হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২১

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২১
Tahrim Muntahana

অপরাহ্ন! দিগন্তে সূর্যের আজ খোলামেলা পদার্পণ। কি জ্বালাময়ী তার রূপের সুধা। জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ভস্ম করে দিবে গোটা পৃথিবীকে। অগ্নি রূপের তান্ডবে স্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে দিবে অল্প অল্প করে, যখন স্ফুলিঙ্গের ক্রমান্বয় বেড়ে যাবে, ধরণী অতিষ্ঠ হবে, ওষ্ঠাগত হবে মানব জীবন, সূর্য টাও তখন মায়াময়ী রূপ ধারণ করে। পশ্চিমে অগ্রসর হয়। ডুবে যায় দিগন্তের অন্তরালে। কিন্তু জমিনে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তে মাংসে গড়া সূর্য টার যে মায়া নেই। দিগন্তে ঝুলে থাকা সূর্যের মতো সে ডুবে না, রাতের আঁধারে আরো প্রকট হয়ে উঠে।
আগুনে আগুনে সংঘর্ষ হলে পুড়ে কারা? আগুন তো পোড়ায়। আফরা-মিরা দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি। দুজনের চোখ‌ই রক্তিম, চোখে মুখে কঠোরতা। একে অপরকে কথার বেড়াজালে আটকে দিতে উদ্যত। ব্যান্ডেজের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ক্ষতের দিকে ইশারা করে মিরা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো,

~ তোকে আমি একবার বলেছি, তুই আর পা বাড়াবি না! মানে না! আমার কথা শুনে তোর মজা মনে হচ্ছে? বাকিটা আমি দেখে নিবো!
প্রতিত্তরে আফরাও কর্কশ কন্ঠে বললো,
~ তুই হয়তো ভুলে গেছিস, এর থেকে চারগুণ ক্ষত নিয়ে আমি হেসেছি, দৌড়িয়েছি। আমাকে তোর দুর্বল মনে হয়?
মিরা চোখ বুজে শ্বাস নেয়। মেয়েটাকে কি করে বুঝাবে, তার ভেতর পুড়াচ্ছে। এমন পরিণতি সে দেখতে পাচ্ছে না। শান্ত সুরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~ তোর কি আমার উপর ভরসা নেই, বিশ্বাস নেই?
মিরার শান্ত সুর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আফরাও শান্ত হয়। টুলের উপর বসে ভাবালেশ বললো,
~ কিছুদিন আগে তুই বিশ্বাস করতে না করেছিলি, তাই বাধ্য হয়ে করিনি!
কন্ঠে রসিকতা। ক্ষেপে উঠে মিরা। আফরা মিরার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো, আবার বললো,
~ আমি নিজেকেই বিশ্বাস করি না, তোকে কি করে করবো? আমার কাজে আমি তোকে সাময়িক ভাবে সাথে নিতে পারি, তবে যা আমার তা আমার‌ই। তাই ছেড়ে দিতে পারি না তো। আমার কাজ আমি যেভাবে করবো, তুই পারবি? বাচ্চা দের মতো খামখেয়ালিপনা করে কি বুঝাতে চাচ্ছিস?

টনক নড়ে মিরা’র। নিভে যায় সে। কোনো এক দিন ঠিক এই কথাগুলোই সে আফরা কে বলেছিল। আজ মেয়েটা কেমন ফেরত দিচ্ছে তাকে। আফরা মিরা’র চুপ হয়ে যাওয়া দেখে মুচকি হাসে। বহুদিন পর পাল্টা জবাব দিতে পেরে ভালো লাগছে। মিরা কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে আফরা’র পাশে বসলো। বললো,
~ যেহেতু লক্ষ্য এক, প্ল্যান এক; বন্টন করতে সমস্যা কি? খুব ক্ষতি তো হবে না!
~ আমি কখন বললাম ক্ষতি হবে? তবে তোমার ইমোশনাল ঘ্যানঘ্যানানি টা আমার পছন্দ নয়, সময় থাকতে শুধরে নাও। নাহলে এক লাথি দিবো আকাশে উড়ে যাবি!
এবার মিরা হাসলো‌। কিছু বললো না। নিরবতায় কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত। আফরা উঠে দাঁড়ালো, পড়নের উড়না টা ঠিকঠাক করে বলে উঠলো,

