হামিংবার্ড পর্ব ৭
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
রোদটা আজ একটু বেশি তীব্র। জানালার পর্দার ফাঁক গলে সোনালি আলো এসে পড়েছে বিছানায়। বিছানার চাদরটা এলোমেলো, মেঝেতে অরা ও আরিশের জামাকাপড় ছড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, যেন রাতের কাহিনী এখনো মেঝের ওপর পড়ে আছে। অরা চোখ মেলে তাকায়। মেয়েটার চোখে ক্লান্তির ছায়া, ঠোঁটে নিঃশব্দ এক অস্থিরতা। শরীরটা যেন নিজেই বোঝায় দুঃসহ একটি রাত পেরিয়েছে । চুপচাপ শুয়ে থাকে সে, পাশ ফিরতেও কষ্ট হয়। সমস্ত শরীরে ব্যথা। আরিশ এখনও ঘুমিয়ে আছে , মুখে প্রশান্তির ছাপ। আরিশের দিকে তাকাল অরা। লোকটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় একেবারে শান্ত লাগছে। অথচ! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা।
অরার বুকের ভেতর একরকম ঝড়—ভয়, লজ্জা, আর একটা অচেনা অনুভূতির মিশেল। বয়স মাত্র আঠারো, কিন্তু এই কয়েকদিনেই সে যেন বড় হয়ে গেছে। সেই চঞ্চলতা হারিয়ে গেছে। অরার অস্থির লাগছে।
ঘড়িতে সকাল নয়টা বেজে গেছে। বিছানা ছাড়তে চায় না শরীর, তবুও অরা উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে গিয়ে হালকা কেঁপে ওঠে—পায়ের নিচে শক্ত মেঝে। অরা আয়নার সামনে দাঁড়াল। গালের একপাশে লালচে ছাপ, ঠোঁট সামান্য ফুলে আছে। গলায়ও লালচে দাগে ভরপুর। কামিজের ভেতরে উঁকি দিয়ে তাকাল অরা। বুকেও এক অবস্থা। হতাশ লাগছে অরার।
সে আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ওই চোখে বিস্ময়, লজ্জা, রাগ—আর একধরনের নীরব সাহস। অরা নিজেকে বোঝাতে চায়—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তুই ঠিক আছিস, অরা। তুই ঠিক আছিস। তুই সব সহ্য করে নিতে পারবি। ”
সত্যি বলতে এই দু’দিনে কিছুটা হলেও সহ্যশক্তি বেড়েছে মেয়েটার। আরিশের পাগলামি কেমন হতে পারে – এতটুকু বুঝে গেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সঙ্গীর সাথে শারীরিক মিলন তখনই আনন্দের হয়, যখন সেটা মন থেকে হয়। অর্থাৎ মানসিক প্রশান্তি থাকে। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ভিন্ন। শারীরিক মিলনের ফলে ছেলেদের মানসিক শান্তি লাভ হয়৷ কিন্তু একটা মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সাথে মিলন করচে গেলে, সে মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ে। এই মানসিক যন্ত্রণা কেবল একজন নারীই বুঝতে পারবে। অরা যতই নিজেকে সামলাতে চাচ্ছে, ভেতর ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারই স্বামী, তাকে ধর্ষণ করছে প্রতিদিন। ধর্ষণ? হ্যাঁ এটাকে বৈবাহিক ধর্ষণই বলে। অরার দুচোখ ছলছল করছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও যেনো শুকিয়ে গেছে। বাড়িতে ফিরবে কিন্তু ফিরে গিয়ে কী বলবে? কীসের জন্য আরিশের সাথে থাকবে না সে? এসবের জন্য? জোর করে সেক্স করে – এসব কীভাবে বলবে বাবা-মাকে! অরার হাসফাস লাগছে। ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে।
ওয়াশরুমে ঢুকে ঠান্ডা পানি ছুঁইয়ে দিলো চোখেমুখে। গোসল করতে হবে। কিন্তু পোশাক আনা হয়নি সাথে। অরা সেসব ভুলে শরীরে পানি ঢালতে শুরু করেছে। গোসল করলে যদি শরীরটা অন্তত একটু ভালো লাগে!
