হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫২+৫৩+৫৪
Tahrim Muntahana
হসপিটালের সামনে গাড়ি রাখতেই আফরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আফীফের দিকে। আফীফ তাকাচ্ছে না, সম্মুখে দৃষ্টি রেখে স্টেয়ারিং ধরে বসে আছে। কিছুটা সময় চলে গেল নিরবতায়। আফরা নামছে না দেখে জিয়াউল বললো,
~ ম্যাম, হসপিটাল যাবেন না?
~ আমি কখন বললাম যাবো? আমি তো আজ আপনাদের ওখানে যেতে চেয়েছি, মিসেস কামিনী’র সাথে দেখা করতে।
আফীফ কিছু না বলেই আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো। এতক্ষণে হয়তো বাবা চলে এসেছে। আফরা স্মিথ হাসলো। জিয়াউল বুঝে উঠতে পারলো না হঠাৎ আফীফের কি হলো। প্রশ্ন করতে গিয়েও চুপ করে গেল অনানের চিমটি তে। চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো। অনান চোখ পাকিয়ে বললো,
~ আপনাকে ছাগল আমি এমনি বলি? বুঝতে পারেন না? আপনার স্যার পাশের মেয়ের প্রেমে মজেছে। কিন্তু মানতে চাইছে না! ভেবেছিল জীবনে মেয়ের প্রবেশ ঘটাবে না, কিন্তু মন তো কথা শুনে না। তাই নিজেকে একটু কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করছে।
~ এমন ভাবে বলছো এই ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞতা আছে। কি ব্যাপার প্রেমে পড়েছো নাকি কখনো?
জিয়াউলের ফিসফিস কথায় সর্বাঙ্গ কেঁপে অনানের। থতমত খেয়ে চুপ রইলো। জিয়াউল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়া মুখশ্রীর দিকে। স্মিথ হেসে মুখ ফেরালো। গাড়ি থামলো বাড়ির সামনে। কোনো রকম হইচই নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশে হাঁটার শব্দ অদ্ভুত শোনাচ্ছে। দেয়ালের একদম কোণ ঘেঁষে কলিংবেল সেট করা। আফরা খানিক অবাক হলো। কলিংবেল বাজার সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। কামিনী বেগম আফরা কে দেখে যেন আর সবাই কে ভুলে গেলেন। হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে কাছে বসালেন। নোট এগিয়ে নিয়ে কিছু লিখে আফরার হাতে ধরিয়ে দিলেন,
~ তুমি এসেছো, জানো কত খুশি হয়েছি? যাও তো মেয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপর অনেক গল্প করবো।
আফরা এদিক ওদিক তাকালো। আফীফরা কেউ নেই, শুধু অনান দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো আফরা। অনান আফরা কে নিয়ে নিজের রুমে যেতেই বলে উঠলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ আপু তুমি খুব মিষ্টি!
হেসে উঠলো আফরা। লজ্জামাখা হাসি নয়, খানিক বিদ্রুপ মেশানো। যা বুঝে অনান নিজেই মুচকি হাসলো। বিছানায় বসে আফরা বললো,
~ উপরের মিষ্টতা সবাই দেখে কিন্তু ভেতরের বিষ?
~ বিষ নিঃসৃত না হলে কেউ টের পায় না। যে টের পায়, তার আর বাঁচার পথ থাকে না। কি নিয়ম তাই না?
~ নিয়ম তো আমরা তৈরি করেছি। প্রয়োজনের তাগিদে কঠোর হয়েছি। আবার প্রয়োজনের তাগিদেই নরম হয়েছি। তোমার অতিতের নির্মমতা কি?
চাপা শ্বাস ফেললো অনান। আফরা’র শরীর ঘেঁষে বললো,
~ আমি কি তোমার কোলে একটু মাথা রাখতে পারি?
আফরা তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার করুণ দৃষ্টি। না করার সাহস তার হলো না। খানিক পিছিয়ে বসে পা মেলে দিতেই অনান শুয়ে পড়লো আফরার কোলে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো। বললো,
~ আমার আব্বু অংতাঙ। সিলেটে বসবাস আমাদের। কর্মজীবনে আব্বু খুব সৎ ছিলো। যে চাকরি তেই একটা অনৈতিক কাজ চোখে পড়তো, বীনা নোটিশে রিজাইন দিয়ে চলে আসতো। আব্বুর চাকরির সূত্রে আমরা নানান জায়গায় থাকতাম। তিন মাসের বেশী সময় থাকা হতো না। আমার কলেজে আব্বু বলে রেখেছিল, শুধু পরীক্ষা দিবো। তাই আমার পড়াশোনায় তেমন সমস্যা হয় নি। সেবার এলাম বান্দরবান। অন্য কোথাও বসবাস গড়ার সময় আমি এতটা খুশি হতাম না, যতটা বান্দরবানের প্রকৃতি দেখে হয়েছি। বেশ চলছিলো আমাদের দিন। এই প্রথম বান্দরবানে আমরা পাঁচ মাস কাটিয়েছি। আব্বু একটি কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। উপজাতি হওয়ায় প্রতিকূল পরিবেশ, কিংবা মানুষের সাথে লড়াই করার মতো শক্তি বা মস্তিষ্ক দুটোই আমাদের ছিলো।
হঠাৎ দেখি কিছুদিন থেকে আব্বু চুপচাপ থাকে, আগের মতো কথা বলে না, কেমন অন্যমনস্ক ভাব। প্রশ্ন করলে উত্তর দিতো না। হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। দু একদিন পর আব্বু অফিস থেকে এসে বলে আমাদের আগের জায়গায় চলে যেতে হবে। এত তাড়াহুড়া করছিলো আম্মু আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিছু তো একটা হয়েছে। জিনিসপত্র গোছানোর মধ্যেই বাইরে হইচই শুনে আঁতকে উঠে আব্বু। আমাকে রান্না ঘরে রেখে তালা দিয়ে দেয়। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কি হচ্ছে। গুলা গুলির শব্দে এতটা ভয় পেয়েছিলাম গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছিলাম না। একসময় গুলাগুলি থেমে যেতেই দেখি কয়েকটা লোক গাড়ি করে চলে যাচ্ছে। আর অনল মাহমুদের লোক বলে উল্লাস করছে।
একটু পর তালা খুলে যায়, আমি দৌড়ে বাইরে এসে দেখি আব্বু দরজায় সামনে পড়ে আছে, সারা শরীর রক্তে..
গলা ধরে আসে অনানের। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত জল। আফরা নিশ্চুপ দেখে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে শুরু করে,
~ আমি কত ডাকছিলাম আব্বু আম্মুকে, ততক্ষণে তারা আমাকে ছেড়ে ওই পরপারে চলে গেছে। দুনিয়াতে আমি একা রয়ে গেলাম। কোথায় যাবো, কি করবো কিছুই জানি না। আমাদের বাড়ির আশেপাশে কোনো বাড়ি ছিলো না, আব্বু বন বিভাগে কাজ করতো। রাত হলো, বাড়ির সামনে আব্বু আম্মু কে কবর দিলাম। মেয়েদের তো কবর দেওয়া জায়েজ না, তাইনা? তবুও আমাকে দিতে হয়েছে। ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলাম কেউ যদি জানে আমি বেঁচে আছি, আমাকেও মেরে ফেলবে। আমার মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল। আমরা যেমন প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বাঁচি, কতবার বাঘের মুখ থেকে আহত হয়ে বেঁচে ফিরেছি। প্রতিশোধ পরায়ণ হওয়া অস্বাভাবিক নয়! সারা বাড়ি হাতড়ে বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলাম, সাথে পেয়েছিলাম চোরাচালানের কিছু প্রমাণ যা আব্বুর কাছে ধরা পড়েছিল। এর পরেই একা সংগ্রাম করে আজ আমি এত দূর!
নিরবতা! অনান উঠে বসে মুচকি হাসলো। আফরা চোখ তুলে বিষাদময় হাসিটা দেখলো। প্রশ্ন করলো,
~ আফীফের খোঁজ পেলে কি করে?