~ দুটো বাজতে চললো, এবার একটু অফিসার নোমান কে দর্শন দিয়ে আসি।
হাঁটতে শুরু করলো আফরা। মিরা অনিমেষ আফরা’র হাঁটার গতির দিকে তাকিয়ে র‌ইলো। মেয়েটা’র হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, হয়তো ঝাঁকুনি লাগার ফলে কষ্টটা দ্বিগুন হচ্ছে। তবুও খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে না। মিরা’র চোখ ভিজে আসতে চায়। এতে নিজেই বিরক্ত হয়। এমন ইমোশনাল সে হতে চায় না, তবে সে বারবার ব্যর্থ হয়। আচমকা দাঁড়িয়ে গিয়ে আফরা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
~ আদিল মাহমুদ কে ভালোবাসিস?
চমকিত দৃষ্টিতে পেছনে তাকালো আফরা। মিরা’র চোখে শুধুই প্রশ্ন, নেই কোনো সন্দেহ। মিহি হাসে আফরা, মাথা কাত করে কিছুক্ষণ ভাবার অভিনয় করে বলে উঠে,

~ তেলে জলে কখনো মিশ খায়? নাকি কচু পাতায় পানি আটকে থাকে? লবণ দিয়ে কখনো চিনির কাজ করা যায়? তাহলে ভাবছিস কি করে? আফরা আদিলে মিশ খাবে, ভালোবাসা’র জালে আটকে থাকবে, তিক্ত কথার বদলে প্রেমের বুলি মুখ থেকে নিঃসৃত হবে! ভাবনা টা একটু বেশীই হয়ে গেল না?
হেঁটে রাস্তায় দাঁড়ায় আফরা। মিরা হাসে, তৃপ্তির হাসি! আফরা’র উত্তরে সে খুশি হয়েছে ঢের বুঝা যাচ্ছে। কিছু একটা মনে হতে সেও তাড়াহুড়ো করে ঘরে চলে যায়। রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে পরবর্তী গন্তব্যে!

রিকশা থামে পুলিশ স্টেশনে। ভাড়া মিটিয়ে আফরা নেমে পড়ে। একপলক চারপাশ নজর ঘুরিয়ে হনহন করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। কনস্টেবল আজাদ আলী এসেছিলেন নোমানের সাথে কথা‌ বলতে। আফরা কে দেখে এগিয়ে আসেন তিনি। জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলেন,
~ আপনি?
আফরা তাকায়, চিনতে অসুবিধা হয় না। সরল কন্ঠে জবাব দেয়,
~ অফিসার নোমান আছে? আসতে বলেছিল!

আজাদ আলী মাথা নাড়ান। দৃষ্টি তে কিছুটা সন্দেহ। বারবার তিনি আফরা’র হাতের দিকে তাকাচ্ছেন। ব্যাপার টা আফরা বুঝতে পেরেও চুপ থাকে‌। ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করে! আজাদ আলী থতমত খেয়ে যান, দাঁত কেলিয়ে হেসে হাঁটা ধরেন। আফরা আর কিছু বলে না। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হাঁটা থাকে।
ব্যস্ততার সহিত ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিল নোমান। আতিকুর আর আশরাফ উদ্দিনের কেস নিয়ে বিরাট ঝামেলা বেঁধে গেছে। উপর থেকে বারবার নির্দেশ আসছে, কেস টি তাড়াতাড়ি সমাধান করার। অথচ সে কোনো দিশাই খুঁজে পাচ্ছে না। দুটো ঘটনার মোটিভ এক কিনা সেটাই এ পর্যন্ত ধরতে পারে‌নি। খু* নী পর্যন্ত পৌঁছাবে কি করে? দরজায় নক পড়ে। ফাইলে দৃষ্টি রেখেই বলে,

