হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৯+৬০
Tahrim Muntahana
ইজি চেয়ারে দোল খাচ্ছিল আদিল। অন্ধকার ঘর, বন্ধ চোখের পাতা খুলে গেলেও একই। ভাবছিল জীবনের সমীকরণ নিয়ে। অতিতের কিছু নির্মমতা, কিছু ষড়যন্ত্র আজ তাকে এই পর্যন্ত এনে দাঁড় করালো। মানুষ বেঁচে থাকে কেন? শুধু মাত্র ভালো জীবনযাপন করার জন্য? তাহলে জীবনে রস থাকে না কেন? কেন মনে হয় এই ভালো জীবনযাপনের পেছনে লুকিয়ে আছে হতাশা, হাহাকার, অশান্তি, অস্থিরতা। সুখ, শান্তি দুটো শব্দ বিলীন হয়ে যায়। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে। এই যে সে আছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মরতে ইচ্ছে করে না, আবার বেঁচে থাকার স্বাদ ও খুঁজে পায় না। শুধু মাত্র প্রয়োজনের তাগিদে কঠোর শরীরটা চালাচ্ছে সে। অন্ধকারের নিস্তব্ধতা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিকট শব্দে ফোন বেজে উঠলো। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো আদিলের। ধরলো না, কেটেও দিল না, নড়াচড়াও করলো না সামান্য। কিন্তু কলের সংখ্যা যখন চার ছাড়ালো, তখন না ধরে পারলো না আদিল। হাত বাড়িয়ে ফোন টা নিয়ে ‘আব্বু’ নামটি দেখে শুকনো ঢোক গিললো। রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে অনল মাহমুদ চাপা স্বরে শুধালেন,
~ মবিন কে কি করেছো আদি?
আদিল চুপ রইলো। এত তাড়াতাড়ি খবর টা অনল মাহমুদের কাছে পৌঁছে যাবে ভাবে নি। প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত সে আগ থেকেই। ভুমিকাহীন জবাব দিলো,
~ অঙ্গ গুলো বিক্রি করার জন্য আমি নিজের হাতে প্যাকিং করেছি আব্বু!
~ কেন করলে এটা?
~ কি করতাম আব্বু? ও আমার রাজনন্দিনী’র দিকে হাত বাড়িয়েছিল!
অনল মাহমুদ চুপ রইলো। চাপা শ্বাস ফেলে আদিল আবার বললো,
~ পুরো পৃথিবী একদিকে রইলেও আমি জানি আমার আব্বু আমার দিকেই থাকবে! ছেলের ভালোবাসা কে মেরে ফেলার অর্ডার আপনি দিবেন না, সে আমি জানি। সাহস করলে তো দাম দিতেই হবে আব্বু!
অনল মাহমুদ শান্ত স্বরে প্রসঙ্গ টেনে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ তাহলে আজ কেন ভুল বুঝলে আদি?
~ ভুল বুঝি নি তো! রাগের বশে আপনি ওর গাঁয়ে হাত তুলে ভুল করেছিলেন আব্বু। মিরা চেয়েছিল আপনার থেকে আমাকে দূরে রাখতে। ইচ্ছে করেই ওমন করেছে। অথচ মেয়ে জানে না অনল মাহমুদ হীনা আদিল মাহমুদের কোনো অস্তিত্ব নেই।
অনল মাহমুদের গলা কাঁপছে। কাঁপা গলায় তিনি বলে উঠলেন,
~ আমি তোমাকে এখন কিভাবে বাঁচাবো আদি? মেয়েটি তোমার জীবন ধ্বংস করে দিবে আদি! আটকে রাখতে, টর্চা”র করতে; কিন্তু মে”রে কেন ফেললে মবিনকে? আমি এখন কিভাবে কি করবো?
আদিল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বহুদিন পর বাবার এমন গলা শুনছে। ঝড় বয়ে যাচ্ছে আদিলের বুকে। এতক্ষণ যে বুকটা কে শান্ত করতে সে নিশ্চুপতা কে বরণ করে নিয়েছিল; সেই বুকটাই এখন অশান্ত হয়ে তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। শান্ত কন্ঠে বললো,
~ আমাকে নিয়ে ভাববেন না আব্বু! এই শহরে কারো বুকের পাটা হয়নি আদিল মাহমুদের শরীরে একটু টোকা দিবে! যাদের সুযোগ দিয়েছি একমাত্র তারায় পেরেছে।
অনল মাহমুদ আজ বড়ই শান্ত। কয়েক মুহূর্ত নিরবতায় কেটে গেল। হঠাৎ অনল মাহমুদ গমগম কন্ঠে বললেন,
~ তোমাকে মেসেজ করা হয়েছিল, অপেক্ষা করছি এসো!
এবার আদিলের মাঝে পরিবর্তন দেখা গেল। খানিক কেঁপে উঠলো সে। নিম্ন কন্ঠে পরাজয় বরণ করে বলে উঠলো,
~ আমাকে ভুল বুঝবেন না। ওদের ছেড়ে দিন আব্বু। ওরা তো নির্দোষ। আমার উপর ছেড়ে দিন, আমি ওদের দেখে নিবো।
অনল মাহমুদ মেনে নিতে পারলেন। একটু আগের অসহায়ত্ব বোধ আর তার মাঝে নেই। একরাশ রাগ এসে ভর করেছে। রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
~ পর কখনো আপন হয়না, তুমি তার একমাত্র প্রমাণ আদিল! তুমি আমার জীবনে চরম ভুল ছিলে !
ফোন কেটে যেতেই আদিল ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। ইজি চেয়ার টা অন্ধকারে কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করলো। হাঁসফাঁস করতে লাগলো আদিল। অতিত তাহলে ডানা ঝাপটানো শুরু করেছে!
নিঃশ্বাস চলে যাওয়ার পর শরীর টা হয়ে যায় লাশ! মৃত! ছেলেগুলো অনায়েসেই লাশ শব্দ টা ব্যবহার করে কাজ করছে। আফীফ তো পারছে না! মুখ থেকে শব্দ টা উচ্চারণ করতে পারছে না। মনে হচ্ছে দ্রুতই সে মরে যাবে, পাহাড় সমান ওজনের এই শব্দ টি তার বুকের উপর ঠেসে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে জিয়াউল। সে তো নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, বিষাক্ত এক গ্যাস নির্গত করার থেকে মনে হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস সে গ্রহণ করছে। কি এক অসহনীয় জ্বালা! ক্ষণে ক্ষণে ওই ক্ষতটা যে তাকে দগ্ধ করছে, ভেতর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। তক্তপোষের উপরই বসে ছিল আফীফ। জিয়াউল এখানে নেই। বক্সে ভরে পাঠানো হয়েছে ঢাকা সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে। সাথে একটি চিঠিও প্রেরণ করা হয়েছে। সে না আসা পর্যন্ত মাটি দিতে না করা হয়েছে। মাহমুদ বংশ কে হাতের মুঠোয় পুরেই সে খুব শীঘ্রই ফিরবে। অপেক্ষা করছে বাবার ফোনের। এমন সময় ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সৈয়দ। খুড়িয়ে হাঁটছে ছেলেটা। ক্ষত খানিক সারলেও ঠিক মতো হাঁটতে পারে না। আফীফের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু সময় চুপ রইলো। প্যান্টের পকেট থেকে সাদা একটি কাগজ বের আফীফের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
~ স্যার, এটা ছোট স্যার আপনার জন্য লিখেছে।
আফীফ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কাগজটির দিকে। সৈয়দ আবার বললো,
~ ছোট স্যার কে অজ্ঞান করে ফেলে রেখেছিল। জ্ঞান ফেরার পর ছোট স্যার বুঝে যায় সবটাই। বন্দু*ক আগ থেকে নিয়ে নেয় ওরা। অনল মাহমুদ সরাসরি ছোট স্যারের শেষ ইচ্ছের কথা জানতে চায়। তখন ছোট স্যার বলে তাকে পাঁচ টা চিঠি লিখার সময় দিতে। অনল মাহমুদ চিঠির সংখ্যা শুনে হাসলেও কি মনে করে রাজী হয়। আর ছোট স্যার আমাদের ছেড়ে দিতে বলে। নাহলে আমাদেরও মে*রে..
