হামিংবার্ড পর্ব ২
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
” গুড মর্নিং হামিংবার্ড। ”
আচমকা আরিশের কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলো অরা। আরিশ কেয়ারটেকার জলিলকে নাস্তার প্লেট বিছানার একপাশে রাখতে বলে, তাকে রুম থেকে চলে যেতে বলল। জলিলও মালিকের কথামতো খাবার রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে। অরা আরিশকে ঠিক বুঝতে পারছে না। রাতে যে ভয়ংকর রূপ দেখাল, আর সকাল হতেই এতো মিষ্টি কথা? ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না অরার। আরিশ অরাকে আপাদমস্তক দেখছে। অরা মেহরিন– নামের থেকে হামিংবার্ড নামটাই এই মেয়ের জন্য পারফেক্ট। তাছাড়া তেজরিন খান আরিশ তার স্ত্রী’কে এমন নামেই ডাকবে, যে নামে অন্য কেউ কখনো তাকে না ডাকেনি এমন।
” কী হলো? চুপ করে আছো কেন? কথার জবাব দাও। ”
আরিশের মৃদু ধমকে ভয় পেলো অরা। আরিশ এরমধ্যে বিছানার একপাশে বসেছে। পরনে তার কালো রঙের শার্ট, জিন্সের প্যান্ট। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়তো অরা তার সুদর্শন বরের প্রেমে হাবুডুবু খেত এখন।
” গুড মর্নিং। ”
আরিশ হাসল, ঠিক যেনো শয়তানি হাসি। অরা বুঝতে পারছে না, লোকটা কি অসুস্থ? না-কি অতিরিক্ত রাগী বলে এমন মনে হয়? রাগ না হয় স্বাভাবিক কিন্তু……
” জলিলের দিকে তাকিয়েছিলে কেনো হামিংবার্ড? ”
জলিল? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরা। আরিশ অদ্ভুতভাবে হেসে ফের বলে,
” যে ছেলেটা নাস্তা রেখে গেলো ওর নামই জলিল। ”
এবার বুঝতে পেরেছে অরা। কিন্তু জলিলের দিকে কেনো তাকিয়েছিলে– এটা আবার কেমন কথা? রুমে কেউ এলে একবার তো সবাই তাকায়। স্বাভাবিক!
” এমনি, রুমে কে এসেছিল দেখার জন্য…… ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” চুপ! পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকালেও শেষ করে ফেলব। না টাকাপয়সার অভাব থাকবে আর না সে**র। নারীরা তো এগুলোই চা, তাই না হামিংবার্ড?”
আরিশের অসংলগ্ন কথাবার্তা ভীষণ খারাপ লাগছে অরার। ঘৃনায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলেছে সে। লোকটার মন-মানসিকতা এত নিচ! তবে লোকটাকে বাইরে থেকে যেমন পরিপাটি মনে হয় ভেতরে অন্য রকম, এলোমেলো। মনে হয় স্বাভাবিক না। অরার নীরবতা আরিশকে ভাবাচ্ছে, তার বউ কি জলিলের কথা ভাবছে? মুহুর্তেই মাথা গরম হয়ে গেলো তার। অরার কাঁধে হাত রাখল সে।
” কী? কথা বলছ না কেন? ওর কথা ভাবছ, ঠিক না?”
” না ভাইয়া। ”
অরা কাঁধে ব্যথা পাচ্ছে, ভয়ে ভয়ে তবুও উত্তর দিলো সে।
” চুপ! কীসের ভাইয়া? আর একবার ভাই বলে ডাকলে খু* করে ফেলব। আর হ্যাঁ আজকের পর অন্য কোনো ছেলের দিকে তাকাতেও ভুলে যাবে তুমি। ”
অরা ভয়ে কাঁদছে। ওর ছোট্ট দেহখানি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে কেবল। আরিশ কথা বলতে বলতে নিজের শরীরের শার্ট বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। অরা ভালো করেই বুঝতে পারছে, তার সাথে কী হতে চলেছে। তাই প্রাণপণে আরিশের কাছে হাতজোড় করে বলতে লাগলো,
” প্লিজ এসব করবেন না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি….. আর কারো দিকে তাকাব না। ”
আরিশ অরার থুতনি চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
” কষ্ট হয়? ঠিকমতো দিলে কষ্ট হয়, আর না দিলে পরপুরুষের কাছে যাস তোরা। তোদের নারীজাতিকেই ঘৃণা করি আমি। তোরা মা নামের কলঙ্ক। ”
আরিশের কোনো কথার আগামাথা বুঝতে পারছে না অরা আর না তো এই মুহুর্তে বুঝতে চাচ্ছে। আরিশের চোখ লাল হয়ে গেছে। অরার শরীর থেকে সবটুকু পোশাক খুলে, ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলল সে।
” আমার সাথে কেনো এমন করছেন! কী করেছি আমি! ”
” মেশি* সমস্যা, কে জানি বলেছিল?”
