন্দেহ থেকেই মনিরার হয়ে বলেছে। না হলে এই লোকের থেকে মনিরা মিহি এবং তার তিনজনেরই বিপদ। অন্যদিকে মনিরা অবাক হয়ে আফরা’র দিকে তাকিয়ে আছে। সে তো খেলাটা ঘুরিয়ে খেলতে চাইছিল। তার কাছে স্ট্রং কোনো জবাব ও ছিল না এই ছবিগুলো ছাড়া। মেয়ে টা এক নিমিষেই কেমন আরাফের দোষী হওয়ার চান্স একশো তে নব্বই করে দিলো! তার আর কিছুই করতে হলো না। অফিসার নোমান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবলেন। তারপর মনিরা কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
~ একটা কেস লিখে আসবেন থানায় গিয়ে। ছবি গুলো আমি নিয়ে যাবো। আর আপনাদের মা-মেয়ের সুরক্ষার জন্য দুজন মহিলা কনস্টেবল রেখে যাবো। ভেঙে পড়বেন না, শক্ত করুন নিজেকে।
হুট করেই মনিরা কেঁদে দিলো শব্দ করে। আফরা এগিয়ে গেল। কাঁদে ভরসার হাতের ছোঁয়া পড়তেই মনিরা আফরা’র বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আফরা অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই কান্না অভিনয় নয়, এই কান্নাগুলো যে বুকের জমায়িত কষ্টগুলোর প্রতিচ্ছবি। সে আজ মস্ত বড় কাজ করেছে। একদিক মেয়ের ভবিষ্যত মেপে মস্ত বড় বাঁধা কে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, আরেক দিকে কেউ যেন তার মেয়েকে চরিত্রহীন বাবার মেয়ে না বলতে পারে সেটাও ঠিক করে রাখলো। এই অভিনয় করতে তার কত কষ্ট হয়েছে তা কি মিহি আফরা জানে? কেউ তার মনের ক্ষত গুলো দেখতে পাবে না। যতক্ষণ না সে দেখাবে!
অফিসার নোমান কিছুক্ষণ মনিরা’র কান্না মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হুট করে তার মনে হয় বুকে কেমন চিনচিনে ব্যাথা করছে! পাত্তা না দিয়ে আরাফের সামনে গিয়ে বললো,
~ আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে মি. আরাফ। চলুন!
চেতে উঠে আরাফ। নোমানের কলার চেপে ধরে গর্জে বলে উঠে,
~ তোর সাহস কি করে হলো আমাকে এরেস্ট করার। চিনিস আমাকে? তোর চাকরি খেতে আমার দু মিনিট সময় ও লাগবে না। আমাকে এরেস্ট করতে এসেছিস?
নোমান হেসে উঠলো। দুই মাসের চাকরি জীবনে এই নিয়ে দুইবার ক্রিমিনাল তার কলার চেপে ধরলো। এতে সে বিব্রত হয় না। বরং তার হাসি পায়। হাসতে হাসতেই আরাফের হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে মুচড়ে ধরে বললো,
~ আমার চাকরি খাওয়ার আগে তুই নিজেকে নিয়ে ভাব, আগে নিজেকে বাঁচা!
ধাক্কা দিয়ে কনস্টেবলের হাতে আরাফ কে দিয়েই নোমান হনহন করে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। আফরা’ও আর এক মুহূর্ত ও দেরী করলো না, মনিরা কে নিয়ে উপরে চলে গেল। এখানে থাকলেই কথা বাড়বে সে বুঝতে পেরেছে। ঘরে গিয়ে তিনজনই কেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তিনজনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে খানিক হাসলো। আফরা মনিরা’র পাশে বসে বললো,
~ কি অভিনয় করলেন আপু! আমি আর মিহি তো একদম শকড!
মনিরা হাসলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মিহির দিকে তাকালো। হেসেই বলে উঠলো,
~ স্যার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ট্রাজেডি নাটক ম্যাকবেথ, নাটকের শেষের দিকে লেডি ম্যাকবেথ যখন আত্মহত্যা করে তখন জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ম্যাকবেথ বলেন,
Life’s but a walking shadow, a poor player, That struts and frets his hours upon the stage, And then is heard no more.
এই বিখ্যাত ট্রাজিক নাটকটি ইঙ্গিত দেয়, ‘জীবন আসলে কিছুই না, শুধু কিছুদিন অভিনয় করে যাওয়া ছাড়া!’