ডুকরে কেঁদে উঠে সৈয়দ। আফীফ ডান হাত বাড়িয়ে সৈয়দের মাথায় হাত রাখে। তারপর চিঠিটা হাতে নিয়ে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সৈয়দ দুটো চিঠি এগিয়ে দেয় আফরা, অনানের দিকে। আফরা স্বাভাবিক ভাবেই হাতে তুলে নিয়ে প্রস্থান করে। অনান মেয়েটার বেহাল দশা। এলোমেলো চুল, জামাকাপড়ে ধুলোবালি, রক্তিম চোখ ফুলে কেমন দেখাচ্ছে, চোখের পানি শুকিয়ে গালে দাগের সৃষ্টি করেছে, হাতে সাদা কাগজ; ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সেদিকেই। কোনো শিল্পী মেয়েটিকে হয়তো অন্যভাবেও রচনা করতে পারতো! সৈয়দ চলে যায় বন্ধুদের কাছে। আফীফ বড়সড় ঢোক গিলে কাগজের ভাঁজ খুলে। প্রথমেই নজরে পড়ে ভেজা অংশ! চোখের পাতা কেঁপে উঠে আফীফের। লেখার সময় ছেলেটা কাঁদছিল! ঝাঁপসা চোখে নজর বুলিয়ে যায় গুটিগুটি অক্ষরে,
“ছোট স্যার,
আপনি যখন আমার চিঠিটা পড়ছেন আমি তখন পরলোকগমন করেছি। এবং কি আমার শরীর টা তখন আপনার থেকে বহুদূরে। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে না? আমি জানি তো! আপনি যতই আমার উপর রাগ করেন না কেন, আমাকে আপনি ভীষণ ভালোবাসেন। বলেছিলাম আপনার সাথে আমি পাতালে যেতেও রাজী। কিন্তু দেখেন ভাগ্য আমাকে একাই পাতালে পাঠালো, আমি এভাবে একদম আসতে চাই নি স্যার। কিন্তু কি থেকে কি হলো.. বাদ দেন সেসব। আমার আদর্শ আপনি! আমি আমার ইউনিফর্মের মান রেখেছি স্যার। বীরের মতো মৃত্য বরণ করেছি, ভয় পাইনি। আমার অসম্পূর্ণ কাজ আপনি একাই করবেন স্যার, আমি চাই আপনার হাতেই ওই অনল মাহমুদের মৃত্যু হোক! আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আমার কবরের পাশে এসে চুপিচুপি একটু ভালোবাসি বলে যাবেন স্যার। এই দেখেন একটু বেশীই আবেগী হয়ে পড়েছি। মরে যাবো তো, তাই আরকি। আপনি রাগ করবেন না। আসবেন তো?”
আর কিছু লেখা নেই! আফীফ পর পর কয়েকবার পড়লো চিঠিটা। একসময় সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। চুপচাপ দেখে গেল সবাই। কি বলে সান্ত্বনা দিবে? আছে কিছু? নেই! যার ক্ষত তারই জ্বলন। অন্যকেউ উপলব্ধি করতে পারবে না! আফরা আবার সেই মাঠে এসে বসেছে। আজ পূর্ণিমা টা এত স্বতঃস্ফূর্ত; ছোট ছোট অক্ষর গুলো পড়তে পারছে আফরা। যদিও কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে তবে বেশী নয়। আফরা স্বাভাবিক ভাবেই চিঠিখানা পড়তে শুরু করে। তার মতে তাকে বলার কিছুই নেই জিয়াউলের, শুধু মাত্র ফর্মালিটিজ!
“অপ্রিয়-প্রিয় ম্যাম,
আপনি আমার কাছে অপ্রিয় ছিলেন কিছুটা, সেসব ছেলেমানুষী ব্যাপার। প্রিয় হলেন আমার ছোট স্যারের জন্য। ম্যাম ও সে জন্যই ডাকা। ছোট স্যার আমার কাছে অধিক সম্মানের, তাই সম্মান টা আপনারও প্রাপ্য। আপনাকে চিঠি দেওয়ার আমার কোনো কারণ নেই। কি যেন মনে হলো, লিখে ফেললাম। আমার ছোট স্যার আপনাকে খুব ভালোবাসে। মেয়ে থেকে দূরে থাকা স্যার কে যখন আপনার প্রতি আসক্ত হতে দেখলাম আমার যে কি আনন্দ হচ্ছিল। আমি জানি আপনি খুবই কঠোর, রহস্যময়ী। ভালোবাসতেও বলবো না। কিন্তু হুট করে হারিয়ে যাবেন না প্লিজ। বন্ধু হয়ে থাকবেন নাহয়, নাহলে আমার স্যার প্রথম ভালোবেসেই ছ্যাকা খেয়ে যাবে। যদিও আমি অভিশাপ দিয়েছিলাম একসময়, তবে এখন ফিরিয়ে নিয়েছি। আপনি যদি স্যার কে ফিরিয়ে দেন তাহলে আপনারও আর কোথাও বিয়ে হবে না। ভেবে দেখবেন জিয়াউলের অভিশাপ কিন্তু ফলে যায়।”
আফরা’র কি হলো সে জানে না। ফিক করে হেসে দিয়ে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। এত বড় একটা ছেলে এমন বাচ্চামো কথা কি করে বলে? এত আদুরে ভাবে কথা কিভাবে বলে? কাগজ টাই ছোট করে ঠোঁট ছোঁয়ালো আফরা। নাদিয়ার মৃত্যু তাকে কষ্ট দিলেও এই কষ্টটার মতো নয়। সে জানতো হুট করেই তাদের মধ্যেই কারো কিছু হবে। আন্দাজ করতে পেরেছিল। অথচ সাবধান করার আগেই ঘটে গেল!