~ আমি নানান প্রমাণের পেছনে ছুটছিলাম, কোথায় যাইনি? কিন্তু কিছুইতেই পৌঁছাতে পারছিলাম না। বাবার প্রমাণ টা হাতে নিয়ে ঘুরা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু ততদিনে ওদের পরিবারের অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। মনে হলো আমাকে প্রশাসনের আশ্রয় নিতে হবে, তবে এখানের নয়। ঢাকা গেলাম, খোঁজ নিয়ে শুনলাম আফীফ মুনতাসির বান্দরবান গিয়েছে। হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। তার বাবা আর তার সুনাম সর্বত্রই ছড়িয়ে। ভরসা করেছিলাম। তাই জিয়ার সাথে ফোনের নাটক করে, তারপর নেপিউ পাড়া তে মিথ্যে বলে গাইড হয়ে ওদের চোরাচালান দেখিয়েছি। এখন এইতো কাজ হচ্ছে!
আফরা ধরতে পেরেছিল। তাই আর প্রশ্ন করলো না। ওয়াশরুমে গিয়ে একটু চোখ মুখে পানি দিয়ে এলো। ঘর থেকে বের হতে যাবে অনান প্রশ্ন করলো,
~ তুমি কেন এতসব করছো?
থেমে গেল আফরা। পিছু তাকালো। কপাল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
~ তোমার জানা উচিত ছিলো, কেন জানো না?
থতমত খেয়ে গেল অনান। মেয়েটা কি কঠোর। আমতা আমতা করে বললো,
~ শুধু মাত্র বোনের জন্য? তোমার বোন তো বেঁচে আছে?
~ ওটাকে বাঁচা বলে? কি জানি! আমার তো মনে হয় মৃত দেহ কে ফেলে রেখেছি। যাই হোক, আমাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না অযথা সময় নষ্ট!
বের হয়ে গেল আফরা। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অনান ফ্রেশ হতে চলে গেল। ডাইনিংয়ে অপেক্ষা করছিলো আফীফ রা। কামিনী বেগম একটু পর পর অনানের ঘরের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। আফরা কেন আসতে দেখেই তিনি মিষ্টি হাসলেন। আফীফের পাশে বসিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন। আফরা হয়তো কিছুটা টের পেল। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
~ একটু বেশীই খিদে পেয়েছে!
কামিনী মিটিমিটি হেসে খাবার বেড়ে দিলেন। কিন্তু আফরা আগেই খেল না। এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখলো। নিচের দিক তাকিয়েও আফীফ মুচকি হাসলো। মুখ তুলে গম্ভীর দৃষ্টি ফেললো আফরা’র উপর। দৃঢ় কন্ঠে শুধালো,
~ কাউকে খুঁজছেন মিস আফরা?
আফরা বিচলিত হলো। তবে বুঝতে দিলো না। সরল কন্ঠে বললো,
~ অনান আসছে না কেন এখনো?
আফীফ চোখে হাসলো। ভ্রু উঁচিয়ে কিছুক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে রইলো। তারপর মায়ের দিক তাকিয়ে ইশারা করলো। মিসেস কামিনী মাথা নাড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে আফীফ গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ নুরুল আলম সিদ্দিকী ঘরকুনো হলো নাকি?
হাঁটার শব্দ এলো। আফরা উৎসুক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। আফীফ একপলক আফরা কে দেখে নিজ খাওয়ায় মন দিলো। স্বাস্থ্যবান লোকটি সরাসরি চেয়ার টেনে বসলো। মুখের আদলে কোনো ভাঁজ নেই, মেদ হীন শরীর; বয়স অনুমান করা একটু জটিল ই হবে। পেটানো শরীরে অদ্ভুত সুদর্শন লাগে। আফরা অপলক তাকিয়ে রইলো মানুষ টির দিকে। নুরুল আলম সিদ্দিকী ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন,
~ এই আসার সময় হলো তোমার? সেই বিকেল থেকে অপেক্ষা করছি। চেহারার কি অবস্থা করেছো, যত্ন নাও না একটুও। খাওয়াও ঠিক মতো করো না, সকালের জগিং করো না। সবই শুনলাম এসে।
আঙুল উঁচিয়ে চমৎকার ভঙ্গিমায় কথাগুলো বলেই মুচকি হাসলেন। আফীফ কিছুটা শব্দ করে হাসলো। এসেই শুরু করেছে। পাল্টা বললো,
~ সে তো তুমিও যত্ন নাও না। আম্মা হীন আব্বু আমার শুকিয়ে গেছে। আম্মা যত্ন না নিলে নিজে নিতে পারো না? একজন প্রতিষ্ঠিত অফিসারের থেকে এরকম কিছু আশা করা যায় না।
জিয়াউল ফিক করে হেসে দিয়েও নুরুল আলম সিদ্দিকীর চোখ রাঙানো তে চুপ মেরে গেল। এবার নুরুল আলম সিদ্দিকী সবার দিকে নজর ঘুরালেন। আফীফের পাশে আফরা কে দেখে একটু নয় অনেকটাই অবাক হয়েছে। তবে বেশী অবাক হয়েছে মেয়েটার চাহনিতে। কিভাবে দেখছে তাকে। অবাকতা কাটিয়ে প্রশ্ন করলো,
~ কি দেখছো, মা?
আফরা চমকে নজর ঘুরালো। ঘন পলক ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে কাটকাট গলায় বললো,
~ এমন সম্বোধনে আমার সাথে কথা বলবেন না, ঠিক হজম হয় না!
নুরুল আলম সিদ্দিকী অতি বিস্ময়ে কথায় বলতে পারলেন না। আফীফ খাওয়ার মধ্যে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
~ এটম বোম সবাই কেই পুড়ায়!
সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ হালকা করতে বললো,
~ আম্মু রেগে যাচ্ছে আব্বু।
নুরুল আলম সিদ্দিকী চট করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। অগ্নি চোখে ফুসফুস করছেন কামিনী বেগম। শুকনো ঢোক গিলে খাওয়ায় মন দিলেন। খাওয়ার সময় কথা বলা একদম পছন্দ করেন না কামিনী বেগম। অপছন্দের কাজ টাই সে বেশী করে। বাবার ভয় পাওয়া দেখে আফীফের বেশ হাসি পেল। খোঁচা দিয়ে বলে উঠলো,
~ ঠিক এই কারণে আমার জীবনে মেয়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমন চোখ রাঙানো দেখে কুঁজো হয়ে বসে থাকা হজম হবে না। দেখা যাবে বউ রেগে বোম, আমিও বোম। বিস্ফোরণে সংসার উড়ে যাবে। আবার ডিউটি তে গেলে, কোনো অপারেশনে গেলে বউ মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে, তার রাগ ভাঙাতে গিয়ে দেখা যাবে আসামি পক্ষ ছুরি ঘুরিয়ে চলে গেছে। এতদিনের সম্মান এক নিমিষেই শেষ। না ঘর ঠিক থাকবে, না কর্ম।
আফীফের কথায় সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নুরুল আলম সিদ্দিকী মাত্রই কিছু বলতে মুখ খুলবেন, পূর্বেই আফরা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
~ লেইম এক্সকিউজ! আর কেউ এই পেশায় নেই? আপনার বাবা ভেসে গিয়েছেন? তিনি বিয়ে করেন নি? সংসার সামলে চাকরি তে রয়েছেন না? তাহলে আপনি পারবেন না কেন? এমন কাউকে কেন জড়াবেন যে রিয়েলিটি না বুঝে টিনেজার দের মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে, আবার নেমন্তন্ন করে তার রাগ ভাঙাতে হবে? যোগ্য কাউকে বেছে নিন যে আপনার অনুপ্রেরণা হবে! প্রতিটা মিশনের আগে আপনার বলিষ্ঠ হাতে হাত রেখে সাহস দিবে!
