হামিংবার্ড পর্ব ৫৭

হামিংবার্ড পর্ব ৫৭
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

অরার অসুস্থতার জন্য অনেক কিছুই মিস করতে হয়েছে তাকে। যেমন, তালহা আর তামান্নার বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটার সময় অরা সঙ্গে থাকতে পারেনি। তবে আরিশ পুরো সময়টা তাকে ভিডিও কলে যুক্ত রেখেছিল। কিন্তু ভিডিও কলে শপিং দেখে কি আর সত্যিকার আনন্দ পাওয়া যায়? না… অরার মন তাতে ভরেনি।
তবু কী আর করার ছিল! জোর করেও কোনো লাভ হতো না। কারণ, এসব বিষয়ে আরিশ কখনোই তার কথা শুনে না– অন্তত এমন বিষয়গুলোতে তো নয়ই।

সন্ধ্যাবেলা।
খান বাড়িতে চলছে বিয়ের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
সারা বাড়িটা চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। লাইটিং ও ডেকোরেশনের লোকজন প্রতিটি খুঁটিনাটি ভালো করে পরীক্ষা করে নিচ্ছে।
নয়না বসার ঘরে একা বসে আছে। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকবে সে। তালহা একটু বেরিয়েছে – কিছু বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া বাকি ছিল, সেই কাজটাই সেরে আসছে। সাবিহা আর তামান্না ঘরে বসে জিনিসপত্র দেখছে। কোন ড্রেসটা কেমন হলো, কোন গয়না বেশি সুন্দর – এসব নিয়েই তাদের আলাপ।
অরা নিজের ঘরেই বসে আছে চুপচাপ।
আরিশ তাকে বাইরে যেতে মানা করেছে। বাড়িতে অতিথি আসছে, লোকজন অনেক।
আর অরার কাছে এসব নিয়ে কিছুটা বিরক্তিই লাগে এখনও। আরিশের কিছু কিছু কাজ এখনো সহ্য হয় না তার।
বসে বসে বেশ বোরিং লাগছিল অরার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঠিক তখনই আরিশের ফোনে একটা কল এল।
ভদ্রলোক ফোনটা ঘরেই রেখে বাইরে গেছেন।
অরা চোখ বুলিয়ে দেখল—ডা. শেলিনা আক্তার কল করেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী হয়ে উঠল সে।
কলটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বারান্দা পেরিয়ে এগোতে লাগল।
“হ্যালো, মি. খান বলছেন?”
“আমি অরা বলছি।”
“ও আচ্ছা, কেমন আছো তুমি অরা?”
“জি, আগের থেকে অনেকটাই ভালো আছি।”
“ভালো কথা, আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা শোনো, তোমার জন্য আরেকটা খবর আছে।”
“কী খবর?”
অরা সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ায়। ডেকোরেশনের কাজ চলছে। দুটো ছেলে কাজ করছে জোরেশোরে।
ডাক্তার বললেন,

“আমার মনে হয়, এই কথাটা তোমাকে বলার চেয়ে তোমার হাসবেন্ডকে বললে তিনি বেশি আনন্দিত হবেন। তবে আমি এখনই শতভাগ নিশ্চিত নই। এজন্য একটা টেস্ট করাতে হবে।”
ঠিক তখনই আরিশ অরাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। সে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা বলছে।
“ডাক্তার আপু কল দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।”
অরা ফোনটা বাড়িয়ে দিল আরিশের দিকে।
আরিশ ফোনটা হাতে নিলেও কথা না বলে চুপ করে রইল। হঠাৎ, তার চোখ আটকে গেল, দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর দিকে। দুজনের একজন ছেলেটা একদৃষ্টিতে অরার দিকে তাকিয়ে আছে তাকানোর ভঙ্গি যেন চেনা। আরিশের মেজাজ মুহূর্তেই বিগড়ে গেল। ফোনটা কেটে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে সোজা এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে।
এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ছেলেটার কলার চেপে ধরল সে। হিসহিস করে বলল,