তীব্র হর্নের আওয়াজে ঘোর কাটে আফরার। দুটো গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে আসছে। আফরা তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়। কাগজ টা প্যান্টের পকেটে রেখে দৌড়াতে শুরু করে ছাউনির দিকে। সকলে সেখানেই ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো,
~ বস্তির মধ্যে ঢুকে পড়ো তোমরা, ফাস্ট। পেছন দিক দিয়ে যাবে। প্রশ্ন না করে দৌড়াও।
ছেলেগুলো দৌড়াতে থাকে কথা মতো। আগেই বলা ছিল, এরকম পরিস্থিতিতে দোটানা না করেই দৌড়াতে। ছেলেগুলো ছাউনি ছাড়তেই শব্দ করে দুটো গাড়ি থেমে যায়। হাঁটার শব্দ ভেসে আসে। আফরা আফীফের কাছে যায়, সেভাবেই বসে আছে ছেলেটি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠে,
~ মি. আফীফ! বসে থাকার সময় নেই, ওরা এসে গেছে।
আফীফ ঘাড় উপরে তুলে। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে। পরক্ষণেই ছাউনির দরজার দিকে তাকিয়ে অভিনব কায়দায় কাঁধ ঝাঁকায়। যেন শরীর থেকে সকল ক্লান্তি ভাব, আফসোস, দুঃখ ঝেড়ে ফেললো। ডান হাত পেছনে এনে দেখে নেয় অস্ত্র টি ঠিক ঠাক আছে কিনা। আছে, চিন্তা নেই। আফীফ মুখে কঠোরতা এনে আফরা কে বলে,
~ অনান কে দেখুন। এসব ঝামেলায় আসবেন না।
কথাটা অত্যন্ত হেলায় নিয়ে আফরা নিজের পকেট থেকে রিভল*বার বের করে ছাউনির দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়ে। আফীফ কিছুটা চোখ রাঙালেও পরক্ষণেই ঘরের মধ্যে সুরসুর করে ঢুকে পড়া কয়েকজন কালো পোশাকধারী লোককে দেখে দৃষ্টি ফেরায়। লোকগুলো এসে শুধু দাঁড়িয়েই থাকে! অতর্কিত হামলা, প্রহার বা অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। আফীফ ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ঝোঁপ বুঝে কো*প দেওয়াতে তার জুড়ি মেলা ভার। কিছু সময় যেতেই প্রবেশ করে সাদা পাঞ্জাবি পড়া এক যুবক। মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস, হাতে রিভল*বার অভিনব কায়দায় আফীফের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। দৃষ্টি বিনিময় হতেই রিভল*বার আফীফের কপালে ঠেকিয়ে মৃদু শব্দে হাসে। আফীফ চিনতে পারে, স্পষ্ট কন্ঠে উচ্চারণ করে,
~ মি. আদিল মাহমুদ!
মাস্ক খুলে ফেলে আদিল, ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে দেয়। খানিক বাহবা’ও বলা চলে। আফীফের চোখ মুখে ভয়, আতঙ্ক, অবাকতা, বিস্মিত কোনও ভাবই নেই। অনুভূতিহীন কঠোর দৃষ্টি মেলে রয়েছে আদিলের চোখে। আদিল ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ ভয় করছে না মি. আফীফ মুনতাসির?
আফীফ শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসির ধমকে শরীর দুলছে তার। আদিল শক্ত দৃষ্টি তে হাসিটা দেখতে থাকে। দেখার মাঝেই টের পায় পেটে কিছু ঠেকানোর ইঙ্গিত। ভ্রু কুঁচকে নিচের দিকে তাকাতেই আবছা আলোয় অস্ত্রটা চিনতে অসুবিধা হয় না তার। আফীফ ঘাড় বেঁকিয়ে বলে উঠে,
~ ভয় করছে না মি. আদিল মাহমুদ?
আদিল কিছু বলতে পারে না, পূর্বেই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে আফরা। আদিলের দিকে রিভলবার তাক করে ঠোঁট এলিয়ে হাসে। এগিয়ে আসবে, বাঁধা প্রদান করে একজন গার্ড। হাত বাড়িয়ে আটকে দেয় তাকে। বিরক্তি তে ‘চ’ শব্দ করে অসন্তুষ্ট দৃষ্টি ফেলে গার্ডটির উপর। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খায় ছেলেটি। থতমত ভাবটা বাড়িয়ে ঠাসস চড় বসিয়ে দেয়। ছেলেটি গালে হাত দিয়ে মুখ হা করে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকায়। আফরা এবারও অসন্তোষ প্রকাশ করে দ্বিতীয় বার চড় লাগায়। গমগম কন্ঠে বলে উঠে,
~ যেখানে বস কিছু বলছে না, তুই বাঁধা দিস কেন? দ্বিতীয় চড় ঠিক এটাই না বুঝতে পারার জন্য। আদিল মাহমুদের চ্যালা হয়ে এমন নির্বোধ হয়েছিস, আমার দেখতেই লজ্জা লাগছে!
আদিল অপমান টা গাঁয়ে মাখে না। হাত দিয়ে ইশারা করতেই গার্ডটি পেছনে সরে যায়। আফরা এগিয়ে এসে আদিলের মাথার পেছনে বন্দুক ধরে। তিনটে মানুষ একে অপর কে ধ্বংস করতে উদ্ধত্ব! আফরা হেঁয়ালি করে বলে উঠে,
~ আসুন ট্রিগারে চাপ দিই, জাস্ট খেলা! তিনজনে মরে গেলে সব খেলা শেষ। এটাই ভালো হবে, আপাতত আপনার সো কল্ড বাবার জন্য!
আদিল চাপা স্বরে বলে,
~ অনল মাহমুদ কে ছোঁয়ার সাধ্য আপনার নেই মিস আফরা! আপনার কেন? মি. আফীফের মতো শ শ পালোয়ান এলেও অনল মাহমুদের দেখা পর্যন্ত পাবেন না। তাঁর হাতের মুঠোয় যতগুলো লোক রয়েছে; আপনাদের এক নিমিষে পিষিয়ে দিবে।
কথা বলা শেষ করেই আদিল রিভলবার গুটিয়ে নেয়। আফীফ আফরাও তাই করে। আদিলের মুখে চরম সত্য শুনেও দুজনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে নি। আদিল তক্তপোষের উপর বসতে যেতেই অনান ছুটে আসে, উন্মাদের মতো আদিল কে কিল ঘুষি দিতে দিতে বলে উঠে,
~ বসবি না এখানে, বসবি না। তুই পাপী, তুই খারাপ। এখানে আমার খালেদা জিয়ার ছোঁয়া আছে, তুই বসলে অপবিত্র হয়ে যাবে। দূরে যা , দূরে যা বলছি। বসবি না, তুই বসলে আমার খালেদা জিয়া মিলিয়ে যাবে। তোকে আমি মেরে ফেললো।
আদিল ফেরায় না। অনান কে স্পর্শ পর্যন্ত করেনা। চুপচাপ কিল ঘুষি হজম করে দাঁড়িয়ে রয়। আদিলের নির্লিপ্ততায় আফরা অবাক হয়ে এগিয়ে যায়। অনান কে সরিয়ে নেয় কাছ থেকে। তক্তপোষের একপাশে বসিয়ে দেয়। আদিল শান্ত কন্ঠে বললো,
~ ভালোবাসা হারালে কষ্ট হয়! হজম করে নিলাম। আমি এখানে যুদ্ধ করতে আসিনি। অনুরোধ করতে এসেছি। আদিল মাহমুদ অনুরোধ করতে এসেছে। এই যুদ্ধ থামিয়ে দিন। আপনারা চরম ভুল করছেন। অনল মাহমুদ কে ধরা আপনাদের কাম্য নয়। প্রিয়জন হারাবেন একে একে। আমি চাইছি না এই হারানোর সংখ্যা বাড়ুক। বুকের কষ্ট বাড়ুক। দুনিয়া তে এমন অনেক অনল মাহমুদ আছে। কয়জন কে ধরবেন? কয়জন কে খুঁজে বের করবেন? পারবেন না! ফিরে যান নিজেদের নীড়ে, মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যান। বান্দরবানে আর আসবেন না!
