হামিংবার্ড পর্ব ৪৫
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
দরজায় ঠকঠক আওয়াজেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তামান্নার। সে যেন আজ পণ করেছে– কিছুতেই ঘর থেকে বেরোবে না আজ।
“ তামু? এই তামু! দরজা খোলো। কতবার কল দিলাম, ছাদে যাবে না?”
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো তালহা। তামান্না এখনো বিছানায় শুয়ে আছে। রাগে শরীর জ্বলছে তার। সে উঠলো না৷ ওভাবেই শুয়ে রইলো। তালহা বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করলো।
“ ঘুমিয়ে গিয়েছ, তামু? “
“ হ্যাঁ, আপনিও গিয়ে ঘুমান। “
তালহা ফিক করে হেসে উঠল। মেয়েটার কণ্ঠে রাগ আর অভিমান স্পষ্ট।
“লক্ষ্মীটি আমার, প্লিজ এসো, আই মিস ইউ।”
শোয়া থেকে উঠে বসলো তামান্না। মেয়েদের একটাই সমস্যা—ভালোবাসার পুরুষ একটু মিষ্টি করে বললেই সব কিছু ভুলে যায়।
তামান্নাও মন কম্পমান করে আস্তে আস্তে দরজা খুলে দিলো।
“ কী হয়েছে? “
কিছুটা রেগেই জিজ্ঞেস করলো তামান্না। তালহা তামান্নার হাতদুটো নিজের হাতের মাঝে ধরে বলল,
“ রাগ করেছ কেন, সোনা বউ?”
“ বউ! এতো ঢং করতে হবে না। কিছু হয়নি আমার। “
“ বুঝতে পেরেছি। রেবেকাকে বাসায় পৌছানোর জন্য, তাই তো?”
“ বুঝলে আবার ঢং করেন কেন, তালহা ভাই? “
তামান্না ভাই বলে ডাকাতে চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো তালহার।
“ তারজন্য ভাই ডাকতে হবে? কী করবো বলো? ভাইয়ার আদেশ তার ওপর একটা মেয়ের নিরাপত্তার বিষয়। “
“ হুম জানি তো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আচমকাই তালহা তামান্নাকে জোরে বুকে জড়িয়ে ধরল। তামান্না হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো, চোখ বড় করে চমকে উঠল। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হতে লাগলো। মুহূর্তেই বুকে বাঁধা রাগ আর অভিমান যেন ভুলে গিয়ে তার শরীর ভরে গেলো তালহার উষ্ণতায়। তালহার স্পর্শে তার মন এক অন্য জাগরণে পৌঁছলো, যা আগে কখনো অনুভব হয়নি। ছোট্ট এই আলিঙ্গনে, দুজনের মাঝের দূরত্ব মুহূর্তেই মিশে গেলো।
“ লক্ষ্মীটি অভিমান করে থেকো না। “
তামান্না থরথর করে কাঁপছে। লজ্জায় আর ভালোবাসার মিশ্রণে ঠোঁট দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।
“আমি… আমি ঘুমাবো। ছাড়ুন…”
তার কাঁপা কাঁপা গলায় কথা শুনে তালহা একটু হাসল, তারপর আলতো করে তাকে মুক্ত করে দিলো। সে-ও লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে, চোখ সরিয়ে নিচ্ছিলো। দুইজনের মধ্যেই সেই অদ্ভুত, মিষ্টি নীরবতা বাস করছিলো– যেখানে কথা কম, অনুভূতি বেশি।
“ শুভ রাত্রি। “
“ শুভ রাত্রি। “
তালহা হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে নিজের ঘরের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল।
