হামিংবার্ড পর্ব ৫২

হামিংবার্ড পর্ব ৫২
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

রাতের খাবার খেয়ে কেবলই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে মেহরাব। আজ অফিসে অনেক কাজের চাপ ছিলো। এজন্য কিছুটা ক্লান্ত সে। ফোন হাতে নিয়ে সাবিহাকে কল করতেই যাচ্ছিল মেহরাব, এরমধ্যে সালমা আক্তার দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সম্পর্কে তিনি মেহরাবের মা। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই, পরনে ছাই রঙা শাড়ি, চুলগুলো খোঁপা করা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
“ মেহরাব! “
মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
“ মা! কিছু বলবে? ভেতরে না এসে ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সালমা। ধীরপায়ে ছেলের ঘরে ঢুকলেন।
পাশের ফ্ল্যাটের রহিমার ছেলে সাকিব বিয়ে করেছে মাসখানেক হলো। বিয়ের পর নিজের মা’কে রুমে ঢোকার আগে অনুমতি নিতে বলেছে সে । আর সেসব কথা রহিমা এসে সালমার সাথে বেশ কেঁদে কেঁদে বলেছিল। ফলশ্রুতিতে সালমার মন কিছুটা খারাপ হয়ে আছে। মেহরাবকেও তো বিয়ে করাতে হবে। তখন যদি মেহরাবও তেমন কিছু বলে? সেজন্য আগে থেকেই রুমে ঢোকার আগে অনুমতি নেওয়ার অভ্যাস করছেন সালমা।

“ বলো, এবার। “
“ বয়স তো কম হলোনা তোর, এবার তো বিয়ে-শাদি করতে হবে। “
“ আর কয়েক বছর যাক, তারপর…… “
“ আমি ম রার পর?”
আঁতকে উঠল মেহরাব। মায়ের হাত ধরে বলল সে,
“ এমন কথা বলছো কেন মা? প্লিজ তুমি এরকম কথা আর বলবে না। “
“ তাহলে বিয়েতে রাজি হয়ে যা। “
“ আমি একজনকে পছন্দ করি, মা। তবে সে লেখাপড়ার জন্য কানাডায় থাকে এখন। “
ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো সালমা,
“ মেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করে? “
“ হ্যাঁ। তবে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে দেশে থেকেই। গ্রামের মেয়ে। শহুরে মেয়েদের মতো চালচলন না তার। তোমার অপছন্দ হওয়ার কথা না, মা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করে শুনে কিছুটা বিরক্ত হলেন সালমা। মূলত সালমা আক্তার শহুরে মেয়েদের আধুনিক চালচলন দেখতে পারেন না। মেহরাব সেই কারণে সাবিহার বিষয় সবকিছু স্পষ্ট করে বলল।
“ বেশ। আমাকে ছবি দেখাস। আর মেয়ের সাথে আগে থেকেই কথাবার্তা বলে রাখিস। আর পারলে বিদেশ থেকে দিশে ফিরতে বলিস। কী হবে এতো লেখাপড়া করে? সেই তো শ্বশুর বাড়িতে এসে সংসার করতে হবে। “
মেহরাব চুপ করে রইলো। তার মা’কে বলে লাভ নেই কিছু। তিনি নিজে যা বোঝেন, ভাবেন সেটাই বলেন। উনার চিন্তাভাবনা এমনই। মেয়েদের কেবল একটাই কাজ – বিয়ে করে সংসার করা এবং বাচ্চা লালন-পালন করা।

“ আচ্ছা। “
“ ঘুমা তাহলে, গেলাম আমি। “
“ ঠিক আছে। “
সালমা আক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাবিহার কল এলো। মেহরাবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তাতে। সব ভাবনা বাদ দিয়ে কল রিসিভ করলো সে।
“ হ্যালো! “
“ ইয়েস, সুন্দরী। কেমন আছো?”
“ হুম ভালো, আপনার কী অবস্থা? ভুলে গেলেন না-কি? “
“ আরে না, না। কাজকর্ম নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম দু’দিন। সেজন্য নক করা হয়নি। কল করতাম আমি। “
লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল সাবিহা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলো। রৌদ্রময় দিন, আকাশটা দেখতে দারুণ লাগছে।

