হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৪
Tahrim Muntahana
গভীর রাত! চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে আছে। ঘুমন্ত শহর, নিশ্চুপ। সরু রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে আরাফ। বিধ্বস্ত তার চেহারা, চোখমুখে ভয়-ব্যাথার ছড়াছড়ি। ফোলা চোখের কোণ ঘেসে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কা*টা গালটায় কেমন সাদা মাংস বের হয়ে আছে। রক্তিম নাক টা থেতলে গেছে। কা*টা বাম হাত নিয়ে ছটফট করতে করতে দৌড়াচ্ছে সে। উদ্দেশ্য লোকালয়! হাইওয়ের বড় রাস্তা ধরে এখনো সাই সাই করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। একবার রাস্তাটা ধরতে পারলেই তার জীবন আজ বেঁচে যাবে। কা*টা হাতের কাঁধ চাপড়ে ধরে পেছনে ঘুরলো আরাফ।
হুড়ি জ্যাকেট পরিহিত লোকটার হাতে মস্ত বড় ছু*রি, তাকে ধরার জন্য ধাওয়া করছে। যদিও সে এখন লোকটার পায়ের শব্দ ছাড়া কিছুই দেখতে পারছে না তবে লোকটা কে যে সে দেখেছে! অনুমান তার ভুল নয়! আরাফের গলা ছেড়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভয় ব্যাথায় গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আওয়াজ করলেই অন্ধকারে লোকটা তার অবয়ব টের পেয়ে যাবে। তাকে ধরে মস্ত বড় ছু*রিটা গলায় বসিয়ে দিবে, আর সে ছটফট করতে করতে মৃত্যর কোলে ঢুলে পড়বে। কথাটা মনে হতেই যেন আরাফের পায়ের গতি বৃদ্ধি পায়। একসময় হাইওয়ের রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট টা চোখে পড়তেই আশার আলো খুঁজে পায় সে। ওই যে দ্রুত বেগে এক গাড়ি আসছে। বারবার উপর ওয়ালা কে ডাকছে সে, এইবরের মতো বাঁচিয়ে নেওয়ার কত প্রার্থনা। প্রার্থনা টা যেন কবুল হয়েই গেল। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল সে। দ্রুতগামী ট্রাক টা শরীর টাকে ছুড়ে ফেলতে গিয়েও থেমে গেল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পটলা মাছের মতো লাফানো বুক, কুকুরের মতো বের করা জিহ্বা নিয়ে আরাফ ঢলে পড়লো রাস্তায়! ট্রাক ড্রাইভার কে নামতে দেখেই হুড়ি পড়া লোকটা লুকিয়ে পড়লো গাছের আড়ালে। তীক্ষ্ম রক্তিম চোখ মেলে দেখতে লাগলো নেতিয়ে পড়া শরীরটা। চোখে যেন আক্রোশ, খিদে! রক্তের খিদেয় বটে! আজ যে শিকার তার হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ট্রাক ড্রাইভার যখন তাড়াহুড়ো করে আরাফের শরীরটা মালবাহী ট্রাকটাই তুলে হসপিটালের পথ ধরলো লোকটা আড়াল থেকে বের হলো। ডান হাতে থাকা ছুরিটা মুখ বরাবর ধরে নাক টেনে ঘ্রাণ নিলো। আহা! রক্তের ঘ্রাণ এত মিষ্টি কেন? খেতে না জানি কতটা মিষ্টি হবে। হয়তো অমৃত! বারকয়েক নিঃশ্বাস টেনে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
~ দ্বিতীয় বার আমার মুখোমুখি পড়িস না! তোর রক্তের ঘ্রাণ যে আমার পাকস্থলী নাড়িয়ে দিয়েছে! যতক্ষণ না স্বাদ গ্রহণ করবে, থামবে না!
অন্ধকারে আসা আগুন্তক আবার অন্ধকারেই মিশে গেল, মিলিয়ে গেল রাতের কৃষ্ণকুহরে! হয়তো আবার কোনো একদিন দেখা মিলবে, হাতে শোভা পাবে মস্ত বড় সেই ছু*রিটা, তীক্ষ রক্তিম থাকবে নয়ন যুগল, মনে থাকবে রক্ত পানের আকাঙ্ক্ষা! এতটুকুই তো যথেষ্ট কারো জীবনের অন্তিম টানতে!