উঠে দাঁড়ালো আফরা। ভাত যতটুকু দিয়েছিল ততটুকুই রয়েছে। খায়নি। আফীফ রহস্যময় হেসে নিজের খাওয়া শেষ করে। নুরুল আলম সিদ্দিকী, কামিনী বেগম কে চোখে চোখে প্রশ্ন করেন। তবে উত্তর আসে না। জিয়াউল মিটিমিটি হাসছে। খাওয়া শেষে নুরুল আলম সিদ্দিকী ঘরে যেতেই জিয়াউল অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়ে। বিরতিহীন গড়গড় করে বলতে থাকে নিজের মতো!
আফীফ খেয়ে বসার রুমেই বসে ছিলো। পাশেই অনান বসে আছে। আফরা রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়, এবার তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। কামিনী বেগমের থেকে অনুমতি নিতে যাবে তার আগেই আফীফ আটকে দেয় তাকে,
~ বসুন মিস আফরা, কিছু কথা বলবো।
আফরা শব্দহীন বসে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করতেই নিরবতা কাটে নুরুল আলম সিদ্দিকী’র গমগম আওয়াজে,
~ এত বড় রিস্ক কেন নিচ্ছো আফীফ? আমি মানছি আমাদের কাজটাই রিস্ক, সেখানে এখানে তো রিস্ক সর্বোচ্চ তাই বলে এমন ছেলেমানুষী কেন? এত জন স্পেশালিস্ট থাকতে তুমি বাচ্চাছেলে দের ঝুঁকি তে ফেলছো। পরিণতি কি হতে পারে জানো তুমি? ওরা না জানে ফাইট, না জানে বাঁচার কৌশল, ছুরি ঘুরিয়ে বোকাদের থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নিলেই কেউ প্রশিক্ষিত হয় না আফীফ।
আফীফ কথাগুলোর জন্যই বসে ছিলো। সে ভাবালেশ জিয়াউলের দিক তাকিয়ে বললো,
~ সব উগলে দেওয়া হয়েছে নাকি কিছু বাকি আছে?
জিয়াউল মাথা চুলকে ক্যাবলাকান্তের মতো হাসতেই আফীফ মুখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকালো। গাম্ভীর্যতার সহিত বলে উঠলো,
~ বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক সরকার পদ্ধতি বিদ্যমান আব্বু। এককেন্দ্রিক বলতে কি বুঝি আমরা? একক, অখন্ড, সুসংবদ্ধ সরকার ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা সাংবিধানিক ভাবে সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। এই শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রই থাকে সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে। আঞ্চলিক সরকার গুলো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতা ব্যবহার করে। এ ধরণের শাসন ব্যবস্থায় স্থানীয় বা আঞ্চলিক সরকার গুলোর সাংবিধানিক কোনো ক্ষমতা নেই। আমি কি বুঝাতে চেয়েছি বুঝতে পেরেছ?
অনল মাহমুদ হলো বান্দরবানের সেই তথাকথিত সরকার, যার আঙুলের ইশারায় নৃত্য করে স্থানীয় প্রতিনিধি! পুরো বান্দরবান তার কব্জায়। ঢাকা থেকে হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসলেই আমরা কেউ হই না। তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি সরকারের দাসত্ব আমরা বরণ করে নিয়েছি। এখন যদি উপর থেকে হুকুম আসে আমাদের ফিরে যেতে হবে। হ্যাঁ আব্বু, ফিরতে হবেই। সরকারের চোখে পর্দা টানিয়ে দেওয়া অনল মাহমুদের বা হাতের খেল। সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আমরা সফল কোনো ভাবেই হবো না! তাই আমি তিন মাসের ছুটি নিয়ে এখানে!
আমার ভাবনা খুব উপরে আব্বু, আটঘাট বেঁধেই নেমেছি। আমাকে আমার মতো করতে দাও, যদিও আমি সহজ ভাবে নিয়েছিলাম। কিন্তু হসপিটাল দু দিন থেকে বুঝতে পেরেছি খুব জটিল! একটা হসপিটালে দু জন মানুষ একে অপরের আক্রোশে আহত হলো, অথচ টু শব্দ হলো না! কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকলে এমন হতে পারে, ভাবো! সেখানে হসপিটাল বসে পুরো হসপিটাল সার্চ করা সম্ভব নয়! তাই প্লেন চেঞ্জ করেছি আমি!
কথাটি শেষ করেই এক গ্লাস পানি এক চুমুকে শেষ করলো আফীফ। বাবার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। নুরুল আলম সিদ্দিকী এখন ছেলের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আফীফ স্মিথ হেসে ঘাড় নাড়ালো। আবার বললো,
~ আর যদি বলো প্রশিক্ষণের কথা তাহলে বলবো, ওদের আমি হাতাহাতি করতে নিচ্ছি না। যে প্রমাণ গুলো যোগাড় করতে আমরা ব্যর্থ সে প্রমাণ গুলো ওরা আমাদের এনে দিবে। ছুরি চালানো বেশ জানে, খেলনা গুলি দিয়ে যারা ভয় দেখাতে পারে প্রয়োজনে গুলি চালাতেও পারবে। আমি চাইলে সিক্রেটলি অফিসার দের কাজে লাগাতে পারতাম কিন্তু অনল মাহমুদের কাছে ধরা পড়ার চান্স থাকতো। তখন আমাদের ক্যারিয়ার টানাপোড়েনে পড়তো, সৈনিকের উপর মিথ্যে অভিযোগ আনতেও তিনি কন্ঠাবোধ করতেন না। যুবকের রক্ত আব্বু, ওদের মন কে তাতিয়ে তুললে ওরা সরকারের জন্য কতটা হুমকি তুমি জানো আব্বু। শ্রমিকের হাতিয়ার হলো ধর্মঘট! সরকার সেখানেই পুলিশ লাগিয়ে ভুল করে! আমি অনল মাহমুদের কিঞ্চিৎ ভুল হওয়ার অপেক্ষা করবো, প্রমাণ হাতে পাওয়া মাত্রই সৈনিক রা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন অনল মাহমুদের কিছুই করার থাকবে না, সরকারও তখন এক ছুটে মিশনে বাঁধা দিতে পারবে না।
নুরুল আলম সিদ্দিকী উৎফুল্ল চোখে ছেলেকে দেখলেন। আর কত গর্ব করবেন তিনি? আফীফ লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গমগম কন্ঠে বললো,
~ আমরা তোমার আদর্শে বড় হয়েছি আব্বু! এই যে জিয়াউল ছেলেটা কে দেখছো, তার মাঝে তোমার প্রতি যে আনুগত্য রয়েছে তোমার সারাজীবনের পরিশ্রমের সুখ সেখানেই অন্তর্নিহিত।
আফরা’র বুকে কেমন চিনচিনে ব্যাথা করছে। বুকের ব্যাথাটা সারা শরীর ছড়িয়ে অসাড় করে নিচ্ছে যেন। বাবা ছেলে কে একপলক দেখে চেয়ার ছাড়লো সে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ আমি এবার আসবো! মিস অনান আপত্তি না থাকলে আমার সাথে আসুন! অযহত প্রশ্ন করবেন না।
আফীফের ইশারা পেয়েই অনান আফরা’র পিছু চললো।যদিও আফীফ চেয়েছিল আফরা কে পৌঁছে দিবে তবে হয়ে উঠলো না। সে ঢের বুঝেছে মেয়েটা এখন কোনো কাজেই যাবে! নুরুল আলম সিদ্দিকী অনেক সময় আফরা’র গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটার চাহনি সন্দেহজনক! কেমন বুক কেঁপে উঠে। আফীফ কে শুধালেন,
~ মেয়েটি কে?
আফীফ নিজ ঘরের দিকে যাচ্ছিলো। প্রশ্ন শুনে চওড়া হাসলো। পেছন ঘুরে বলে উঠলো,
~ সে এক রহস্যময়ী! হাসির আড়ালে বিষ, ফুলের আড়ালে ছুরি । সে এক অধরা মানবী, ছুঁয়ে দিয়েও যেন দেয় না! সে এক বিষকন্যা, যার বিষ আমার হৃদয় দগ্ধ করেছে!