মনিরা থামলো। মেয়ের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আফরা’র দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো,
~ আমার জীবনের ম্যাকবেথ আত্মহত্যা না করলেও তাকে তো কেউ হ*ত্যা করেছে। তবে ম্যাকবেথের মতো আমি কিন্তু জীবনের প্রতি আগ্রহ হারায় নি। আরো জীবনে প্রতি আগ্রহ, মায়া, ভালোবাসা ফিরে পেয়েছি। ট্রাজিক নাটকটার সারমর্ম ধরে একটু নাহয় অভিনয় করলামই। জীবন যে রঙ্গমঞ্চ! সবাই অভিনয়ের সামিল! কেউ সেরা, কেউ বা কিছুটা পিছিয়ে!
~ ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট বোম্বেতে পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যদের বিদায় অনুষ্ঠানে ক্যাপ্টেন গনি বলেন
“তোমরা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দেবে বাঙালি সৈন্যরা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতই সক্ষম”।
তাঁর হাত ধরেই কিন্তু সেনানিবাস, সেনাবাহিনীর প্রসার। ক্যাপ্টেন গনি’র মতো আমিও বলবো,
“এমন ভাবে নিজেদের গড়ে তুলো, এমন ভাবে নিজেদের প্রকাশ করো পুরো বিশ্ব যেন বুঝতে পারে, জানতে পারে বাঙালি সৈন্য রা সক্ষম, বাঙালি সৈন্য রা অন্যান্য জাতির মতোই সতন্ত্র!
গাম্ভীর্যের সহিত কথাগুলো শেষ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক’জন সেনা সদস্যের দিকে তাকালেন লেফটেন্যান্ট নূরুল আলম সিদ্দিকী! তারা সবাই নিজ নিজ দিক থেকে সতন্ত্র। এখানে কেউ কেউ যুদ্ধকালীন বীরত্বের
সম্পাদনা, সেনাবাহিনী পদক, অসামান্য সেবা পদক, বিশিষ্ট সেবা পদকে ভূষিত! আবার কেউ কেউ জাতিসংঘ শান্তি পদকে। উপরোক্ত কথাগুলো তারা হাজার বার শুনেছে। যেদিন থেকে স্বপ্নের পাখা মেলে দেশ সেবায় নিয়োজিত হয়েছে, আর এই মানুষ টার সাথে দেখা হয়েছে সেদিন থেকে মধ্যবয়স্ক লোকটি তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠিত হতে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছে, দেশ সেবায় কিভাবে জীবন বাজি রেখে লড়াই করতে হয় হাতে ধরে শিখিয়েছে। তাই তো আজ তারা এত এত সম্মাননা, পদকে ভূষিত! লেফটেন্যান্ট নুরুল আলম সিদ্দিকী’র কথাকে সম্মান জানিয়ে সবাই একসাথে স্যালুট দিয়ে উঠতেই হাসলেন তিনি। হাতের ইশারায় বসতে বলতেই একপ্রকার হামলে পড়েই বসলো সবাই। নন-কমিশন্ড অফিসার জিয়াউল সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বললো,
~ এরপরের টুকু আমি বলি স্যার?
সবার দৃষ্টিই এখন জিয়াউলের দিকে। ছেলেটা কয়েকমাস হলো সেনাবাহিনী তে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যে নিজের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে ছাপিয়ে গেছে অনেক কে। তবে কথায় কথায় বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসার জন্য সেনানিবাসে ফানি ম্যান হিসেবে বেশ আলোচিত, পরিচিত। নুরুল আলম সিদ্দিকী বরাবরের মতো একটা ধমক দিতে গিয়েও চুপ করে যায়। ছেলেটা প্রত্যেক দিন ই তার কাছে আবদার করে। আজ নাহয় নিজের গাম্ভীর্য পূর্ণ ফর্ম টা দূরে রাখা যাক। মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিতেই এক লাফে উঠে দাঁড়ালো জিয়াউল। সবার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ আমার আই মিন স্যারের এসব কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য।
এইসব উৎসাহব্যঞ্জক কথার সাথে ক্যাপ্টেন গনি ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুইটি পাইওনিয়ার কোম্পানি নিয়ে ঢাকায় ফিরে পিলখানায় বর্তমান বিজিবি হেডকোয়ার্টার্সে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে তিনি প্রশাসনের কাছে সৈন্যদের উপযুক্ত আবাসস্থল চান। তিনি রাজধানীর উত্তর দিকের কুর্মিটোলাকে সেনানিবাসের উপযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেন। দিনের পর দিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এখানে জঙ্গল পরিষ্কার করে ব্যারাক, প্যারেড গ্রাউন্ড ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়।
