হামিংবার্ড পর্ব ৩৭
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
সন্ধ্যা নেমেছে খান বাড়িতে, আর আজকের পরিবেশ যেন একটু ভিন্ন। উৎসবের আমেজ চারদিকে, যদিও বাইরের অতিথি প্রায় নেই বললেই চলে। এসেছে কেবল মেহরাব আর অরার বাবার বাড়ির লোকজন আসার কথা ছিলো। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন তারা। নিজেদের মধ্যে এক ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করেছে আরিশ।
হলরুমের এক কোণে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা। পরনে তার ছড়িয়ে পড়া সাদা গাউন, যেন রাতের নিঃশব্দতা ছুঁয়ে আসা কোনো শুভ্র মেঘ। খোলা চুলগুলো নরম ঢেউ খেলে পড়েছে কাঁধের ওপর, চোখে একধরনের নির্লিপ্ত ভাব, তবু যেন অনেক না বলা কথা লুকিয়ে আছে দৃষ্টিতে।
রাত পোহালেই চেনা শহর, দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিতে জমাতে তাকে। সাবিহার কানাডা যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে আরিশ। এতে অবশ্য তাসলিমা খাতুন খুশিই হয়েছেন। কারণ লাভ-ক্ষতির হিসাবটা তিনি বেশ ভালো বোঝেন। আরিশকে যে কখনোই সাবিহার সাথে জড়ানো যাবে না এটা তিনি বুঝে গেছেন। আরিশ আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় যে, অরা চলে গেলেও সাবিহাকে বিয়ে করে নেবে। সে যখন একবার বলেছে সাবিহা কেবল তার কাজিন সুতরাং এটাই শেষ কথা। তাই তাসলিমাও সবকিছু মেনে নিয়েছেন। কানাডা গিয়ে লেখাপড়া করলে সাবিহারই ভালো। ভালো চাকরি করতে পারবে, ভালো পরিবারে বিয়ে হবে। এরচেয়ে বেশি আর কী চাই?
“হেই বিউটি কুইন! কেমন আছো?”
আচমকা মেহরাবের কণ্ঠে চমকে উঠল সাবিহা। বিরক্তি লুকিয়ে কিছুটা অনিচ্ছায় উত্তর দিল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ভালো। আপনি?”
“সুন্দরী নারী আশপাশে থাকলে পুরুষ মানুষের মন-মেজাজ সবই ভালো থাকে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল সাবিহা। সৌন্দর্যের প্রশংসায় সব নারীই যে পুরোপুরি পটে যায় – তা নয়। তবে, সে একেবারে খুশিও হয়নি তেমনটা না। আধাখানা হাসি যেন ঠোঁট ছুঁয়ে গেল সাবিহার ঠোঁটের কোণে।
“ওও, তাই বুঝি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব?”
“জি হ্যাঁ, বিউটি কুইন।”
“বয়স তো কম হলো না মশাই, এখন ফ্লার্টিং বাদ দিয়ে বিয়েটা করে ফেলুন।”
“বিয়ে করছে না তো কেউ!”
“কেন?”
“কারণ… আমার এখনও বিয়ের বয়সই হয়নি।”
সাবিহা হেসে ফেলল মৃদুস্বরে। মেহরাবকে সত্যিই একদম একঘেয়ে বলা যায় না, লোকটা জটিল হলেও মজার।
“বেশ ভালো মজা করেন আপনি।”
“তুমিও কিন্তু খুব ভালো কুবুদ্ধি আঁটতে পারো।”
মেহরাবের আকস্মিক মন্তব্যে থমকে গেল সাবিহা। চোখে জ্বলজ্বলে রাগ, গলায় অপমানের তীব্রতা।
“হাউ ডেয়ার ইউ? আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি কোনো কুবুদ্ধি করছি?”
“আরে কুল ডাউন, বিউটি কুইন। তুমি জানো, আমিও জানি– আজ তুমি একটা শেষ চেষ্টা করছো, একটা মরণকামড়। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও, মানুষের মনের দিকটাও বোঝার চেষ্টা করি আমি। আর একটা কথা বলি– তুমি যাই করো না কেন, আরিশ তোমার হবে না। অরা চলে গেলেও না।”
একটু থেমে মেহরাব আবার বলল,
“আমি আরিশকে চিনি, খুব ভালো চিনি। ও নিজেও জানে না, সে অরাকে কতটা গভীরভাবে ভালোবাসে। সুতরাং সাবধান, নিজের ক্ষতি করে বসো না। আজ তুমি যা করতে চাও, তা যদি করো… কাল হয়তো কানাডা নয়, গ্রামের বাড়িতেও ঠাঁই পাবে না।”
মেহরাবের কথায় সত্যিই একটু ঘাবড়ে গেল সাবিহা। ওর কণ্ঠে যেমন ছিল হালকা ঠাট্টা, তেমনি ছিল অদ্ভুত এক সতর্কবার্তা। কথা শেষ করে মেহরাব মুচকি হেসে ধীরে ধীরে ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেল।
সাবিহা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকেই – যদি সত্যিই অরাকে আঘাত করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ করে ফেলে? যদি সব পথ বন্ধ হয়ে যায় তার জন্য?
