হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৮
Tahrim Muntahana
বস্তির সরু রাস্তা দিয়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটছে আদিল। চারপাশ ধুলোবালি, ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ তে ঠাসা। কোনো রকম নাক ছিটকানো ভাব নেই। সাদামাটা টিশার্ট, চোখে চশমা, মুখে মাস্ক পড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন হয়ে হেঁটে চলছে আপন মনে। হাতে শোভা পাচ্ছে সাদা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট। একটু পর পর হাতে থাকা প্যাকেটের দিকে চোখ বুলাচ্ছে, আবার চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ টাও দেখে নিচ্ছে সে। সুক্ষ্ম এক চোর চোর ভাব। যে কেউ ই দেখলে ধরতে পারবে না। হঠাৎ করেই তার মনে হচ্ছে পেছনে কেউ একজন আছে, যে তাকে বেশ খানিকটা সময় ধরে অনুসরণ করছে। প্রথমে খুব একটা পাত্তা না দিলেও ব্যাপারটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। হাঁটার গতি থামিয়ে দিয়ে যেই না পেছনে ঘুরেছে আফরা কে দেখে তার চোখ জ্বলে উঠেলো। মেয়েটাও একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এভাবে ধরা পড়ে যাবে হয়তো ভাবতে পারেনি। আদিল ভাবছে মেয়েটার সাহস নিয়ে। সীমা ছাড়িয়ে গেছে না? গমগম কন্ঠে বললো,
~ আপনার কি মনে হয় মিস আফরা ইবনাত? আমাকে ভেদ করা এত সহজ?
আফরা খানিক কেঁপে উঠে। তবে নিজের ভয় আদিল কে সম্পূর্ণ বুঝতে না দিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় আদিলের সামনে বরাবর। মুখে মুচকি হাসি বজায় রেখে বলে উঠে,
~ আফরা ইবনাতের কাছে কোনো জটিলতায় বেশি দিন টিকতে পারে না। এই দেখুন না, কেউ কি আদিল মাহমুদ কে অনুসরণ করার সাহস দেখিয়েছে কখনো? কিন্তু আফরা ইবনাত নামক মেয়েটা কিন্তু পেরেছে। যদিও ইচ্ছে ছিল না, জাস্ট কৌতুহল!
রাগে হাত দিয়ে কপাল ঘঁষে আদিল। এই মুহূর্তে রাগ করা মানে বিনা নোটিশে শত্রুর মুখে পড়ে যাওয়া। বর্তমানে সে এমন কিছু চাইছে না। তাই নিম্ন সুরে বলে উঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ কৌতূহল মিটেছে? এবার আপনি আমার পিছু ছাড়লে ধন্য হবো!
~ এই মুহূর্তে ধন্য আমি আপনাকে করতে পারলাম না। কৌতূহল জুড়ালো হয়ে সন্দেহে রূপ নিচ্ছে। আপনি এখানে কি করছেন মি. আদিল মাহমুদ?
বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে আদিল। রাগে মনে হচ্ছে পেট গুড়ুগুড়ু করছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। তবে তাকে যেকোনো উপায়ে শান্ত থাকতে হবে। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
~ চারপাশ দেখেন, একটা কাকপক্ষীও নেই। দুপুর সবে, বস্তির মেয়ে বউ রা ভাত ঘুম দিয়েছে, পুরুষ রা কর্মক্ষেত্রে। এই মুহূর্তে আমি আপনার সাথে যা কিছু করতে পারি। এই যে দেখেন, মেয়ে মানুষ! পুরুষের রক্ত তো গরম হবেই। ধরেন হাত ধরে টেনে নিয়ে বস্তির কোনো ঘরে চলে গেলাম, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা আমার এক মিনিটের কাজ! আবার ধরেন গলায় ছুরি ও চালিয়ে দিতে পারি। আমি আদিল মাহমুদ মানুষ খুব একটা সুবিধার নয় কিন্তু। সাবধান হন, আপনার জন্যই মঙ্গল!