পাঁচতলা বিল্ডিং টার চারতলা টা গমগম করছে। রঙবেরঙের লাইটিং, দামী পোশাকে আবৃত এক ঝাঁক নারী-পুরুষ, সফট মিউজিক; পরিবেশ আনন্দে ভরপুর। কয়েক যুগল ছেলে-মেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে, হাতে সফট ড্রিংকস; কয়েক যুগল ছেলে মেয়ে মদ খেয়ে গানের তালে নাচ করছে। সে নাচ আদৌ হচ্ছে কিনা বুঝা মুশকিল। কোমর দুলিয়ে চুল নাচালেই তো আর নাচ হয়ে উঠে না, মাতলামি ছাড়া এটাকে কি বলা যাবে? আবার কয়েকজন জোড়ায় জোড়ায় চলে যাচ্ছে সারি সারি রুম গুলোর দিকে। বিচিত্র, উশৃঙ্খল পরিবেশে কোথাও একটা শৃঙ্খলা রয়েছে।
এই যে এত এত মানুষ যে যার কর্মে ব্যস্ত, অন্য কারোর দিকে তাকানোতে লাজুক তারা। নিত্য দিনের ঘটনা ভেবেই যে যার মতো এনজয় করছে। কিন্তু মেনে নিতে পারছে না অনান। উসখুস করছে সে। যে দিকেই তাকাচ্ছে অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। এর আগে হয়তো কোথাও ওপেনলি কিস করাটা দেখেনি, না ওপেনলি সেক্সুয়াল কথা বলতে শুনেছে। কান গরম হয়ে চোখ মুখ আরক্তিম হয়ে এসেছে তার। প্রচন্ড ঘৃণা জমছে চারপাশের মানুষ গুলোর প্রতি। বাস্তবতার চরম দেখেও এই ঘটনা গুলো থেকে দূরে ছিলো সে। আফরা’র বদৌলতে আজ এই অভিজ্ঞতা টাও হলো। অথচ এই পরিবেশেও মেয়েটা শান্ত, গম্ভীর। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। বারংবার অবাক হচ্ছে অনান, এ কেমন মানুষ! অনানের আনইজিনেস খেয়াল করেছে আফরা। কিছু বলেনি, সময় দিয়েছে। কিন্তু আধাঘণ্টা যাওয়ার পরও মেয়েটা স্বাভাবিক হতে পারছে না। শক্ত করে হাত চেপে ধরলো আফরা। অনান হয়তো ভেবেছিল অন্য কেউ হবে, চমকিত দৃষ্টিতে পাশে তাকায়। আফরা কে দেখে ঠোঁট গোল করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শক্ত নিম্ন কন্ঠে আফরা বলে উঠে,
~ বি ইজি! তোমাকে আমি অন্য রকম ভেবেছিলাম বলেই নিয়ে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে আ’ম রং! এমন উসখুস করলে যে কেউ’র চোখেই বাঁধতে পারে। এই যে দেখছো কারোর দিকে তাকানোর সময় নেই, তখন তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এদের সময় লাগবে না। বি এলার্ট, টেইক ইজি।
তিরস্কার হজম হলো না অনানের। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে রইলো। আড়ালে মুচকি হাসলো আফরা। চেয়ারে বসে হুইস্কি বলে চিৎকার করে উঠতেই দুটো লোক দৌড়ে এলো হুইস্কি নিয়ে। অনান হা হয়ে তাকিয়ে রইলো আফরা’র দিকে। অনান কে বিস্ময়ে সমুদ্রে স্নান করিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে সিগারেট ধরালো আফরা। অভিনব কায়দায় এক টান দিয়েই অনানের দিক ধোঁয়া ছেড়ে দিলো। খুকখুক করে কেশে উঠতেই গিয়েই চুপ রইলো অনান। একটু আগের তিরস্কার সে দ্বিতীয় বার রিপিট শুনতে চায় না। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে খানিক এগিয়ে এলো, নিচু কন্ঠে অনান কে নির্দেশ দিয়ে আফরা বললো,
~ খেতে হবে না, শুধু গ্লাস টা হাতে ধরে রাখো। নিচু হয়ে ফ্লোরে ফেলবে, কেউ যেন বুঝতে না পারে!
অনান তাই করলো। আফরা কেউ সে একই কাজ করতে দেখলো। অথচ তিন গ্লাস মদ ফ্লোরে ফেলে না খেয়ে কেমন মাতালের মতো অভিনয় করছে। অনানের মনে হচ্ছে সে কিছুই পারে না, বাঘের খাঁচা থেকে ফিরতে পারলেও এরকম কায়দা করে প্রতিকূল এই পরিবেশে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো না। যা সামনের মেয়েটির পারছে। ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজতেই ছেলেগুলো কেমন হইহই করে উঠলো, চুলে হাত বুলিয়ে পরিপাটি হতেও দেখলো তারা। আফরা রহস্যময় হেসে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসলো, হাতে এখনো জলন্ত সিগারেট। দৃষ্টি তার সামনের উঁচু জায়গাটায়। আফরার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনান সেদিকে তাকাতেই লাইট অফ হয়ে গেল। নিরব পরিবেশ, হুট করেই বিকট শব্দে মিউজিক বেজে উঠতেই আলো জ্বলে উঠলো। সুন্দরী এক রমনী চমৎকার সেজে শরীর দুলিয়ে নাচ করছে। ছেলে গুলো কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ঠিক পেরে উঠছে না। কয়েক পাল কালো পোশাকধারী আটকে দিচ্ছে তাদের, মেয়েটিকে আবদ্ধ করে রেখেছে তার গন্ডিতে। আফরা পলক হীন চোখ পুরো নাচ দেখলো। এরকম নাচ সচারচর দেখা যায় না, বেশ ভালো রপ্ত করেছে। নাচ শেষে মেয়েটি একটি টেবিল দখল করে বসলো। যার কয়েক হাত দূরে দুটো গার্ড। আফরা অনান কে উদ্দেশ্য করে বললো,
~ নাচতে জানো?
~ আমাদের মানে উপজাতি দের নাচ জানি, তোমাদের এসব না।
~ কোমর দুলাতে তো পারো?
~ তা পারবো, মাতলামি করতে!
~ বেশ চলে যাও মঞ্চে। আমাকে বের হতে দেখে চলে আসবে, যে কোনো উপায়ে ব্যস্ত রাখো আমি কাজটি সেরে নিই?
ভয় পেলো অনান। তবুও উঠে দাঁড়ালো। পা কাঁপছে তার, সামনে এগোতে পারছে না। মনে হচ্ছে মঞ্চে গেলেই ছেলে রা তাকে অসৎ উদ্দেশ্য ছুঁয়ে দিবে। আফরা চাপা শ্বাস ফেলে অনানের হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। হতাশ কন্ঠে বললো,
~ দুর্ভাগ্য নাচ, গান কিছুই রপ্ত নেই। তোমাকে আনা আমার বড় সড় এক ভুল হয়েছে। চুপ করে..
থেমে গেল আফরা। তার অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দরজার দিকে। আদিল ঢুকছে, গার্ড নেই কোনো তবে পাশেই একটি ছেলে। আফরা চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলো, ঝটপট বলে উঠে,
~ ভিড়ের মাঝে লুকিয়ে পড়ো, আমার উপর নজর রাখবে, আমাকে বের হতে দেখেই বেরিয়ে পড়বে। উল্টাপাল্টা কিছু করলে খুব খারাপ হবে কিন্তু! ফাস্ট যাও!
অনান আর দেরী করলো না, লুকিয়ে পড়লো। আদিল বসে পাশের ছেলে টিকে বসার ইশারা করতেই সে কাচুমাচু হয়ে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর কন্ঠে শুধালো,
~ শুনলাম বেশ কাজ করছো, কোনো অনুমতির দরকার নেই। নিজেকে রাজা ভাবছো নাকি মবিন?
মবিন চমকালো, ভড়কালো। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। মবিনের ভয় পাওয়া মুখশ্রী দেখে আদিল বাঁকা হাসলো। মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,
~ ভয় পাচ্ছো কেন মবিন? কোনো ভুল করেছো নাকি? বলো বলো!
শব্দ করে হেসে উঠলো আদিল। হাসির দমকে শরীর দুলছে। মবিন মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো,
~ বস, আপনার উপর এট্যাক করেছে শুনে মাথা ঠিক ছিল না। আমি বুঝতে পারি নি। ক্ষমা করে দিন বস!