অন্যদিকে, তামান্না দরজা আঁটকে দেয়ার পর দ্রুত ধুরুধুরু করেও বুকে হাতে হাত রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার মন এখনো থমথমে, শরীরটা লজ্জা আর অদ্ভুত উষ্ণতায় ভরপুর।
দিন যতই এগোচ্ছে সাবিহার প্রতি মেহরাবের ভালোবাসাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকাল প্রায় কথা হচ্ছে দু’জনের। কখনো অল্পস্বল্প আবার কখনো বেশি। সাবিহাও নতুন দেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
বাহিরে টিপটিপ বৃষ্টি নেমেছে, মেঘের ঘন আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মাঝেমধ্যে গর্জন করে মেঘেরা তার গম্ভীর গান শোনাচ্ছে। শুক্রবার, অফিসের ছুটির দিন। তালহা, আরিশ দুই ভাই আজকের এই স্নিগ্ধ দিনে বাড়িতেই আছে । আরিশের হাতের ব্যথা এখন অনেকটাই সেরে গেছে।
বৃষ্টিমুখর এই দিনে খাবারও বিশেষ কিছু হওয়া লাগবে। তাই খিচুড়ির সঙ্গে মসলাদার গরুর মাংস ভুনা রান্না করা হয়েছে। আর এই বাড়ির ছেলেরা তো বিরিয়ানি ছাড়া আর কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না, তাই অন্য খাবারের বূলে একটু বদলে অন্যরকম খাবার তৈরি করা হয়েছে। তামান্না আর অরা মিলে যত্ন করে দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করলো, ঘরটা যেন এখন ঘ্রাণে ভরে উঠেছে, মশলার টঙটঙানি আর রান্নার হাসি-আনন্দে।
গতকাল থেকে আরিশের আচরণ অরার কাছে অদ্ভুত লাগছে। যেন সে নিজেকে অরা থেকে একটু একটু করে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। কথা বলতেও যেন মন করছে না, শুধু জরুরি কিছু বলেই উঠে যাচ্ছে। এই হঠাৎ পরিবর্তন অরাকে শুধু অবাক করেনি, বরং তার মনকে আরও বেশি ব্যথিত করছে – এক ধরনের অকথিত কষ্ট, যা বুঝতে পারছে না কেন এমন হলো। অরার হৃদয় ঝড়ের মত বিক্ষুব্ধ, আর পাশে থাকা মানুষটা যেন তার থেকে হিমশীতল দূরত্ব বজায় রাখছে।
কাজকর্ম শেষে নিজের রুমে প্রবেশ করলো অরা। বিছানায় বসে আছে আরিশ। অরাকে খেয়াল পর্যন্ত করছে না। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। এগিয়ে গেলো আরিশের দিকে।
“ আপনার কী হয়েছে আরিশ?”
“ আমার কী হবে, হামিংবার্ড?”
“ জানি না, আমি। “
আরিশ কিছু বলল না। অরা কিছুক্ষণ তার পাশে চুপচাপ বসে রইল, তবুও আরিশ তাকে একবারও কাছে টানল না—একটু অবাক করা ব্যাপার। অবশেষে অরা নির্বিকার ভঙ্গিতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
অরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বউয়ের কাছ থেকে দূরে সরে থাকার চেয়ে বড় কষ্ট তার আর কিছু নেই—এই ভাবনা ঘোরাতে ঘোরাতে সে মেহরাবকে টেক্সট করল।
“ভাই, মনে হচ্ছে আমার নিঃশ্বাস আটকে আছে। এভাবে থাকা কি সম্ভব?”
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহরাবের রিপ্লাই আসলো,
“বউয়ের ভালোবাসা পেতে হলে, বউকে সারপ্রাইজ দিতে গেলো, এমন করতেই হবে বস।”
“রাখ, তোর কেরামতি! বউ আমার কাছে আসছে অথচ আমি হাবলা পুরুষদের মতো চুপচাপ বসে আছি! আরিশ খানের পক্ষে এটা কি সম্ভব বল?”
