হলুদ বসন্ত পর্ব ২৫
জাওয়াদ জামী জামী
” ইশু, আজকেই যে ঢাকা যাবি, তোর ইন্টারভিউ কবে? ”
” ঠিক তিনদিন পর। কেন, মা? হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছ যে? ”
” আজকে না গেলে হয়না? এই তিনদিন থাকবি কোথায়? নিশ্চয়ই হোটেলে? ইন্টারভিউ এর আগের রাতে চলে যাস। তুই কি নিশ্চিত এই চাকরিটা তোর হবে? আগের রাতে গেলে কোন অসুবিধা হবে? ”
” হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত। আচ্ছা, তুমি যখন বলছ তখন আগের রাতেই যাব। ”
” কোন পদে তোকে নিতে চাইছে? সেটাতে কি তুই কমফোর্ট ফিল করবি? ” ইসহাক আজাদ জিজ্ঞেস করলেন। ”
” রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার এর জন্য তারা অনুরোধ করেছে। আশা করছি কাজ করতে পারব। তবে বাবা, জার্মানের একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে আমাকে ডেকেছে। তারা খুব করে চাচ্ছে আমি তাদের সাথে কাজ করি। অফিস থেকেই বাড়ি, গাড়ি সব দেবে। স্যালারিও মন্দ নয়। কি করি বলতো? ”
” তুই কি চাচ্ছিস? তোর জীবন, সিদ্ধান্তও তোর। ”
” আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। একবার মনে হচ্ছে দেশেই থাকি, তো পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে এই দেশে কোন কাজেরই যথাযথ সম্মান কিংবা মূল্য নেই। এখানে ক্যারিয়ার গড়তে গেলে পদে পদে বাঁধা আসবে। চারপাশে ধনী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখে আমি হতাশ হই। ”
” তাহলে জার্মান চলে যা। আমরা চাই তুই সফল হ। ”
” আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই, বাবা। তাই অন্য কোথাও যেতে মন সায় দেয়না। ”
” আমি বলি কি, তুই কিছুদিন দেশেই চাকরি কর। ছয়মাস পর যদি ভালো না লাগে, ঠিকমত সুযোগসুবিধা পাচ্ছিসনা তখন বাহিরের দেশে যাস। ”
” তোর বাবা ঠিক কথাই বলেছে। এখানে কিছুদিন কাজ কর। তারপর সিদ্ধান্ত নিস। আর চাকরিতে জয়েন করেই একটা ফ্ল্যাট দেখবি। অবনীর মেডিকেলে যাতায়াতে সুবিধা হয় এমন জায়গায় নিবি। অবনী, তুই আর কয়দিন গ্রামে থাকবি? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আরও পনেরদিন থাকব। ”
” তুমি এইডা কি কইলা? তোমার কি আক্কেল জ্ঞান কিছুই নাই? পোলাডার এখনো চাকরি হইলোইনা আর তুমি হেরে বাড়ি নিবার কইতাছ? আবার এই ছেমরিরেও রাখবার চাইতাছ সেইখানে? ইশু, কয় ট্যাকা বেতন পাইব সেইডা কি তুমি জানো? সেইসব না জাইনাই আগেই এই ছেমরির সংসার পাতনের চিন্তা করতাছ তুমি? ঐ ছেমরির নতুন বাড়িতে থাকন লাগব ক্যান? ” কুলসুম বেগম বরাবরের মতোই বাগড়া দিল।
” আমার আক্কেল-জ্ঞান, বিবেক-বিবেচনা সবই আছে। আমার ছেলে বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। ওর চাকরিও ভালো প্রতিষ্ঠানে হবে সেটা আমি জানি। আর ও কয় টাকা বেতন পাবে, সেটা ওর ব্যাক্তিগত বিষয়। কম টাকা বেতন পেলেও ওকে বউ নিয়ে থাকতে হবে, বেশি টাকা বেতন পেলেও বউ নিয়েই থাকতে হবে এতদিন পড়াশোনার জন্য বাহিরে ছিল তাই বউ নিতে পারেনি। এখন চাকরি করবে তাই বউ অন্য কোথাও থাকবে কেন? আবার অবনী ওর সাথে থাকলে ইশুর খাওয়ার সমস্যা হবেনা। অবনীরও তাই। মেয়েটা হোস্টেলে গেলেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। ইশু, আমি কি বলেছি বুঝতে পেরেছিস? ” শ্বাশুড়ির কথাকে মোটেও পাত্তা দিলেননা নাজমা আক্তার।