“কী দেখছিলি ওভাবে? টাকা দিচ্ছি কাজ করার জন্য, না আমার বউয়ের দিকে কু-দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য?”
আরিশের গলার শব্দ আশেপাশে সবকে থামিয়ে দিল। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে খান বাড়ির লোকজন যেন ভূত দেখেছে এমন ভঙ্গিতে সিঁড়ির দিকে ছুটে এল।
অরা তড়িঘড়ি করে আরিশকে থামাতে চেষ্টা করল।
“আরিশ প্লিজ… ছেড়ে দিন!”
কিন্তু আরিশ তখন যেন রাগে পাগল হয়ে গেছে।
ছেলেটার মুখে ঘুষি মারতে মারতে বলছে,
“তুই সাহস কী করে করিস রে… সাহস কী করে হয় তোর!”
সাবিহা, তামান্না, নয়না, তাসলিমা খাতুন সবাই স্তব্ধ। নয়নার চোখ বিস্ময়ে আরও বড় হয়ে গেছে– এই আরিশকে সে কোনোদিন দেখেনি।
এ রকম উন্মত্ত, বেপরোয়া, সীমাহীন হিংস্র একজন পুরুষকে সত্যি দেখেনি নয়না।
“ আরিশ! প্লিজ, ছেড়ে দিন। উফ! “

অরা আরিশের হাত ধরে, কিন্তু আরিশ তার হাত সরিয়ে দেয়। ছেলেটা অবস্থা বেগতিক বুঝে দৌড়ে পালাতে চাইলে অরার গায়ের সাথে ধাক্কা লাগে। ফলশ্রুতিতে মুহুর্তেই সিঁড়ি থেকে ছিটকে নিচে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। ডেকোরেশন লোকজন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তাদের মুখ। আর সেই ছেলেটা বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে।
আরিশ যতক্ষণে অরাকে ধরার জন্য পা বাড়াল, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। অরা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ার পর নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার মাথার পাশে রক্তের লাল রেখা, কপালে কেটে গেছে।
নয়না আপু বলে চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে অরার কাছে আসে।

“আপু! আপু কথা বলো…..”
অরার চোখ আধখোলা, ঠোঁট নীলচে, নিঃশ্বাস ভারী। গলায় একটুকরো শব্দ বের হয়,
“আরিশ…”
নয়না মুহূর্তেই কান্না জুড়ে বসে।
“তুমি চোখ বন্ধ করবে না, শুনছো! চোখ খোলা রাখো!”
আরিশ যেন বরফের মতো জমে গেছে। তার জন্যই তো—তার জন্যই এমন ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটলো। পায়ের তলায় জমাট কুয়াশা, বুকের ভেতর গলগল করে বয়ে যাচ্ছে ভয়।
হঠাৎ জোরে গলা ফাটিয়ে উঠে আরিশ অরাকে কোলে তুলে নেয়, অরার মাথা ঝুলে পড়ছে তার কাঁধে।
“জলিল! জলিল! গাড়ি বের কর…..”
তার কণ্ঠে উন্মাদনা, কান্না, অপরাধবোধ সবকিছুর ঝাঁপটা।
অরার নিঃশ্বাস যেন একেকবার আসছে, থেমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শরীর কেঁপে উঠছে অদ্ভুতভাবে। তার পেটের ওপর হাত রেখে গুঁড়িয়ে আসা স্বর ফিসফিস করে বলে,
“ব্যথা করছে… ভীষণ… পেটটা…”