তাঁর একক সংগ্রামে যদি সেনাবাহিনীর এত প্রসার হয়েছে তাহলে আমাদের দলগত প্রচেষ্টার ফলে কত কিছুই না সম্ভব। যদি থাকে ইচ্ছা শক্তি, দেশপ্রেম তাহলে আমাদের দ্বারাই বাংলাদেশ প্রসাশন অনেক সুনাম অর্জন করবে। আমাদের ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে হবে না, বাঙালি জাতি আমাদের উপর যে ভরসা স্থাপন করেছে তার যোগ্য প্রতিদান আমাদের কেই ফেরত দিতে হবে। দেশদ্রোহীর ভুমিকায় থাকা সকল কে আইনের আওতায় এনে পূর্ণাঙ্গ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এমন ভাবে সংগ্রাম করতে হবে পুরো বিশ্ব যেন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দিকে! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তা আমাদের সর্বক্ষেত্রে বহাল রাখতে হবে। আমাদের জীবন যুদ্ধের সামিল! শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতে হবে।
কথাগুলো শেষ করেই জিয়াউল আবার হাসলো। মাথা ঝুকে ধন্যবাদ জানাতেই নুরুল আলম সিদ্দিকী রাগী কন্ঠে বললেন,
~ তোমাদের বলেছিলাম কারোর সামনে মাথা ঝুঁকবে না। সে হোক, মস্ত বড় পালোয়ান। তোমাদের দায়িত্ব হলো কর্মকর্তা দের সম্মান জানিয়ে স্যালুট দেওয়া, মাথা ঝুঁকে নিজেকে কৃতদাস প্রমাণ করবে না। এবার যার যার কাজে যাও।
সদস্যবৃন্দ চলে যেতেই নুরুল আলম সিদ্দিকী মাথার টুপি টা খুলে ফেললেন। জিয়াউল ছেলেটা তার খুব পছন্দের। শুনতে শুনতে কেমন মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিতেই তার নেত্রপল্লবে ভেসে উঠে কঠোর এক মুখশ্রী। ঈষৎ কেঁপে উঠেন তিনি। চোখ খুলে টেবিলে থাকা পানির গ্লাস টা হাতে তুলে নেন। ঢকঢক করে পুরো পানি পেটে চালান করেই উঠে দাঁড়ান। অতিত মনে করলে বুকে শুধু পোড়ায়! হাঁটার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে ভেসে আসে কোনো এক গম্ভীর কন্ঠ,
~ আব্বু!
নুরুল আলম সিদ্দিকীর মুখে আপনাআপনিই হাসি ফুটলো। পেছন ঘুরে ছেলের মুখ দেখে হাসি চওড়া করে এগিয়ে আসলেন। বললেন,
~ এখনি চলে আসলে?
~ আমার তিনমাসের বিরতি চাই আব্বু, এট এনি কস্ট! ছুটি মঞ্জুর করার দায়িত্ব তোমার। মায়ের সাথে সফরে যাবো, অনেক দিন সময় দেওয়া হয় না আম্মুকে। আমিও একঘেয়েমি কাটাতে চাই!
নুরুল আলম সিদ্দিকী কিছুক্ষণ ভাবলেন। তিনমাসের ছুটি একটু জটিল ই হবে। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। ছেলে যে নিজের জন্য কিছুটা সময় চেয়েছে এই অনেক। মাথা নেড়ে সায় জানাতেই দুজন মানুষ দু’দিকের পথ ধরলো! তবে দুজনের ঠোঁটের ভাজেই সুক্ষ্ম এক হাসি!
প্রকৃতিতে এখন গোধূলি বিকেলের শুরু।
বাংলার জল-মাটি-হাওয়ার অকৃত্রিম সুধা
রূপ-রস-গন্ধ একেবারে ঢেলে দিয়েছে যেন। আজ সূর্যের তেজ নেই বললেই চলে। বৈশাখের তাপদাহ’ও আজ ছুটি নিয়েছে। ঠান্ডা প্রকৃতি যেন আগ থেকেই জানান দিচ্ছে কালবৈশাখী ঝড়ের আগমন। নোমানের পাশেই থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে আরাফ। এদিকে প্রকৃতির শান্ত রূপে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে নোমান ও শান্ত দৃষ্টি ফেলে ফোন দেখে যাচ্ছে। গাড়িতে বসেও বার কয়েক শাসানো হয়েছে তাকে। তবে সেসবের পাত্তা সে দেয় নি। হুট করেই ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে কনস্টেবল কে গাড়ি থামাতে বলে নোমান। ছোট খাটো এক জঙ্গলের পাশেই। কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করে আরাফ কে নিয়ে বেরিয়ে যায় সে। প্রাকৃতিক কাজ সারার বাহানাতেই! আরাফ কিছুক্ষণ অবাক চোখে নোমান কে দেখেই বললো,
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৪
~ আমার দরকার ছিল না, আমাকে আনলেন কেন?
নোমান হাসলো। গুনগুন করে গান গেয়ে কাজ সারতেই উঠে দাঁড়ালো সে। আরাফের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
~ আমাকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ান! পেছনে ঘুরবেন না! আজ রাতের মধ্যে শহর ছাড়বেন!