হামিংবার্ড পর্ব ৬৭
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
সকালটা একটু ধীর গতিতে শুরু হয়েছিল আজ। তবে শহরের যানজট পেরিয়ে যখন আরিশ তার অফিসে পৌঁছাল, তখন ঠিক সাড়ে ন’টা। গেট থেকে ঢুকে অফিস বিল্ডিংয়ের লিফটে ওঠে। লিফট থেকে নেমেই অফিসের করিডোরে হেঁটে নিজের কেবিনে ঢুকে বসল সে। ডেস্কে বসেই প্রথম কাজ তার —ল্যাপটপ অন করা নয়, বরং ফোন খুলে অরার একটা ছবি দেখে নেয়া। এই ছবিটা ওদের গ্রামে থাকা সময় তোলা।
“তুমি জানো, তোমার এই ছবিতে তাকিয়ে থাকলে অফিসে বসেও শান্তি পাই। ”
মৃদু স্বরে নিজেকেই বলল আরিশ। দরজায় টোকা পড়তেই মাথা তুলে দেখে, শাওন দাঁড়িয়ে আছে ফাইল হাতে।
“স্যার, মিটিংয়ের সময় হয়ে গেছে। ক্লায়েন্ট ওয়েট করছেন কনফারেন্স রুমে।”
“আসছি, তুমি যাও।”
কিছুক্ষণ পর কনফারেন্স রুমে ঢুকলো আরিশ। কাঁচের দেয়ালঘেরা আধুনিক সেই রুমে আলো-ছায়ার খেলা চলছে। বড় স্ক্রিনে চলছে প্রেজেন্টেশন, আরিশ নিজের স্লাইডস উপস্থাপন করছে দৃঢ় কণ্ঠে। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার চোখ স্লাইডের ভেতরের একটা লাইনে আটকে যায়, যেখানে লেখা—
“We design emotions that stay.”
মন যেন হুট করে অরার দিকে চলে গেলো।
আরিশ হালকা হাসে নিজের মনে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“স্যার?”
“জি?”
“আপনি একটু গা-ছাড়া লাগছে। ঠিক আছেন তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি। একটু…আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। যাইহোক আবার শুরু করছি। ”
সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্রে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো আরিশকে। বেচারা বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সামনে নয়নার এসএসসি পরীক্ষা।
স্কুলের মাঠে শেষ বিকেলের রোদে লালচে আভা ছড়িয়ে আছে। গাছে বসে কাক, দূরে খেলছে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির কিছু ছেলে-মেয়ে। স্কুলের বারান্দায় বসে আছে নয়না, রাণী আর তানহা –ওরা তিন বান্ধবী।
রাণী হাতে একটা ছোট আয়না ধরে নিজের মুখ দেখছে। কপালে টিপটা সোজা লাগছে কি না, বারবার ঠিক করছে। সাজগোজের বিষয় খুব সতর্ক সে। তানহা পাশেই বসে ছিলো। হুট করে বলল,
“আয়না ফেলে দে, পরীক্ষা সামনে। চেহারা নয়, এখন পড়াশোনার প্রস্তুতি দরকার।”
রাণী চোখ ঘুরিয়ে বলল,
“রচনার নাম যদি হয় ‘আমার প্রেম’ তাহলে আমি টপার হবো।”
তিনজনেই হেসে উঠল। হাসির ফাঁকেই তানহা নয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর চোখ কেমন যেন… শান্ত, কিন্তু বিষণ্ন। কী ব্যাপার রে? পলাশ ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে?”
নয়না চমকে তাকাল তানহার দিকে। কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
“ওর কথা তো ভুলিনি কখনো, তানহা। আমি শুধু ভাবি… ও এখন কেমন আছে। ভালো আছে কি না। আমাকে মনে পড়ে কি না… এসব।”
রাণী মুখে বাঁকা হাসি এনে বলল,
“তোর মতো মেয়েকে কেউ ভুলতে পারে?”
“তোর মনে হয় সে এখনো তোর কথা ভাবে?” জিজ্ঞেস করল তানহা।
নয়না আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসলে মনে পড়ে, চাইলেও ভুলা যায় না। আমি এখনো প্রতিদিন তার দেখা পাওয়ার আশায় স্কুলের গেটের দিকে তাকাই। হয়তো একদিন হঠাৎ চলে আসবে। দুই বছর হওয়ার আগেই হয়তো চলে আসবে– মাঝে মধ্যে এসব মনে হয়। ”
রাণী আর তানহা এবার আর ঠাট্টা করলো না।
তানহা ধীরে নয়নার হাতটা চেপে ধরল। বান্ধবীর মন খারাপের পাল্লা কতখানি তা দু’জনেই অনুভব করতে পারছে।
“তুই কি তাহলে এখনো ওর জন্য অপেক্ষা করছিস?”