আজ যেন মেহরাব তাকে তার অবস্থানটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সে কি পারবে অজপাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকতে? একঘেয়ে, শ্বাসরুদ্ধ করা জীবন? না, তা কখনোই নয়। তার চেয়ে বরং বিদেশের আরামদায়ক, আধুনিক জীবন হাজার গুণে ভালো।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। তারপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে আরিশকে খুঁজতে লাগল। কয়েক কদম সামনে এগোতেই ওর চোখে পড়ল – আরিশ। আলো-আঁধারির মাঝে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সাবিহার চোখ ছলছল করে উঠল। পার্টি শেষ হলে সে আরিশের সঙ্গে কথা বলবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মনটাকে শক্ত করল সে।
দরজার দিকে তাকিয়ে আছে অরা। পরনে তার লাল টুকটুকে গাউন। আরিশ তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেহরাবের সাথে কথা বলছে। অরার মনটা তার বাবার বাড়ির লোকজনের জন্য ছটফট করছে। তামান্না খাবারদাবার রেডি করে ট্রে-তে করে করে নিয়ে আসছে এদিকে। তামান্না একা খাবারদাবার, জুসের ব্যাপার সামলাতে পারবে না বলে জলিলকেও ডাকা হয়েছে আজ। তবে অরা ভুলেও কারো দিকে একবারের পর দ্বিতীয়বার তাকায়নি আজ। লোকটা যথেষ্ট ভালো হয়ে গেছে – পড়াশোনা করতে দেবে বলেছে, বাবার বাড়ির লোকজনকে দেখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এতেই খুশি অরা। হ্যাঁ আরিশ একটু পাগলাটে স্বভাবের তবে অতটাও মন্দ না। আরিশের দিকে এসব ভাবছিল অরা। কখন যে আরিশ ওর সামনে এসে দাঁড়াল সেসব টেরই পায়নি সে। হাতে তুড়ি বাজিয়ে বলল আরিশ,
“ কার কথা ভাবছ, হামিংবার্ড? কে আছে তোমার ভাবনায়?”
অরা জানে আরিশ যেকোনো মুহুর্তে রেগে যেতে পারে। এই লোককে শান্ত করতে হবে, মুচকি হাসল অরা।
“ আপনি, আপনার কথা ভাবছি। “
আরিশের বুকটা ধক করে উঠলো। কলিজায় কেমন শান্তি শান্তি অনুভব হতে লাগলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তার। অরার গালে হাত রেখে হাসল সে।
“ কী ভাবছো আমাকে নিয়ে? “
“ সুন্দর লাগছে আপনাকে। “
আরিশ নিজের দিকে তাকাল একবার, তারপর অরার দিকে।
“ থ্যাংক ইউ, জানেমন। তুমি জানো, তোমাকে আজ, আস্ত একটা লাল গোলাপের মতো লাগছে, রেড রোজ! “
“ আর আপনাকে, ব্লাক রোজ! “
অরার ঠোঁটের কোণে হাসি। আরিশ নিজের দিকে তাকাল, তার ফর্সা শরীরের সাথে কালো রঙের পোশাকগুলো সবসময় দারুণ লাগে। আজও তার ব্যতিক্রম লাগছে না৷ আসলেই ব্লাক রোজ!
