হামিংবার্ড পর্ব ৪৩
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। আরিশের হাতটা ধরে আলতো করে একটা চুমু খেলো।
“সরি, রাগী ভূত। আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হব না।”
“হলে কিন্তু আস্ত থাকবে না।”
শুকনো ঢোক গিলল অরা। এই মানুষটা চাইলে যা খুশি করতে পারে – সবই সম্ভব তার কাছে।
“আচ্ছা।”
কাঁপা গলায় বলল সে, চোখ নামিয়ে নিলো।
আরিশের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি খেলল। ইশারায় অরাকে কাছে ডাকল।
অরা ওর ইশারার মানে ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“কী?”
“এদিকে এসো।”
বসে থাকা অরা ধীরে উঠে এসে আরিশের মাথার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
“এখন ঝুঁকে আমার কপালে কিস করো।”
কিছুটা লজ্জা পেল সে, তবু অবাধ্য হলো না। ধুকপুক বুকে একটু ঝুঁকে প্রিয় স্বামীর কপালে নরম করে একটা চুমু এঁকে দিল।
“আমারটা…?”
নিচু স্বরে শুধাল সে।
আরিশ একটু চমকে উঠল। বউটা নিজে থেকেই চুমু চাইছে আজ!
“তোমার কী মনে হয়, হামিংবার্ড? তোমার বর কি এসব নিয়ে কিপটেমি করে? তুমি না বললেও কিস করতাম।”
বলল আরিশ, চোখে সেই চেনা দুষ্টু ঝিলিক।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরা একটু ঝুঁকল, কিন্তু আরিশ কপালে নয় সরাসরি ঠোঁটেই মনোযোগ দিলো। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আরিশ। হালকা ব্যথায় ভুরু কুঁচকে উঠল অরা। মিনিট দুয়েক পর সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, কিছু না বলেই ঠোঁটে হাত রাখল। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখ দুটো যেন খানিকটা নরম অভিমানে ভরা। মুডটাই নষ্ট হয়ে গেছে অরার। সব সময় চুমু দিতে গেলেই রক্ত বের করে ছাড়ে লোকটা।
আরিশ জিজ্ঞেস করল, “কি হলো?”
অরা ধীরে মাথা নাড়ল।
“কিছু না…”
“ব্যথা পেয়েছো?”
এবার আরিশ একটু নরম কণ্ঠে শুধালো , অরা যে ব্যথা পেয়েছে সেটা বুঝে গেছে হয়তো।
অরা নিচু গলায় বলল,
“ সব সময় এমন করেন কেন? একটু আস্তে দিলেও তো হয়… ব্যথা পেয়েছি…”
আরিশ এবার একটুও হাসল না। গম্ভীরভাবে বলল,
“তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি, হামিংবার্ড। কিন্তু তুমি জানো, আমার আদরের ধরণ এমনই। ছুঁয়ে দিলে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। “
অরা মাথা নিচু করে রইল, খুব আস্তে বলল,
“ হুম, জানি। “
“ এবার আস্তে কপালে কিস দেবো, কথা দিচ্ছি।”
অরা কেবল একবার মাথা ঝাঁকাল। রাগ করেনি, তবু একটু অভিমান রয়ে গেলো চোখের ভেতরে।
“আমি কি ভুল সময় এসে পড়লাম?”
দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে থাকা তালহার গলায় ছিল শান্ত স্বর, কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠেছিল একরাশ জিজ্ঞাসা।
আচমকা তালহার উপস্থিতিতে হকচকিয়ে গেলো অরা। তড়িঘড়ি করে হাত দিয়ে ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা রক্ত মুছে নিলো।
আরিশ নিঃশব্দে শুয়ে, মুখে একটুও ভাবান্তর নেই। যেন এই মুহূর্তটাই ছিলো তার জন্য একেবারে স্বাভাবিক।
“না, আয়।” সংক্ষেপে বলল সে।
ভাইয়ের অনুমতি পেয়ে তালহা কেবিনে ঢুকল। চোখ বুলিয়ে নিলো ভাই-ভাবির দিকে।
“ভাইয়া, তোমার কথামতো ডিসচার্জের ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আগামীকাল সকালেই আমরা বাসায় ফিরে যেতে পারবো।”
“কিন্তু উনি তো পুরোপুরি সুস্থ হননি!”