আদিল ফিরে যেতে চায়। পূর্বেই আফীফ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
~ দুনিয়া তে অনল মাহমুদ হাজার টা থাকলেও আফীফ মুনতাসির একটাই! যেখানেই দেশদ্রোহীর খোঁজ পেয়েছে, পরিবার পরিজন ভুলে ছুটে গিয়েছেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। আমার আদর্শ তিনি। আপনি যেমন বাবার ছেলে; আমিও আমার বাবার ছেলেই! আপনি দশজন নিয়ে আসবেন, আমি একাই যথেষ্ট তাদের রুখতে! বান্দরবান আদিল মাহমুদ নামে ভয়ে কাঁপলে; আফীফ মুনতাসির নামে পুরো ঢাকার ক্রিমিনাল রা কাঁপে! জাস্ট ওয়েট এন্ড সি; ক্ষত কিভাবে ফেরত দিতে হয় তা আমার ভালো করেই জানা!
আদিল একপলক আফীফ কে দেখে হেসে বেরিয়ে যায়। আফীফ আফরা’র কুঁচকানো মুখ দেখে প্রশ্ন করে,
~ ডায়লগ কি একটু বেশী হয়ে গেল?
আফরা এবার হতভম্ব হয়ে যায়। এ কোন আফীফ? লোকটা পাগল হয়ে গেছে! উন্মাদ হয়ে গেছে!
দুটো জিপ থেমে গেল ধীর গতিতে। যতটুকু শব্দ না করলেই নয়। নেমে গেল একদম ছেলেপেলে। শব্দ বিহীন জিপ থেকে নেমে অনল মাহমুদ চারপাশে নজর বুলান। নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সর্বত্রই। গভীর রাত! ঘুমে বিভোর সবাই। শুধু মাত্র একটি বাড়িতেই আলো জ্বলছে। অনল মাহমুদ চাঁদের আলোয় হাঁটতে থাকেন। কয়েক কদম হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়েন আলো জ্বালানো বাড়ি টাই। হাতের ইশারা পেতেই লোক গুলো কয়েকটা বোতল নিয়ে দৌড়ে আসে। ইঙ্গিত পেতেই পুরো বাড়িতে পেট্রোল গুলো ছিটিয়ে দেয়। অনল মাহমুদ কিটকিটিয়ে হাসেন। আরো কয়েক বোতল পেট্রোল রয়েই গেছে। অনল মাহমুদ লোকগুলো কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
~ দেড় যুগ পরে এসে, দেড় যুগ আগের কাহিনী রিপ্লেস করছি; ব্যাপার টা মজার। যাই একটু সাক্ষাত করে আসি, মৃত্যুর দূত হয়ে এসেছি!
হাসতে হাসতে এগিয়ে যায় অনল মাহমুদ। কলিং বেলে চাপ দেয়, হাসি নেই এখন মুখে। বেশী ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, দরজা খুলে যায়। নত করে রাখা মুখ উপরে তুলতে তুলতে বলে উঠেন,
~ সালাম! অনল মাহমুদ বলছিলাম, দেখা করতে চলে এলাম। কেমন আছে…
বাক্যটা সম্পন্ন করতে পারেন না তিনি। সামনে দৃষ্টি যেতেই কন্ঠ তার রোধ হয়ে আসে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হাত থরথর করে কেঁপে উঠে। দরজায় দাঁড়ানো কামিনী বেগমের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। দু পা পিছিয়ে যান তিনি। অসীম ভয়ে দরজা আটকাতে চান, পারেন না। অনল মাহমুদ ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েন। কামিনী বেগম আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলতে চান, এবারও ব্যর্থ হোন। আকস্মিক দেখা টা দুজনই মেনে নিতে পারেন না। কামিনী বেগম ঢুলে পড়তে নিলেই আগলে নেন অনল মাহমুদ। স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইলেন বন্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ধারা’র দিকে। অস্পষ্ট কাঁপা কন্ঠে বলেন,
~ কা মি নী ফু ল!
নিঝুম রাত্রির শেষ প্রহর। খানিক পরেই পূর্ব দিগন্তে সূর্য রশ্মির প্রভাব ফেলবে। জেগে যাবে প্রকৃতি, মানুষ। ছুটোছুটি লেগে যাবে সবার মাঝে। অন্ধকার এখনো সময়টাকে গ্রাস করে আছে। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় অসাড় হয়ে পড়ে থাকা শরীর টা দেখছেন অনল মাহমুদ। আঁকানো শরীর, বয়সের খানিক ছাপ, ঘুমন্ত মুখশ্রী! অনল মাহমুদের চোখে স্নিগ্ধতার প্রতীক হয়ে ধরা দিচ্ছে। অপলক, অনিমেষ তিনি দেখে যাচ্ছেন। যে মেয়েটা তাঁর যৌবনের প্রথম আকাঙ্ক্ষা ছিল, চোখের তৃপ্তি ছিল, অন্তরের ভালোবাসা ছিল; সেই মেয়ে টা কে তিনি দীর্ঘ দুই যুগ পর দেখছেন। পিপাসা কি আদৌও মেটার? সময়ের কাছে পরাজয় মেনে, স্থানের কাছে হেরে অনল মাহমুদ নিজের খোলস ছেড়েছেন। ভুলে গেছেন খানিক পরের পরিণতির কথা। ভুলে গেছেন শুয়ে থাকা মহিলার সাথে তার জীবনের চরম সত্যির কথা। এই মুহূর্তে শুধু চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন তিনি।
পিটপিট করে চোখ খুললেন কামিনী বেগম। আবছা আলো অন্ধকারে ঘরের কয়েকটা সরঞ্জাম দেখে বুঝার বাকি রইলো না তিনি কোথায় আছেন। হাসপাতাল! পাশে নজর রাখলেন, নেত্রপল্লবে অনল মাহমুদের মুখশ্রী ভেসে উঠতেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। অনল মাহমুদ চাপা শ্বাস ফেললেন। উঠে দাঁড়িয়ে বাম হাত বাড়িয়ে কামিনী বেগমের মাথায় রাখতে গিয়েও ফিরিয়ে নিলেন হাত। কামিনী বেগম আঁচ করতে পেরেছিলেন। মৃদু স্বরের ঝংকার তুলে বলে উঠলেন,
~ খবরদার আমাকে স্পর্শ করবে না।
অনল মাহমুদ মুচকি হাসলেন। নরম স্বরে বললেন,
~ একই তেজ, একই ভঙ্গিমা, একই মুখশ্রী, একই শরীর; কিন্তু সম্পর্ক আলাদা কেন? তুমি আর আমার নও কামিনী ফুল। আমি কি করে মেনে নিবো এটা? আমার সহ্য হচ্ছে না কামিনী ফুল। তু মি ব লো না তু মি আ মা র ই আ ছো!