“ থ্যাংক ইউ, এগেইন। এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? “
দরজার দিকে তাকিয়ে বলল অরা,
“ নয়নারা এখনও এলোনা! “
“ এসে পড়বে। চলো বসবে ততক্ষণ। “
আরিশ অরার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর এক কাঁধে হালকা হাত রাখল। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে ওকে নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গেল একপাশে।
দূর থেকে সব দেখছে সাবিহা। তবে আজ তার চোখে রাগ নেই, ঘৃণাও না। শুধু একটা গভীর যন্ত্রণা জমে আছে দৃষ্টির গভীরে – হারানোর, না-পাওয়া এক অপূর্ণতা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রোকসানা মল্লিক, সোলাইমান মল্লিক ও নয়না খান বাড়িতে এসে পৌঁছালেন। অরা তাদেরকে দেখে, বসা থেকে উঠে এগিয়ে যেতে শুরু করল। আরিশও ধীরে ধীরে অরার পিছুপিছু যাচ্ছিল। মেয়েটিকে দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন রোকসানা। লাল গাউনে সজ্জিত অরা যেন এক পরী, হাসিমুখে ছুটে আসছে।
“কেমন আছো, মা? বাবা কেমন আছেন?”
বাবা-মাকে দেখে আনন্দে অরা জড়িয়ে ধরল। রোকসানা মল্লিকের চোখে জল ছিল।
“ভালো আছি মা, তুই কেমন আছিস?”
“ভালো আছি মা।”
সোলাইমান মল্লিক অরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুচকি হেসে বললেন,
“তুই ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকি।”
অরা হালকা হাসল। আরিশ এগিয়ে গেলো নয়নার দিকে।
“কী খবর নয়না রাণী?”
“এইতো ভালো ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?”
“তোমার আপু সাথে থাকতে খারাপ থাকতে পারি আমি?”
নয়না হেসে উঠল। সোলাইমান মুচকি হেসে বললেন,
“গুড ইভেনিং স্যার।”
আরিশ একটু অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এসেছেন আজ, নিজের বসের বাড়ি নয়। চলুন বসেন।”
সোলাইমান আরিশের আচরণে একটু বিস্মিত হলেন। ছেলেটা কিছুটা বদলাচ্ছে, ভাবলেন তিনি, এবং মুচকি হাসলেন।
রোকসানা মল্লিক চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলেন আরিশের দিকে। ছেলেটা সবার সাথে কথা বললেও তার সাথে কিছু বলছিল না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি, সব কিছু সময়ের ওপর ছেড়ে দিলেন।
“ঠিক আছে, বাবা।”
সোলাইমান মল্লিক বললেন।
আরিশ অরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনাদের নিয়ে বসাও। আর তামান্নাকে বলো, সবকিছু দেখতে যেন থাকে।”
“আচ্ছা।”
আরিশ অন্য দিকে চলে গেল। অরা মুচকি হেসে বাবা-মা ও বোনকে নিয়ে অন্য দিকে এগোল।
বাড়িতে ফিরেই তালহা তামান্নাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। রান্নাঘর, ডাইনিং রুম কোথাও নেই মেয়েটা। গেলো কোথায় ভাবতে ভাবতে সিড়ি হয়ে দোতলার দিকে এগোচ্ছিল সে। এরমধ্যেই সামনে কারো সাথে ধাক্কা লাগাতে থতমত খেয়ে গেল বেচারা।
“ তালহা ভাইয়া, আপনার নজর থাকে কোথায়? “
ভ্রু কুঁচকে ফেলল তামান্না। ধমকে উঠলো তালহা।
“ আবার ভাইয়া? “
“ তো কী কাদের চাচা বলে ডাকবো?”
“ উফ! “
“ কী? “
“ কিছু না। সরো তো, রুমে যাবো। “
“ যাচ্ছেন না কেন? আমি কি আপনার পথ আঁটকে দাঁড়িয়েছি না-কি? “
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তালহা। মেয়েটা ইচ্ছে করে এমন করছে কেন? তালহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হলরুমের দিকে এগোল তামান্না।
“ আরিশ!”
সাবিহার গলা শুনে পেছনে ফিরে তাকাল আরিশ৷
“ কী?”
“ তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো। “
“ যা কথা বলার বলে দিয়েছি আমি। আগামীকাল সকালের ফ্লাইটে কানাডা যাচ্ছো তুমি। “
আরিশের স্পষ্ট কথা। সাবিহা অনুনয় করে বলল,
“ প্লিজ আরিশ!”