অরার কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ। আরিশ শান্ত গলায় বলল,
“আমি অতটাও অসুস্থ নই, পাখি। হাতে গুলি লেগেছিল, বের করে ফেলা হয়েছে। বাকি চিকিৎসা বাসা থেকেই হবে। দরকার পড়লে নার্স রাখবো। তুমি চিন্তা করো না।”
তালহা ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি টেনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভাই আর ভাবির প্রেম দেখার মধ্যে যেন এক ধরনের মজা খুঁজে পেল সে।
কিন্তু আরিশের শেষ কথাগুলো বিশেষভাবে পছন্দ হয়নি অরার। তার কপাল কুঁচকে উঠলো। ভেতরে জমে থাকা বিরক্তিটা চেপে গেলেও, চোখে সেটা ধরা পড়ে গেল স্পষ্টভাবেই।
“নার্সের দরকার নেই। আমি আছি তো।”
শান্ত গলায় বলল অরা। তালহা মুখে দুষ্টু হাসি টেনে বলল,
“ওহ, তাই তো! ভাবি তো আছেনই। নার্সটার্স কিছুই লাগবে না।”
আরিশ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর চোখ খুলে ঠান্ডা গলায় বলল,
“না, নার্স লাগবে। আমার চিকিৎসার জন্য একজন প্রফেশনাল নার্স থাকা জরুরি। অরার এসব বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই। কাজেই, তুমি গিয়ে হসপিটালের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে ফেলো।”
অরার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কথাটা যেন একরকম অবজ্ঞা করেই বলা হলো। রাগে আর অপমানে সে মাথা নিচু করে রইল। ঠোঁট কাঁপলেও কিছু বলল না।
তালহা দাঁড়িয়ে উঠে বলল,
“ঠিক আছে, আমি কথা বলছি।”
“ওকে।”
তালহা বেরিয়ে যেতেই ঘরে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো।
আরিশ মুচকি হাসছে, যেন খুব তৃপ্ত। চোখ সরিয়ে সরাসরি অরার দিকে তাকিয়ে। অরা কিছুই বলছে না। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝের দিকে। আরিশের হাসিও তার চোখ এড়িয়েই গেল।
নিশুতি রাত। চারপাশ ঢেকে রেখেছে গভীর নিস্তব্ধতা। যেন পুরো পৃথিবী নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে কোনো অজানা ঘটনার জন্য। দূরে কোথাও একটা নেড়ি কুকুর ঘেউঘেউ করে উঠছে মাঝে মাঝে, আর তার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসে দু-একটা গাড়ির যান্ত্রিক শব্দ। শহরের এই অংশে রাত যেন আরও ঘন, আরও ভারী।
আরিশ বারবার নিষেধ করেছিল অরাকে রাতে হসপিটালে না থাকতে। তার যুক্তিও অমূলক ছিল না– সারারাত বসে থাকা, ক্লান্তি, অস্বস্তি–সব মিলিয়ে অরার জন্য সেটা যে ঠিক সুবিধার হবে না, সেটা সে ভালো করেই জানতো। কিন্তু অরা নাছোড়বান্দা। নিজের একরোখা ভালোবাসা আর উদ্বিগ্ন মনের জোরেই একপ্রকার কাকুতি-মিনতি করে স্বামীর পাশে রাত কাটানোর অনুমতি আদায় করে নিয়েছে।
শেষমেশ আরিশের কেবিনেই আরেকটা বেডের ব্যবস্থা করে দিলো কর্তৃপক্ষ। যদিও এমনটা হাসপাতালের নিয়মের বাইরে, তবু আজকাল টাকার কাছে নিয়মের মাথা নোয়াতেই হয়। ক্ষমতাবান রোগীর ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করার সাহস কারই বা আছে?