“তাহলে… কিছু বললাম না। দাঁত বের করা ইমোজি দুইটা।”
মেহরাবের টেক্সট দেখে মুচকি হাসল আরিশ। তারপর ফোন ধরলো, কোথাও কল করে খোঁজ নিলো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি-না। অপরপ্রান্ত থেকে সান্ত্বনামূলক কথা শুনে কল কেটে দিলো সে।
“ নয়না! এই নয়না!”
মায়ের ডাকে হকচকিয়ে গেলো। পড়া বাদ দিয়ে পলাশকে নিয়ে ভাবনায় বিভোর ছিলো সে।
“ হ্যাঁ, মা। বলো।”
“ তুই বল তো, কী হয়েছে তোর? ইদানীং এতো অন্যমনস্ক থাকিস কেন?”
থতমত খেলো নয়না। থেমে থেমে বলল,
“ কই! কী হয়েছে বলো তো।”
“ তোর বাবা তোর জন্য কীসব জামাকাপড় নিয়ে এসেছে। ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে আয়। “
“ নতুন ড্রেস!”উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল সে।
“ আচ্ছা মা,যাচ্ছি। “
নয়না এক মুহুর্ত কালক্ষেপণ না করে ড্রইং রুমের দিকে এগোল। রোকসানা মল্লিকের খটকা লাগছে। নয়নার আচরণ মোটেও ঠিকঠাক লাগছে না উনার।
“ আজকে ঘুমাতে হবে না। “
আচমকা আরিশের এমন কথায় শোয়া থেকে উঠে বসলো অরা। আরিশ খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা ব্যাগ।
“ কিন্তু কেন?”
“ আমার ইচ্ছে। উঠে এই শাড়িটা পরে নাও, পাখি। “
আরিশ অরার দিকে ব্যাগটা এগিয়ে দিলো। অরা ব্যাগটা হাতে নিলো। ধীরে ধীরে ব্যাগের ভেতর থেকে অপূর্ব, চোখ ধাঁধানো একটা শাড়ি বের করলো। খাঁটি সোনার জরির সুতোয় হাতে বোনা জামদানি। শাড়ির জমিনে সূক্ষ্ম মসলিন, আর পাড়জুড়ে জ্যামিতিক নকশা। যার মূল্য কয়েক লক্ষ টাকা! প্রতিটি সুতোয় যেন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ভালোবাসার ঘ্রাণ লেগে আছে।
অরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
“এটা… এটা তো কোনো সাধারণ শাড়ি না! মনে হচ্ছে অনেক দামি!
আরিশক হেসে বলল,
“না, এটা ‘তোমার’ শাড়ি। তোমার শাড়ি তো সাধারণ হতে পারে না, হামিংবার্ড।
নারায়ণগঞ্জের একজন বুড়ো তাঁতিকে দিয়ে হাতে বুনিয়েছি চার মাস ধরে।”
অরার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। টাকাপয়সার হিসাব করছে না সে কিন্তু এতগুলো মাস ধরে একটা শাড়ি তৈরি করানো মানে কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো তাতে!
“ আপনি… এতগুলো মাস ধরে এটা তৈরি করিয়েছেন!”