ক্রুর হাসল আরিশ। অরা নিরুপায়, আরিশের দুই হাতের নিচে নিজের হাত চাপা পড়ে গেছে ওর। ঠোঁটের ক্ষতে আবারও কামড় দেওয়াতে চিৎকার করতে চাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু আরিশ তার ঠোঁট দিয়ে সেই আওয়াজ বন্ধ করে রাখছে। ঠোঁট থেকে গলা, গলা থেকে বুক, সব জায়গায় আরিশের দাঁতের দাগ বসে গেছে। অরার দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে কেবল। মনে হচ্ছে, নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে সে। আরিশ অরার দু’পায়ের মাঝখানে বসল। অরার দু-চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। গতরাতের মতো আবারও তেমন কিছু হলে সইতে পারবে তো ?
” শুড আই গিভ ইট টু ইউ? অব কোর্স, আই উইল।”
আরিশ অনুমতি চাইলো না-কি নিজের ইচ্ছের কথা বলল জানে না অরা। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল সে,
” দয়া করুন! আমি ম**রে যাবো। ”
আরিশ বিশ্রীভাবে হাসে। অরার চোখের জলে তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু হঠাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে নড়েচড়ে উঠল সে। জরুরি কল আসার কথা ছিলো। আরিশ অরাকে ওভাবে রেখেই বিছানা থেকে নেমে ফোন হাতে নিলো। হ্যাঁ জরুরি কল! রিসিভ করে কথা বলল সে। অরা কোনোমতে বিছানার চাদর মুড়ি দিয়ে, ভয়ে চুপচাপ তাকিয়ে আছে কেবল।
” জরুরি কল, কাজ আছে আমার। ঠিকমতো খেয়ে নিও। তামান্না আছে বাসায়, তোমার দেখাশোনা করবে। ”
কথা বলতে বলতে পোশাক পরে নিলো লোকটা। অরা গোপনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আরিশ আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আরিশ চলে যেতেই দ্রুত পোশাক পরে নেয় সে। মা যে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই অরার। কিন্তু প্রশ্ন হলো জেনেশুনে এমন ছেলের সাথে কেনো বিয়ে দিলেন রোকসানা? অরা ভেবে পায় না।
বারান্দায় গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সোলাইমান মল্লিক। বাইরে কতশত গাড়ি নিজেদের মতো ছুটে চলেছে। কাল থেকে আবার অফিস, আজ ছুটি। সেজন্য বাড়িতে বসে আছেন তিনি।
” কী হয়েছে তোমার? এখনও রাগ করে আছো?”
রোকসানা মল্লিকের কথায় কোনো ভাবান্তর হলোনা সোলায়মান মল্লিকের। স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,
” কীসের রাগ? আর কী হবে রোকসানা? ”
” আমি জানি, আরিশের সাথে অরার বিয়েটা তুমি মন থেকে মানতে পারোনি এখনও। ”
ম্লানমুখে বললেন রোকসানা। কিন্তু সোলাইমানের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। জেনেশুনে কারো পছন্দ – অপছন্দের দাম না দিয়ে পরে, সেসব জিজ্ঞেস করে কীসের জন্য? যখন বিয়েটা হয়েই গেছে এসব বলে লাভ কী?
” না মানলে তো কারো কিছু যায় আসে না। তোমার মেয়ে, তুমি তার সাথে যা ইচ্ছে তাই করেছ। ”
” এভাবে বলো না! অরা তোমারও মেয়ে। ”
” আমার মেয়ে হলে, কখনোই এভাবে বিয়ে দিতে পারতে না তুমি। ”
সোলাইমান কেমন করে যেন হাসলেন, বিষয়টা রোকসানা সহ্য করতে পারছে না। তার স্বামী বড্ড ভালো মানুষ। অথচ আজ এভাবে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি, বিষয়টা স্ত্রী হিসেবে রোকসানার নিকট সত্যি বড় যন্ত্রণার।
” আরিশ তো পর না, বলো? আমারই বোনের ছেলে। ”
” হ্যাঁ, তোমারই বোনের ছেলে। সেই ছেলে যে একজন মানসিক রোগী। বাইরে থেকে সে যথেষ্ট ভালো মানুষ হলেও মাঝে মধ্যে তার অসুস্থতার কথা অফিসে কানাঘুষা শোনা যায় রোকসানা। ছেলেটার মাথার ঠিক নেই। আর এসবের জন্য দায়ী তোমার বোন, কেবলমাত্র তোমার বোন। আর আজ অরাকে আরিশের সাথে বিয়ে দিয়ে সেই দায় এড়াতে চাইছ তুমি? ”
” এসব তুমি কী বলছ! আরিশ অসুস্থ না। আপুর ওসব কাজকর্মে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল ছেলেটা কিন্তু অসুস্থ নয়। তাছাড়া অরার মা আমি, জেনেশুনে ওর ক্ষতি করতে পারি না আমি। ”
সোলাইমান মল্লিক চুপ করে গেলেন এবার। সত্যি তো! রোকসানা অরার মা। সোলাইমান মল্লিক অরার জন্মদাতা পিতা নন, তবে ছোটো থেকে কম আদর স্নেহ করেননি তিনি। অরার বাবার অকালমৃত্যুর পর রোকসানাকে সমাজের কুনজর থেকে রক্ষা করে ভালোবেসে নিজের ঘরের বউ করেছিলেন সাইদ।
হামিংবার্ড পর্ব ১
” আমাকে একা ছেড়ে দাও রোকসানা। ”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরার মা। মৃদু হেসে বলল,
” ঠিক আছে। ”
নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রোকসানা। আসলেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য, সময় দরকার।