অরার বিছানাটা জানালার পাশে। জানালার ওপারে শহরের আলো ধুঁয়াটে হয়ে ঝাপসা লাগে, আর বাতাসে কেমন একটা ওষুধের গন্ধ।
অরা বিছানায় শুয়ে থাকলেও চোখে ঘুম নেই। পাশ ফিরে বারবার তাকায় আরিশের দিকে।
আরিশ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, নিঃশব্দ, নির্লিপ্ত। হয়তো ঘুমিয়ে আছে সে। অরার মনে পড়ে– বিকেলের সেই ঘটনাগুলো, ঠোঁটের ক্ষত, আরিশের কণ্ঠে রুক্ষ ঠাণ্ডা সিদ্ধান্ত… সবকিছু মিলিয়ে মনটা ভার হয়ে আছে তার। তবুও অরা শান্ত। কারণ সে জানে, যত রুক্ষই হোক, যতটা উদাসীই দেখাক না কেন, এই মানুষটিই তার নিজের। আর এটাই যেন এই রাতের নিস্তব্ধতায় তার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।
রাতের আঁধার পেরিয়ে নতুন ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে শহরজুড়ে। জানালার কাচ গলে আসা নরম আলো যেন নিঃশব্দে জানান দিচ্ছে– নতুন একটি দিনের শুরু।
ঘড়িতে সময় সকাল দশটা ছুঁইছুঁই। ড্রইংরুমে বসে চা পান করছেন সোলাইমান মল্লিক। পরিপাটি পোশাকে থাকলেও তার চোখেমুখে দায়িত্বের ছাপ স্পষ্ট। সামনে রাখা পত্রিকাটায় চোখ বুলিয়ে আবার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে রোকসানা নয়নার জন্য সকালের নাস্তা সাজালেন – গরম গরম পরোটা, ডিম, কলা আর এক গ্লাস দুধ। নয়না ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে শুরু করল, রোকসানা পাশে এসে বসলেন।
“কল করে দেখবে একবার?”
সোলাইমান কণ্ঠে সজাগ ভাব।
“তারপর না হয় রওনা দিলাম।”
রোকসানা ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে উত্তর দেন,
“দরকার নেই। গতকাল রাতেই তো অরার সাথে কথা হলো আমার। ও বলেছে, সকালে বাসায় ফেরার কথা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে এসেছে হসপিটাল থেকে।”
সোলাইমান মাথা নাড়লেন। চা শেষ করে টেবিলে কাপটা রাখলেন পরিপাটি করে।
“ঠিক আছে। নয়নার খাওয়া শেষ হলে তোমরা মা-মেয়ে রেডি হয়ে নাও। আমার তো রেডি হওয়ার বালাই নেই, একটা শার্ট পরলেই চলবে।”
রোকসানা হালকা হেসে সম্মতি জানালেন,
“ঠিক আছে।”
রোকসানা নয়নার পাশে বসে নাস্তা শুরু করলেন। সোলাইমান আগে থেকেই খাওয়া শেষ করে বসেছিলেন।
সকাল থেকেই দরজার পাশে বারবার এসে দাঁড়াচ্ছিল তামান্না। শুধু প্রিয় ভাবির বিপদের জন্য নয় – তার সাথে আরিশ ভাইয়ের আহত হওয়ার খবরও তাকে অস্থির করে তুলেছে। এতগুলো বছর ধরে আরিশ ভাই আশ্রয়, আর আজ সেই মানুষটাই হসপিটাল থেকে ফিরছে আহত অবস্থায়! অস্থিরতায় সারাটা সকাল পার করেছে সে। পুরো বাসাটা পরিষ্কার করে, রান্না শেষ করে এখন শুধু ওদের ফেরার অপেক্ষা।