শেষের বাক্য টায় হালকা তোতলালেন তিনি। কামিনী বেগম অত্যন্ত রুষ্ট। চোখের দৃষ্টিতে যেন অগ্নি ঝরে পড়বে। গলা খানিক উঁচিয়ে বললেন,
~ আমি তোমার কখনোই ছিলাম না অনল। এখন তো প্রশ্নই উঠে না। আমি সম্পূর্ণই নুরুল আলম সিদ্দিকী’র। আমাদের ভালোবাসার ফসল আমাদের ছেলে। একদম স্পর্শ করবে না আমায়, তোমার হাতের ছোঁয়ার অধিকারী অন্য কেউ !
অনল মাহমুদ আজ বড়ই শান্ত। প্রসঙ্গ ছেড়ে প্রশ্ন করে,
~ কেন ডিবোর্স দিলে কামিনী ফুল। আমার কামিনী ফুল আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেল? ভালোবেসে ছিলাম আমি, তোমার জন্য বাড়ি, গাড়ি, আভিজাত্য এবং কি মা বাবা ভাই সব ছেড়েছিলাম। সেই তুমিই আমায় চোখে আঙুল দিয়ে আমার ভুল টা দেখিয়ে দিলে? কেন করলে এমন?
চমকিত দৃষ্টিতে তাকালেন কামিনী বেগম। বিস্মিত কামিনী বেগম জবাব দেওয়ার কিছুই পেলেন না। তার মাথায় ঢুকছে না, সব কিছু জানার পরেও লোকটা কেন এসব বলছে। বিস্মিত মনোভাব কাটিয়ে কাটকাট কন্ঠে প্রশ্ন করেন,
~ ভালোবাসা? বড় বোন কে ভালোবাসার কথা বলে, বিয়ে করে; গোপনে ছোট বোনের সাথে নোংরামি চালিয়ে যাওয়াকে ভালোবাসা বলে অনল? এ কেমন ভালোবাসা?
~ আমার জীবনের সবচেয়ে ব্যর্থতা কি জানো? আমার ভালোবাসা আমাকে কখনোই বিশ্বাস করে নি।
~ আর কিভাবে বিশ্বাস করবো অনল? ছোট বোনের বুকে সুখ খুঁজা অনল কে দেখে কি বিশ্বাস করতে বলো? স্বামীর বড় ভাই যখন রাতে এসে বলে আমার স্বামী তারই বদল তার বড় ভাইকে পাঠিয়েছে রাত্রী যাপনের জন্য; কি করে বিশ্বাস করবো অনল? ছোট বোন যখন প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট এনে পায়ে পড়ে আমার কাছেই আমার স্বামীকে ভিক্ষা চায়; আর কিভাবে বিশ্বাস করবো অনল? আমি কখনোই আত্মমর্যাদা হীন ছিলাম না, না কারো সাথে ঢলাঢলির স্বভাব ছিল। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করা। মাহমুদ বাড়ির নির্মমতা জেনেও সেই বাড়িতে প্রবেশ করা।
অনল মাহমুদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কামিনী বেগমের দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
~ তুমি আমাকে ঠকিয়ে অন্য ছেলের সাথে চলে গিয়েছিলে কামিনী!
পরক্ষণেই মাথা চেপে ধরেন তিনি। মৃদু চিৎকার দিয়ে নিজের মতোই বলতে থাকেন,
~ এত বড় ষড়যন্ত্র? এতবড় ধোঁকা? আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে নিয়ে খেললো? বিশ্বাস করো কামিনী তোমার ছোট বোনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে আসতে চাইতো আমার কাছে, আমি বারংবার ফিরিয়ে দিয়েছি। তুমি তোমার বোন কে খুব ভালোবাসতে তাই আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। বলি নি কখনো। আর কি বললে? বড় ভাই কে আমি তোমার ঘরে পাঠিয়েছিলাম? তুমি এটা কিভাবে বিশ্বাস করলে কামিনী? যার দিকে কোনো ছেলে তাকালে বাঁচা মুশকিল হয়ে যেত, তার কাছে আমি আমার বড় ভাইকে পাঠাবো?
এতটা অবিশ্বাস?
কামিনী বেগম নিশ্চুপ। অনল মাহমুদ রাগে ফেটে পড়ছেন এবার। কামিনী বেগমের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলেন,
~ কি হলো আন্সার দাও কামিনী!
কামিনী বেগম অনুভূতিহীন চোখে তাকালেন। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
~ অবিশ্বাস করিনি তো! তোমার ভাই যখন রুমে এসে আজেবাজে কথা বললো তখনই আমার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোট বোনকে খায়েশ মিটিয়ে পিটিৌয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছোট্ট ছেলেটাকে যখন মারার হুমকি দিলো তোমার ভাই, এবং আমার সামনেই তিনবছরের বাচ্চাটিকে কষিয়ে থাপ্পড় মারলো; সহ্য করতে পারিনি। রাতে তোমাকে বলবো, দেখি মাতাল হয়ে তুমি ঢুলছো; শার্টে মেয়েলি ঘ্রাণ, লিপস্টিকের দাগ! তখনি বুঝেছিলাম আমার ভালোবাসা তোমাকে এখন আর টানে না। পরদিন সকালে তীব্র জ্বরে পড়েও ছোট বোন আমার প্রতিশোধ নিতে ভুলে না। আমার মারের যোগ্য জবাব দিতে তার ছেলের ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে হাজির হলো। যেখানে স্পষ্ট ছিল, অনল মাহমুদ ছোট্ট আদিলের বাবা। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে সেদিনই চলে এসেছিলাম। বুঝেছিলাম আমার ছোট্ট প্রাণ ওই পরিবেশে বাঁচতে পারবে না। তবুও একটা ছোট্ট আশা মনের ভেতর ছিল। অনল আমাকে ছাড়া কাউকেই ভালোবাসতে পারে না। কিন্তু একদিন খবর এলো অনল মাহমুদ বিয়ে করেছে, আমারই ছোট বোন কে। একটু খানি বিশ্বাস আমার ভেঙে গেল। সেসব অতিত ভুলে বছর কয়েকটা কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু পাষাণ অনল মাহমুদ অতিত ভুললো না। ঠিক আমাকে খুঁজে বের করে যমের দোয়ারে ঠেলে দিলো। সেদিন নুরুল না থাকলে হয়তো বাঁচতামই না। আমার বাঁশশক্তি কেড়ে নিয়েছো তুমি! অথচ দেখ সুখ কাড়তে পারো নি!
কামিনী বেগম তীব্র রাগে হালকা কাঁপছেন। জটিল কথা গুলো কেমন অনায়েসেই বলে দিলেন। অনল মাহমুদ ঢের বুঝলেন তার কামিনী ফুলের মনে তার জায়গা নেই। একটুও নেই। সেদিকে আর গেলেনও না। কাঁপা কন্ঠে শুধালেন,
~ আফীফ আমার ছেলে? আমার ছোট অগ্নি? আমার মানিক?