…
~ কিরে বোন আজ এত দেরীতে ঘুম থেকে উঠলি? রাতে ঘুমাস নি?
বড় বোনের কথায় কিছুটা চমকালো অথৈ। ধরা পড়ার একটা ভাব। আফরা যেন এক নিমিষেই বুঝে ফেললো বোনের মনোভাব। রাগে কঠোর হলো তার মুখশ্রী। গজগজ করে বলে উঠলো,
~ দুধ দিয়ে কালসাপ পুষি। খায় আমার টাকায়, চিকিৎসা চলে আমার টাকায়, ভাবে অন্যকারোর কথা। মরিস না কেন তুই?
কথাটা বলতে বলতেই কেঁদে উঠলো আফরা। চুপচাপ সেই তপ্ত নোনা জল দেখে নিলো অথৈ। দেখতে দেখতে কখন তার চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো একটুও টের পেল না। টের পেল তখন যখন আফরা তার ধার ঘেঁষে বসেছে। নরম হাতে চোখের জল মুছিয়ে দেয়, কেঁপে উঠে অথৈ, মুখে ফুটে উঠে ব্যাথা। বলতে ইচ্ছে করে অনেক কথা, বলতে পারে না। তার ভালোবাসা যে শুধু তার গলার স্বর টাই কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে চারটে বছর, কেড়ে নিয়েছে তার জীবনের সকল সুখ! কোন মুখে বোনকে জবাব দিবে? সেই সাধ্য যে তার নেই। আফরা বলে,
~ খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হবি বোন। আমি তোকে মস্ত বড় ডক্টর দেখাবো। আর মাত্র কয়েকটা মাস কষ্ট কর, এর পর তুই সুস্থ হবি, দু বোন এই শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবো। এ শহর ভালো না!
চুপ থেকে নিরব সমর্থন জারি করলো অথৈ। চোখ মুছে ঘর থেকে বের হয়ে গেল আফরা। কয়েক লোকমা ভাত খাইয়ে দিয়ে, ঔষধ খাইয়ে দিল বোনকে। তারপর নিজেও কিছুটা খেয়ে বেরিয়ে পড়লো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। যদিও আজ ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে তার ছিল না। তবে যাকে কেন্দ্র করে তার সাথে সম্বোধনের খেলা চলছে তাকে তো চিনতে হবে! মনে মনে পণ ও করে নিয়েছে আজ যে প্রথম তাকে ভাবী বলে ডাকবে, গলা চেপে ধরে হলেও পেট থেকে কথা বের করে ছাড়বে। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, ভার্সিটি তে টিকে থাকা মুশকিল হবে।
সারা ঘরময় ছুটোছুটি করছে মনিরা। আজ আনন্দগুলো যেন উপচে পড়তে চাইছে। পুরো বাড়ি আজ আহাজারি, চিৎকারে গমগম করলেও মনিরার মাঝে কোনো রকম বিষাদের চিহ্ন নেই। একজন ধর্ষকের জন্য আর যাই হোক সমবেদনা মানায় না। তার তো ইচ্ছে করছে ভালো হাতটাও দুমড়ে মুচড়ে দিতে। আর কোনো দিন যেন কোনো মেয়ের সম্মানে থাবা না বসাতে পারে। কাল রাতেই খবর এসেছে। বাড়ির বড় ছেলে পুলিশ অফিসার আতিকুর ডিউটি থেকে এসেছে সবে, তখনি খবর টা পেয়েছে। ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই ছুটে গিয়েছিলো । ভাইয়ের এমন অবস্থায় আরামের ঘুমে বিভোর থাকতে পারে সে? খবরটা তখনও মনিরার কানে পৌঁছায় নি! আজ সকালেই সে পেয়েছে, তার পর থেকেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। আপাতত এখন নিজের শশুড় বাড়িতে ধর্ষণ হওয়ার ভয় পেতে হবে না! এমন অশ্লীলতা যে তার সহ্য হয় না!
~ আমার চা এখনো আসলো না কেন? ঘুমাচ্ছো রান্না ঘরে?