তাসলিমা খাতুন আজ ঘর থেকেই বের হননি। তামান্না একা একাই সমস্ত কাজ সেরে রেখেছে। সকালটা কেমন গুমোট ছিল তার কাছে, এক ধরনের চাপা আতঙ্ক যেন বুকের মাঝে ঠাঁই নিয়েছিল। আকস্মিকভাবে গেটের বাইরে গাড়ির শব্দ শুনেই চমকে উঠল সে। রান্নাঘরে থাকা অবস্থাতেই শব্দটা কানে আসে। সব ফেলে রেখে একপ্রকার দৌড়ে চলে এলো ড্রইং রুমে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আগেভাগেই দরজাটা খুলে দিলো।
তালহার সঙ্গে আরিশকে নিয়ে গেটের ভেতর ঢুকছে অরা। শান্ত, ধীর ভঙ্গিতে হাঁটছেন তারা। আরিশের হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, যদিও তার মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। পায়ে কেবল সামান্য কাটাছেঁড়ার দাগ, তেমন গুরুতর কিছু না। কিন্তু তালহা ঠিকই তাকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে। ভাইকে একা ছেড়ে দেওয়ার মানুষ সে নয়। তাদের পেছনেই আসছেন একজন নার্স, হাতে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম।
তামান্নার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে নীরবে তাকিয়ে রইলো সে। ভালোবাসার মানুষগুলোর সুস্থভাবে ফিরে আসাটা যে তার কাছে এক বিশাল স্বস্তির বিষয়।
“ভাবি! আপনি ঠিক আছেন তো?”
তামান্নার গলা কাঁপছিল উদ্বেগে।
“আমি ঠিক আছি।”
নরম গলায় জবাব দিল অরা।
মনে হচ্ছিল যেন চোখের পানি আটকে রেখেছে তামান্না। সামনে পেয়ে আর দেরি করল না,ছুটে এসে অরাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল। যেন বুকের ভেতরের সব ভয়, সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে এই আলিঙ্গনে।
আরিশ একটু বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
“আমি অসুস্থ, আমার জন্য চিন্তা কর, তামান্না। তোর ভাবিকে জড়াজড়ি বন্ধ কর।”
তার স্বরের মধ্যে ছিল হালকা হিংসে মেশানো সুর। তালহার মুখে মিটিমিটি হাসি ফুটে উঠল। ভাইয়ের এই জেলাসির মিষ্টি রূপ সে বহুবার দেখেছে। তবে গতকালের ঘটনার পর, আজ যেন আরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে– আরিশ তার অরাকে কতটা ভালোবাসে।
“ভাইয়া, এখন আপনার হাত কেমন? আর পায়ের ব্যথা, কি কিছুটা কমেছে?”
অরাকে ছেড়ে এবার আরিশের দিকে এগিয়ে গেল তামান্না।
“সব ঠিক আছে। অল্প একটু জ্বালাপোড়া হয় মাঝে মাঝে। তবে এখন একটা চা হলে বেশ ঝরঝরে লাগবে।”
“ঠিক আছে ভাইয়া, যাচ্ছি আমি।”
তামান্না রান্নাঘরের দিকে হেঁটে গেলো। তালহা এবং নার্স রেবেকা ইসলাম মিলে আরিশকে ধরে দোতলার দিকে ওঠানোর জন্য এগোলো।
কিন্তু হঠাৎই অরা এগিয়ে এসে তালহার পথ রোধ করে বলল,
“ভাইয়া, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আর নার্স আপু, আপনাকেও উনাকে ধরতে হবে না। আমি নিজেই নিয়ে যাচ্ছি আরিশকে।”
তার চোখে ছিল দৃঢ়তা, কণ্ঠে ছিল যত্ন আর দখলদারির এক অদ্ভুত গম্ভীরতা। তালহা আর নার্স একে অপরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে সরে গেল পাশে।
“কিন্তু আপনি কি সত্যিই ওনাকে নিয়ে যেতে পারবেন?”