পিলে চমকে উঠলেন কামিনী বেগম। আবছা অন্ধকারে অনল মাহমুদের ছলছল চোখ তার এড়ালো না। বিচলিত হলেন তিনি। তবে সত্য স্বীকার করে মাথা নাড়ালেন। পরক্ষণেই বলে উঠলেন,
~ ছোট্ট অগ্নি কে নিয়ে আমি সংগ্রাম করছিলাম, সুন্দর একটি পরিবেশ আমি তাকে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যখন তোমার লোকদের পাঠালে আমার থেকে আমার ছেলে কে কেড়ে নিতে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মাহমুদ বাড়ি গেলে আমার ছেলে ঠিক তোমার মতো খু*নী হতো, নষ্ট হতো। প্রাণপণে ছুটছিলাম আমি ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে। বেশীক্ষণ যেতে পারিনি। তার পূর্বেই পেছন থেকে লাঠি ছুড়ে দেওয়া হয়। ঘাড়ে লেগে আমি রাস্তায় পড়ে যায়। একটুর জন্য আমার ছেলেকে তোমরা নিয়েই নিতে। তখনই নুরুলের জিপ আসে। তোমার লোকরা পালিয়ে যায়। এরপর থেকে যাত্রা শুরু। ওর বাড়িতে আশ্রয় নিই। কিছুদিন পরেই নুরুল ট্রেনিংয়ে চলে যায়। আমাদের বন্ধুত্ব টা গাঢ় হয়ে উঠেছিল। নুরুল বিয়ের প্রস্তাব দেয়, আমিও স্বার্থপরের মতো ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজী হয়ে যাই। ওর জন্য নুরুলের মতো বাবার খুব দরকার ছিল। নাহলে আমার ছেলে আজ বীরসেনা হতে পারতো না। নুরুলের ব্যবহার, আচার-আচরণ আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। কাঙালের মতো অপেক্ষা করেছে লোকটা। কিন্তু আমার ব্যর্থতা কি জানো? একজন খুনি, ধর্ষককে আজও আমি ভুলতে পারিনি। পারিনি মন থেকে মুছতে। আজও রাতের কোনো এক প্রহরে চোখ ভিজে আসে, মনে পড়ে সেই রাতগুলোর কথা। খুনসুটিময় গল্প গুলো চোখের পাতায় ভাসে। ঠিক তখন ভরসা হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় নুরুল। তখন আর তুমি আমার কাছে ধরা দিতে পারো না অনল!
অনল মাহমুদ উঠে দাঁড়ালেন। সবটা তার কাছে এখন ক্লিয়ার। কিন্তু কামিনী বেগমের কাছে প্রকাশ করলেন না কিছু। ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
~ তোমার জীবনের সবটা জুড়ে আমি। নায়ক, খলনায়কের ভুমিকায় সবই আমি। শেষ পর্যন্ত খলনায়ক হয়েই থেকে যাবো কামিনী ফুল। আজও বলবো তুমি নারী আমার জীবনে চরম ভুল ছিলে। ছলনাময়ী নারীর কবলে পুরুষ সত্যিই অসহায়। কেউ ছলনা করে হৃদয় কাড়ে, কেউ ছলনা করে হৃদয় ভাঙে, আবার কেউ ছলনা করে পুরুষের জীবন কে ফেলে দেয় ধ্বংসস্তূপে! সকল পুরুষের জীবনে নারী নিষিদ্ধ করা হোক!
কামিনী বেগম স্তব্দ দৃষ্টিতে ব্যাথা মিশ্রিত মুখটা কে দেখলেন। অনল মাহমুদ হাঁটা ধরলেন। দরজার কাছে গিয়ে আবার পিছু ফিরে বললেন,
~ সত্য কি জানো? এই অনল কামিনী ফুল কে এখনো ভালোবাসে।
কামিনী চোখ বুজে নিতেই অনল মাহমুদ বড় বড় পা ফেলে করিডর বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। বুকের ভেতর এক ছলকা ব্যাথা ঢুকে গেল, হু হু করে উঠলো মন। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে যে সত্য টা লুকিয়ে ছিলেন আজ ছেলের কাছে সব প্রকাশ হবে। ছেলে তাকে ভুল বুঝবে না তো? এই ভয় টার থেকে তার কয়েক ঘন্টা পরে কি হবে সেটা ভেবে ভয় লাগছে। তার জীবনে এই লোকটা যে কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে তার প্রমাণ ঝরে পড়া অশ্রু। তিনি আদৌও ঠিক জানেন তো? নাড়ি ছেঁড়া ধনের জন্য ঠিক ভুল বিচার না করেই মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন? ভাবতে পারেন না কামিনী বেগম। ঘরের ছাদে দৃষ্টি রেখে শুধু অশ্রু ঝরাতে থাকেন!
অনল মাহমুদ যখন নিজ বাড়ির কলিং বেল বাজালেন তখন পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিট। ঘুমন্ত বাড়ি, কলিংবেল বিকট আওয়াজ সৃষ্টি করে। মিসেস নুরি ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে ছিলেন। ইদানিং রাতে ঘুম আসে না, ফযরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল; কলিংবেলের আওয়াজে ছুটে যায়। তাড়াহুড়ো করে ছুটে যান তিনি। দরজা খুলে দিতেই অনল মাহমুদ ভেতরে ঢুকেন। সোফায় বসেন গম্ভীর মুখে। মিসেস নুরি ছুটে যান রান্না ঘরে, পানি নিয়ে ফিরে আসেন। বাড়িয়ে দেন অনল মাহমুদের দিকে। অনল মাহমুদ শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন মিসেস নুরির ঘুম ঘুম তৈলাক্ত মুখশ্রীর দিকে। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
~ তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনোই ছিল না, সে জানো তুমি?
~ স্বামী স্ত্রীর বিশেষ মুহূর্তে স্বামী যখন প্রাক্তন স্ত্রীর নাম নিয়ে হাজারো মধুর বুলি আওড়াতে থাকে; তখন স্ত্রীর আর বুঝতে বাকি থাকে কিছু?
মিসেস নুরির নির্লিপ্ত উত্তর। অনল মাহমুদ কিছুটা শব্দ করেই হাসলেন। মুহুর্তেই কন্ঠে কঠোরতা এনে শুধালেন,
~ আমার থেকে আমার কামিনী ফুল কে কেন কেড়ে নিলে নুরি?
মিসের নুরি চমকালেন, ভড়কালেন। ভয়ে কেঁপে উঠলেন। আচমকা বিস্ফোরিত প্রশ্নে হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে, ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল। অনল মাহমুদ যেন মজা পেলেন ভীষণ। অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হেসে কোমরে গুঁজা রিভলবার বের করে টি-টেবিলে রাখলেন। অতঃপর রসিকতা করে বলে উঠলেন,
~ ভয় পেয়েছো বেবি? আহা আমি আছি তো, তুমি কেন ভয় পাবে? বলো বলো!