তীক্ষ্ণ চোখে মবিন কে পরখ করলো আদিল। থম মেরে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ করে কাউকে পাশের চেয়ারে বসতে দেখে প্রতিক্রিয়া বিহীন তাকালো। হয়তো আশা করেনি, কিছুটা চমকানো ভাব ফুটে উঠার সাথে সাথেই মিলিয়ে গেল। আফরা ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে খানিক জড়ানো কন্ঠে বললো,
~ লাইটার হবে?
~ মিস আফরা, আপনি এখানে?
নিভু নিভু চোখ করে আদিল কে দেখলো আফরা। মিনিট খানেক তাকিয়ে রইলো। তারপর হেসে সুর করে বলে উঠলো,
~ তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কি জানো না…!
ত্যাড়ামো করে হাসলো আদিলও। মবিন আড়চোখে আফরা কে দেখে যাচ্ছে শুরু থেকেই। আদিল হয়তো লক্ষ্য করলো, চোখ রাঙিয়ে বলে উঠলো,
~ এখান থেকে যাও!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হলো মবিন কে। হাঁটার তালে দু বার পেছন ফিরে তাকালো, তিনবারের বেলায় আদিলের চাহনি তে টিকতে পারলো না। ভেতরে চলে গেল। মবিন চলে যেতেই আফরা চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে টেবিলে পা তুলে দিলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ টাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো আদিল। আফরা হাসছে, বিদ্রুপের হাসি। সিরিয়াস কন্ঠে বললো,
~ রূপসী আই মিন রাতের ঝলক কে আমার চাই! এ্যাট এনি কস্ট মি. আদিল মাহমুদ!
আদিল আফরার চোখে চোখ রেখে কিছু বুঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো কিনা বুঝা গেল না। ঘাড় ঘুরিয়ে মবিন কে ডেকে পাঠালো। ছুটে এলো মবিন। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ মিস আর কে নিয়ে এসো!
মবিন যেন বুঝে উঠতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আদিলের আগেই আফরা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ রাতের ঝলক আই মিন মিস আরকে নিয়ে আসতে বলছে শুনতে পাস নি? ক্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চেহারা দেখতে?
মবিনের রাগ হলো কিন্তু বস কিছু বলছে না দেখে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একটি টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। মদ গিলছে মেয়েটি। মবিন কে দেখে এমন ভাবে তাকালো, মবিন গাঁ দুলিয়ে হাসলো। হাত এগিয়ে মেয়েটির পিঠ ছুঁয়ে দিতেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। কিছু বলার সুযোগ দিলো না, চোরাচোখে আদিল কে দেখেই হাত ধরে এগিয়ে গেল আদিলদের টেবিলে। মেয়েটি কে একপলক দেখে আদেশের সুরে বললো,
~ মিস আফরা’র কাছে হ্যান্ডওভার করা হচ্ছে। এখান থেকে আপনি মুক্ত!
রূপসী’র চোখে মুখে কোনো উচ্ছাস নেই, নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। সে তার ভাগ্য কে মেনে নিয়েছে। অনেক চোখের জল ফেলেছে, আকুতি করেছে কাজ হয়নি। আফরা আর অপেক্ষা করে না। উঠে দাঁড়িয়ে রূপসীর হাত আঁকড়ে ধরে দুলতে দুলতে দরজার দিকে হাঁটা ধরে। কিছুটা চেঁচিয়ে ব্যাঙ্গ করে সুর তুলে,
~ তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কি জানো না…ও অপ্রিয়..!
দরজা দিয়ে বাইরে চলে যেতেই মবিন ব্যস্ত কন্ঠে আদিল কে শুধায়,
~ বস এটা কি করলেন? কেন করলেন? ওর জন্যই এই বার টা এত ভালো চলছে। ওকে ছেড়ে দিলেন কেন? যদি ঝামেলা করে। আপনি ভুল করছেন বস।
উত্তেজনায় ঠিক কি বলছে মবিনের খেয়াল ছিল না। যখন হলো বুক কেঁপে উঠলো তার। দু পা পিছিয়ে গেল রক্তিম ভয়ংকর চোখ দেখে। আমতা আমতা করে কিছু বলবে আদিল ওয়াইনের বোতল ছুঁড়ে মারে টেবিলে। কাঁচের টেবিল ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক। চারপাশ নিস্তব্ধ, মাতাল গুলোও ভয়ে চুপ মেরে যায়। আদিল চিৎকার করে বলে উঠে,
~ একে নিয়ে যাও আমার ডেরায়। নিয়ে কি করতে হবে খুলে বলতে হবে না নিশ্চয়ই? আদিল মাহমুদ বাবার পর তিনজনের ভুল গুলোই বারবার ক্ষমা করে! চতুর্থ কেউ না এসেছে, না আসবে!
গার্ড গুলো আর দেরী করে না। একপ্রকার হামলে পড়েই মবিন কে নিয়ে চলে যায়। আদিল চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনোদিকে না তাকিয়ে বের হয়ে পড়ে বার থেকে। ঠোঁটের কোনো মুচকি হাসি। গাড়িতে উঠে বসে একপলক ছুটে চলা গাড়িটার দিকে দৃষ্টি ফেলে। রহস্যময় হেসে বিড়বিড় করে বলে উঠে,
~ আমার রাজনন্দিনী আমার ছোঁয়ায় ভালোবাসা পাবে, আমার ছোঁয়ায় আহত হবে! তৃতীপক্ষ বলে কেউ থাকবে না, সে হোক স্বয়ং অনল মাহমুদ!
এলাকা টা বেশ উন্নত। রাস্তাঘাট দোকানপাট দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আফরা খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে। মৃদুমন্দ বাতাসে হাঁটতে ভালো লাগছে। পাশেই রূপসী, অনান। এ পর্যন্ত রূপসী একটা কথাও বলেনি। আফরা কিছুটা যাচাই করতে বললো,
~ ভয় করছে মেয়ে?
মুখ খুললো রূপসী। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
~ ভয়? কিসের ভয় করবো? শরীরের? সে তো অনেক আগেই বিলীন! মরনের? সে তো সেই দিনই মরে গেছি! আপনি আর নিয়ে গিয়ে কি করবেন? হয়তো ব্যবসায় কাজে লাগাবেন, নয়তো কাজের লোক করে রেখে দিবেন!
আফরা মুচকি হাসলো। অনান কিছু বলতে চেয়েছিল তবে আফরা’র ইশারায় থেমে গেল। নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে আফরা আবিষ্কার করলো কোথাও কেউ ভালো নেই। প্রত্যেক টা মানুষের কোথাও না কোথাও একটা অসহায়ত্ব বোধ, পিছুটান, আবেগের কলহ বুক ফুলিয়ে দন্ডায়মান থাকে। সেই দন্ডায়মান ঝড়ে কেউ ঠিক ভালোর মতো ভালো থাকতে পারে না। একটা হতাশা মিশে থাকে ঝকমকে হাসির মাঝেও। অন্যমনস্ক আফরা হুট করেই্ দাঁড়িয়ে পড়লো শটান হয়ে। পকেটে হাত গলিয়ে রিভলবার হাতের মুঠোয় নিয়ে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখলো। মনে হচ্ছে কেউ তাদের অনুসরণ করছে। ছায়া টা একটু করে এগিয়ে আসতেই আফরা রিভলবার জায়গা মতো রেখে দিলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
~ এই গভীর রাতে তিনটে মেয়েকে ঠিক কি উদ্দেশ্যে ফলো করছেন মি. নোমান?
হেলতে দুলতে এগিয়ে এলো নোমান। এরকম কাজ করে বা ধরা পড়েও তার মাঝে কোনোরকম লজ্জা নেই। আফরা’র পাশে দাঁড়িয়ে ভাবালেশ কন্ঠে জবাব দিলো,
~ ভুল! তিনটে না তো একটা! ফলো না তো পাহারা দিচ্ছিলাম।
~ পুলিশের চাকরি ছেড়ে কবে থেকে দারোয়ান গিরি করছেন?