তালহার কণ্ঠে ছিল খুনসুটির সুর, চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি। ওটা একরকম ইচ্ছে করেই বলল সে– অরাকে হালকা করে জ্বালানোর জন্য।
আরিশ তখন ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, পারবে। নিশ্চয়ই পারবে। তুই যা, নিজের কাজ কর। আমাকে আমার বউ নিজেই নিয়ে যাবে রুমে।”
“ওকে জাহাঁপনা! এলাম আমি, বিদায়!”
তালহা হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। আরিশ বিষয়টা খেয়াল করলো। এদিকে রেবেকা ইসলাম তখনো দাঁড়িয়ে। অরা এবার তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দোতলার তিন নম্বর রুমটা আমাদের। আপনি আগে যান। আমি উনাকে নিয়ে আসছি।”
রেবেকা বিনয়ের হাসি হেসে মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
আর তখনই আরিশ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“তালহা রান্নাঘরে গেলো কেন?”
প্রশ্নটা শুনে অরার মুখটা পড়ে গেল মুহূর্তে। ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল সে। বুকের ভিতর ধুকপুক করে উঠল এক অজানা আশঙ্কায়। যদি আরিশ কিছু টের পায়? যদি তামান্না আর তালহার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলে? এই সময়, এই অবস্থায় এসব হলে তো পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাবে।
একটু সামলে নিয়ে চোখ নামিয়ে অরা বলল,
“এমনি, হয়তো কোনো দরকার ছিল ওর। রান্নাঘরে কিছু লাগতে পারে…”
আরিশ গভীরভাবে তাকাল অরার চোখের দিকে। এক মুহূর্ত যেন থেমে রইল সময়। অরার ভেতরের উদ্বেগটা বুঝে ফেলল কি? নাকি স্রেফ ক্লান্ত হয়ে আর প্রশ্ন করল না—বোঝা গেল না ঠিক।
“চলুন, ঘরে যাই।”
কণ্ঠে তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। অরা যেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্রসঙ্গটা থেকে সরে যেতে চায়।
আরিশ এক ধরণের প্রশ্রয়মিশ্রিত সন্দেহের হাসি হাসল, তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
“মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছ আমার কাছ থেকে। তুমি জানো হামিংবার্ড, তোমার ব্যাপারে আমি মারাত্মক ওভার পজেসিভ। আর আমার রাগ যখন ওঠে… তখন কিন্তু কন্ট্রোলে থাকি না আমি।”
শুকনো ঢোক গিলল অরা। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে, আজ যেন কিছুটা বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে আরিশ। তাই একটু আমতা আমতা করে বলল,
“আমার এমন কিছু নেই যা আপনার কাছ থেকে লুকানোর প্রয়োজন আছে।”
“শিওর?”
আরিশের চোখে একধরনের গভীর খোঁচা মেশানো দৃষ্টি।
“হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর, রাগী ভূত!”
মাথা দুলিয়ে বলল অরা।
“হাউ কিউট! রাগী ভূত!”
আরিশ খিলখিল করে হেসে ফেলল।
“চলো ঘরে। গতকাল রাতের আদরটা তো মিস হয়ে গেছে, এবার সেটা ফুলফিল করতে হবে।”
অরা এক ধাক্কায় থেমে গেল। মুখ গম্ভীর করে, চোখ কুঁচকে কিছুটা রেগে বলল,
“রুমের মধ্যে তো রেবেকা-সেবেকা বসে আছে!”
