হামিংবার্ড পর্ব ৭০
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
চারদিনের সাজেক ভ্রমণ শেষে অরা আর আরিশ ফিরে এসেছে ঢাকা শহরে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে শহরের চেনা কোলাহলে ফিরে আসা যেন দুজনকেই কিছুটা থমকে দিয়েছে। তবে এই ফিরে আসার ভেতরেও একরকম উত্তেজনা, প্রস্তুতির ঘনঘটা ছড়িয়ে আছে চারপাশে—কারণ খান বাড়িতে আসন্ন দুটি বিয়ের আয়োজন! এরমধ্যে সাবিহা ও মেহরাব তাদের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। মেহরাবের মায়ের সাথে কথা বলেছিল সাবিহা। ভদ্রমহিলা একটু খিটখিটে হলেও খারাপ নন। ছেলের সুখশান্তির কথা ভেবে ও সাবিহার আচরণে বিয়েতে ‘ হ্যাঁ ‘ বলে দিয়েছেন তিনি।
তালহা আর তামান্নার বিয়ে একসঙ্গে—এই খবরে পুরো পরিবার এখন যেন একসাথে হাঁটছে উৎসবের দিকে। বাড়ির সবাই ব্যস্ত, তৎপর। গেট সাজানো হবে কীভাবে, বরযাত্রী যাবে কয়টা গাড়িতে, মেয়েদের গায়েহলুদে কোন গানে দলবেঁধে নাচ হবে–এসব নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা চলছে আলোচনা।
শপিংয়ের জন্য আজ সবাই বেরিয়েছে। সকাল থেকেই অরা, তামান্না, সাবিহা আর তাসলিমা খাতুন রেডি হচ্ছিলেন। সাজেক থেকে ফেরা পর অরার মুখে যেন আলাদা এক শান্তির ছাপ। ঠোঁটের কোণে থাকে নরম হাসি, চোখে স্থির প্রশান্তি। তামান্না তো রীতিমতো উত্তেজনায় কাঁপছে—নিজের বিয়ে বলে কথা! ওর কথার মধ্যে অস্থিরতা, হাসির মধ্যে আনন্দ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবার আগে পৌঁছানো হয়েছে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে। লিফট থেকে নেমে রীতিমতো ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। তাসলিমা খাতুন বেশি ঘোরাঘুরি করেন না, তিনি একটা নির্দিষ্ট দোকানে ঢুকে শাড়ি আর ওড়না দেখে সময় কাটাচ্ছেন। সাবিহা নিজের জন্য একটা মেরুন শাড়ি হাতে তুলে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যাচাই করছে। অরা আজ হালকা রঙের একটা সালোয়ার পরে এসেছে। তার চোখে ক্লান্তি নেই, বরং চারপাশের ব্যস্ততা ও আয়োজন উপভোগ করছে নিঃশব্দে। সে মাঝে মাঝে তামান্নাকে জামার ডিজাইন দেখায়, কখনো সাবিহার জন্য গয়নাও পছন্দ করে।
তালহা আর আরিশ আলাদা করে ছেলেদের শপিং সামলাচ্ছে। আরিশ অরার পছন্দ বুঝে আজকাল নিজের স্টাইলেও হালকা পরিবর্তন আনার কথা ভেবেছে। সে হালকা ধূসর পাঞ্জাবি রঙের পাঞ্জাবি কিনেছে। অরা একবার দেখে বলেছিল, “আপনার গায়ের রঙের সঙ্গে ধূসর রঙটা খুব যায়।” সেজন্য আজ অরার অগোচরে সেই রঙের একটা পোশাক কিনলো সে, যাতে করে ভবিষ্যতে অরাকে চমক দিতে পারে।
শপিংয়ের ব্যাগ ক্রমশ ভারী হচ্ছে, তালিকা শেষ হয় না যেন। কেউ কনের জন্য গয়নাবক্স খুঁজছে, কেউ বরের জুতা। মেয়েদের পার্লারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, গায়ে হলুদের মেহেদির ডিজাইন, বর-কনের কো-অর্ডিনেটেড ড্রেস—সবকিছুই যেন একটা রঙিন পরিকল্পনার খুঁটিনাটি। শহরের একেকটা দোকান ঘুরে সবাই ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে–বিয়ে শুধু এক অনুষ্ঠান নয়, এটা বিশাল দায়িত্বের ব্যাপার।
“ তোমাদের হলো?”