” তাহলে কী করবে মা? ভাইয়ার কাছে কল দিবে?”
তালহার কথায় চুপ করে রইলেন তাসলিমা খাতুন। পাশেই চেয়ারে বসে আছে সাবিহা। তালহা উনার বড় ছেলে। গায়ের রঙ তার শ্যামলা, ছিপছিপে গড়ন। মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে। দারুণ মনখোলা স্বভাব—ঘর ভর্তি মানুষ থাকুক বা না থাকুক, সে একাই সবকিছু মাতিয়ে রাখতে পারে।
” হ্যাঁ। এখানে থেকে কী হবে বল? তোর লেখাপড়া শেষ। এবার তো নিজের জায়গাটা বুঝে নিতে হবে তোকে। আর সাবিহারও তো বিয়েশাদি দিতে হবে। ”
” আমি বিয়ে করবোনা এখন, মা। ”
মাঝখানে কথা বলল সাবিহা। সাবিহা বলতে গেলে আগুন সুন্দরী। ফর্সা রঙ, ঘন লম্বা চুল, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি। অনার্স শেষ করে ঘরে বসে আছে এখন। তাসলিমা বললেন,
” সেসব পড়ে দেখা যাবে। আগে ঢাকা চল, তারপর আরিশ করবে যা করার। তোর বাবার অনুপস্থিতিতে আমাদের তো কোনো কমতি রাখেনি সে। কাছাকাছি থাকলে তোদেরকে আরো বেশি ভালোবাসবে। ”
তালহা জানে তার ভাই এমনিতেই খুব ভালোবাসে তাদের। যদিও তেমন কথা হয় না, দেখা হয় না। কিন্তু মনের টান আছে। সাবিহা চুপ করে গেলো। বিয়ে করলে আরিশকেই করবে সে, নয়তো নয়। বুঝদার হওয়ার পর থেকে আরিশকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন।
” ঠিক আছে মা। তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলো। আমরা সব গোছগাছ করে নেবো। ”
ছেলের কথায় খুশি হলেন তাসলিমা খাতুন। আরিশের চাচা বেঁচে থাকতে, পরিবার থেকে দূরে থেকেছেন কেবল আরিশের জন্য। স্ত্রী, সন্তানদের গ্রামে রেখে বছরের পর বছর শহরে পড়ে থেকেছেন। তাসলিমা অবশ্য সে বিষয় কখনো কিছু বলেননি। মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পেলেই তিনি খুশি হতেন। সত্যি বলতে আরিশের চাচা দেলোয়ার কখনো চাননি, আরিশ আবারও কারো খারাপ কথা শুনে বড়ো হোক। নিজের স্ত্রী’কে ভালো করেই চিনতেন তিনি। সে কারণেই ঢাকায় পরিবার নিয়ে আসতেন না দেলোয়ার। স্ত্রী, সন্তানদের গ্রামে রেখে নিজে ভাতিজার দেখাশোনা ও ভাইয়ের ব্যবসা সামলাতেন।
” বেশ। আমি রাতে কল দেবো। তোরা সব গুছিয়ে নে৷ ”
তালহা মুচকি হাসল মায়ের কথায়। সাবিহা মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মনে মনে সে দারুণ খুশি। এতদিনে আরিশের কাছাকাছি থাকতে পারবে সে!