হাসপাতালের করিডোরের হলুদ আলোয় থমথমে পরিবেশ। সোলাইমান মল্লিক, আরিশ আর তালহা—তিনজন তিন কোণে পায়চারি করছে যেন কেউ ভিতর থেকে খবর নিয়ে বেরিয়ে আসলেই হুট করে দৌড়ে যাবে তার দিকে। করিডোরের একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে রোকসানা, নয়নার হাত আঁকড়ে ধরে কাঁদছে ফুঁপিয়ে। নয়নার মুখও ভেজা, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে।
আরিশের শার্টে বড় বড় রক্তের ছোপ। বুক বরাবর ছড়িয়ে পড়েছে লালচে ছোপগুলো। সেই রক্ত কার– অরার। আর এই ব্যাপারটা যেন সবাইকে ঠান্ডায় জমে যেতে বাধ্য করেছে।
সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই, রাস্তায়, গাড়ির ভেতর, অরা একবারও চোখ পুরো খুলেনি। বারবার শরীর ঝাঁকিয়ে উঠেছে, আর পেট চেপে ধরে শ্বাস নিতে চেয়েছে। ব্লিডিং হয়েছে থেমে থেমে।
তামান্না, যতটা পারে, রোকসানাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে,

“আন্টি… চিন্তা করবেন না। অরা ভাবি ঠিক হয়ে যাবে। ভিতরে ডাক্তাররা আছে…”
কিন্তু রোকসানা কোনো কথা শুনছে না, শুধু বলছে,
“ আমার মন কু’ডাকছে তামান্না। আমার মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। “
নয়না মা’কে জড়িয়ে ধরে বুকে।
কোথায় রাত পোহালেই সবার বিয়ে বাড়ির আনন্দে মেতে ওঠার কথা ছিল, তার বদলে এখন করিডোর জুড়ে কান্নার শব্দ, উন্মাদ আরিশের আর্তনাদ আর প্রত্যেকের বুকে চেপে বসা এক ভয়ানক নীরবতা।
আরিশ যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে সে। তালহা কোনোমতে আরিশকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করছে।

“ আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো না কেন? ডাক্তার এতক্ষণ কী করছেন ভেতরে? “
“ ভাইয়া! শান্ত হও। ভাবীকে আগে দেখুক, তারপর তো জানাবেন। “
সোলাইমান আরিশের অবস্থা দেখে পাশে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ ডাক্তারকে দেখতে দাও। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই আমাদের। “
আরিশ শান্ত হতে পারে না। তার হামিংবার্ড চোখ বন্ধ করে আছে, কথা বলছে না – সে কীভাবে শান্ত হতে পারে?
এরমধ্যেই কেবিনের দরজা খুলে গেল। সাদা অ্যাপ্রোন পরা ডাক্তারের মুখটা ক্লান্ত, চোখে চাপা গম্ভীরতা। ডা. শেলিনা আক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। আর কোনো কথা না শুনেই আরিশ দৌড়ে গেলেন তার দিকে, প্রায় ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

“ডাক্তার… অরা? অরা ঠিক আছে?”
তার গলা কাঁপছে, চোখ দুটো ছলছল করছে। বুকে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে।
ডা. শেলিনা এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তারপর ধীরে বলেন,
“ মাথায় ছোট একটা আঘাত লেগেছে, কিন্তু সেটা বিপজ্জনক না। আমরা স্ক্যান করেছি, ব্রেইনে আঘাত নেই। হাতের একটা হাড় হালকা চিড় ধরেছে… তবে…”
তিনি থামলেন।
আরিশের বুক কেঁপে উঠলো।
“তবে…?”
তার কণ্ঠ আরেকটু নরম হয়ে এলো। ডাক্তার শেলিনা এবার সরাসরি তাকিয়ে বললেন,

“মিস্টার খান… উনি গর্ভবতী ছিলেন। প্রায় ছয় সপ্তাহের মতো। অরা নিজেও জানতোনা, হয়তো। আমি সন্ধ্যায় এটা বলতেই কল করেছিলাম। সন্দেহ করেছিলাম অরা প্রেগন্যান্ট কি-না, সেজন্য একবার টেস্ট করাতে বলতে চেয়েছিলাম। সম্ভবত আপনিও জানতেন না । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পড়ে যাওয়ার কারণে অরা মিসক্যারেজ করেছে। আ’ম সরি! ”
কথাটা যেন মুহূর্তে দেয়ালের মতো ধাক্কা দিলো আরিশকে। পেছন থেকে রোকসানার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অস্ফুট চিৎকার,
“অরা প্রেগন্যান্ট ছিলো…?”