অরা জিজ্ঞেস করলো সাবিহা ও তামান্নাকে। তাসলিমা খাতুন আগেভাগে তালহার সাথে গিয়ে গাড়িতে বসেছেন। আরিশ পেমেন্ট করার জন্য সবগুলো ব্যাগপত্র নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে।
“ হ্যাঁ, ভাবি। চলো। “
সাবিহা হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলো। আরিশের পিছুপিছু ওরা তিনজন এগোতে লাগলো। শপিং করতে গিয়ে গোটা একটা দিনই যেন চলে গেলো।
“ বিকেলে তালহা আসবে, তোকে ও বাড়িতে নিয়ে যেতে। “
নিজের কিছু কাপড় ভাজ করে ওয়ারড্রবে ঢুকিয়ে রাখলেন রোকসানা। নয়না মায়ের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে।
“ ঠিক আছে। “
নয়নার সংক্ষিপ্ত উত্তর। রোকসানা মল্লিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এগিয়ে গেলেন নয়নার দিকে।
“ তোর কী হয়েছে নয়না? দিনদিন কেমন মনমরা হয়ে গেছিস!”
মেকি হাসল নয়না। মা’কে যেন কিছু বুঝতে দিতে চায়না সে।
“ আমার আবার কী হবে মা? সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, টেনশন হচ্ছে। এছাড়া কিছু না। “
“ সত্যি তো? “
মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন তিনি। নয়না হুট করে মা’কে জড়িয়ে ধরে, বলে,
“ হুম মা। “
“ আচ্ছা। তুই বস, আমি গিয়ে রাতের জন্য রান্না বসাই। “
“ আচ্ছা মা।”
নয়না মা’কে ছেড়ে দিলো, রোকসানাও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেয়েটা।
বিকেল নামছে ধীরে ধীরে। জানালার কাঁচে লেগে থাকা মরা রোদের আলো ঘরের ভেতরে এসে পড়েছে। নয়না চুপচাপ মায়ের ঘরের জানালার পাশে বসে আছে। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। তালহার আসার কথা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অপেক্ষা নয়নার মন করছে সেই কারো জন্য যার খোঁজ অনেক দিন নেই। মা এসে দরজা খুলে বললেন,
“তালহা এসেছে মা। রেডি হয়ে আয়।”
“ আচ্ছা। “
নয়না আর কিছু বলে না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ওয়ারড্রোব থেকে ওড়নাটা তুলে নেয়, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়ায় এক মুহূর্ত। নিজেকে দেখে। চোখে হালকা ক্লান্তি। ঠোঁটে একরকম প্রাপ্তিহীনতার নীরবতা।
রাত গভীর। চাঁদের আলো ঘরের জানালার ফাঁক গলে নরম ছায়া ফেলে রেখেছে বিছানায় শুয়ে থাকা দু’টি মানুষের ওপর। জানালার পর্দা হালকা দুলছে বাতাসে। সেই বাতাসে মিশে আছে ক্লান্তির, প্রশান্তির, আর ভালোবাসার গন্ধ। অরা বিছানায় আরিশকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। নিঃশ্বাসের তালটা শান্ত, ঘাড়ে লুটিয়ে থাকা চুলগুলো ঘামে ভেজা। আরিশ ঘুমায়নি। চোখ মেলে মেয়েটাকে দেখছে। এলোমেলো চুল, ঘুমিয়ে পড়ার পরও ঠোঁটে রয়ে যাওয়া একরকম ভালোবাসার ছাপ,যেটা তার নিজের হাতে এঁকে দেওয়া।
কিছুক্ষণ আগেই, সেই ঘন নিঃশব্দে তারা একে অন্যকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুঁজে নিয়েছে নিজের মতো।
তীব্র কামনার ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়েছে দুজনের শরীরে। অরার তপ্ত কাঁধ, দুলে ওঠা বুক, কানে ফিসফিস করে বলা আরিশের স্বর–সবকিছু মিলিয়ে যেন অন্ধকারে লেখা এক দীর্ঘ কবিতা।
আরিশ অরাকে এতটাই নিবিড়ভাবে ছুঁয়েছিল, যেন স্পর্শের মধ্য দিয়েই সমস্ত কষ্ট ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছিল। অরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল দমবন্ধ করা দীর্ঘশ্বাসে, অদ্ভুত নিঃশব্দতায়।
ক্লান্ত হয়ে, শান্ত হয়ে, এখন সে ঘুমিয়ে আছে।
আরিশ তাকিয়ে থাকে অরার দিকে। নিজের আঙুল দিয়ে ওর চুলের এক ফাঁকা গোছা পেছনে সরিয়ে দেয়, কপালে একটুখানি চুমু খায়।
তার বুকের ভেতর হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে।
মনে পড়ে যায়– যদি সেই ছোট্ট প্রাণটা টিকে থাকতো… যদি একফোঁটা কান্না এই ঘরে যোগ হতো…তাহলে কি আজকের রাত আরও অন্যরকম হতো? আরেকটা ছোট হাত কি তাদের মাঝখানে শুয়ে থাকতো?