এলার্ম-ঘড়ির শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে আরিশের। ঘুমঘুম চোখে পাশে তাকিয়ে অরাকে খুঁজছে সে। কিন্তু যাকে খুঁজছে সে নেই পাশে৷ সজাগ দৃষ্টিতে ঘরের প্রতিটি কোণে চোখ বুলাতে লাগল আরিশ। কিন্তু নাহ, অরা ঘরে নেই! আরিশের ঘুম ছুটে গেলো। মুহুর্তেই শোয়া থেকে উঠে বসল। এরমধ্যেই
ওয়াশরুম থেকে বেরোল অরা, পরনে কেবল একটা তোয়ালে। ভেজা চুলগুলো খোলা, এলোমেলোভাবে পিঠে ঝুলে আছে। আরিশ থেমে গেলো। সেই দৃশ্য দেখে তার দৃষ্টি আটকে গেল, নিঃশ্বাস ধীর হয়ে এলো। জীবনে এই প্রথম অরার দিকে এমন গভীর চোখে তাকিয়ে আছে সে।
ফর্সা, মেদহীন শরীর যেন নিপুণ কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা। লম্বা চুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তার কোমল কাঁধ। চোখদুটো—ভীষণ মায়াবী, যেন একবার তাকালেই মন ডুবে যায়। আর ঠোঁট!
সেটা যেন সদ্য ফোটা গোলাপের পাপড়ি—নরম, কোমল আর একধরনের আকর্ষণে ভরা। আরিশ থমকে যায়। তার দৃষ্টিতে, তার মনোজগতে এক অদ্ভুত ঘোর নেমে আসে।
আরিশকে বসে থাকতে দেখে ভীষণ ভড়কে গেল অরা। চমকে উঠেছে, চোখ-মুখ তাতে স্পষ্ট। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে উঠেছে। মন এতটাই উদাস ছিল, যে জামাকাপড় না নিয়েই ঢুকে পড়েছিল ওয়াশরুমে। ধরে নিয়েছিল, আরিশ এখনো ঘুমিয়ে আছে। তাই তো তোয়ালেতেই নির্বিকারভাবে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন? এই মুহূর্তে কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই অরা। নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাটি ফেটে গেলে সোজা সেখানে ঢুকে যায়। তবুও কিছু একটা করতে হবে। নিজেকে সামলে লম্বা এক নিঃশ্বাস ফেলল সে। মাথা নিচু করে, চোখ তুলে তাকাল না আরিশের দিকে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ওয়ারড্রবের দিকে। চুপচাপ। কিছু না বলে।
অরা ওয়ারড্রব খুলে জামাকাপড় খুঁজছে। হাত কাঁপছে—সে টের পাচ্ছে স্পষ্টভাবে। কিছু না দেখেও বুঝতে পারছে, পেছন থেকে আরিশ তাকিয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টির ভার যেন ঘাড়ে এসে পড়ে আছে অরার। বুক ধুকপুক করছে, গলা শুকিয়ে গেছে।
আর কিছু না ভেবে জামাকাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ফিরতেই চুপচাপ ভেঙে গেল সেই নিস্তব্ধতা—
” হামিংবার্ড!”
আরিশের গলা। নরম, শান্ত! অরা থমকে দাঁড়ায়।
পেছনে ফিরতে সাহস হয় না। নিঃশ্বাস আটকে যায় তার। চোখ বন্ধ করে মুহূর্তটা কাটানোর চেষ্টা করে।
আরিশ শান্ত কণ্ঠে বলল,
” শরীর ঠিক আছে? ”
অরা দাঁড়িয়ে থাকে—নীরবে, নিঃশব্দে। তার মুখে কোনো শব্দ নেই, অথচ চোখে অভিমান, রাগ আর মনের গভীরে অজানা এক আলোড়ন। সারারাত পশুর মতো আচরণ করে, এখন শরীরের খোঁজ নিতে এসেছে! অরা কী বলবে? কোন কথায় রেগে যায় বলা মুশকিল। আরিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অরার দিকে গভীর মনোযোগ তার। মেয়েটার গলায়, ঘাড়ে অনেক দাগ বসে গেছে। আরিশকে এগোতে দেখে ভয় লাগছে অরার। দ্রুত বলল সে,
হামিংবার্ড পর্ব ৬
” হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমি জামাকাপড় পরে আসছি। ”
” এখানেই পরো। আমি দেখব না। ”
আরিশের কথায় হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না অরা। কী হাস্যকর কথাবার্তা বলছে লোকটা।