“ ওকে, বলো। শুনছি। “
“ এখন না, রাতে। “
“ ঠিক আছে। পার্টি শেষ হোক, আমি যাবো তোমার কাছে। “
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সাবিহা। আরিশের চোখেমুখে গম্ভীরতা।
“ ঠিক আছে। “
আরিশ আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে সেখান থেকে চলে গেলো। পুরো বিষয়টাই দূর থেকে খেয়াল করেছে অরা। সাবিহার সাথে আরিশের কী কথা হয়েছে সেসব না শুনলেও কথা হয়েছে এটুকু তো নিশ্চিত সে।
দুই পরিবারের সবাই একসাথে দারুণ একটা সন্ধ্যা কাটাল আজ। নয়না থেকে গেছে। রোকসানা মল্লিক ও সোলাইমান মল্লিক যথারীতি নিজেদের বাড়ি চলে গিয়েছেন। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার ঘরে গিয়েছে। নয়না এখনও অরার সাথে কথা বলছে। আরিশ এখনও রুমে আসেনি। অরার কেমন জানি অশান্তি লাগছে। সাবিহাকে এক চুল পরিমাণ বিশ্বাস করে না সে। আগামীকাল সকালের আগে যদি কোনো ভুলভাল কাজ করে ফেলে সে!
“ আপু? তোমার কী হয়েছে? কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছো!”
নয়না জিজ্ঞেস করলো। অরার ভাবনার ছেদ ঘটলো তাতে।
“ কই! কিছু হয়নি তো।”
“ তুমি না বললে, ঠিক আছে। কিন্তু কিছু একটা তো হয়েছে। “
ম্লান হাসল অরা। নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আহ্লাদী স্বরে বলল,
“ পাকা বুড়ি একটা! যা ঘুমাতে যা। অনেক রাত হলো। “
“ হ্যাঁ প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। কিন্তু আরিশ ভাইয়া কোথায়? এখনও রুমে আসেনি! এমনিতে তো সব সময় তোমার সাথে সাথে থাকে। “
ফের অন্যমনস্ক হয়ে গেলো অরা। নয়না বলল,
“ আপু?”
“ পেকে যাচ্ছিস রে। যা ঘুমাতে৷ শুভ রাত্রি। “
হেসে বলল অরা। নয়না বসা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ শুভ রাত্রি আপু। “
অরা কিছু বলল না। এরমধ্যে তামান্না এলো ঘরে । এত রাতে তামান্নাকে দেখে ভাবুক হয়ে গেলো অরা।
“ আরিশ আমি জানি, তুমি আমার ওপর বিরক্ত। রেগে আছো। আর আমি যা যা করেছি তাতে এটা স্বাভাবিক। “
সাবিহা অনুতপ্ত হয়ে বলল। আরিশ বিরক্ত হচ্ছে।
“ এসব বলার জন্য, কথা বলবে বলেছিলে?”
“ আম সরি আরিশ। আমি সবকিছু জেলাসি থেকে করে ফেলেছি। “
“ জেলাসি? কীসের?”
মাথা নিচু করে ফেলল সাবিহা।
“ আমি তোমাকে ভালোবাসি আরিশ। এজন্য অরাকে তোমার সাথে সহ্য করতে পারি না। “
আরিশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সাবিহা আরিশের দিকে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“ কাউকে ভালোবাসলেই সে-ও যে ভালোবাসবে এই প্রত্যাশা রাখা ভালোবাসা নয়। ভালোবাসো মানে নিজের মতো করে বাসো। প্রেম করতে দুই পক্ষ লাগে কিন্তু ভালোবাসার ক্ষেত্রে নয়। মানুষ আজীবন একা একা ভালোবেসে যেতে পারে। তুমি জানো আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। যা বললাম সবটা অরাকে দেখে, ওর সাথে থেকে উপলব্ধি করেছি। আমি জানি না ভালোবাসা বিষয়টা আসলে কেমন। কিন্তু তার প্রতি যে ফিল করি সেটাকেই ভালোবাসা ভাবি। তোমার ভালোবাসাকে সম্মান করি আমি। কিন্তু এটা কখনো সম্ভব না সাবিহা। জীবনে ভালোবাসার থেকে ভালো থাকা বেশি জরুরি আমার কাছে। অরা আমাকে ভালোবাসে কি-না জানি না কিন্তু আমি ওর সাথে ভালো আছি। তুমিও ভালো থাকার পথ বেছে নাও। লেখাপড়া করো, নিজের ক্যারিয়ার গুছিয়ে নাও। “
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল সাবিহা।
“ ঠিক আছে। আমি যাবো কানাডা। “
“ গুড গার্ল। অনেক রাত হয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে নাও। সকালে দেখা হবে। “
আরিশ এতটুকু বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনে পড়ে রইলো কেবল সাবিহার ভগ্ন হৃদয় আর সাবিহা নিজে।
“ ঘুমিয়ে গেছো, হামিংবার্ড?”