” ঠিক আছে, মা। আগে তাদের সাথে কথাবার্তা বলি। কাজে জয়েন করি। এরপর ফ্ল্যাট দেখব। দাদী, তুমি ঢাকা যাওয়ার জন্য তৈরী থাক। আমার নতুন বাসা গুছিয়ে দিতে হবে তোমাকে। কি পারবেনা? ”
” পারন তো লাগবই। ” কুলসুম বেগম মুখ কালো করে বলল।
” তুমিও কি ইশু ভাইয়ার সাথেই ঢাকা যাবে? ”
” কেন? আমি ঢাকা গেলেই বুঝি তোর সুবিধা হয়? পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিনরাত বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করতে পারবি। আমি থাকলে সেটা করতে পারছিসনা। এজন্যই আমার যাওয়া নিয়ে এত উতলা হচ্ছিস? ”
সাদাফের কথা শুনে আকাশ থেকে পরল অর্নি। ও ভালোভাবে একটা কথা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু সে অর্নির কথার উল্টো মানে বের করল! কিন্তু অর্নি সাদাফের ওপর একটুও রাগ করলনা। কেন যেন ও সাদাফের ওপর রাগ করতেই পারেনা।
” অপবাদ দেবেনা বলে দিলাম। আমি মোটেও বন্ধুদের সাথে হৈচৈ করিনা। এমনকি আমার ফোন নম্বরও কেউ জানেনা। তুমি আগেই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলে। তাই কারও সাথেই আগ বাড়িয়ে বন্ধুত্ব করতে যাইনা। ”
” আমার কথা মনে রেখেছিস জন্য ধন্যবাদ। তোর পরীক্ষা শুরু হলে আমি ঢাকা যাব। প্রথমদিন পরীক্ষা কেন্দ্রে আমি তোকে নিয়ে যাব। ”
” আমিও এটাই চাচ্ছিলাম। তুমি আমার সাথে না গেলে আমার ভয় লাগত। ”
” কেন আমি কি তোর ভয় রোধকারী মেডিসিন? ”
” জানিনা। তবে তুমি আশেপাশে থাকলে সাহস পাই। ”
” বাব্বাহ্ মেয়ে দেখছি বড় হয়ে গেছে! আকারইঙ্গিতে এ্যাডাল্ট কথাবার্তা বলার চেষ্টা করছে! চাচী জানে, তার মেয়ে তলে তলে সিএনজি চালাচ্ছে? ” সাদাফ দুষ্টু হেসে তাকিয়ে আছে অর্নির দিকে।
এদিকে সাদাফের কথা শুনে অর্নি পারলে লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়। লোকটা আজকাল অর্নিকে লজ্জা পাইয়ে দেয়।
” আপনি এই ধরনের কথা বললে, আমি আপনার সাথে আর কখনোই কথা বলবনা। ”
” আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবি? ”
” খুব পারব। ”
” ওকে। পরীক্ষা শুরু হোক তাহলে? তাহলে এখন থেকে কাল সারাদিন তোর সাথে কোন কথা নেই। দেখি কেমন থাকতে পারিস। ”
সাদাফের কথা শুনে অর্নি ওর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল। কত সহজেই লোকটা বলে দিল কাল পর্যন্ত কথা বন্ধ থাকবে! সে কি জানেনা তার সাথে কথা না বললে অর্নির দম বন্ধ হয়ে যায়? তারপরও সে কেন এই কথা বলল? কষ্টের নোনাজল চোখের কোনে এসে জমা হল। অনেক কষ্টে তাদের ঝরে পরা থেকে আটকে রাখল অর্নি। ভাঙ্গা গলায় বলল,
” তুমি পারলে আমিও পারব। ” এরপর বেরিয়ে গেল সাদাফের রুম থেকে।
সাদাফের চোখে অর্নির চোখের পানি ঠিকই ধরা পরেছে। অর্নির ছেলেমানুষী দেখে হাসল সাদাফ। ও নিজেও অর্নির সাথে কথা না বলে থাকতে পারবেনা জেনেও অর্নিকে কথাটা বলেছে। এখন দেখার বিষয় কে আগে কথা বলে।
সাদাফের রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই ইশরাকের সাথে ধাক্কা খেল অর্নির।