তিনি কাঁদতে কাঁদতে এক হাতে মুখ চেপে বসে পড়ে হঠাৎই। তামান্না রোকসানার হাত ধরে । তালহা হতবাক, কিছুই বলতে পারছে না। তাসলিমা খাতুনও চুপ করে আছেন। সোলাইমান ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়েছেন। নয়না উনাকে সামলাচ্ছে।
আরিশ এক পা পিছিয়ে গেল। ঠোঁট কাঁপছে, চোখ জলে ঝাপসা—
“সে… জানত না… আমিও না…”
ডাক্তার বললেন,
“এটা খুব কমন। অনেকেই প্রথম কয়েক সপ্তাহ টের পান না। কিন্তু পড়ে যাওয়ার ধাক্কা, অভ্যন্তরীণ শকে এমব্রিও আর টিকে থাকতে পারেনি। এখন জরায়ু পরিষ্কারের জন্য একটা ছোট প্রসিডিউর করবো—D&C। চিন্তার কিছু নেই, আমরা সব ব্যবস্থা নিচ্ছি। ”

আরিশ কিছু বলতে পারছিল না। তার চারপাশটা যেন ঘূর্ণি হয়ে ঘুরতে লাগলো। শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল–
“আমাদের অজান্তেই একটা প্রাণ চলে গেলো… অরা জানতেই পারলো না…”
ডা. শেলিনা ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেলেন, পেছনে ফেলে গেলেন এক চাপা, ভারী নিঃশ্বাসে মোড়ানো গুমোট নীরবতা।
দেড় ঘণ্টা পর।
অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে গেল।
দুজন নার্স স্ট্রেচারে করে অরাকে কেবিনে নিয়ে এলো। চোখ বন্ধ, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইন, এবং শরীর নিস্তেজ।
আরিশ উঠে দাঁড়িয়েই থমকে যায়। অরাকে এ অবস্থায় দেখে নিশ্বব্দে চোখের জল ফেলতে থাকে সে। হাতে কাগজ, রিপোর্ট, আর চোখে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে ডাক্তার শেলিনা পাশে এসে দাঁড়ান।

“সব ঠিকভাবে হয়েছে। আমরা জরায়ু পুরো পরিষ্কার করেছি। এখন বিশ্রাম দরকার। শারীরিকভাবে ঠিক হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। তবে মানসিকভাবে… আপনাদের সবাইকে পাশে থাকতে হবে।”
অরাকে কেবিনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। রোকসানা তার মাথার পাশে বসে কপালে হাত বুলাতে থাকে। নয়না ধীরে ধীরে তার হাত চেপে ধরে। আরিশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে, কথা বলতে পারছে না—শুধু তাকিয়ে আছে।
ঘণ্টাখানেক পর। অরার চোখ দুটো ধীরে ধীরে খুলে যায়। আলো ধাঁধিয়ে যায় তার চোখে। আরিশ সর্তক হয়ে ওঠে।
“ মা… আমি কোথায়?”
গলা কাঁপা কাঁপা।
রোকসানা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
“তুই হাসপাতালে। পড়ে গিয়েছিলি। এখন তুই নিরাপদ… মা, আমরা তোকে নিয়ে হসপিটালে আছি।”
অরা চোখ ঘোরায়। নয়নাকে দেখে। তারপর ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে তাকায় আরিশের দিকে।
“আরিশ…”
আরিশ এগিয়ে আসে। নিচু গলায় বলে,
“আমি এখানে আছি… আমি তোমাকে একটুও ছেড়ে যাইনি।”
অরা চোখ বুজে ফেলে একবার। তারপর হঠাৎ যেন কী যেন মনে পড়ে যায়। পেটের ওপর ধীরে হাত রাখে সে।
“আমার পেট… ব্যথা করছে… কেমন যেন লাগছে… অস্বস্তি লাগছে। কিছু হয়েছে? ডাক্তার… ডাক্তার কি বলেছে কিছু?”