ঘৃণায় গাঁ রি রি করে উঠে আফরার। লোকটা তার নারীত্বের উপর থাবা বসানোর হুমকি দিচ্ছে? সে দুর্বল? সাহসী মনোভাব নিতে গিয়েও যেন ভেতর থেকে নিজেকে দুবর্ল টের পাচ্ছে আফরা। পুরুষের সাথে একটা নারী কখনোই পারবে না! আদিল গা জ্বালানো হাসি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। অপমানে ঘৃণায় এক দলা থুতু মাটিতে ফেলে হেসে উঠে আফরা। তার এখন মজার মুড এসেছে। তাই আদিলের গাঁ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
~ ভাগ্য সুপ্রসন্ন! বিয়ে তো আপনার আমাকেই করতে হবে, সে হোক আপনি আগে ধর্ষক উপাধি পেলেন! সারাজীবন চোখ মেলাতে পারবেন তো?
সীমা থাকে তো? আদিলের মনে হচ্ছে মাথায় রাগে রা কিলবিল করছে। দাঁতে দাঁত চেপেও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। সময় তার হাতে খুব কম। দশমিনিট সময়ের মধ্যেই তাকে এই ঝামেলা এড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। রাগে চোখ রক্তিম হতেই হাতের প্যাকেট মাটিতে ফেলে আফরা’র হাত আকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আদিল। পকেট থেকে মিনি সাইজের ছুরি টা বের করে গলায় চেপে ধরতেই আফরা চোখে যেন সর্ষে ফুল দেখে। একটা টান, তার জীবনের ইতি ঘটাতে সক্ষম। বড় বড় চোখে আদিলের ছুরি ধরা হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাগের তোপে আদিল হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
~ বলেছিলাম না আদিল মাহমুদ মানুষ টা সুবিধার নয়। ‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে’ উক্তিটা একদম সঠিক। এতদিন ছাড় দিয়েছিলাম বলে খুব উড়ছিলি না? ডানা আজ একেবারেই ছেটে ফেলি?
আফরা চুপ থাকে। ব্যাথায় চোখ মুখ অসম্ভব কুঁচকে আসছে। ছুরিটা ধারালো হওয়ায় গলায় বসে গিয়ে খানিক রক্তও বের হচ্ছে। আদিল আবার বলে উঠে,
~ তোকে মেরে এখানে ফেলে রাখলে কেউ খুঁজ নিতে আসবে না। এমন বস্তিতে অহরহ লাশ পাওয়া যায়। কয়েক দিন পুলিশের দৌড়ঝাঁপ তারপর শেষ! আমার টিকিটিও কেউ খুঁজে পাবে না। মেয়ে মানুষের এত সাহস ভালো না! তোরা মেয়ে মানুষ থাকবি পুরুষের বিছানার সঙ্গী, খেদমতের জন্য, একদম পায়ের তলায়; তুই তো মেয়ে মানুষের ধারায় পাল্টে দিলি!
আফরা’র আর সহ্য হয় না। মেয়ে মানুষ এত নিচ? মা জাতিকে যে মানুষ টা পায়ের তলায় রাখে তাকেও তো দেখানো উচিত! জুতার হিল দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি বসায় আদিলের পায়ে, ছুরি ধরা হাতটা গলা ছেড়ে দেয়। সুযোগ বুঝে ছুরিটা এক টানে নিজের হাতে নিয়ে আদিলের পেটে ঘুষি বসিয়ে দেয় আফরা! ঘোরের মধ্যে আছে মনে হয় আদিল। কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো, ততক্ষণে এক মেয়ের হাতে ঘুষি খেয়ে সে বসে পড়েছে মাটিতে। আফরা’র চোখে যেন প্রতিশোধের নেশা চেপেছে। একটু আগে লোকটা যেভাবে তার গলা কা* টার হুমকি দিচ্ছিল, কাজটা পুনরায় ঘটাতে ইচ্ছে করছে। সময় ব্যয় করে না আফরা, গলা ধরে ধাক্কা দিয়ে আদিল কে মাটিতে ফেলে উপরে বসে পড়ে, সাথে সাথে হাত চালিয়ে দেয় গলায়। চমকে উঠে আদিল। ভীষণ অবাকতা ফুটে উঠে চোখ মুখে। নিজের বিজয় সুনিশ্চিত দেখে আফরার মুখে হাসি ফুটে। ঠিক আদিলের মতো হিসহিস করে বলে উঠে,
~ তোকে মেরে এখানে ফেলে রাখলে খুঁজ নিতে সবাই আসবে। শহর তন্নতন্ন হয়ে যাবে। লোকমুখে একটা কথায় শোভা পাবে, ‘কার এত সাহস হলো আদিল মাহমুদ কে হ* ত্যা করার। কে করলো এমন টা!’ সবাই ভাববে তোর কোনো শত্রু, তোর কোনো বিরোধী দল। কিন্তু কেউ বুঝতে পারবে না তুই কোনো এক মেয়ের হাতে নিজের প্রাণ হারিয়েছিস। সে মেয়েটা এই আফরা ইবনাত!