মিসেস নুরি হাঁসফাঁস করছেন। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু আশেপাশে তেষ্টা মেটানোর কিছুই খুঁজে পেলেন না। একসময় তিনি শান্ত হয়ে গেলেন, বুঝলেন আজ তার নিস্তার নেই। অনল মাহমুদের পাশেই বসে পড়লেন তিনি। চাপা শ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,
~ আমি আর সফিকুল ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। লুকিয়ে, যখন তখন ও আমার কাছে আসার চেষ্টা করতো। পছন্দ হতো না আমার। পারিবারিক ভাবে বিয়ে করার সুযোগ ছিল না। তাই লুকিয়ে বিয়ে করি। সফিকুল তখন হাতে অনুমতি পত্র পেয়ে গেল। যখন তখন কাছে আসা, ভালোবাসা; এমন না আমার ভালো লাগতো না। ভালোবাসতাম তাকে। কিন্তু অসাবধানতাবশত ভুল হয়ে যায়, শরীরে মাতৃত্বের চিহ্ন দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ছুটে গিয়েছিলাম সফিকুলের কাছে। আমার সব আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসাকে ছুড়ে ফেলে আমাদের সন্তান কে অস্বীকার করে বসলো। আমি তখন চোখে অন্ধকার দেখি। আপা তখন তোমার সাথে পালিয়ে এসেছে, আবার যদি আমার মা হওয়ার খবর টা ছড়িয়ে যায় আব্বা মা মুখ দেখাতে পারবে না। হয়তো গলায় দড়ি দিবে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম ভালোবাসার পরিণতি যদি এটাই হয় আমি আর আমার পবিত্র ফুল টা মরে যাবো। কলঙ্ক নিয়ে বাঁচতে পারবো না। ভাবনাতেই রয়ে গেল সব, আপা সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে নিলো। আশ্রয় দিল তোমাদের বাড়িতে। একটু একটু করে ভ্রূণ টা বড় হচ্ছিল। মাতৃত্বের ছাপ ও স্পষ্ট হচ্ছিল। আপার আর তোমার ভালোবাসার সংসার দেখে আমারো স্বপ্ন বুনতে ইচ্ছে করতো। তোমাকে কখনোই আমি ভাইয়ের নজরে দেখতে পারিনি। কেন পারিনি বুঝতাম না। কিন্তু আপার সংসারে ঢুকার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। অনুভূতি টা নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু একদিন গভীর রাতে তোমার ভাই আমার ঘরে এলো!
থামলেন মিসেস নুরি। রান্না ঘর থেকে পানি এনে পর পর দু গ্লাস পানি শেষ করলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন,
~ একবছরের আদিল, দু বছরের অগ্নি বিছানায় ঘুমে বিভোর। তুমি হয়তো আপার সাথে সময় কাটাতে চেয়েছিলে, তাই আমার কাছে দিয়ে গেছ। তোমার ভাই আমার লোভ দেখালো টাকার, কাজ হলো না। তোমাকে পাওয়ার লোভ দেখালো; আমি একটু হলেও লোভী হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু যখন আপার মুখটা ভেসে উঠলো লোভ আর কাজ করেনি। তোমার ভাই রেগে গেল, ঘুমন্ত দুই শিশুর গলা টি*পে বলে উঠলো, মে*রে ফেলবে ওদের যদি না তার কথায় আমি রাজি না হয়! আমি জানতাম তার ক্ষেত্রে কি কি করা সম্ভব। আমার হাতে কোনো অপশন ছিল না। একদিন রাতে জানালো তোমাকে ভরপেট মদ খাইয়ে দিয়েছে। আমাকে কি করতে বললো জানো, মাতাল অনল কে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যেতে বললো। কি এক অসহায়ত্ব বোধ। তোমার ভাইয়ের পাঠানো মেয়েটা আদিল কে ধরে রাখলো।
একটু উনিশ বিশ হলেই মেরে ফেলবে। নিয়ে গেলাম ঘরে। আপাকে ওই মেয়েটা খবর দিলো, ছুটে এলো আপা। সেদিনই হয়তো আপা মরে গিয়েছিল। এরপর ভুয়া প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো আপাকে বলতে। আপার অবিশ্বাস ছিল, তোমাকে কিছু জানতে দেয়নি। তোমার ভাই যখন আপার ঘরে গিয়ে উল্টাপাল্টা বললো আপা বুঝে গিয়েছিল। রাগে দুঃখে রক্তাক্ত করেছিল আমাকে। কিছুই বলতে পারিনি। মনের মধ্যে জেদ চেপে গিয়েছিল, বারবার মনে হচ্ছিল একটা পদক্ষেপ নিলেই তোমাকে আমি পাবো। সুখের সংসারের লোভ মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমার অসময়ে যে আপা আমাকে আশ্রয় দিল, আমার অনাগত বাচ্চার সব দায়িত্ব নিলো, আমাকে কলঙ্ক থেকে বাঁচালো; সেই আপায় আমার কাছে বিষের মতো মনে হচ্ছিল। আদিলের ভবিষ্যত, রিস্ক; মাথা গুলিয়ে ফেলেছিল।
পরদিন টাকা দিয়ে মিথ্যে রিপোর্ট করলাম। তোমাদের নিজস্ব হসপিটাল থাকায় কোনো অসুবিধায় হয়নি। আদিল কে তোমার সন্তান রূপে তুলে ধরলাম আপার কাছে। এটাও বললাম এই বাড়িতে ঢোকার জন্যই মিথ্যে বলেছি, সফিকুল বলতে কোনো লোক আমার জীবনে নেই। আপা বিশ্বাস করেছে কিনা জানি না, কিন্তু বুঝে গিয়েছিল তার অগ্নি এই পরিবেশে থাকতে পারবে না। হয়তো মরবে, নয়তো মাহমুদদের মতোই রক্ত নিয়ে খেলবে। রাতের আঁধারে পালিয়ে গেল। তোমাকে বুঝানো হলো কোনো ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। ভালোবাসা হারানোর ব্যাথা, ছেলের জন্য তুমি পাগল প্রায়। তোমার ভাই আমাকে হুকুম করলো আদিল কে তোমার কাছে রাখতে। মায়া হবে, তুমিও ট্রমা থেকে উঠতে পারবে। তাই হলো। ছোট্ট আদিল তোমার মনে বিশাল জায়গা করেছিল।
আর বলতে দিলেন না অনল মাহমুদ। নিজে বলে উঠলেন,
~ আদিল যখন আমার সর্বত্র জুড়ে আমার ভাই এলো কাছে। বললো আদিল কে জীবিত রাখতে আমাকে তাদের সাথে যোগ দিতে হবে। চোরা*চালান, খু*ন এসব অপরাধের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। যার মূলে ছিল কামিনী। ওর ভালোবাসা আমাকে এসব থেকে দূরে রেখেছিল। কিন্তু আমার ভাই বাধ্য করলো। কামিনী কে আমার জীবন থেকে সরিয়ে আদিল কে গুটি বানালো। ছোট্ট আদিলের প্রাণ বাঁচাতে অনল হয়ে উঠলো অনল মাহমুদ। মাহমুদ বংশের উত্তরাধিকার, সকল ব্যবসায়ের পরিচালক। কামিনী যেন আমার জীবনে আর না ঢুকতে পারে জোর করে ডিবোর্স দেওয়ালো। কামিনীর পাঠানো ডিবোর্স পেপার সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম। ডিবোর্স হওয়ার পরপরই জুড়ে দিল তোমাকে। মানতে পারছিলাম না। ব্যবসায়ে নিজেকে ডুবিয়ে নিলাম। আদিল হয়ে উঠলো আমার জীবন। কিন্তু সেই আদিল যখন বুঝতে শিখেছে। আমার ভাই তাকেও কাজে লাগালো। বলে দিল আমি তার জন্মদাতা নয়। ছেলের একেকটা প্রশ্ন আমাকে মৃত্যুর স্বাদ পাওয়াচ্ছিল। বলে দিলাম সব কিছু। এরপর থেকে অনল মাহমুদ আর আদিল মাহমুদের জার্নি শুরু। দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু তুমি আমাকে ঠকিয়েছ নুরি। আমি তোমার কাছে কখনোই আসি নি নুরি। তাহলে অনিক কি করে হলো? কি করে নুরি?