আরিশ অরাকে জড়িয়ে নিলো এবার। কপালে কপাল ঠেকাল। কোমরে শক্ত করে হাত রেখে বলল,
“ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আরো কিছু দেওয়ার বাকি আছে। “
অরা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। এইতো তার চেনা মানুষটা। মুচকি হাসল সে।
“ আমি রেডি হয়ে আসছি। “
“ এখানেই চেঞ্জ করো। “
“ কিন্তু আপনি….. “
আরিশ কিছু বলল না। হুট করে রুমের অন্য দিকে চলে গেলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। রুমে বসেই চেঞ্জ করার সিন্ধান্ত নিলো। আরিশ যে অন্য দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এটাই অনেক।
“ এখন চেঞ্জ করো, হামিংবার্ড।”
আচমকা আরিশের আগমনে চমকাল মেয়েটা। চেয়ার নিয়ে এসে, আঁটসাঁট হয়ে বসেছে সে।
“ আপনি! “
“ হ্যাঁ আমি, তোমার একমাত্র স্বামী। শুরু করো। “
অরা কী বলবে সেটাও যেন ভুলে গেলো। এর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ঝটপট চেঞ্জ করে নিলো অরা। চুলগুলো আঁচড়ে, কানে ডায়মন্ডের দুল ও গলায় নেকলেস পরে নিলো। তবে সব গয়নাই সিম্পল। আরিশ মুগ্ধ নয়নে অরার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ ঠিক আছে? “
গলা নিচু করে শুধালো অরা। আরিশ বসা থেকে উঠে অরার দিকে এগোল।
“ ইচ্ছে করছে আদর করি কিন্তু এখন তোমাকে ধরলে সব সাজগোছ নষ্ট হয়ে যাবে। ‘“
অরা ফিক করে হাসলো। বেচারা আরিশ! দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে সে। আর মাত্র দু’মিনিট বাকি!
রাত ঠিক বারোটা।
ঘরের বাতি নিভে গেল আচমকাই। অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশ আলোয় ভরে উঠল– হালকা গোলাপি, সোনালি আর মোমবাতির নরম আলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে ধীর লয়ের পিয়ানো মিউজিক বাজছে ।
নরম সাদা পর্দার আড়াল থেকে এগিয়ে এলো আরিশ। হাতে এক কালো ভেলভেট বক্স, ঠোঁটে মৃদু হাসি।
“শুভ জন্মদিন, মাই প্রিন্সেস।”
চমকাল অরা। আজ ওর জন্মদিন! ভুলেই গিয়েছিল সে। চোখ ছলছল করে উঠলো তার।
“ আজ আমার জন্মদিন, সেটাও আপনি জানেন!“
“ আমার বউয়ের কোন তারিখ কী, সবকিছুই জানি আমি, ডার্লিং। “
আরিশের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি। লোকটা আর ভালো হলোনা। পেছন থেকে আরিশ জড়িয়ে ধরলো তাকে। তারপর সামনে এসে ধীরে ধীরে হাতে তুলে ধরল কালো রঙের ভেলভেট বক্সটা।
অরা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এইটার দরকার ছিল না…”
আরিশ হাসল,
“তোমার জন্মদিনে আমি শুধু একটা জিনিস দিতে চেয়েছি– তোমার মতো রাজকীয় কিছু।”
বক্স খুলতেই আলোর ঝলক, যেন তারার চেয়ে বেশি উজ্জ্বল কিছু! হোয়াইট গোল্ডে গড়া, হীরা, ওনিখস আর সবুজ এমারেল্ড চোখে পরা এক রাজসিক চিতা। নেকলেস নয়, যেন অরার গলার জন্য তৈরি এক রাজমুকুট।
“ তোমাকে এই জগতে একমাত্র আমার বলে জানাতে এর চেয়ে দামি কিছু আমি পাইনি। আমার সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেছি হামিংবার্ড।”
আরিশ বলল মৃদু কণ্ঠে। অরা এখনও গয়নাটার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ফেরাতে পারছে না।
“ এজন্যই গতকাল থেকে ওরকম অদ্ভুত আচরণ করছিলেন? “
“ অদ্ভুত? “
“ হুম। রাগ করছিলেন না, জোর করছিলেন না,আর আদ…..”
থেমে গেলো অরা। লজ্জা লাগছে তার। আরিশ মিটিমিটি হাসছে। আচমকাই অরার হাত দুটো পেছনে চেপে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো সে। চোখ বন্ধ করে ফেলল অরা।
“ আই লাভ ইউ, অরা। ডু ইউ লাভ মি?”