~ ইয়েস কাম ইন!
আফরা সরাসরি ভেতরে ঢুকেই চেয়ার টেনে বসে পড়ে‌। কিছুক্ষণ চুপ থেকেও যখন নোমানের সাড়া পাওয়া যায় না। তখন নিজে থেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলে উঠে,
~ আপনাদের থানায় তো দেখছি আতিথেয়তার বালাই নেই! এলাম পাঁচ মিনিট হলো, এ পর্যন্ত চায়ের অফার টুকু পেলাম না। বড়‌ই হতাশা জনক!
মেয়েলি ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠ শুনে কিছুটা চমকায় নোমান। সে ভেবেছিল কোনো কনস্টেবল এসেছে। ফট করে মাথা তুলে আফরা কে দেখেই ভ্রু কুঁচকায়। মেয়েটি থানায় কেন? ভুল ভাল দেখছে নাকি? পরক্ষণেই মনে পড়ে, সেই বলেছিল। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে, দুটো কেসের চক্করে সে পাগল হয়ে যাবে‌। আফরা’র কথার জবাবে বললো,
~ আপনি তো স্পেশাল, তাই শুধু চা দিয়ে আপনাকে অপমান করি কি করে বলুন মিস আফরা?
নোমানের নজর পড়ে আফরা’র হাতের উপর। কপালে বড় সড় ভাজ পড়ে। তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে হাতের উপর, সন্দেহী কন্ঠে বললো,

~ হাতে ব্যান্ডেজ কেন?
~ চোট পেয়েছি বলেই ব্যান্ডেজ! মানুষ নিশ্চয়‌ই লোক দেখানোর জন্য ব্যান্ডেজ করে না! কি জন্য ডেকেছেন সে কথায় আসুন!
~ ওকে সে কথায় আসছি তাহলে! কাল রাতে কোথায় ছিলেন?
~ আমি আকাশে, পাতালে, বাতাসে, পানিতে যেখানেই থাকি না কেন, সেটা জেনে আপনি কি করবেন? নিশ্চয়ই পুলিশ জিপ নিয়ে ছুটে যাবেন না!

নোমান চোখ রাঙিয়ে তাকায় আফরা’র দিকে। ভারী বেয়া* দব তো মেয়েটা! দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ আশরাফ উদ্দিন যে রাতে মারা গিয়েছে অর্থাৎ কাল রাতে আপনি সে বাড়ি থেকে আনুমানিক নয়টাই কি সাড়ে নয়টাই বেরিয়েছেন। তার পরেই আশরাফ উদ্দিন কবর দেখার নাম করে বেরিয়ে যায় অথচ সে কবরস্থানে যায় নি। সকালে তাকে মৃত হিসেবে পাওয়া যায়, গু* লি করে হ* ত্যা করা হয়েছে। আজ আপনার হাতে ব্যান্ডেজ! আমি ঠিক কি ইঙ্গিত করছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

~ আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিন না! আপনাদের মতো আইন কি আর আমি বুঝবো?
আফরা’র হেঁয়ালি উত্তর। রাগে দাড়িয়ে যায় নোমান। চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠে,
~ আপনার হেঁয়ালি গুলো প্রমাণ করছে না আপনি লুকাচ্ছেন কিছু? যাই হোক, আপনি আসতে পারেন। আপনি যেহেতু আমাদের সাথে কো-অপারেট করবেন না! আমি লিগ্যাল স্ট্যাপ নিতে বাধ্য হবো! রিমান্ড মঞ্জুর হবে, আমাদের কত কৌশল জানা আছে!

আফরা উঠে দাঁড়ায়। টেবিলে দু’হাত রেখে একটু ঝুঁকে মুচকি হাসে। রসিকতা কন্ঠে বলে উঠে,
~ বেস্ট অফ লাক মি. নোমান! আপনার থ্যারাপি গুলো হজম করতে আমি প্রস্তুত। তবে একটা কথা বলবো?
নোমান রাগ চেপে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আফরা চোখ ছোট ছোট নোমান কে দেখে হেসেই বলে উঠলো,
~ আপনাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে! রূপ তো নয় যেন শত মেয়ের হার্ট অ্যাটাকের কারণ!
থতমত খেয়ে যায় নোমান। মেয়েটা তার সাথে ফ্লাট করলো? পুলিশ স্টেশনে এসে পুলিশের সাথে ফ্লাট? ব্যাপার টা ঠিক হজম হচ্ছে না নোমানের। মিনিট খানেক দরজার দিকে থম মেরে তাকিয়ে রয়। ততক্ষণে হয়তো আফরা পুলিশ স্টেশনে ছেড়ে চলে গেছে। হুট করে ফিক করে হেসে দেয় সে। আজব প্রকৃতির মেয়ে! অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে বের হয়ে যায়,