ঘরে ঢুকে বাতি বন্ধ দেখে অন্ধকারে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আরিশ। ধীরপায়ে এগিয়ে বাতি জ্বালাতে লাগলল সে।
“ না। “
বিছানায় শুয়ে আছে অরা। চোখে জল টলমল করছে। কীসের জন্য এমন হচ্ছে তা-ও জানে না সে। তখন তামান্না এসে বলল, সাবিহার ঘরে ঢুকেছে আরিশ। অরার অবাক লাগলো কথাটা। কৌতূহলবশত সাবিহার ঘরের দিকে এগোল মেয়েটা। ঘরের বাইরে যখন পৌঁছল তখন, সাবিহা আরিশকে তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করছিল। ওসব শুনে আর একমুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারেনি অরা। চোখে জল নিয়ে সোজা ঘরে এসে বিছানায় বসে পড়েছিল।
“ তাহলে এভাবে শুয়ে আছো কেন?”
আরিশ অরাকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে নিলো। না চাইতেও আরিশের গলা জড়িয়ে ধরল অরা। আরিশ বরাবরের মতো বিনা অনুমতিতে তার ঠোঁটে রাজত্ব করতে লাগলো। অরা চুপ করে রইলো পুরোটা সময়।
“ কী হয়েছে তোমার? “
শুধালো আরিশ। সবসময় অরা রেসপন্স না করলেও একটা ছটফটানি থাকে ওর মধ্যে। কিন্তু আজ একেবারে শান্ত হয়ে গেছে সে। বিষয়টা অদ্ভুত লেগেছে আরিশের।
“ কিছু না। “
“ কী হয়েছে সেটা বলতে বলেছি। বলো। “
কিছুটা ধমকে উঠলো আরিশ। আর পাঁচটা স্বামীর মতো রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করা তার স্বভাবের বাইরে। কিন্তু আরিশের ধমকের পরই ঘটলো এক ঘটনা! ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। চমকাল আরিশ। বিছানায় বসিয়ে দিলো তাকে। দুই গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে শুধালো,
“ কান্না করছো কেনো? শরীর খারাপ? কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। তাহলে? “
“ আপনি খারাপ! খুব খারাপ মানুষ। আমি আপনার সাথে থাকবো না।”
আরিশের বুকে লাগলো কথাগুলো। চোখে জল চলে এলো। অরা তার সাথে থাকবে না ভাবতেই সবকিছু যেনো অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। মুহুর্তেই চোখমুখ বদলে গেলো তার। অরারকে পেছন ফিরিয়ে শুইয়ে দুই হাত পিঠে শক্ত করে চেপে ধরল সে। ব্যথা, কষ্টে কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেতে থাকলো অরার।
“ কী বললে তুমি, হামিংবার্ড? আমার সাথে থাকবে না?”
কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো আরিশ। অরার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যতটা কষ্ট হাতে পাচ্ছে তারচে বেশি কষ্ট হচ্ছে মনে। কেন হচ্ছে তা জানে না সে। সাবিহার সাথে আরিশকে একঘরে, সাবিহার ভালোবাসার কথা শুনে কেন এমন এলোমেলো লাগছে তা বুঝতে পারছে না অরা।
“ আপনি সাবিহা আপুর রুমে কেন গিয়েছিলেন? উনার ভালোবাসার কথা শুনতে? যদি তাই হয় তবে আমাকে জোর করে আঁটকে রেখেছেন কেন? “
রাগ-ক্ষোভ সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে অরার কণ্ঠে। আরিশ ভ্রু উঁচিয়ে মুচকি হাসল। ধীরে ধীরে অরার হাত আলগা করে দিল। অরার এমন আচরণের কারণ এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে আরিশ। সে অরাকে ধীরে ধীরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বুকের ওপর শোয়াল। মাথার তালুতে কিছুটা অবধি চুমু খেল। অরা তার দিকে তাকিয়ে ফোঁপাচ্ছে।
হামিংবার্ড পর্ব ৩৬
“ সাবিহা কথা বলবে বলেছিল, কী বলবে সেটুকু শুনতে গিয়েছিলাম শুধু। তুমি তো জানোই, সকালে চলে যাবে ও। “
“ তাই বলে আপনাকে ভালোবাসি বলবে?”
“ তুমি নিজেও বলবে না আর কেউ বললেও সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু কেনো বলো তো? “
চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো আরিশ। অরা ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে কেবল। সত্যি তো, এরকম কথাবার্তা কেন বলছে সে? সাবিহা আরিশকে ভালোবাসার কথা বলতেই পারে, কেউ কাউকে ভালোবাসতেই পারে। তাতে অরার কী? সে তো আরিশকে ভালোবাসে না। তবে?