রোকসানা আর নয়না মুখ নিচু করে রাখে। কেউ কিছু বলে না।
আরিশই এগিয়ে আসে ধীরে। তার কণ্ঠ কাঁপছে, কিন্তু ঠোঁট শক্ত করে ধরেছে সে। ভেতর ভেতর অদ্ভুত এক অপরাধবোধ কাজ করছে তার। সেজন্য অরার পাশেও যেন বসেনি এতক্ষণ। কিন্তু এখন আর দূরে থাকার সময় নেই। সে অরার পাশে বসে। সকলের সামনেই অরার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
“তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে… আমরা কেউ জানতাম না… এমনকি তুমিও না… কিন্তু…”
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয় আরিশ।
“ কিন্তু পড়ে যাওয়ার ধাক্কায়… আমাদের বাচ্চাটা আর নেই…”
অরা প্রথমে বুঝে না। চোখে একটা শূন্যতা। এক সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড… তারপর মুখে ধীরে ধীরে নেমে আসে হতবিহ্বলতা। চোখ বড় হয়ে যায়। ঠোঁট ফাঁকা হয়ে পড়ে।

“ আমি মা হতে যাচ্ছিলাম?”
থেমে যায় সে। শুকনো ঢোক গিলে ফের বলে,
“কিন্তু আমি তো… আমি জানতাম না… আমি তো… একটিবারও অনুভব করতে পারিনি… আমি…”
অরা হাউমাউ করে কাঁদে না। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, নিঃশব্দে। এক হাত পেটের ওপর, অন্য হাত চেপে ধরে আরিশের কাঁধ।
“আরিশ… আমাদের বাচ্চাটা… চলে গেলো?”
তার গলা ভেঙে যায়। আরিশ তার কপালে মুখ গুঁজে কান্না চেপে রাখে।
হাসপাতালের এককোণে, এক দম্পতি চুপচাপ বিদায় জানায় একটি অনাগত প্রাণকে–
যে এসেছিলো নিঃশব্দে, আর চলে গেলো আরও নিঃশব্দে…একটিবার “মা” বা “বাবা” ডাকার সুযোগ না দিয়েই।
রোকসানা মেয়ের এমন ভেঙে পড়া সহ্য করতে না পেরে নয়নার হাত ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। নয়নাও চোখ মুছতে মুছতে পিছনে তাকায়,অরার সেই ফাঁকা চাহনির দিকে।
অরার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তার ঠাণ্ডা চোখে শুধু প্রশ্ন – কী হারাল, কেন হারাল। আরিশ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অরাকে আজ কীভাবে শান্ত করবে জানে না আরিশ । সে নিঃশব্দে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

“পাখি…”
“আমার পেটে বাচ্চা ছিলো? আমি… আমি মা হতাম?”
অরার গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে যেন গিলে ফেলছে কান্না।
আরিশ তার মাথার তালুতে এলোমেলোভাবে চুমু খায়। ঠুকরে ঠুকরে কেঁদে ওঠে। অরাও আর ধরে রাখতে পারে না। চোখ বন্ধ করে, বুক চেপে ধরে হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে — অবশেষে শব্দ করে কান্না জুড়ে বসে।
“শান্ত হও, অরা… যে চলে গেছে, তাকে আর ফেরানো যাবে না। আমরা তো কেউ জানতাম না… আমরা আবার বাবা-মা হতে পারবো, ইনশাআল্লাহ। তুমি সুস্থ—এটাই এখন বড় জিনিস।”
আরিশের কথা শুনে মুহূর্তেই যেন অরার মুখশ্রী বদলে যায়। চোখে বিষণ্ন দৃষ্টি, ঠোঁট শক্ত করে বলে,
“আপনার কাছে আমাদের বাচ্চাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? আপনি… এত সহজে কীভাবে বললেন ‘আবার বাবা-মা হতে পারবো’?”