“ বেশ, বুঝলাম। “
“ শুনলাম তালহা আর তামান্নার বিয়ের কথা হচ্ছে। আরিশ কল করেছিল, গতকাল রাতে দেশে ফিরেছে ওঁরা। “
“ হ্যাঁ। সবকিছু তো ঠিকই ছিলো, শুধু মা বেঁকে বসেছিলেন। উনাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালাম। আমার ভাই তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাক – এটুকুই চাওয়া। “
“ উমম….. মিস সাবিহা দেখছি বেশ বদলে গেছে। “
মুচকি হাসল সাবিহা। মেহরাবের ঠোঁটের কোণেও হাসি খেলা করছে।
“ তা বলা যায়। “
“ তা নিজে কবে বিয়ে করবে শুনি?”
“ ঠিকঠাক ছেলে পেলে এখুনি করতে পারি। “
“ শিওর? “
“ অফকোর্স! “
“ তা ঠিকঠাক বলতে কেমন ছেলে দরকার তোমার? “
“ বেশিকিছু না, কেবল আমার প্রতি সৎ থাকতে হবে। আর একটু ভালোবাসতে হবে, ব্যাস!”
“ একটু ভালোবাসলেই হবে? “
“ হুম। বাকিটা একসাথে থাকতে থাকতে হয়ে যাবে। “

মেহরাব বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো আবার। ক্লান্তিতে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে তার চোখে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল মেহরাব , রাত বারোটা ছুঁইছুঁই এখন। তারমানে কানাডায় এখন দুপুরবেলা।
“ বুঝলাম। লাঞ্চ করেছ?”
“ এখনো না, একটু পর খাবো। আপনি ডিনার করেছেন”
“ হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগে খেলাম। এখন শুয়ে আছি। নিদ্রার অপেক্ষায়! “
“ নিদ্রা? ওহ ঘুম…. ‘
“ জি, হ্যাঁ ম্যাডাম। নিন্দ্রা মানে ঘুম – কোনো নারী নহে। “
থতমত খেলো সাবিহা। কোনো নারী হলেও বা তার কী? মেহরাবটা বড্ড সেয়ানা। কথার মানে বুঝতে সময় লাগে না তার।
“ হু,হু। আচ্ছা পরে কথা হবে আবার। রাখছি এখন। “
“ ওকে। বায়। “
“ হুম, বায়। “

কল কেটে ফোন বালিশের পাশে রাখল মেহরাব। আগামীকাল একবার আরিশের অফিসে যাবে সে। বন্ধুকে মনের কথাটা এবার বলার সময় এসেছে। আগামীকাল আরিশের সাথে কীভাবে সবকিছু বলবে সেসব ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল মেহরাব।
বিছানায় বসে নোটপ্যাডে কীসব লিখতে ব্যস্ত অরা। আরিশ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরার প্রতিটি নড়াচড়া খুব গভীরভাবে খেয়াল করাই যেন তার কাজ।
দুপুরে তামান্না ও তালহার বিয়ের বিষয় কথাবার্তা হয়েছিল। যেহেতু এখন তাসলিমা খাতুনও রাজি সেজন্য বিয়েতে দেরি করতে চাচ্ছে না আরিশ। শুধু সাবিহার ছুটি পাওয়া নিয়ে সমস্যা। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে তার বোন থাকবে না, এটা তো হয় না। সাবিহার সাথে আরিশ কথা বলবে আগামীকাল। আজকে বিভিন্ন কাজকর্মের ঝামেলায় কথা বলবে বলবে করেও বলা হয়নি।

“ হ্যাঁ, হয়ে গেছে। “
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল অরা। চোখেমুখে তার খুশির ঝিলিক।
“ কী হয়ে গেছে, শুনি?”
অরার হাত ধরে কোলে তুলে নিলো আরিশ। গলা জড়িয়ে ধরে বলল অরা,
“ তামান্না আপু আর তালহা ভাইয়ের বিয়েতে কী কী কিনবো সেসব লিস্ট করলাম। “
“ লিস্ট? কই দেখি তোমার লিস্ট! “
আরিশ হাত বাড়িয়ে নোটপ্যাডটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো সেটা– দু’টো শাড়ি, একটা লেহেঙ্গা, একটা থ্রিপিস লেখা আছে – সাথে কিছু গয়নাগাটি। আরিশের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে অরা। লিস্ট কি বেশি লম্বা হয়ে গেলো?
“ এই তোমার লিস্ট? “
“ হু হু। কেন কী হয়েছে?”