আরিশ জানে,এই কথা অরার ঘুম ভেঙে বললে ও নিশ্চয় কেঁদে ফেলত। তাই সে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে মেয়েটার কপালের হাড়ে ঠোঁট রেখে থাকে কিছুক্ষণ। তার খুব ইচ্ছে করে অরাকে জাগিয়ে তুলে আবার একটু গায়ে মুখ ঘষে বলুক,
“এই যে, ঘুমিয়ে গেলে কেন?”
তার খুব ইচ্ছে করে অরার গলা বরাবর আঙুল টেনে নামিয়ে আনুক, বুকের গাঁথুনিতে মুখ লুকাক, আবার হারিয়ে যাক সেই উষ্ণতার গভীরে। কিন্তু না। কাল বিয়ের দিন, গায়ে হলুদও আছে । অরার শরীর ভেঙে পড়লে ওর মিষ্টি মুখটায় আলো ঝলমল করবে না । তাই সে নিজেকে সংযত করে।
সারাটা ঘর নিঃশব্দ। তবু এই নীরবতায় আরিশ অনুভব করছে–এই নারী, এই দেহ, এই ভালোবাসা–এটাই তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আশ্রয়।
বাহিরে এক পশলা বাতাস জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আরিশ নিজের পাশে রাখা পাতলা কম্বলটা টেনে নেয় অরার শরীরজুড়ে। তারপর নিজের শরীরটাকেও ওর গায়ে একটু ঢেকে নেয়।
ঘুমানোর আগে শেষবারের মতো একবার ফিসফিস করে বলে ওঠে–
“তুমি ঘুমোলে রাতের শব্দ থেমে যায়।
আর আমি তোমাকে ছুঁয়ে,
নিজেকেই খুঁজে পাই, হামিংবার্ড।”
সকালের আলো বিছানায় পড়তেই ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙে অরার। চোখের পাতায় সূর্যের নরম আলো এসে পড়ে, আর পাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকা আরিশের গলা বরাবর তার কপাল স্পর্শ করে। অরার চোখ খুলতেই দেখে আরিশ তাকিয়ে আছে, ঠোঁটে দুষ্টু হাসি
“এইভাবে দেখলে কিন্তু ভালো হবে না।”
ঘুমভাঙা গলায় বলে অরা।
আরিশ হেসে বলে,
“আমি তো আমার মানুষকেই দেখছি। সেটা কি নিষেধ?
অরা কাঁথাটা মুখ পর্যন্ত টেনে নেয়, হালকা লাজুক হয়ে পড়ে।
“ তা বলিনি তো। “
আরিশ অরাকে ধরে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসাল, শক্ত করে তার কোমরে হাত রেখে নিজের কোলে তুলে বসাল।
“ কিছু বলো না, ডার্লিং। আমার দিকে তাকিয়ে থাকো, আমি আজন্মকাল ধরে তোমার চোখের চাহনি দেখি৷ “
অরা ভেংচি কাটল। হেসে বলল,
“ সব জানি। এখন ছাড়ুন। সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ, কাজকর্মের তদারকি তো করতে হবে মশাই। “
আরিশ ওভাবে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
“ পাখি, ভাবছিলাম ওদের বিয়েটা হওয়ার পর আমরাও অনুষ্ঠান করে বিয়ে করে নেবো। “
“ কী!”
“ যা শুনেছ তাই। “
“ ঠিক আছে। বউ আপনার, সিন্ধান্তও আপনার! “
হামিংবার্ড পর্ব ৬৯
অরা হেসে উঠল, ধীরপায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে। আরিশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল।
সকাল থেকেই বাড়িতে উৎসবের হাওয়া। উঠোনজুড়ে হলুদের রঙে মোড়ানো প্যান্ডেল, গাঁদার মালায় সাজানো গেট, আর চারপাশে হাসির শব্দে মুখরিত পুরো খান বাড়ি। আজ তামান্না আর সাবিহ গায়ে হলুদ।