কুটিল হাসে আদিল। আফরা ভড়কে যায়। তবুও শক্ত হাতে ছুরিটা ঠিক গলায় চেপে ধরে থাকে। আফরার রক্ত যেমন প্রবাহিত হয়েছে, তেমনি আদিলের রক্ত ও প্রবাহিত হচ্ছে। তবে দুজনের কারোরই সেদিক বিন্দু মাত্র নজর নেই। দুজন যেন এই মুহূর্তে কথার যুদ্ধে নেমেছে। সাহসীকতার যুদ্ধে নেমেছে। ‘তুমি যতই ভয় দেখাও আমি ভয় পাচ্ছি না’ এমন টাইপ স্লোগানে দুজন যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। হাসে থামিয়া আফরার চোখে চোখ রেখে আদিল বললো,
~ আপনি আমাকে মারবেন না জানি! এই যে আপনার চোখে শুধু প্রতিশোধ, নারীজাতিকে নিচু করেছি বলে গর্জে উঠেছেন! এই গর্জে উঠা ঠিকঠাক কারো প্রাণ নিতে পারবে না। আপনার উচিত আরেকটু সাহস নিয়ে আমার সাথে যুদ্ধে নামা!
বড় বড় নয়ন যুগলে রক্তিম আভা। আফরা চোখ বুজে হজম করে নেয় কথাগুলো। লোকটা যে তার দৃষ্টি ঘুরাতে চাইছে সে ঢের বুঝতে পারছে। তাই আদিলের পুরো পরিকল্পনা টাকে নষ্ট করে দিয়ে ছুরিটা আরেকটু চেপে ধরে বললো,
~ আপনার মতো কিট কে আমি এখনি শেষ করে দিতে পারি! আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না। একদম শেষ হয়ে যাবেন। তবে আমি দুর্বল কে কখনো কখনো আঘাত করি না। আপনি এখন বেশ দুর্বল। প্রাণে বেঁচে গেলেন!
উঠে দাঁড়ালো আফরা। ছুরিটা অদূরে ঢিল দিয়ে নিজের শরীরে লেগে থাকা ধুলোবালি গুলো ঝেড়ে নিলো। আদিল তখনো মাটিতে শুয়ে থেকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আফরা কে দেখছে। আফরা স্বচ্ছ এক হাসি দিয়ে আদিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। না চাইতেও আদিল হেসে উঠে। এতক্ষণ যে তারা দুজন একে অপর কে আঘাত করায় তৎপর হয়ে উঠেছিল; দুজনের যেন খেয়াল নেই। আদিল আফরার হাত আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়ায়। নিজেও ধুলো ঝেড়ে মাটিতে পড়ে থাকা প্যাকেট হাতে তুলে নেয়। আফরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
~ চিকিৎসা নিন! লড়াই টা বেশ এনজয় করেছি! তবে মিস আফরা ইবনাত, লড়াইয়ের পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন। বরাবরের মতো বেস্ট অফ লাক!