~ ভেরী ডিফারেন্ট ওমেন! আই লাইক দিস এটিটিউট!
…..
~ আদিল অফিসে আছে?
মেয়ে টি আড় দৃষ্টিতে মিরা কে দেখে। বস কে সরাসরি নাম ধরে ডাকায় হয়তো অবাক ‌ও হয়েছে‌। জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলে,
~ আপনি কে?
~ সেটা বলা জরুরি নয়, আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা জরুরি!
মেয়েটির হয়তো রাগ হয়। তবে প্রকাশ করা পথ নেই‌। নরম কন্ঠেই বললো,
~ জি স্যার অফিসেই আছেন। আপনার আগ থেকে এপয়েন্টমেন্ট ছিল? কার্ড দেখান প্লিজ!
মিরা আরেকটু এগিয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে উঠে,
~ কাছের মানুষের কাছে যেতে এপয়েন্ট লাগে?

কথাটা বলেই মিরা হাঁটা ধরে। মেয়েটা একদম থতমত খেয়ে যায়। কি বলে গেল? কাছের মানুষ? কয়জন লাগে? মেয়েটি থতমত খেয়েই বসে থাকে। আগে জানতো বস মেয়ে বিদ্বেষী! গার্লফ্রেন্ড তো দূর মা, বোনের সাথেও থাকে না। অথচ আজ সে জানলো তাদের মেয়ে বিদ্বেষী নামক বসের দু দুটো সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড আছে।
মিরা কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে আসে। পেছনে ঘুরে মেয়েটিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে হেসে নিজের ফোন বের করে সামনে ধরে। চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। ওয়ালপেপারে মিরা আর আদিলের যুগলবন্দী ছবি। একেঅপর কে জড়িয়ে ধরে আছে। মিরা লজ্জামাখা হাসি দিয়ে আবার এগিয়ে যায়। বোকা মেয়েটি বুঝতেও পারলো না, সব ইডিটের কামাল। মিরা নিজেকেই নিজে বাহুবা দেয়। হুট করে মাথায় এসেছিল বলেই তো আজ আদিলের মুখোমুখি হতে পারছে। নাহলে লোকটা কে তো অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না।

রিলেক্সে বসে ছিল আদিল। হাতে তেমন কাজ নেই! সরাসরি নক পড়ায় কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে ভ্রু। সে তো বলে দিয়েছে, কেউ এলে ফোন করে আসতে! তাহলে? দরজা খুলে দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে।
মিরা সবে দরজায় পা দিয়েছে। আদিল কে দেখেই বুকে হাত দিয়ে পড়ে যাওয়ার ভান করে বলে উঠে,
~ উপস, বুকে লাগলো মনে হলো! এত সুন্দর কেন আপনি? নজর লেগে যাবে তো!
আদিল গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে মিরা কে দেখে। কয়েক মুহূর্ত দেখে শান্ত স্বরে বললো,
~ দুই বান্ধবীর ক্যারেক্টারের নমুনা দেখছি এক‌ই! তা ব্যবসায় কেমন চলে?
গাঁয়ে মাখে না মিরা। এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠে,

~ আপনাকে খুব মিস করছিলাম জানেন? তাই তো অসুস্থ বান্ধবী কে ফেলেই চলে আসলাম।
~ কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন?
~ বারে প্রিয় শত্রুর কাছে আসতে পারি না?
মিরা ভাবালেশ উত্তর দিয়ে আদিলের নিজস্ব কেবিনে ঢুকে পড়ে। চেয়ার টেনে বসে, এসির রিমোট হাতে তুলে নেয়! একবার বাড়ায়, একবার কমায়! আদিল আজ বড়‌ই শান্ত! চোখে মুখে কোনো রাগ নেই! চোখ কোনো রকম বিদ্রোহ ঘোষণা করছে না। আদিল কে দেখে রিমোট টেবিলে রেখে মিরা বললো,
~ আপনি আজ এত শান্ত কেন? মানাচ্ছে না!
~ আপনাদের ঠিক কি উদ্দেশ্য? কেন‌ই বা এত শত্রুতা?