“ লিস্ট করেছো, ভাবলাম অনেক কিছু লিখবে কিন্তু যা লিখেছ সেসব তো এমনি মনে রাখা যায়। তোমার আসল শপিং তো আমি করবো। আমার লিস্টের দরকার পড়বে না, পাখি। “
অরা কিছু বলার আগেই আরিশ তার ঠোঁটে কিস করলো একটা। অরা বলতে শুরু করলো,
“ লিস্ট করে নতুন পোশাক কেনার মধ্যে অন্য রকম একটা আনন্দ আছে, রাগী ভূত। ছোটোবেলায়, ঈদ আসলেই লিস্ট করতে বসতাম। তারপর সেই লিস্ট অনুযায়ী কসমেটিকস কিনতাম। “
শৈশবের কথা ভাবতেই মনটা কেমন বিষিয়ে উঠলো আরিশের। তার ছোটবেলায় এমন কোন মধুর স্মৃতি নেই যা সে বলতে পারবে। এতক্ষণ কথার ফাঁকে ফাঁকে কিস করে যাচ্ছিল আরিশ, আচমকা থেমে যাওয়াতে তার দিকে মনোযোগ দিলো অরা। ভদ্রলোকের চেহারার হাবভাব বদলে গেছে। কেমন বিষণ্ণতা ভর করেছে চোখেমুখে।

“ কী হলো? “
“ ইম… কই? কিছু হয়নি তো, হামিংবার্ড। “
“ কেমন অন্যমনস্ক লাগছিল আপনাকে। “
“ ঠিকই আছি আমি। কিন্তু তুমি ঠিক থাকবে না এখন। “
“ কেন!”
কিছুটা অবাক হয়ে বলল অরা। আরিশ তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের করে নিতে নিতে বলল,
“ কথা কম, কাজ বেশি করতে হয়। “

অরা মুচকি হাসল। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আরিশ তার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় নেশা ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আরিশের স্পর্শ মানেই এক জ্বালাময়ী অনুভূতি – যেখানে ঘোরলাগা নেশার সাথে যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে।
রাতের আঁধার ঘনিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে চারদিকে। শহরের ব্যস্ততা এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। যানবাহনের কর্কশ শব্দও কিছুটা কম শোনা যাচ্ছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল নয়নার। গতকাল রাতেও ভালো ঘুম হয়নি তার। ইদানীং ঘুম কমে গেছে। ঘুম ভাঙলেও কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো সে। তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো একবার, সকাল ছয়টা বেজেছে কেবল।

আজকাল পলাশের কথা খুব মনে পড়ে নয়নার। যতই তার কথা ভুলতে চায় ততই যেনো সবকিছু বেশি মনে পড়ে। পলাশ যখন আশেপাশে ছিলো তখন এতটা অনুভব করতোনা তাকে, অথচ দূরত্ব বাড়তেই সেই অনুভূতি প্রখর হচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠলো নয়না। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো পড়ার টেবিলের দিকে। ড্রয়ার খুলে একটা ছোটো কাগজ বের করলো। পলাশের ফোন নম্বর লেখা কাগজটায়। কিছুক্ষণ কাগজটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। পলাশের বলা শেষ কথাগুলো ভাবতে লাগলো। পলাশ বলেছিল তার অনুপস্থিতিতে নয়নাও বুঝবে, তার গুরুত্ব। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নয়না । বাড়ির কারো ফোন দিয়ে একবার কল করবে কি-না সেটাই ভাবতে লাগলো এবার । কিন্তু ভাবনা যেন শেষই হচ্ছে না। দ্বিধা কাটছে না তার।

“ নয়না! এতো সকালে পড়তে বসেছিস যে আজ? “
আচমকা মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠল সে। হাত থেকে কাগজটা ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো। কিন্তু নয়না সেটা খেয়াল না করে টেবিলের পাশ থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো।
“ পড়তে বসিনি, মা। ঘুম ভাঙল তাই ভাবছিলাম, পড়তে বসবো কি-না! “

হামিংবার্ড পর্ব ৫১

ঘর ঝাড়ু দিতে এসেছেন রোকসানা। মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতেই কাজ করছেন তিনি।
“ তাহলে ফ্রেশ হয়ে নে। চা-বিস্কুট খেয়ে তারপর না হয় পড়তে বসবি। “
“ ঠিক আছে, মা। “
নয়না মায়ের কথামতো ফ্রেশ হতে চলে গেলো। রোকসানা ঝাড়ু দিতে থাকলেন। অসাবধানতার ফলে পলাশের নম্বরটা যে ময়লার ঝুড়িতে পৌঁছে গেলো, সেটা নয়না টের অবধি পেলো না।

হামিংবার্ড পর্ব ৫৩