~ বছর খানেক তো হবেই!
আফরা তপ্ত শ্বাস ফেললো। আর কিছু না বলেই হাঁটা ধরলো। নোমান আফরা’র রাগ দেখে হাসলো। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
~ আপনার খুশি হওয়া উচিত ছিলো প্রাণভ্রমর!
দাঁড়িয়ে পড়লো আফরা। অবাক চোখে তাকালো। নোমান কিছুটা থতমত খেয়ে চুপ রইলো। অস্পষ্ট স্বরে আফরা শুধালো,
~ প্রাণভ্রমর?
~ হ্যাঁ মানে না মানে হ্যাঁ, মানে না না ভুল শুনেছেন!
জড়ানো কথা শুনে আফরা’র ভীষণ হাসি পেল। লোকটা তাকে ভয় পাচ্ছে। আফরা’র ইচ্ছে করলো আরেকটু ভয় দেখাতে। তবে মন সায় দিলো না। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
~ এমন কিছু বলবেন না, পরবর্তী তে জবাব দিতে হিমশিম খান। সুযোগ্য পুলিশ অফিসারের এমন মানায় না! অনেক টা বছর একা, তাই ঠিক আপনার পাহারা টা আফরা ইবনাতের লাগবে না। হসপিটাল ফিরে যান!
দাঁড়ায় না আফরা, পা চালিয়ে অনান দের পাশাপাশি হাঁটতে থাকতে। নোমান আর এগোনোর সাহস পায় না। চেঁচিয়ে বলে উঠে,
~ জবাব দিতে হিমশিম খেলেও আমার অনুভূতি মিথ্যে নয় মিস আফরা!
আফরা ঘুরে দাঁড়ায়। নোমান ঠোঁট এলিয়ে হাসে। আনমনা কন্ঠে বলে উঠে,
~ স্বচ্ছ, স্পষ্ট, দৃঢ় আমার অনুভূতি! যে অনুভূতির জন্মে আপনি, মৃত্যু তেও আপনি! প্রাণভ্রমর ছুটে গেলে দেহে প্রাণ থাকে বুঝি?
রান্না শেষ করে খেতে বসেছে মনিরা। একা! কিছুদিন হলো সালেহা বেগম ঘর থেকে বের হোন না। কি এক একঘরে থাকার অসুখ তাকে চেপে ধরেছে, মনিরার শত কথাও তার মন গলাতে পারে নি। মিহি স্কুলে চলে গেছে। পুরো বাড়িটায় সেই একা রয়ে গেছে। খেতে ইচ্ছে করে না ইদানিং, দুনিয়াবি চিন্তা চেতনা থেকে রেহায় নিয়েছে। খানিক পর পর দীর্ঘশ্বাস ই তার সঙ্গী। খাওয়া শেষ করে এঁটো বাসন গুলো মেজে, একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবলো মনিরা। কয়েক সিঁড়ি বেয়ে যেতেই থেমে গেল সে, কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছে কেউ ব্যস্ত হাতে। কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তি পায়ে এগিয়ে গেল । দরজা খুলে অপর পাশের মানুষ টিকে দেখেই শিতল হলো চোখের দৃষ্টি। কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইলো অপলক, তারপর শব্দহীন দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই ভেতরে ঢুকলো আহিশ। মনিরা একটু বিব্রত হলো, লজ্জাও পেল নিজের বোকামির জন্য। দরজা লাগিয়ে তাড়াহুড়ো করে উপরে যাওয়া ধরতেই থামিয়ে দিলো আহিশ,
~ এই মেয়ে, যাচ্ছো কোথায়?
আচমকা ডাকে থতমত খেয়ে থেমে গেল মনিরা। বুকে কাঁপন সৃষ্টি হলো, কি এক গোপন ব্যাথা জ্বলন ধরালো। ‘এই মেয়ে’ ডাক টা বক্তার জন্য স্বাভাবিক হলেও শ্রোতার জন্য এই মুহূর্তে কতটা পীড়াদায়ক যদি বক্তা বুঝতো! চাপা শ্বাস ফেলে মনিরা বললো,
~ কিছু বলবেন?
~ শুনলাম বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছো?
বিব্রতবোধ করলেও কাটকাট গলায় জবাব দিলো,
~ ভুলে শুনেননি জানেন, আবার প্রশ্ন করছেন কেন?
~ আমার জন্য চলে যাচ্ছো? রাগ না অভিমান?
প্রশ্নটার উত্তর মুহুর্তেই দাঁড় করাতে পারলো না মনিরা। রাগ, অভিমান তো তার প্রতিই করা যায় যে আপন, সামনের মানুষটি কি তার আপন? নিজেকেই প্রশ্ন করলো। উত্তর ও পেল সে। আপন তো, সামনের যুবকটিকে সে আপন ভাবে, অতি আপন করতে চেয়েছিল; তাই তো অভিমান হয়, রাগ হয়। মুখে এসব কিছু বললো না। শক্ত গলায় কিছু বলবে তার পূর্বেই আহিশ অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো,
~ শুনো মেয়ে আমি তোমার কেউ হই না, অযহত রাগ অভিমান করলেও তা আমাকে ছুঁতে পারবে না। তাই অপাত্রে ভালোবাসা দান করো না, রাগ অভিমান তো নয় ই। এই বাড়িতে তোমার অধিকার রয়েছে, মা হিসেবে চিন্তাটাও। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিও না তোমার পরিণতি তোমার মেয়ের জীবনে প্রভাব ফেলে। মূল কথা হলো মিহির আপন একমাত্র তুমিই, আমরা কে? আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি। এই স্বার্থের দুনিয়ায় অন্যের জন্য কেউ কিছু করে না। আজ আমি মিহি কে ভালোবাসি, কাল আমার মনের পরিবর্তন হবে না কে বলতে পারে? তখন? তুমিই তার একমাত্র ভরসা। তাই ছোট্ট মেয়েটার ভবিষ্যত অনিশ্চিত করো না। মিহির অধিকার থেকেও তাকে বঞ্চিত করো না।
ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে থামলো আহিশ। সোফায় বসে আবার বললো,
~ মাথার উপর শক্তপোক্ত ছাদ না থাকলে বৃষ্টির পানি শরীর ছুঁয়ে দিবে। বাড়িটায় সেইফ আছো, বাইরে যাবে কোথায়? একা মেয়েলোক কোথাও শান্তি নেই, বাড়ি ভাড়াও সেইফ মতো পাবে না। নিজেকেই রক্ষা করতে হিমশিম খাবে, মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে কি করে ভাববে? মাথা খাটাও মনিরা, ইমোশনের কবলে পড়ে রক্তাক্ত হয়ো না!
মনিরা নিশ্চুপ ভাবছে। হুট করে মুচকি হেসে আহিশের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে বসলো। ভাবালেশ কন্ঠে শুধালো,
~ চলে যাওয়ার কথা বলেছে, মত পরিবর্তনের কথা বলে নি আম্মা?