ঠোঁট কামড়ে হাসল আরিশ। এমন রাগ আর হিংসার মিশ্রণে ফুঁসতে থাকা অরাকে সে দারুণ উপভোগ করছে।
এখনো সিঁড়ি বেয়ে দোতলার বারান্দায় উঠছে তারা।
“ওহ, তাই নাকি! সমস্যা নেই, সুস্থ হয়ে উঠি আগে। দুই-তিন দিন যাক না… তারপর না হয়—”
আরিশ ইচ্ছে করেই বাক্যটা অসম্পূর্ণ রাখল, যেন আগুনে একটু ঘি ঢালে।
অরার চোখমুখ দেখে বোঝা যায়, মেয়েটা চূড়ান্ত বিরক্ত। তবুও সে শান্ত গলায় বলল,
“হ্যাঁ, সেটাই। এখন ভেতরে চলুন। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
“ হ্যাঁ, চলো।”
আরিশের চোখেমুখে দুষ্টমি ভর করেছে আজ। কিন্তু অরা সেটা বুঝতে পারছে না বলেই, ভেতর ভেতর রাগে জ্বলছে।
অরা আর আরিশ রুমে ঢুকতেই রেবেকা সেখানে ছিলো, চারপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে সাজানো।
আরিশ তার খাটে বসে একটু হালকা করে চোখ বন্ধ করল, যন্ত্রণা ও ক্লান্তির মাঝেও স্বস্তি খুঁজছে। হসপিটাল থেকে ফেরার পর শরীর এখন একটু বিশ্রামের দাবি করছে। অরা আরিশের পাশে বসেছে। রেবেকাকে একদম সহ্য হচ্ছে না তার। রেবেকার বয়স কম, পঁচিশ হবে হয়তো, দেখতে সুন্দরী।
রেবেকা ব্যান্ডেজ বদলানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে পাশে একটি চেয়ার টেনে বসলেন।। তাঁর সতর্ক নজর আরিশের হাতে আর পায়ের ক্ষতের ওপর রাখা, যেন কোথাও কোনও সমস্যা না হয়।
“ আপনি একটু রেস্ট নিন। তারপর আমি ক্ষতস্থান দেখে ব্যান্ডেজ করে দেবো। “
আরিশ মাথা নেড়ে বলল,
“ ওকে রেবেকা ম্যাম। “
মেজাজ বিগড়ে গেলো অরার। ঢং করে আবার ম্যাম বলতে হবে কেন? যত্তসব আদিখ্যেতা!
আচমকা পেছন থেকে কেউ এসে জড়িয়ে ধরায় তামান্না চমকে উঠল। হাতের কাপটা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। কারণ বুঝতে বাকি রইল না। এই বাড়িতে তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরার সাহস রাখে কেবল একজনই—মিস্টার তালহা।
“এইভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে? যদি আপনার মা দেখে ফেলেন?”
তালহার কণ্ঠে নিস্পৃহ ভঙ্গি,
“তখন যা হওয়ার হবে। আমি তো তোমার, আর তুমি আমার। “
“নাহ, ছাড়ুন এখন। কাজ করছি আমি।”
“আচ্ছা, ছাড়লাম। শোনো, রাতে ছাদে যাবো। কল করব, সঙ্গে সঙ্গে চলে এসো। দয়া করে ঘুম ঘুম অভিনয় করে পালিয়ে যেয়ো না।”
“রাতে? কখন?”
হামিংবার্ড পর্ব ৪২
“গভীর রাতে। সবাই যখন ঘুমে ডুবে থাকবে।”
“কেন?”
“ভালোবাসতে।”
তামান্না তাকাল একটু থেমে। চোখেমুখে অনিচ্ছা, কিন্তু গালে লুকোনো একরাশ লালিমা।
“আচ্ছা, এখন আপনি যান। আমি চা নিয়ে যাচ্ছি সবার জন্য। আপনার রুমেও দিয়ে আসবো।”
“তাহলে তো ভালোই! আপাতত টাটা, মিস তামান্না ভাটিয়া!”
তালহা চোখ টিপে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেলো। তামান্নার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, যার ব্যাখ্যা সে নিজেও দিতে পারে না।