স্বামীর গম্ভীর চিৎকারে ট্রে ধরে রাখা হাতটা সামান্য কেঁপে উঠলো মনিরার। ভয়ে ঢোক গিললো। খুশিতে ভুলেই গিয়েছিল। পা চালিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত সে। আজ হঠাৎ তুমি! স্ত্রীকে দেখে আতিকুর মুচকি হাসলো। মনিরার অবাকতা যেন বেড়েই চলছে। হুট করেই আতিকুর মনিরার হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে অন্যত্র রেখে জড়িয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে। এবার যেন মনিরা বাকরুদ্ধ, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার পেল না। আতিকুর বললো,
~ আজ মন টা বেশ ভালো দেখছি?
মনিরা তবুও চুপ। আতিকুরের হাসি চওড়া হলো। বউয়ের নরম গাল টা টেনে বললো,
~ জানো, আজ আমি খুব খুশি। এতটা খুশি আমি গত কয়েক বছরে হইনি।
~ এত খুশি কেন?
বোবার ভান টা ছেড়ে মুখ খুললো মনিরা। অস্পষ্ট স্বরের কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই রহস্যময় হেসে আতিকুর বললো,
~ যে কারণে তুমি এত খুশি!
…..
~ ভাবী সম্বোধনের কারণ, মাধ্যম আজ না বললে; এখান থেকে সোজা প্রিন্সিপালের রুমে যাবো। বুঝতেই পারছেন ক্ষতিটা কার হবে!
ভয়ে বড়সড় এক ঢোক গিললো সামনের মেয়েটি। প্রিন্সিপাল স্যার মানেই তাদের জন্য জম। এই লোকটা এতটা কড়া! যদি শুনতে পারে ব্যাপারটা, এখনি হয়তো ভার্সিটি থেকে বের দিবে। আফরা সেই সুযোগটাই নিয়েছে। এদের কিছু বলেও লাভ হচ্ছে না, মন খুশিতে ভাবী ডেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সকলের ভাবী ডাকার জন্য সে উন্মুক্ত, সরকারি একটা ভাব! মেয়েটা ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
~ আপু আমি তো জানি না, আপনি বড় ভাইয়াদের জিজ্ঞেস করুন। তারা যা বলতে বলেছে আমরা তাই বলছি!
আফরা হাসলো। মেয়েটার হাত টা শক্ত করে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
~ এই যে তোমার চোখ; আমি স্পষ্ট ভয়, মিথ্যে দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখ এড়িয়ে যাওয়া এতটা সহজ নয়। আমি অপারগ এখন, এতগুলো মানুষের দোষের শাস্তি তোমাকে একাই বহন করতে হবে। কারণ একটাই, তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো!
মেয়েটি এবার ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে উঠলো। দাঁড়িয়ে গেল আফরা। কোনো রকম সমবেদনা, সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। অপেক্ষা করলো মেয়েটির শান্ত হওয়ার। মেয়েটি খানিক পর শান্ত হলো। ফ্যাচফ্যাচ কন্ঠে বললো,
~ আপু ভাইয়া রা আমাদের ভাবী ডাকতে বলেনি, শুধু ছেলেদের বলেছিল। যাতে আপনাকে কেউ ডিস্টার্ভ করতে না পারে, আপনার যেন কোনো সমস্যা না হয়। আর কিছু বলেনি, এর জন্য আমরাও মজা করে আপনাকে ভাবী ডাকছি। আমার কাজিন একজন এখানের সিনিয়র। আমি তার থেকেই শুনেছি সব।
আফরা চোখ মুখে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো। ভার্সিটি তে তিনটা বছর কাটিয়ে ফেললো নিজের মতো, এখন আসছে ডিস্টার্ভ যেন না করে সাবধান করতে! বিষয়টা হাস্যকর। মজা করার ব্যাপারটা নিয়ে আফরার চোখ মুখ লাল হয়ে এলো। সে কি মজার পাত্রী, নাকি এরা তাকে পাগল ভাবছে? যে যেভাবে পারছে মজা করছে। কাটকাট গলায় বললো,
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩
~ এতকিছু জানতে চাই নি। আমার অজানা, অচেনা জামাই টা কে সেটা বলুন! যার মেহেরবানী তে সরকারী ভাবী হয়ে গেলাম, তার দর্শন না পেলে চলবে?
মেয়েটা এদিক ওদিক তাকিয়ে কেউ আছে নাকি দেখে নিলো। আফরার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
~ আদিল মাহমুদ!