নয়নার চোখে জল চিকচিক করল, কিন্তু মুখে হাসি রাখল সে।
“আমি নিজেও জানতাম না, আমি তার জন্য এভাবে অপেক্ষা করবো। আমি কাউকে বলিনি আমার এই দূর্বলতার কথা। আজ বললাম, তুই-রাণী ছাড়া কেউ জানেও না। আমি অপেক্ষা করছি না, আমি প্রার্থনা করি— যেন নির্দিষ্ট সময়ে মানুষটা সুস্থভাবে আমার কাছে ফিরে আসে। ”
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। হঠাৎ সেখানে তাদের এক ক্লাসমেট এসে জানালো দু’দিন পর প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। তানহা হেসে বলল ,
“ভালোবাসা গেল, এবার পরীক্ষার প্রেমে পড়!”
রাণী বলল,
“হ্যাঁ, আর যদি পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না আসে, পলাশ ভাই তোকে নেবে না!”
নয়না হেসে ফেলল এবার। মনের গভীর শূন্যতায় একফোঁটা রোদ পড়ে গেলে যেমন হয়, তেমন শান্তি লাগল তাকে।
তিনজন একসাথে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল স্কুলের গেট পেরিয়ে। নয়নার চোখ আবার একবার ঘুরে গেল ডান পাশে, যেখানে একসময় পলাশ দাঁড়িয়ে থাকত।
আজ সে কোথাও নেই। তবুও নয়না জানে, তার হৃদয়ের উঠোনে এখনো পলাশের একটা বসার জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে।
সন্ধ্যাবেলা। ড্রইং রুমে বসে টিভিতে নিউজ দেখছে অরা। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। হ ত্যা, ধ র্ষ ণ, চাঁদা*বাজি সবকিছুই বেড়ে গেছে। চব্বিশের জুলাই যেন ফের ধরা দিয়েছে পঁচিশে এসে। অরার কোমল হৃদয় এসব নিতে পারে না। র*ক্ত দেখলেই সেদিনের দূর্ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। সেই সিড়ি থেকে পড়ে যাওয়া…. তারপর র*ক্ত… আর! আচমকাই চিৎকার করে ওঠে অরা। রান্নাঘরে তামান্না চা তৈরি করছিল । আচমকা অরার চিৎকার শুনে আঁতকে উঠল সে। কাজকর্ম সব রেখে ছুটে ড্রইং রুমে পৌঁছে দেখল অরা অবচেতন অবস্থায় ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে আছে।
“ ভাবি! ভাবি! কী হলো আপনার? “
তামান্না ব্যস্ত হয়ে উঠল। অরার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বারবার ডাকতে লাগলো তাকে। এরমধ্যে তামান্নার গলার আওয়াজে সাবিহা ও তাসলিমা খাতুনও ড্রইং রুমে চলে এসেছেন। অরাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে তারা-ও ঘাবড়ে গেলো।
“ ভাবি, অরা ভাবির কী হয়েছে? “
সাবিহাও অরার পাশে বসেছে। তাসলিমা খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন।
“ আমি জানি না আপা। রান্নাঘরে ছিলাম, আচমকাই ভাবির চিৎকারের শব্দ পেলাম। তারপর এসে দেখি!”
“ সোফায় তুলে বসা অরাকে, আমি আরিশকে কল করে আসছি। “
তাসলিমা খাতুন ফোন করার উদ্দেশ্য পা বাড়ানোর সাথে সাথে কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো। তামান্না বলল,
“ ভাইয়া চলে এসেছেন, হয়তো। “
“ আমি যাচ্ছি, দরজা খুলে দিচ্ছি। “
তাসলিমা খাতুন গিয়ে দরজা খুলতে এগোলেন। এদিকে সাবিহা ও তামান্না মিলে ধরাধরি করে অরাকে সোফায় তুলে বসিয়েছে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরিশের মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সে কিছুটা ক্লান্ত। অফিসের টানা কাজ শেষে ফিরেছে। কিন্তু তাসলিমা খাতুনের মুখের আতঙ্ক আর কণ্ঠে উদ্বেগ শুনে মুহূর্তেই তার চোখের ভাষা পাল্টে গেলো। তালহা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
“ আরিশ, অরা বেহুঁশ হয়ে গেছে!”
তাসলিমা খাতুন দরজার দিকে ইশারা করে তাড়াহুড়ো করে বললেন। আরিশ এক মুহূর্ত দেরি না করে জুতো খুলে ছুটে গেলো ড্রইং রুমে।
অরাকে সোফায় হেলান দিয়ে বসিয়ে রেখেছে তামান্না ও সাবিহা। চোখদুটো বন্ধ, মুখটা কেমন ফ্যাকাশে। হালকা ঘেমে গেছে কপাল। ভাইয়ের পেছন পেছন তালহাও দৌড়ে এসে দাঁড়াল একপ্রকার।
“অরা!”
আরিশ ছুটে গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। কপালের ঘামটা মুছে দিয়ে নাম ধরে ডাকল বারবার।
“এই কী হলো তোমার? চোখ খোলো, প্লিজ… এই পাখি!”