আহিশ মাথা নাড়ালো। মনিরা আবার হাসলো। বললো,
~ আপনার উপর আমার কোনো রাগ নেই, অভিমান ও নেই। তবে আমি আমার অনুভূতি সম্পর্কেও অস্পষ্ট নয়, একদম স্পষ্ট। আমার জীবনে দ্বিতীয় বার সুখ হয়ে এসেছিলেন আপনি, এতে হয়তো আপনার কোনো দোষ নেই। তবে মন যে ত্যাড়ামো করতে ভালোবাসে। সে যাই হোক ওসব নিয়ে ভাবছি না। ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন নিয়ম থাকলে দুনিয়া হয়তো কবেই নিপাত যেত। আমার ভালোবাসা টা একান্ত আমারই থাক, একতরফা ভালোবেসে যেতেও একধরনের সুখ সুখ অনুভূত হয়। আমি উন্মাদ হয়ে ভুল করেছিলাম, সে স্বীকার করতে আর লজ্জা নেই। নাদিয়ার ভালোবাসা দেখে আমার মনে ভয় জেগেছিল আপনি ওকে ভালোবাসলে আমার কি হবে। তাই উন্মাদ হয়ে ওরকম অভিনয় করে ওকে দূর করতে চেয়েছি। হয়তো সেক্ষেত্রে সফল হয়েছি। তবে চরম পর্যায়ে এসেই হেরে গেলাম। কিন্তু কষ্ট পাই নি। আম্মা যখন বললো আমার ভালোবাসার মানুষের একটা ভালোবাসার সংসার ছিলো তখনই আমার ভালোবাসাকে নিজের মনের মাঝেই দাফন করে দিয়েছে। সেটা শুধুই আমার মনের ব্যাপার।
চুপ করে গেল মনিরা। আহিশ শান্ত দৃষ্টিতে মনিরা কে দেখছে। মেয়েটা কে সে ওইদিনের সাথে মেলাতে পারছে না। কোলে নিয়ে যখন পালস চেইক করলো তখনি তার নিকট সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। মনিরার প্রতি কড়া এক বিদ্বেষ ও জন্ম নিয়েছিল তবে এখন খুব টের পাচ্ছে , সে বিদ্বেষ আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। এক ধরনের সহানুভূতি এসে বাসা বাঁধছে। মনিরা উঠে দাঁড়ালো। একপলক আহিশ কে দেখে বললো,
~ আপনাদের ভালোবাসার কাছে হয়তো আমার ভালোবাসা টা খুব ছোট। আমি নিজ উদ্যোগে যে সম্মান টা নষ্ট করেছিলাম অনুরোধ করবো তা আর মনে রাখবেন না। অনুতপ্ত দাসী কেও ক্ষমা করার ইতিহাস আছে!
মনিরা আর দাঁড়ালো না। জলদি পায়ে হেঁটে উপরে চলে গেল। আহিশ ও উঠে দাঁড়ালো। এই বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। মা কে দেখতে এসে বেমালুম ভুলে গেল তার ঘরে যেতে। দরজা দিয়ে বাইরে চলে যেতেই মনিরা করিডর থেকে মাথা উঁচিয়ে আহিশের যাওয়া দেখলো। মুখে হাসি, ছলছল চাহনি, তৃপ্ত এক ভঙ্গিমা। শান্ত কন্ঠে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল,
~ পরপারে আপনার আবার সংসার হোক, আপনি ভালোবাসা বুকে নিয়ে ভালো থাকুন। আমি নাহয় জ্বলতে জ্বলতে একেবারে নিভে যাবো। নিঃশেষ হয়ে যাবো। ধুলিসাৎ হয়ে যাবে মাটির দেহ। তবুও প্রাণে থাকবে একটু খানি প্রেম।
হসপিটাল এসেছে আহিশ। দোনামোনা করে ভেতরে ঢুকেছে তবে কিছু বলছে না। মিরা চুপচাপ কাত হয়ে শুয়ে আছে। নিজেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে না। কিছুটা সময় যেতে আমতা আমতা করে আহিশ বললো,
~ কিছুটা সুস্থ?
~ আমি অসুস্থ ছিলাম?
পাল্টা প্রশ্নে থতমত খেল আহিশ। খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে ঠিক করে নিলো। বললো,
~ তাহলে হসপিটাল পড়ে আছো কেন?
~ সার্টিফিকেটধারী ভূয়া ডক্টর গুলো ছাড়ছে না।
~ আজকে ছাড়বে, তবে আমার সাথে যাবে এক জায়গায়? যেহেতু তোমার আর আমার উদ্দেশ্য এক, প্রশ্ন থাকার কথা নয়।
মিরা আহিশের দিকে শান্ত চোখে তাকালো। তারপর উঠার চেষ্টা করলো , একা পারলো না। আহিশ সাহায্য করলো, আড়ালে মুচকি হাসলো মিরা। আহিশ প্রশ্ন করলো,
~ হাঁটতে কষ্ট হবে না তো?
~ সে আমার ব্যাপার! আপনি অনুমতি নিয়ে আসুন, আমি ঠিকঠাক হয়ে নিচ্ছি।
আহিশের মন ছলকেই ভালো হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে এলো অনুমতি নিতে। মিরা কিছুটা ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। হাঁটতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে, সয়ে নিতে পারবে। নিচে নামতেই দেখলো আহিশ একটি ডক্টরের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি করছে। মিরা কে দেখা মাত্রই ডক্টর টি চমকে গেল। কিছু বলবে তার পূর্বেই মিরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
~ আদিল মাহমুদ কে বলে দিবেন তার খাঁচা আর পাখি চায় না!
হনহন করে বেরিয়ে এলো হসপিটাল থেকে। এতটুকু হাঁটতেই হাঁপিয়ে গেছে সে, আহিশ দৌড়ে এসে মিরা কে ধরলো। মিরা কিছু বললো না, একটা সাপোর্ট দরকার ছিলো এখন। গাড়িতে সেইফলি বসিয়ে , আহিশ খুব ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে থাকলো। মিরার হঠাৎ করেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার স্থানে এই মুহূর্তে আপাই থাকলে খুব ক্ষতি হতো? সে পেছনে বসতো, পাশের মানুষটির মুখেও সতেজ হাসি থাকতো! তা যে আর হওয়ায় নয়! তবুও মন মানতে চায় না, কষ্ট হয়।
গাড়ি থামলো চেনা জায়গায়। মিরা অবাক হয়ে তাকালো, আহিশ শান্ত চোখে একপলক আশ্বাস দিয়ে মিরা কে সেইফলি নামালো। শব্দহীন মিরার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বাগান পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো।
বোন কে খাওয়াচ্ছিলো আদিল। সকাল থেকে বোনের আশেপাশেই থাকছে সে। কেন যেন দূরে গেলেই মনে হয় বোন হারিয়ে যাবে। এসে আর পাবে না। নিজের কঠোর খোলস ছেড়ে কিছুটা বেরিয়েছে। ঠিক করেছে বোন কে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি বাইরের কান্ট্রিতে যাবে, যদি বিধাতা সহায় হোন, ঝুঁকি নিয়ে যদি কাজ হয়, শেষ চেষ্টা করবে সে। অকালে মেয়েটির বিয়োগ তার ভেতর নাড়িয়ে দিয়েছে। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, অনুমতি বিহীন ঢুকে পড়ে আহিশ, মিরা। আহিশ কে দেখামাত্রই নাদিয়া চমকে যায়, মুখে উল্লাসের হাসি ফুটে। কিন্তু সহ্য হয় না আদিলের। দুটো হাতের বন্ধন হৃদয়ে যেমন রক্তক্ষরণ ঘটায় মস্তিষ্কেও রক্ত সঞ্চালনের গতি বেড়ে যায়। কপালের রগ ফুলে উঠে, রক্তিম চোখ ভয়ানক দেখায়। তবুও চুপ থাকে, আহিশ এগিয়ে আসে নাদিয়ার কাছে। নাদিয়া দেখে আহিশের হাতের ভাঁজে মিরার হাত। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। করুণ চোখে আহিশের দিকে তাকায়। নাদিয়ার করুণ দৃষ্টি আহিশের ঠোঁটে হাসি ফোটায়, ছলকেই আদিল কে দেখে নেয়। মনের ভেতর অদ্ভুত উন্মাদনা টের পাচ্ছে। দুটো হৃদয় কে কষ্ট দিয়ে সে আনন্দ পাচ্ছে।
নাদিয়ার পাশে বিছানায় বসে আহিশ। কিছুটা উবু হয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ কেমন আছো নাদিয়া? কান্না করছো কেন? আমাকে আর মিরা কে মানিয়েছে না? তুমি তো বলেছিলে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে, তাই চেষ্টা করছি। ভালো করেছি না? সুস্থ হয়ে উঠলে তো দেখবেই, নাহলে! যাই হোক, তোমাকে দেখতে ও দেখাতে এসেছিলাম। এখনই উঠবো। ভালো থেকো যাতনা নিয়ে!
