হলুদ বসন্ত পর্ব ১৩
জাওয়াদ জামী জামী
” মা, আমার রেজাল্ট শুনে তোমরা খুশি হওনি? ” অর্নির এমন বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন মিনারা খাতুন।
” তোর কেন মনে হল, আমরা খুশি হইনি? মেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে, আর আমরা বাবা-মা হয়ে খুশি হবোনা, এটা কি আদৌও সম্ভব? ”
” আপুর রেজাল্ট শুনে তোমাদের খুশিতে কাঁদতে দেখেছি। কিন্তু আমার বেলায় তোমরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছ। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”
এবার মেয়ের কথা শুনে হেসে উঠলেন মিনারা খাতুন। অর্নিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন।
” ওরে পাগলী মেয়ে আমার, অবনী ছোটবেলা থেকেই ভিষণ দুরন্ত ছিল, ঠিকমত পড়াশোনা করতনা। তাই ওকে নিয়ে আমাদের চিন্তা একটু বেশিই ছিল। ও মেধাতালিকায় স্থান পরও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল। তাই ওর রেজাল্ট দেখে আমরা একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। কিন্তু তুই ছোটবেলা থেকেই আমার বাধ্য মেয়ে ছিলি। মন দিয়ে পড়াশোনা করেছিস সব সময়ই। আমি জানতাম তোর রেজাল্ট ভালো হবেই। তোর বাবাও বলত, অর্নি আমার বুদ্ধিমতি মেয়ে। ভালো রেজাল্ট ও করবেই। এবার বুঝেছিস ঘটনা কি? আমরা আগেই জানতাম তুই পারবি। তাই যখন শুনলাম, তুই বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম হয়েছিস, আমরা একটুও অবাক হইনি। ”
” সত্যিই তোমরা বিশ্বাস করতে, আমি ভালো রেজাল্ট করব! ”
” তোর কি মনে হচ্ছে, আমি মিথ্যা বলছি? ”
” মোটেও না। আমি শুধু অবাক হয়েছি। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অর্নির রেজাল্টের ঠিক দুইদিন পর সাদাফ বাড়িতে আসল। ও বাড়িতে এসেই অর্নির খোঁজ করল। কিন্তু অর্নি ওর এক বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ায়, ওর সাথে দেখা হলোনা।
” অবনী, এই যে তোর সাজেশন। আমার এক ফ্রেন্ড মেডিকেল কোচিং করায়, ওর কাছ থেকেই কতগুলো সাজেশন নিয়ে এসেছি। ” সাদাফ অবনীকে একগাদা ফটোকপি করা কাগজ বের করে দিল।
সাজেশন পেয়ে অবনী ভিষন খুশি হয়। এগুলো সত্যিই ওর প্রয়োজন ছিল।
” অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এগুলো জোগাড় করতে তাইনা, ভাইয়া? ”
” এত ফর্মালিটি দেখাসনা। তোর মুখে ভাইয়া ডাক মোটেও শোভা পায়না, বুঝলি? ইনফ্যাক্ট তোর এই জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারাও তোর অবয়বের সাথে যায়না। তুই যতই আলাভোলা নারী হওয়ার চেষ্টা করিসনা কেন, ভেতর থেকে তুই কিন্তু আস্ত ডাইনী। শুধু সময়ের অভাবে নিজের রূপ প্রকাশ করতে পারছিসনা। একবার মেডিকেলে চান্স পেয়ে যা, দেখবি কখন তোর ঐ গোপন রূপ বেরিয়ে আসবে টেরই পাবিনা। ”
সাদাফের কথা শুনে অবনী চোখ সরু করে ওর দিকে তাকায়। ভিষণ রাগ লাগছে। কিন্তু সাদাফের চোখে চোখ পরতেই বুঝে গেল, সাদাফ ওকে রাগানোর চেষ্টা করছে। এবং প্রায় সফলও হয়েছিল। কথাটা চিন্তা করতেই অবনীর রাগ পানি হয়ে গেল।
” আমার রূপ তা-ও গোপনে থাকে। আর তোমার ঐ বদখৎ রূপ হাজার চেষ্টা করেও গোপন করতে পারবেনা বুঝলে? চোখে একটা চশমা লাগালেই যদি জ্ঞানী হওয়া যেত, তবে ঐ পাড়ার সদানন্দ সরকারও জ্ঞানী। যার জ্ঞানের দরুন তার বাপের সব সম্পত্তির শ্রাদ্ধ হচ্ছে বছর বছর। ”
” তুই আমাকে সদানন্দ সরকারের সাথে তুলনা করলি? ঐ বুড়ো পুরো জীবনব্যাপি বিয়ে করেই গেছে, আর ওর বউরা বছর বছর বাচ্চা পয়দা করেই চলেছে। তুই আমার সাথে এমন অন্যায় করতে পারিসনা। তোর কথা এখনই উইথড্র করে নিবি, নইলে তোর চুল একটাও মাথায় থাকবেনা। ”