তার কণ্ঠে ভয় আর উদ্বেগ মিশে গিয়ে যেন পুরো ঘরে কাঁপন তুলল।
তামান্না বলল, “টিভিতে একটা র*ক্তাক্ত লাশের ছবি দেখাচ্ছিল, সম্ভবত সেদিকে তাকিয়ে আচমকা চিৎকার করে উঠেছিল ভাবি। আমি রান্নাঘরে ছিলাম। ”
আরিশ থমকে গেলো। ঠোঁট চেপে ধরলো।
তার মুখের পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল। মুহূর্তে মাথার ভেতর ঝড় উঠে গেলো– সেই পুরোনো স্মৃতি, সেই সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া, হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষা করতে থাকা তার নিঃসহায় মুখ। অরার কোল থেকে সেদিন হারিয়ে যাওয়া ভ্রূণটা আজও তাকে তাড়া করে ফেরে। হয়তো সেসব স্মৃতি অরাকে আজও মানসিকভাবে ভোগাচ্ছে। ডাক্তার তখনই বলেছিল – অরার মানসিক ট্রমা কাটতে অনেক সময় লাগবে।
“আমার অরাকে এসব কেন দেখতে দিলে তোমরা? ”
আরিশের কণ্ঠে কষ্ট আর রাগের দাগ। চোখ লাল হয়ে গেছে তাট। সে আবার অরার মুখের দিকে তাকাল। হুট করেই কোলে তুলে নিলো। তালহা ডাক্তারকে কল কর, ফাস্ট!
” কল করেছি আমি। উনি আসছেন। ”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। অরাকে নিয়ে বেডরুমের দিকে এগোল।
বাড়ির সবাইও আরিশের পিছুপিছু যেতে লাগলো।
রাত প্রায় আটটা বাজে। তাহলার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছেন ডা. শেলিনা আক্তার।
এতক্ষণ ভালো করে অরাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। আরিশ অরার মাথার পাশে বসে আছে। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এককোনায়।
ডা. শেলিনা মাথা হেঁট করে একটুখানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“এই রকম রেসপন্স সাধারণত কোনো মানসিক ট্রমা থেকে আসে। আমি জানি, ও আগেও একটা দুর্ঘটনায় গর্ভপাতের শিকার হয়েছিল। সেই সময়ের স্মৃতি, রক্তের ভয়, আর মানসিক চাপ মিলিয়ে এই ধরনের রিয়্যাকশন আসতে পারে।”
আরিশ যেন গিলতে পারল না কথাগুলো। মুখ শক্ত হয়ে গেল। যা ভেবেছিল তাই হলো।
“এটা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD) এর অংশ হতে পারে।”
ডা. শেলিনা ব্যাখ্যা করলেন,
“ওর স্নায়ু এখন অনেক বেশি সংবেদনশীল। একটু ভয়, অথবা রক্তের মতো কিছু দেখলেই তার মধ্যে আতঙ্ক জন্ম নিচ্ছে। সেই কারণেই বেহুঁশ হয়ে যায়। ভালো করে বিশ্রাম দিতে হবে। প্রয়োজনে একজন সাইকোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলানো উচিত।”
আরিশ বলল, “কী করলে ভালো হবে? প্লিজ, ওকে সুস্থ করতে হবে। ”
“সবার আগে ওর মানসিক শান্তি দরকার। মানসিক চাপ দেওয়া যাবে না। কিছু হালকা ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি, রাতে ভালো ঘুম হলে মাথা ঠান্ডা থাকবে। আর, কেউ যেন ওর সামনে এসব ভয়াবহ খবর বা আলোচনার প্রসঙ্গ না তোলে। বুঝেছেন?”
” আমি ব্যবস্থা নেব, ডক্টর। ওর সামনে এমন কিছু আর আসতে দেবো না।”
আরিশের গলায় দৃঢ়তা। ডা. শেলিনা হালকা হাসলেন।
“আমি জানি মিস্টার খান। আপনার মনোযোগই এখন ওর সবচেয়ে বড় ওষুধ।”
আরিশ কিছু বলল না। ডাক্তার শেলিনা আক্তার বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন,
” তাহলে আমি আসছি। ঔষধ দিয়েছি যেগুলো ওগুলো খাওয়াবেন। আপাতত ভয়ের কিছু নেই। ”
” থ্যাংক ইউ ডক্টর। তালহা উনাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আয়, জলিলকে বল ঠিকমতো পৌঁছে দিয়ে আসতে। ”
” ঠিক আছে, ভাইয়া। ”
হামিংবার্ড পর্ব ৬৬
তালহা ডাক্তার শেলিনাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাকিরাও রুম থেকে চলে যাওয়ার পর আরিশ অরাকে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আচমকা অরাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে আরিশের যেন হৃৎস্পন্দন থেমে যাচ্ছিল।