অরার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে কিছু বলতে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। চোখে মুখে দ্বিধা, সংকোচ আর গভীর আবেগের মিশ্র ছায়া। আরিশ অপেক্ষায়– তার ধৈর্যের সীমা যেন শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অরার এই দীর্ঘ নীরবতা অসহ্য ঠেকছে তার কাছে।
অরা নিজেকে সামলে নিচ্ছে, ভেতরে ভেতরে সাহস সঞ্চয় করছে। সেও আজ বলতে চায়… ভালোবাসার সেই জমে থাকা কথা। ঠোঁট খোলার চেষ্টা করতেই হঠাৎ- ঘাড়ে তীব্র এক ব্যথা অনুভব করলো সে।
চমকে উঠল অরা। মুহূর্তেই বুঝে গেল, অধৈর্য আরিশ তার ঘাড়ে কামড়ে দিয়েছে। ভালোবাসার উন্মাদনায়, একরোখা আবেগে এমন পাগলামিটুকু করাতে নিজেকে থামাতে পারলো না আরিশ।
“ লাগছে, আমার।”
আরিশ মুচকি হাসল। অরার কথা অগ্রাহ্য করে পরপর অনেকগুলো কামড় বসাল ঘাড়ে।
“ অপেক্ষা করালে কেন, হামিংবার্ড? আমি অপেক্ষা করতে পারি না। আমার উত্তর চাই। “
“ আমি…. আমি…. “
“ থাক। আজকের দিনটা তোমার। তাই আজ কোনো জোর করবোনা। কাল থেকে প্রতিদিন, প্রতিরাত শুধু আমার। বুঝেছ, পাখি? অধৈর্য আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। “
অরা মাথা নাড়লো কেবল। আরিশ তাকে কোলে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল। অরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কোথায় যাচ্ছেন? “
“ ওয়েট এন্ড সি। “
অরা চুপ করে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আরিশ। তার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে বারান্দায় রঙবেরঙে আলো জ্বলে উঠছে। অরা অবাক হয়ে দেখছে সবকিছু। আরিশ একপা এক পা করে এগিয়ে চলছে সাথে রঙিন বাতি জ্বলে উঠছে এবং লাল গোলাপের পাপড়ি ঝড়ে পড়ছে। সবকিছু স্বপ্নের মতো সুন্দর লাগছে অরার কাছে ।
এক পা এক পা করে তারা যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল, তখন মনে হচ্ছিল তারা কোনো স্বপ্নের দৃশ্যের মাঝে হাঁটছে।
ড্রইংরুমে পৌঁছাতেই থমকে দাঁড়াল অরা। এক মুহূর্তের জন্য যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার। চারপাশে সব পরিচিত মুখ, তাদের চোখে ভালোবাসা আর উচ্ছ্বাস। কেউ হাসছে, কেউ চোখ মুছছে। সবাই নতুন জামাকাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে, এমনকি অরার বাবার বাড়ির মানুষজনও! পুরো ঘর জুড়ে বাতাসে ভাসছে কনফেটি আর গোলাপের ঘ্রাণ।
তাকে কোলে রেখেই নিচে নামিয়ে দিলো আরিশ। এরপর ধীরে ধীরে তার হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো। চারপাশ থেকে গেয়ে উঠলো সবাই—
❝ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….
হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার অরা… হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…. ❞
রোকসানা মল্লিক মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, মমতার স্নেহে ভরা একটুখানি চুমু রাখলেন মেয়ের গালে। নয়না আদরে আপ্লুত হয়ে বোনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছে, চোখে তার আনন্দের দীপ্তি। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে এক উষ্ণ, ভালোবাসায় ভরা আবহ। সবাই খুব খুশি, হাসির ঝিলিকে ভরে উঠেছে পুরো ঘরটা।
অরার সুখ, আনন্দ সব একাকার হয়ে গেছে এই মুহূর্তে। তার চোখের কোণে জমে থাকা জলের বিন্দুগুলো গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। সে কখনো কল্পনাও করেনি যে তার জন্মদিন এমন বিস্ময় আর ভালোবাসায় ভরা হবে। আরিশ চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে অরার প্রতিক্রিয়া দেখছে। সে চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসল।
অরা চারপাশে তাকিয়ে দেখে, দেয়ালের ওপরে বড় করে লেখা,
“আমাদের আলো অরা, শুভ জন্মদিন।”
রঙিন বেলুন, ঝলমলে লাইটিং, পাপড়ির ছড়াছড়ি– সব মিলিয়ে পুরো বাড়িটা যেন স্বপ্নপুরী হয়ে উঠেছে। ড্রইং রুমের এক পাশে রাখা বিশাল কেকটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হাসিমুখে বলে,
“এতকিছু… আমার জন্য? তোমরা আমাকে এতো ভালোবাসো!”