” কেন উইথড্র করব? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? সুযোগ পেলে তুমিও সদানন্দ সরকারের মতই বিয়ে করে বেড়াতে, আর তোমার বউরা বছর বছর বাচ্চা পয়দা করত। তুমি শুধু বড় চাচার জন্য সেই সুযোগটা পাওনি। ”
” থামবি তোরা? সাদাফ তুই এসেই শুরু করো দিয়েছিস? পাঁচ-সাত ঘন্টা জার্নি করেও তোর ক্লান্তি লাগছেনা? যা ভেতরে যা। গোসল সেড়ে কিছু খেয়ে নে। এরপর যতখুশি ঝগড়া করিস। অবনী, তোর শ্বশুর তোকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি যা। ” ওদের দু’জনের ঝগড়ার মাঝেই বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন নাজমা আক্তার।
মায়ের ধমক খেয়ে সাদাফ সুড়সুড় করে বাড়িতে ঢুকে পরল। অবনীও গেল ওর চাচার কাছে।
” তোকে বারণ করা স্বত্বেও কেন বাড়ির বাহিরে গিয়েছিলি? একটু ভালো রেজাল্ট করেছিস জন্যই কি সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? নাকি পাখনা গজিয়েছে? ”
সন্ধ্যার একটু আগে অর্নি বাড়িতে এসে শুনল সাদাফ এসেছে। মা ওকে পিঠার বাটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, সাদাফকে দিতে। এই বাড়িতে এসে দেখল, কেউই বাড়িতে নেই। প্রতিটা ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল। কিন্তু বড়মা, চাচা, দাদু,দাদি কাউকেই দেখলনা। শেষে কৌতূহলবশত সাদাফের ঘরে উঁকি দিতেই দেখল সাদাফ শুয়ে আছে। ওকে দেখতে পেয়েই সাদাফ উঠে বসল। অর্নিকে ভেতরে ডাকল। আর অর্নি ভেতরে আসার সাথে সাথেই কথার বানে ওকে বিদ্ধ করল সাদাফ।
” চাচী আমাকে ডেকেছিল, সেজন্যই ঐ পাড়ায় গিয়েছিলাম। ঐ বাড়ির কেউই না খেয়ে আসতে দিলনা, তাই আসতে দেরি হল। আর যাবনা, ভাইয়া। ” মিনমিন করে বলল অর্নি।
” প্রতিবারই একই কথা বলা তোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যখনই দেখবি আমি রাগ করছি, তখনই তোর ডায়লগ হবে, আর সেটা হল, আর হবেনা, আর করবনা, আর যাবনা। ধান্দাবাজি করতে শিখেছিস? তোর বোধহয় জানা নেই, ভালো স্টুডেন্ট হওয়া, আর ধান্দাবাজি করা এক জিনিস নয়। ”
” ভবিষ্যতে আর এমন কাজ করবনা। ”
কান্না পাচ্ছে অর্নির। ও জানতনা আজকে সাদাফ আসবে। জানলে কখনোই ঐ পাড়ায় যেতোনা।
কথাটা বলেই অর্নি ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। ওর সামনে উবু হয়ে বসেছে সাদাফ।
” সরে গেলি কেন? এদিকে আয়? ” ধীরে ধীরে সাদাফ এক হাঁটু গেঁড়ে নতজানু হয়ে বসল। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে, আরেকটা হাত ট্রাউজারের পকেটে।
অপার বিস্ময় নিয়ে সামনে এগিয়ে আসল অর্নি। সাদাফের নিকটবর্তী হতেই, সাদাফ তার বাড়ানো হাত দিয়ে আলতোভাবে ছুঁল অর্নির পা। ইশারায় ওর হাঁটুতে পা রাখতে বলল। বিস্ময়ে বাকহারা অর্নি সাদাফের কথামত কাজ করল। চোখের পলক ফেলতেই অর্নি দেখল ওর পায়ে শোভা পাচ্ছে কারুকার্য-মন্ডিত নুপুর। এক পায়ে নুপুর পড়ানো হলে সাদকফ ইশারা করল আরেক পা রাখতে। অর্নি কলের পুতুলের মত সাদাফের নির্দেশ পালন করল। নুপুর পড়ানো হলে উঠে দাঁড়াল সাদাফ। অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” সামর্থ থাকলেও এর থেকে বেশি কিছু দিতে পারছিনা। কখনো যেন পা খালি না দেখি। নুপুরের রিনিঝিনি শব্দে আমি তোকে খুঁজে নিতে চাই। যদি কখনো দেখি নুপুরগুলো তোর পায়ে নেই, তবে সেইদিনই তোর পা দুটো নির্দিধায় কাটব আমি। ”