এক‌ই প্রশ্ন! মিরা হাসে! উঠে দাঁড়ায়, পুরো কেবিন ঘুরে ঘুরে দেখে‌। হুট করেই তার চোখে পড়ে, সেদিনের সেই রিভল* বার টা অবহেলায় পড়ে আছে টেবিলের কোণায়। চোখ জ্বলে উঠে মিরা’র। আফরা’র রক্তাক্ত হাত, ব্যাথাতুর মুখশ্রী, কাঁতরানো হাঁটার গতি ভেসে উঠে নেত্রপল্লবে। বুকের ভেতর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রবাহ টের পায়! রিভলবার হাতে তুলে নেয় শক্ত থাবায়! আদিল তখনো গম্ভীর, শান্ত, নিশ্চল! মিরা’র হাতে রিভল* বার দেখেও সে নড়ে না। সে জানে তার জীবন সংকটে, মেয়েটি দ্বারা সব‌ই সম্ভব, মেয়েটির হিংস্রতা বুলেট হয়ে তার বুক ঝাঁঝরা করে দিতে সক্ষম। তবুও আদিলের চোখে ভয়, কাতরতা প্রকাশ পায় না। মিরা আদিলের বুক বরাবর রিভল* বার তাক করে। বাঁকা হেসে বলে উঠে,

~ ঠিক এভাবেই তো তাক করেছিলেন? ট্রিগারে চাপ দিয়েছিলেন? আপনার ছুড়া বুলেট আমার আফরা’র হাত ভেদ করে ঢুকে গিয়েছিল! রক্তাক্ত হয়েছিল! এখন যে সময় আমার আদিল মাহমুদ! অনুভূতি কেমন?
মিরা আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে আসে। একদম কাছাকাছি! বুকের সাথে রিভল* বার ধরে হাসে। একপলক রিভল* বারের দিকে তাকায়। দৃষ্টি সরে না, পিছিয়ে আসে সে। রিভল* বার টা ভালো করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। হাত চালিয়ে রিভল* বারের বুলেট গুণে। তিনটা বুলেট মিসিং। ঝটপট বলে উঠে,

~ আশরাফ উদ্দিনের শরীরে পাওয়া বুলেট, আর আপনার রিভল* বারে থাকা বুলেট সেইম! তিনটা বুলেট মিসিং, আশরাফ উদ্দিন কে দুটো, আফরা কে একটা! মানে কিলা*র আপনি আদিল মাহমুদ!
আদিল হাসে! মিরা’র অসাবধানতাই রিভল* বার নিজের কাছে ছিনিয়ে নেয়। চমকে যায় মিরা! পূর্ণ দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকায়। আদিল মিরা’র দিকে রিভল* বার তাক করে না! কাঁচের জানালার দিকে বুলেট ছুড়ে বলে উঠে,

~ কোথায় তিনটা মিসিং মিস মিরা! আমি তো দেখছি চারটে!
কথাটা বলেই আবার রিভল* বার টা মিরা’র হাতে দিয়ে দেয়। মিরা আদিলের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না। কি করতে চাইছে লোকটি? তবে রিভল* বার ঠিক ধরে রাখে। আফরা’র মুখ যখন ভেসে উঠে, যন্ত্রণা গুলো যেন বেড়ে যায়! আদিলের চোখে চোখ রেখে বুক থেকে রিভলবার সরিয়ে ডান হাতে ঠেকায়। ঠিক আফরা’র হাতের নিশানার মতো! নিষ্ঠুর চোখের মায়া ফেলে ট্রিগারে চাপ দেয় মিরা। শব্দ হয়! আদিল কিছুটা কেঁপে উঠে, তবে আর্তনাদ করে না। গুমোট দৃষ্টি ফেলে মিরা’র প্রতিশোধ নেওয়ার আনন্দে চিকচিক করা মুখশ্রী দেখে। গড়িয়ে পড়ে রক্ত। সাদা ফ্লোর রক্তিম হয়ে উঠে। মিরা আদিলের সাথে একদম সেঁটে দাঁড়ায়। বুক বরাবর মাথা নিয়ে বলে উঠে,
~ হৃদপিন্ডের আর্তনাদ কানে বাজে না কেন? আপনার হৃদস্পন্দনের গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে মি. আদিল! এত তৃপ্তি পাচ্ছি কেন? তবে মনের জ্বালা মিটেও মিটলো না। আবার দেখা হোক আমাদের!