হুট করেই এসে হুট করেই দুটো মানব-মানবী প্রস্থান করে। দুটো হৃদয়ে জ্বালা ধরিয়ে দুটো হৃদয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নাদিয়া। এগিয়ে যায় না আদিল, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নাদিয়া বিড়বিড় করে বলে উঠে,
~ সহস্র বার মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলাম, আজ আর হয়ে উঠলো না। তোমার ভালোবাসা আমাকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিল আহিশ, তবুও তোমার স্বাদ মেটেনি!
…..
সকাল থেকে চার্ট তৈরি করছে জিয়াউল। বসের কথা মতো প্রত্যেকটা কাগজে কার কার কি কাজ, কিভাবে করবে সব লিখছে। একটু ফুরসৎ নেওয়ার সময় যেন নেই। অনান একটু পর উঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিছু বলতে চায় সে। সাহস হয়ে উঠছে না। জিয়াউল দু বার লক্ষ্য করেছে। তিনবারের বেলায় ধমকে বলে উঠলো,
~ এই আদিবাসী এদিকে এসো।
এবার রাগলো না অনান। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে জিয়াউলের সামনে এসে দাঁড়ায়। জিয়াউল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শুকনো ঢোক গিলে অনান আমতা আমতা করে বললো,
~ কোবাংনা চাগা তোঁখোঁয়াই হিঁয়ে!
জিয়াউল বিরক্ত হয়। মেয়েটি জানে এই ভাষা তার রপ্ত নেই, তবুও ফাযলামি করতে চলে আসে। বড়সড় এক ধমক দিবে তার আগেই অনান খুশিতে লাফিয়ে বলে উঠে,
~ নাংগো ঙ্গাঁ লোয়ে মি. খালেদা জিয়া!
দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল আফীফ। অনানের কথায় কেশে উঠলো। লজ্জায় চোখ মুখ লাল হতে শুরু করে অনানের। দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, দৌড়ে চলে যায়। জিয়াউল কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আফীফ কে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায় না, হাতের চার্ট গুলো নিয়ে চলে যায় ড্রয়িংরুমে। আগ থেকেই বসে ছিল আফরা। অনানও এখানেই বসেছে। সকাল সকাল মেয়েটাকে ফোন করে আনিয়েছে আফীফ। এতে সে অনুতপ্ত নয়, কাজের জন্যই আসতে হয়েছে। চার্ট গুলো হাতে দিয়ে কিছু বলবে নুরুল আলম সিদ্দিকী উপস্থিত হয়। ছেলের পাশে বসে বলেন,
~ কি কি পরিকল্পনা করলে?
সবটা বলতেই যাচ্ছিলো আফীফ। আফরা’র প্রশ্নে থেমে গেল,
~ উনি এখানে কি করছেন?
আফীফ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,
~ মানে?
~ উনি আমাদের কাজের সাথে যুক্ত নয়, তাহলে নিয়ম মোতাবেক উনি এখানে থাকতে পারেন না।
~ আপনাকে কে বললো উনি যুক্ত নেই?
আফীফের প্রশ্নে আফরা একপলক নুরুল আলম সিদ্দিকী কে দেখে নেয়। লোকটি তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আফরা’র অস্বস্থি হতে থাকলো। কোনোরকম বললো,
~ উনি যুক্ত কিভাবে?
~ মাহমুদ সম্পর্কে অনেক কিছু তার জানা!
~ তাহলে তো আমার বাবারও অধিকার আছে এসব জানা, বলবো? সেও অনেক কিছু জানে?
মুচকি হেসে কথাটি বলতেই আফীফ বিস্ফোরণ চাহনি তাক করলো। বাবার হিসেব টা মিলছে না। সে তো জানতো আফরা এতিম। প্রশ্ন করলো,
~ আপনার বাবা? কে?
~ আপনার বাবার বস অনিমেষ মির্জা!
নুরুল আলম সিদ্দিকী চট করে উঠে দাঁড়ালেন। চোখ তার কোটর থেকে বাইরে বেরোনোর উপক্রম। আফরা আর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাইলো না। একটা চার্ট হাতে নিয়ে বললো,
~ ঠিক সময়ে চলে আসবো, এখন আসছি!
আফীফ হ্যা না কিছুই বলতে পারে না।আফরা দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে যায়। আফরা’র বাবা নিয়ে আফীফের কোনো প্রশ্ন নেই। হুট করেই তার অবচেতন মন কিছুটা সত্য প্রকাশের দোলা দিয়ে যায়। খানিকটা রোমাঞ্চিত হয়েই দৌড়ে পিছু নেয় আফরার। কিছুটা এগিয়ে গেছে মেয়েটি। আফীফ গাম্ভীর্য বজায় রেখে গলা খানিক উঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ শুনে মেয়ে এলোকেশী, আমি তোমার চুলের ভাজেই প্রেম ঢালতে চাই। কালো তে কালো মিশে একাকার হয়ে যাক!
আফরা চট করে ঘুরে দাঁড়ালো। অবাকের কোনো ইঙ্গিত পেল না আফীফ। বড় বড় পা ফেলে আফরা’র সম্মুখে দাঁড়ালো। শান্ত কন্ঠে আফরা প্রশ্ন করলো,
~ ভালোবাসা’র রং কালো বুঝি?
~ সে তো রংহীন কাঁটামুকুট! আমি তো প্রেম ঢালতে চেয়েছি, ভালোবাসা তো শুধু অনুভব। আমার প্রেম যে কালো, অন্ধকার!
মুচকি হেসে হৃদয়ের সুপ্ত আবেগ প্রকাশ করলো আফীফ। আফরা’র শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠলো। বুকের ভেতর হঠাৎ কম্পন টের পেল। আফীফের স্বচ্ছ চোখ তার জটিল লাগছে, নাকি সে জটিল মনে করছে। আনমনা হয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো
~ কাঁটামুকুট?
অদ্ভুত ভঙ্গিতে আফরার নিকটস্থ দাঁড়িয়ে কপালে হালকা টোকা দিলো আফীফ। দৃঢ় কন্ঠে বললো,
~ সুশ্রী সুন্দর তকমা পাওয়া ফুলটার গাঁয়ে অসংখ্য কাটা! যে কেউ ই কিন্তু হাতের ভাঁজে ধরে রাখতে পারে না! এই যে তুমি অনন্য সুন্দর এলোকেশী রমনী, যার শরীরের ভাঁজে মেয়েলি আবেগের চেয়ে রহস্যের ধাঁক বেশী! যে কেউ ই বুকে জড়িয়ে রাখতে পারবে না, পেছনের ছুবলটা সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে যে সবাই জন্মায় না। তবে মেয়ে আফীফ মুনতাসির কিন্তু গোলা নয়, নিজেই একটা কামান! ফুলের ভাঁজে কাঁটা গুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে একটা চাপা শ্বাসই যথেষ্ট!
টোকায় নিজের কাছে ফিরে এলো আফরা। সে কি নিজেকে হারিয়ে ফেলছে? চোখ বুজে জোরে শ্বাস নিলো। দু পা পিছিয়ে গিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো,
~ আমি বিবর্ণ বিষাক্ত রমনী! যার শরীরের প্রতিটা ভাঁজে বিষ। আপনাকে খুব দরকার দেশের। আমাকে ছুঁতে এসে তাদের নিরাশ করবেন না! পাপ লাগবে, আমার!
~ আমি নিজেই পাপী! কোন পাপের কথা বলছো তুমি? এই দেশ ততক্ষণ আমার যতক্ষণ কোনো আঘাত আফীফ মুনতাসির পাচ্ছে না! যখনই আফীফ মুনতাসিরের স্বার্থে, একান্তই ব্যক্তিগত গহ্বরে ঘা দিবে; জেনে রেখো এলোকেশী কাটামুকুট আফীফ মুনতাসির তখন স্বার্থপরের বিচিত্রতা তোমাকে দেখাবে!
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫০+৫১
গাঁ দুলিয়ে হেসে উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো আফীফ। পকেটে হাত গুঁজে মাথা কাত করে একনজর আফরার হতবাক দৃষ্টি দেখে নিল। তারপর হাসতে হাসতে বড় বড় পা ফেলে ভেতরে চলে গেল। আফরা শুধু চেয়েই রইলো, চেয়েই রইলো। দেখার বুঝি শেষ নেই?