সাদাফের ফিসফিসানি অর্নির শরীরে উত্তাল তরঙ্গের আগমনী গান ডেকে আনে। ভয়ে-দিশেহারা হয়ে অজান্তেই চোখ বুজল মেয়েটা। ঠিক তখনই ওর কানের লতিতে উষ্ণ অথচ নরম কোন ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠল। এক ঝটকায় চোখ খুলল। ততক্ষণে সাদাফ এর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অজান্তেই অর্নির ডান হাত গেল কানের লতিতে। বাম হাতে ধরে রেখেছে পিঠার বাটি। ওর মন বলছে, সাদাফ একটু আগেই ওকে চুমু দিয়েছে। ওকে অবাক করে দিয়ে সাদাফ ওর হাত থেকে পিঠার বাটি নিয়ে বিছানায় বসে খেতে শুরু করল। আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল অর্নি। কিন্তু সাদাফ ওর দিকে তাকিয়েও দেখলনা। বড়মার গলা পেতেই দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
অর্নি নিজের রুমে এসে কানে হাত দিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ও এতটাও ছোট নয় যে সাদাফের এহেন কাজের মানে বুঝবেনা। কিছুদিন আগে থেকেই ওর মন বলছিল, ওর প্রতি সাদাফের এমন আচরণের নিশ্চয়ই কোন কারন আছে। আজকে তা অর্নির কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। ঠোঁটের কোন প্রসারিত হল অর্নির। ছোটবেলা থেকেই সাদাফ নামক মানুষটার কেয়ার পেতে পেতে ও নিজেও সাদাফে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সাদাফ ওকে বকাঝকা করলেও ওর মন একটুও খারাপ হয়না। জোরে শ্বাস টেনে আনমনেই বলল অর্নি, সত্যিই কি সাদাফ ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে! কথাটা বলেই দু’হাতে মুখ ঢাকল মেয়েটা। সাদাফ আর ভালোবাসা দু’টো শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে লজ্জায় আরক্তিম হল ওর কপোল। কিন্তু যখনই মনে হল নুপুরের কথা, তখনই ওর বুক শুকিয়ে গেল ভয়ে। মা কিংবা আপু যদি জিজ্ঞেস করে, নুপুর জোড়া কোথায় পেয়েছে? কি উত্তর দেবে ও? অনেক ভেবে যুৎসই কোন উত্তর পেলোনা। তাই সিদ্ধান্ত নিল, সাদাফের কাছেই সমাধান চাইবে।
” তুই অর্নির জন্য ফোন এনেছিস? কতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে সেই চিন্তা তোর আছে, সাদাফ? অর্নির ফোনের কোন দরকার আছে? তা-ও যদি বাটন ফোন কিনতিস তবুও কথা ছিল। হ্যাঁ রে বাবা, কত টাকা লেগেছে ফোন কিনতে? ” মিনারা খাতুন একটু রেগেই জিজ্ঞেস করলেন।
” তোমার মেয়ে দুইদিন পর কলেজে যাবে, ওর এখন ফোনের প্রয়োজন আছে। অবশ্য ওর ভালো রেজাল্টই আমাকে এসব দিতে বাধ্য করেছে। চিন্তা করা যায়, সেদিনের অর্না কত ভালো রেজাল্ট করেছে! নুপুর কেমন হয়েছে বললেনাতো? আর শোন, সব সময় এত টাকার চিন্তা করবেনা। টিউশনি করে প্রতিমাসে আমি কত টাকা আয় করি জানো? ”
” তুই কষ্ট করে টিউশনি করে টাকা কামাই করিস, আর সেই টাকা এইসব আজেবাজে কাজে ব্যয় করছিস, এটা ঠিক নয়। তোর খরচ ও তো কম নয়। নিশ্চয়ই অর্নি তোর কাছ থেকে এগুলো চেয়েছে? ”
” চাচী, তুমি জানোনা তোমার মেয়েরা কেমন? ওরা আজ পর্যন্ত আমার কাছে কিছু চেয়েছে? আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই আমি অর্নিকে সামান্য গিফ্ট করেছি। এতে তুমি হতাশ হচ্ছ কেন? ”
” আচ্ছা বাবা, আর কিছুই বলবনা। যত ইচ্ছে খরচ কর। একটু বস আমি ভাত নিয়ে আসছি। আজকে চাচার সাথে খাবি। ”
হলুদ বসন্ত পর্ব ১২
অর্নি এতক্ষণ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে মা আর সাদাফের কথা শুনছিল। ও সন্ধ্যা থেকে বিছানায় বসে ছিল। পাছে মা আর আপুর নজর ওর পায়ের দিকে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই সাদাফ এসে ফোন দিল মিনারা খাতুনের হাতে। আর কায়দা করে নুপুরের কথাটাও বলল। স্বস্তিতে শ্বাস ছাড়ল অর্নি।