রোকসানা মল্লিক বললেন,
“তুই আমাদের পৃথিবী রে মা, তোকে ভালো না বাসলে কাকে বাসবো?”
নয়না হেসে বলে,
“তোর জন্য আজকের পুরো দিনটায় শুধু চমক আর চমক আপু! সবকিছুই দুলাভাইয়ের কাজ। ”
আরিশ সামনে এসে অরার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“চলো, কেক কাটো। এরপরে আরও কিছু চমক বাকি আছে!”
অরা বিস্ময়ের চোখে তাকায় ওর দিকে।
“আরও?”
আরিশ মুচকি হেসে চোখ টিপে দেয়। অরা বুঝে যায়, আজকের রাতটা শুধু তার, আর শুধু আরিশের ভালোবাসায় মোড়ানো এক স্বপ্নের রাত হতে চলেছে।
কেক কাটার পর বাড়ি ভরে ওঠে হাততালি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর হাসির রোলেও। অরা এক এক করে সবার মুখে কেক তুলে দিচ্ছে। সবার প্রথমে অবশ্য আরিশকেই খাইয়ে দিয়েছে। কেক খাওয়া শেষে, আরিশ দূরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। অরা খেয়াল করলেও কিছু বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেলো। চারদিকে অন্ধকার। সকলে চুপ হয়ে গেছে ।
ঘর জুড়ে নেমে এসেছে গভীর অন্ধকার।
তারপরই চারদিক থেকে একসাথে নীলচে, বেগুনি, রূপালি আলো ছড়িয়ে পড়ল । দেয়াল, ছাদ, মেঝে – সবকিছু হারিয়ে গেলো কোনো এক বিশাল গ্যালাক্সির ভিতর।
তারার ঝিলিমিলি, ঘুরছে গ্রহ, উড়ছে উল্কা, দূরে সরে যাচ্ছে নীহারিকা।
ঘর নয়, মনে হয় অরা দাঁড়িয়ে আছে অনন্ত মহাকাশের মাঝে। চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা অসাধারণ দৃশ্য – একবার ধূসর চাঁদ, আবার কোনো লাল গ্রহ। একেক কোণ থেকে ভেসে আসছে নরম স্পেস সিম্ফোনি, যেন মহাবিশ্ব নিজেই তার কানে গাইছে।
আর এই সবকিছুর মাঝে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরিশ। আলো এসে পড়ছে তার মুখে। হাতে ধরা একটা ছোট রিমোট।
আরিশ হেসে বলল,
হামিংবার্ড পর্ব ৪৪
“তোমার জন্য গোটা মহাবিশ্ব এনে দিলাম, হামিংবার্ড। নাও টেল মি… উইল ইউ বি দ্য কুইন অব মাই ইউনিভার্স?”
অরার চোখ বিস্ময়ে ছলছল করে ওঠে। সে কিছু বলতে পারে না, শুধু এক ধাপ এগিয়ে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আরিশকে। চমকাল আরিশ। অরা সবার সামনে এভাবে তাকে আলিঙ্গন করলো!
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ ইয়েস… আই ওয়ান্ট নাথিং মোর দ্যান টু বি দ্য কুইন অব ইয়োর ইউনিভার্স। “