এলোমেলো পা ফেলে মিরা‌ কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে আসে। পেছনে তাকায় না। তার বুকের স্পন্দন টাও কেমন বেড়ে যাচ্ছে। অফিস থেকে বের হ‌ওয়ার আগে পিয়নকে আদিল ডাকছে বলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে যায়। সময় গড়িয়ে যেতেই আদিলের শরীর অসাড় হয়ে আসে। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে সে। বুকের ধুকধুকানি টা সত্যিই বেড়ে যাচ্ছে। তা কি কেবল রক্ত ঝরার জন্য? নাকি অন্য কিছু?

রাগে থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে আফীফ। প্রচন্ড রাগে সে কথা বলতে পারে না।‌ আজ‌ও তাই হয়েছে, কামিনী বেগম এতবার ছেলেকে মানানোর চেষ্টা করছেন। তবুও লাভ হচ্ছে না।
দুপুরে লাঞ্চ সেরে নুরুল আলম সিদ্দিকী ফোন দিয়েছিলেন। নিজস্ব গাড়ি পাঠিয়েছেন, নিচে নেমে চাবিটা নিতে বলে ফোন কেটে দিয়েছেন, আফীফের কথা না শুনেই। রাগের কারণ এটাই। সে চেয়েছিল অতিথি পাখিদের মতো নিড় বাঁধবে এখানে। তা আর হলো ক‌ই? গাড়ি নিয়ে ঘুরা মানে বাবা’র হাতের নাগালে থাকা। এটাই মানতে পারছে না সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। একপলক মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

~ রেডি হয়ে নাও মা, আমরা আজ হোটেল ছাড়বো!
কামিনী বেগম মাথা নেড়ে সায় জানিয়েই
রেডি হতে চলে যান। লাগেজ থেকে কাপড়গুলো নামানো হয়নি। তাই ঝামেলা পোহাতে হলো না। ঝটপট রেডি হয়ে বাইরে বের হতেই ছেলে কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। মুচকি হেসে এগিয়ে যেতেই আফীফ মায়ের হাত আকড়ে ধরলো।‌ যেন বাবা মেয়ে কে আগলে নিচ্ছেন, ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে!
এবারের যাত্রা সাকাহাফং পর্বত। বাংলাদেশের শীর্ষ পর্বত শৃঙ্গ হিসেবে মাথা উঁচু করে আছে বান্দরবানের সাকাহাফং পর্বত। আগে তাজিংডং কে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্বত শৃঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ইউএস টপোগ্রাফি ম্যাপ, রাশিয়ান টপোগ্রাফি ম্যাপ, গুগল ম্যাপ, গুগল আর্থসহ বিভিন্ন অভিযাত্রীদের নেওয়া জিপিএস রিডিংয়ের মাধ্যমে জানা গেছে এখন সাকহাফং-ই বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। সরাসরি চোখে ধারণ করার বড্ড শখ ছিল আফীফের। কতশত নিউজ দেখেছে। আজ খুব এক্সাইটেড ছিল, তবে বাবা’র কাজে কিঞ্চিত মন খারাপ হলেও পাত্তা দিলো না আফীফ। এই মজা আর কখনো পাবে না। আগ্রহের সহিত গাড়ির ডেস্কে ব্যাগ মেলে মা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

~ মা দেখোতো সব ঠিকঠাক! পথ বেশ দুর্গম, প্রস্তুতি না নিয়ে গেলে হবে না।
কামিনী বেগম চোখ মেলে দেখলেন। দু জোড়া ট্র্যাকিং ‘সু’, সাথে দু জোড়া প্ল্যাস্টিকের জুতা, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ওষুধ, মশা পোকামাকড় প্রতিরোধক মলম ওডোমাস ক্রিম , ফাস্ট এইড বক্স, সামান্য খাবার, স্যালাইন এবং পানি! ঘন ঘন মাথা নেড়ে সব ঠিকাছে জানাতেই আফীফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। নিজেই ড্রাইভিং করবে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২০

~ হ্যাপি জার্নি মা!
কামিনী বেগম হাসলেন। মলিন হাসি! কত বছর পর আবার সেই শহরের দেখা পেল! বাতাসে গাঁ বাসাচ্ছে, মাটির ঘ্রাণ নিচ্ছে; তবুও কোথাও যেন প্রাণ নেই! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা শহরের তিক্ততাও যে বিশাল! মানুষ গুলোও সৌন্দর্যের আড়ালো আসল নিজেকে লুকিয়ে রাখে! বড্ড ভয়ংকর!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২২