~ তোমার ভাই চেয়েছিল! আরেকজন আসুক! আমি শুধু গুটি হয়েছি। নাহ এটা বললে ভুল হবে আমার ইচ্ছার বাইরে হয়নি কিছু। জৈবিক চাহিদা সবারই আছে। আমারো ইচ্ছে হতো স্বামীর সান্নিধ্য পেতে, ভালোবাসায় বাঁধতে চেয়েছিলাম তোমাকে। আমার স্বামী তার প্রাক্তন স্ত্রীর মাঝে ডুবে থাকুক আমি চাইনি। কিন্তু মাতাল অনল যখন আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে বারংবার কামিনী ফুল কামিনী ফুল করছিল তখনই বুঝেছিলাম এ জীবনে তোমাকে পাওয়া হবে না!
~ আমার ছেলের জন্য তোমাকে সহ্য করতে হয়েছে নুরি। এইযে সবাই আমাদের পারফেক্ট কাপল বলে চিনে আদৌও সত্যি? সবকিছু লোক দেখানো ছিল! কিন্তু অনিকের প্রতি টান ছিল আমার। আদিলের মতো ভালো না বাসলেও সেও আমার হৃদয়ের অংশ ছিল। তাকেও আমার ভাই পাগল করে রাখলো। আমি যেমন ভালোবেসে বিয়ে করে ভুল করেছিলাম আমার ছেলেও একই ভুল করলো। তার খেসারত তাকে জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে। অকালে ঝরে পড়লো আরেকটা ফুল। অথৈ! মেয়েটা প্রাণবন্ত ছিল, টান ছিল; কিন্তু রক্ষা করতে পারিনি। আমার আদিলও একই ভুল করতে যাচ্ছিল। মিরা কে ভালোবেসে ভুল করেছিল। তার খেসারত, মোহনলালের ভুলের খেসারত ও মিহাকে দিতে হয়েছে। মিরা ভুল বুঝবে আদিল কে, আদিল আর পাল্টাবে না; এমনই ফন্দি করেছিল আমার ভাই! কিন্তু দেখ আমার ভাই যাদের জন্য এত কিছু করলো তারা কেউ এখন বেঁচে নেই! প্রশ্ন করতে না নাদিয়ার প্রতি এত ক্ষোভ কেন? আমি ভালোবাসতে চেয়েছি নাদিয়াকে। কিন্তু ওর মুখ দেখলেই আমার মনে পড়তো আমার জীবন ধ্বংসকারীর রক্ত তার শরীরে বইছে। হ্যা আমার ভাইয়ের মেয়ে সে! পারতাম না মেয়েটাকে ভালোবাসতে। অনল মাহমুদ যেন কামিনী কে না খুঁজতে পারে; আমার ভাই তার দশ বছরের ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে দিল। সেই মবিন আজ মৃত; কিন্তু আদিল কে আমি কিভাবে বাঁচাবো নুরি? খবর যে পৌঁছে গেছে!
শেষের কথাটায় গলা কাঁপলো অনল মাহমুদের। পরক্ষণেই কি যেন মনে করে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিল থেকে রিভল*বার টা তুলে নিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। দাঁড়ালেন মিসেস নুরির একদম কাছে। ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
~ তোমার লোভ তোমাকে এতটা পথ এনেছে নুরি। জীবনে একবার ঠকে গিয়ে তোমার শিক্ষা হয় নি। আদিলের সাথে সাথে তুমি নিজের জন্যও ভেবেছিলে। যে আপা তোমার জীবন বাঁচালো সেই আপার বুকেই ছুরি বসালে। বড্ড ভুল করেছো নুরি। আমার জীবনের শেষ খু*ন হয়তো এটাই! আমাকে ক্ষমা করো নুরি!
মিসেস নুরি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিলেন। বলতে পারলেন না। পর পর দুটো বুলেট পেট ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল। অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাসলেন অনল মাহমুদ। জমিনে লুটিয়ে পড়া দেহটার দিকে তাকালেন না, হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। গাড়িতে উঠার পূর্বেই কাউকে ফোন করে বলে উঠলেন,
~ আফীফ মুনতাসির আমার ছেলে! আমার রক্ত! একটু ক্ষতও যেন না হয়! ধ্বংস করে দিবো সব!
ফোন কাটতেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু অপরপাশের মানুষ টার রসিকতা কথায় থেমে গেলেন তিনি,
~ কিছু করবো না! তুমি আমাকে আড়ালে রাখলে আমি তোমার দু ছেলেকে আড়ালে রাখবো। ডিল ডান?
অনল মাহমুদ হাসলেন। ফোন কেটে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। ছেলেটাকে একটু ছুঁয়ে দিতে খুব ইচ্ছে করছে। বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে অনেক কথা। কিন্তু উপায় নেই। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে ফোন দিলেন পরিচিত এক নম্বরে। অপরপাশ থেকে ভেসে এলো শান্ত কন্ঠস্বর,
~ আব্বু!
অনল মাহমুদের গলা কাঁপছে। শক্তপোক্ত অনল মাহমুদ কথা বলতে হিমশিম খাচ্ছেন। শুকনো ঢোক গিললেন বার কয়েক। রয়েসয়ে চাপা সুরে বললেন,
~ আব্বু তোমাকে অনেক ভালোবাসে আদি!
~ ছোট্ট আদিলের প্রাণের থেকে শতশত প্রাণ খুব জরুরী ছিল আব্বু!
অনল মাহমুদ মুচকি হাসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
~ বাবা হও নি তো! একজন বাবার কাছে সন্তানের উপরে কেউ না! স্বার্থের এই দুনিয়ায় মানুষ নিজের ছাড়া অন্যের ভাবে না আদি! যাই হোক, শেষ একটা কথা রাখবে আদি?
~ আদিল মাহমুদ বাবার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত!
~ নিজ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিবে না আদি। আমি যা করবো, যা বলবো চুপচাপ দেখে যাবে! ধরে নাও এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চাওয়া!
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৭+৫৮
আদিল চুপ রইলো। গলাটা স্বাভাবিক নয়। ভয় করছে তার। কাঁপা গলায় বললো,
~ আপনাকে স্বাভাবিক লাগছে না আব্বু!
কল কেটে দিলেন অনল মাহমুদ। পূর্বে ছোট্ট করে বললেন,
~ কথাটা রেখ আদি!