আরিশ স্তব্ধ। কিছু বলার আগেই অরা নিজেকে সরিয়ে নেয় তার বুক থেকে।
“আপনার কথায় মনে হয় এই সন্তানটা শুধু আমার ছিল। আপনি তো বাবা ছিলেন! তাহলে কষ্ট আপনার হবে না? আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কী হারিয়েছি?”
আরিশ তার দুই গালে হাত রাখে। কোমল গলায় বলে,
“বাচ্চাটা তো তোমার একার ছিল না, অরা। আমারও ছিল। আমিও কষ্টে আছি… অনেক বেশি।”
“তাহলে আপনি… তখন কেন শান্ত থাকতে পারেননি? ওই ছেলেটাকে মারতে গেলেন কেন? আপনি থামলে… থামলে হয়তো এসব কিছু হতো না।”

অরার গলা ভাঙা ভাঙা। চোখে কান্না, ঠোঁটে দুঃখ, গলায় অভিযোগ।
আরিশ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সে জানে, তার সেই আগুনে রাগ… অন্য কাউকে অরার দিকে চোখ তুলে তাকানো দেখলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা – এসবই অরার জীবনে বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তো চেষ্টা করলেও নিজের স্বভাব বদলাতে পারেনি।
“অরা… আমি…”
“না! প্লিজ, আপনি কিছু বলবেন না। আপনার পাগলামি, আপনার সহ্যহীনতা আমাকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আপনার আচরণের কারণেই আজ আমার বুক খালি। আমি তাকে কখনো অনুভব করতে পারিনি… আর এখন—সে নেই!”
অরা যেন পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করে।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করে, আরিশ জড়িয়ে ধরতে গেলে বারবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়।
“ছুঁবেন না আমাকে! আপনার জন্যই… সবকিছু শেষ!”

অতিরিক্ত উত্তেজনায়, দুর্বল শরীর আর ক্ষয়ে যাওয়া শক্তিতে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অরা।
আরিশ আঁতকে উঠে তাকে আঁকড়ে ধরে।
“অরা! অরা প্লিজ চোখ খোলো! ডাক্তার! কেউ আছেন? প্লিজ… ওর কিছু যেন না হয়!”
আরিশ চিৎকার করে ওঠে। কেবিনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নার্স ছুটে আসে, পেছনে ডাক্তার শেলিনা আক্তার ।
“BP একদম নিচে। Pulse ইরেগুলার। স্যালাইন আরও দাও, ওকে নিচু করে শুইয়ে দাও। Oxygen মাস্ক…”
ডা. শেলিনা দ্রুত অরার চোখের পাতা তুলে,চেক করেন। আরিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বিছানার পাশে। তার হাতে অরার হাত, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ডাক্তার, নার্সের উপস্থিতিতেই সে একবার অরার কপালে চুমু খেয়ে শুধু ফিসফিস করে বলে,

“তুমি চোখ খুলছো না কেন, পাখি? আমার ওপর যত রাগ, সব ঝাড়ো… কিন্তু চোখ খোলো প্লিজ…”
ঘড়ির কাঁটা যেন আর এগোয় না। রোকসানা চেয়ারে বসে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া হাতদুটো জড়িয়ে ধরে। নয়না জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, একবারও চোখের জল মুছছে না। তালহা শুধু পাশে দাঁড়িয়ে, আরিশের পিঠে একবার হাত রাখে। কিন্তু আরিশ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“আমার জন্যই সবকিছু হয়েছে, তাই না তালহা?”
“ না ভাইয়া। তকদিরে যা লেখা থাকে তাই হয়। তুমি নিজেকে অপরাধী না ভেবে এখন শক্ত হও। ভাবীকে সামলাতে হবে। “

হামিংবার্ড পর্ব ৫৬

আরিশ মাথা নাড়ে কেবল। চোখে তার জল।
ডাক্তার শেলিনা ধীরে কেবিন থেকে বেরিয়ে বলেন,
“ অরা শকে চলে গিয়েছিল। ওভার স্ট্রেস। ভয় নেই, ও ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পাবে।”
সবাই একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু আরিশের মন শান্ত হয় না। অরার বলা কথাগুলো তাকে ভেতর ভেতর শেষ করে দিচ্ছে। সত্যি কি সবকিছুর জন্য সে দায়িত্ব?

হামিংবার্ড পর্ব ৫৮