আফরা আদিলের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। চোখে মুখে ব্যাথার ভাব ফুটিয়ে তুলে হাত বাড়িয়ে দেয় আদিলের গলায়। রক্ত পড়ছে এখনো। কিছুটা শক্ত হাতেই কাটা স্থানে আঙুল রাখে, ব্যাথায় হাতের মুঠো শক্ত হলেও চোখ মুখ স্বাভাবিক রাখে আদিল। আঙুলের ডগায় লাল রঙা তরল মাখিয়ে আফরা বলে উঠে,
~ আপনার রক্তের ঘ্রাণ এত মিষ্টি কেন? কেমন পিপাসা পেয়ে যাচ্ছে!
শব্দ করে হেসে উঠে আদিল। মেয়েটা অদ্ভুত সাহসী। বারবার তার যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে কেমন প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। তবে দু দিনের এক মেয়ের কাছে আদিল মাহমুদ তো হারতে পারে না। বরং আদিল আরো এক ধাপ এগিয়ে আফরার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। কাটা স্থানে অধর স্পর্শ করে সরে আসে, মুখ ডুবিয়ে দেওয়াটা যে নেতিবাচক নয় আফরা বুঝতে পারে। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আদিলের কথা শোনার উদ্দেশ্যে। আদিলের অধরেও আফরার আঙুলের মতো লাল রঙা তরল শোভা পাচ্ছে। অদ্ভুত ভঙ্গিমায় আদিল বললো,
~ আপনার রক্তের ঘ্রাণ মিষ্টি হলেও আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমার শরীরের ভাজে ভাজে ঝাল! হুট করে মিষ্টি পেয়ে গেলে, কোষ গুলো কেমন তাজা হয়ে উঠে। পরের বার তৃপ্তি নিয়ে পান করবো!
এ যেন রক্ত পিপাসু ভাম্পায়ার! মাংস খেঁকো হায়না যেমন উঁত পেতে বসে থাকে, শিকার দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে; দুজন যেন ঠিক রক্ত পিপাসু মানুষে পরিণত হয়েছে। একে অপরের রক্তের ঝাঁঝ শুকতে ব্যস্ত! দুজনের ঠোঁটের ভাজেই নিরব হাসি। মানুষের পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। নড়েচড়ে উঠে দুজন। সন্ধানী চোখের দৃষ্টি ফেলে এদিক ওদিক দেখে নেয়। আদিল আর এক মুহূর্তও দেরী করে না, হাতের প্যাকেট টা কে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে হাঁটতে থাকে। আজ প্রথম এই কাজে সে এতটা লেট।
এর শোধ সে তুলবে! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। আদিলের অবয়ব যখন বাড়ির আড়ালে মিলিয়ে যায় আফরাও উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরে। যে কাজ সে করতে এসেছিল, অসফল! সাদা প্যাকেটের রহস্য টা আজও ধোঁয়াশা। তবে এক কাজে সে তীব্র ভাবে প্রভাব ফেলতে পেরেছে। সরাসরি যুদ্ধ তো ঘোষণা করে এসেছে! এবার চলতে থাকুক সংগ্রাম। তার অস্তিত্ব যে আদিল মাহমুদ কে টেক্কা দিতে পারে, বুঝুক সে। তবেই না সে মাহমুদ বাড়ির বড় বউ হতে পারবে! তার যে বড্ড স্বাদ জেগেছে মাহমুদ বাড়ির বড় বউ হওয়ার! শূণ্যে দৃষ্টি মিলিয়ে চোখের অনুরাগ প্রকাশ করে আফরা। তার মনে হচ্ছে কয়েক যুগল চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে দেখে হাসছে, বাহুবা দিচ্ছে! ভারী অভিমান হয় আফরার। আনমনেই বলে উঠে,
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৭
~ এ শহর ভালো না আম্মা। এ শহর শুধু রক্তে ভাসে, পুড়া ছাইয়ের গন্ধ ছড়ায়, হাহাকার মিলিয়ে দেয় শূণ্যে। এ শহর যন্ত্রণার শহর গো আম্মা। হৃদয় ছারখার করে দেয়!