” আউচ। আস্তে হাঁট। এভাবে ঘোড়ার মত দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছিস কেন? ”
” তুমি আমার সামনে আসলে কেন? দেখতে পাওনি আমি আসছি? ”
” একে তো তুই আমাকে ধাক্কা দিয়েছিস, তারওপর আমাকেই কাঠগড়ায় তুলছিস? অর্ন, তুই তো দেখছি ভিষণ বেয়াদব হয়েছিস? বড় ভাই প্লাস দুলাভাইকে অসম্মান করছিস তুই! আমি বেঁকে বসলে তোর বিয়ে হবেনা এটা কি তুই জানিস? ”
” আগেতো নিজের বউকে সামলাও তারপর আমার বিয়ের কথা চিন্তা কর। তুমি কি ভেবেছ, তোমাকে দেখলেই যে তোমার বউয়ের মুখটা প্যাঁচার মত হয়ে যায়, সেটা আমি লক্ষ্য করিনি? আবার তুমিও তোমার বউকে দেখলে আশেপাশের সবার সাথে ভেজা বেড়ালের মত আচরণ কর সেটাও কিন্তু আমি জানি। ”
” তুই অনেক কিছুই জানিস, বইন। মাফ করে দে। আর জীবনেও তোর বিয়ের কথা মুখে আনবনা। যা ভাগ। কিন্তু আমিও যে অনেককিছুই জেনে গেছি, এটা কাকে বলি বলতো? তাই বাঁচতে চাইলে আমাকে হুজুর হুজুর করবি। দিনে তিনবার সালাম দিবি। এসবেই তোর মঙ্গল। ”
ইশরাকের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলনা অর্নি। চোখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকল ইশরাকের দিকে। কিন্তু ইশরাক ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের রুমে গেল।
রুমে এসে অবনীকে আলমারি গোছাতে দেখল ইশরাক। ওকে দেখতে পেয়ে অবনী নিজের কাজে আরও গভীরভাবে মনযোগী হল। ইশরাকও কম যায়না। অবনীকে আরও কাছ থেকে দেখার জন্য সে-ও গেল আলমারির কাছে। যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজছে এমন ভান করে এলোমেলো করতে থাকে অবনীর গোছানো কাপড়চোপড়। ইশরাকের এমন কাজে বিরক্ত হল অবনী।
” ধ্যাত্তেরি, এমন ঝামেলা করে কেন? আমি সব কাপড়চোপড় এভাবেই রেখে দেব বলে দিচ্ছি। কাজের মধ্যে এসে অকাজ করছে। যতসব বিরক্তিকর লোকজন। ”
” আমি আবার কি করলাম! একটা জরুরি কাগজ খুঁজছিলাম। ঠিক আছে তোর যদি আমার কাজ পছন্দ না-ই হয়, তবে থাক। লাগবেনা আমার কোন জরুরি কাগজ। আমি বেকারই থেকে যাব। ডক্টর বউয়ের পয়সায় হেসেখেলে জীবনটা কাটিয়ে দেব। লোকে মন্দ বলবে, উপহাস করবে করুক। তাতে আমার কি? আমিতো বউয়ের সুবিধার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ কাগজটা হেলায় হারিয়েছি। ”
ইশরাকের কথা শুনে রাগে জ্বলে উঠল অবনীর শরীর। ওর চোখমুখ গরম হয়ে গেছে। ঝট করে উঠে দাঁড়াল।
” নিন খুঁজুন আপনার সো কোল্ড গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। যদিও আমি এখানে কোন কাগজ দেখিনি কিংবা রাখিনি। আপনি আপনার গায়েবি কাগজ খুঁজে বের করে নিজের কলিজায় শান্তি দিন। ”
অবনীকে রাগতে দেখে দু পা পিছিয়ে গেল ইশরাক। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল,
হলুদ বসন্ত পর্ব ২৪
” গায়েবি কাগজ, ভালো বলেছিস। তুই একটু দোয়া পড়ে আমার মাথায় ফুঁ দিলেই গায়েবি কাগজটা খুঁজে পাব আমি। দে ফুঁ দিয়ে দে। ” ইশরাক মাথা এগিয়ে দিল অবনীর দিকে
” অসহ্য। ” অবনী মেঝেতে সব কাপড়চোপড় রেখেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
অবনী বেরিয়ে যেতেই ইশরাক মৃদু হেসে আলমারি গোছাতে শুরু করল।