হামিংবার্ড পর্ব ৮
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
” হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমি জামাকাপড় পরে আসছি। ”
” এখানেই পরো। আমি দেখব না। ”
আরিশের কথায় হাসবে না-কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না অরা। কী হাস্যকর কথাবার্তা বলছে লোকটা।
” দেখার মতো অবশিষ্ট আছে কিছু? ”
অরার প্রশ্নে আরিশ কিঞ্চিৎ অবাক হলো। তার হামিংবার্ডের মুখে কথা ফুটেছে। মুচকি হাসল আরিশ। কোনো জবাব দিলো না। অরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এই প্রথম আরিশকে হাসতে দেখল সে। আরিশ ড্রেসিংটেবিলের ওপরে রাখা একটা মলম নিয়ে অরার দিকে এগোল। অরা চুপচাপ দেখছে সব। নিজেকে কিছুটা শক্ত করে নিয়েছে সে। ঘৃনা করে কিংবা রাগ নিয়ে, আরিশের সাথেই থাকতে হবে তাকে। সোলাইমান মল্লিক অরাকে যতই ভালোবাসুক, বাবার মতো স্নেহ করুক, অরা আর তাকে কষ্ট দিতে চায় না। তাছাড়া মায়ের ওপর পূর্ণ ভরসা আছে তার। ছোটো থেকে মা-ই তাকে আগলে রেখেছে। মা চাইলেই অরাকে তার দাদার বাড়ি রেখে এসে নিজের মতো থাকতে পারতো। অরার দাদা বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে অরাকে। কিন্তু রোকসানা সেটা করেননি। মেয়েকে সাথে নিয়েই বিয়ে করেছেন। আরিশের স্পর্শে নড়েচড়ে উঠল অরা। গলার ক্ষততে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে সে। অরা অবাক হচ্ছে তার আচরণে। কী চায় আরিশ?
“রি-মুভ দা টাউ-এল, হামিংবার্ড । ”
” কী! ”
হকচকিয়ে গেলো অরা। আরিশ স্বাভাবিকভাবেই ফের বলল,
” বুকেও দাগ আছে, মলম লাগাব। ”
” দরকার নেই। আমি… আমি করে নেবো। ”
” চুপ!”
অরা চুপ করে যায়। আরিশের কথা না শুনলে যদি আবার রেগে যায়! অরা ভয়ে, লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। আরিশ অরার বক্ষবিভাজনে মলম লাগিয়ে দেয়। শরীরের সব ক্ষততে মলম লাগানো শেষে বলে,
” ব্যথার ঔষধ আনিয়ে দিচ্ছি। ব্রেকফাস্ট করে খেয়ে নাও। আর তোমার বন্ধুকে কল করে বলে দিও, তোমার জন্য টেনশন করার দরকার নেই। ইউ আর উইথ ইয়োর হাসব্যান্ড। আর হ্যাঁ,আমি বাসায় থাকতে যেনো কখনো তার কল না আসে। গট ইট বেবি? ”
অরা মাথা নাড়ে কেবল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” গুড গার্ল। পোশাক পরে নাও এখন। এভাবে আর থেকো না। ইফ আই চেইঞ্জ মাই মাইন্ড… ইউ ওউন্ট বি এব্ল টু হ্যান্ডল ইট।”
শুকনো ঢোক গিলল অরা। আর একমুহূর্তও দাঁড়াল না। জামাকাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিলো। আরিশ ওর কান্ড দেখে হাসল একটু। পরক্ষণেই অবাক হলো। সে হাসছে? মানে একটা মেয়ের জন্য হাসছে? মেয়েটা তার স্ত্রী বলেই কি এমন অনুভব হচ্ছে? কিন্তু কী লাভ? সবকিছু পাওয়ার পরেও তো সেই অন্য কারো সাথে চলে যায় এরা! আরিশের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। না, অরার সাথে বেশি ভালো ব্যবহার করার দরকার নেই। নেহাৎ বয়সে এত ছোট বলেই এতটুকু যত্ন করলো। কিন্তু এরপর তা-ও করা যাবে না। মহা ভুল করে ফেলেছে আজ। মলম কিনে দিয়েছে এটাই ঠিক আছে, লাগিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল?
সকাল সকাল কলিংবেলের শব্দে কিছুটা অবাক হলেন রোকসানা। মাত্রই তো সোলাইমান অফিসে গেলেন, নয়নাও স্কুলে গিয়েছে। তাহলে এই সময় কে এলো বাসায়? হাতের কাজ রেখে দরজা খুলে দিতে এগোলেন তিনি।
” তোমরা! এত সকালবেলা? ভেতরে এসো। ”
রিনভী, রনি ও আকাশ এসেছে। ওরা সবাই অরার বন্ধু। রোকসানা মল্লিকের পেছন পেছন বাসার ভিতরে প্রবেশ করল সবাই। রিনভী বলল,
” আন্টি অরা কোথায়? আসলে ক’দিন ধরে, ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। রনি কাল কল দিলো, কিন্তু কোনো কথা না বলেই কল কেটে দিয়েছিল অরা। পরে আর কল ঢোকেনি, ফোন অফ!”
রোকসানা কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। আরিশ এত তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা করলো, কাউকে বলতেও পারেনি অরা।
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। অরার বিয়ে হয়ে গেছে রিনভী। শ্বশুর বাড়ি আছে, স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত এখন। ”
” নাহ! এটা হতে পারে না…. ”
আচমকা আকাশের এমন আচরণে অবাক হলেন রোকসানা মল্লিক। রিনভী আকাশের হাত ধরে কিছু একটা ইশারা করলো। রনি বলল,
” কী আর করবি আকাশ? আমাদের বন্ধু সত্যি বিয়ে করে নিয়েছে। তা-ও না বলেই! ”
রোকসানা বললেন,
” সময়-সুযোগ ছিলো না বলেই তোমাদের ইনভাইট করতে পারেনি অরা। প্লিজ কিছু মনে করো না। তোমরা বসো, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। ”
” না আন্টি। আমরা খেয়ে এসেছি। অরার খোঁজ নিতে এলাম শুধু। এখন উঠছি। ”
তিনজনই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
” ঠিক আছে। আবার এসো একসময়। ”
রিনভী হেসে বলল,
” জি আন্টি। ”
ওরা চলে যাওয়ার পর দরজা আঁটকে, নিজের কাজে এগোলেন রোকসানা।
” আকাশ, কন্ট্রোল ইয়োরসেল্ফ। হোয়াট আর ইউ ডুইং? আরেকটু হলেই একটা সিনক্রিয়েট হতো। ”
রনি বেশ জোরেই বলল আকাশকে। আকাশ চুপ হয়ে গেছে। রাস্তায় হাঁটছে তিনজন। রিনভী আকাশের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” আকাশ? কথা বল প্লিজ! দ্যাখ, অরাকে তো তুই কখনো নিজের মনের কথা বলতেই পারিসনি। ও বেচারির তো দোষ নেই। ”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আকাশ। ক্লান্ত গলায় বলল,
” আমি তো অরাকে দোষারোপ করিনি রিনভী। দোষ আমার, আমার ভাগ্যের। জন্মের পর মা ছেড়ে চলে গিয়েছে, আজ ভালোবাসার মানুষকেও হারালাম। বাবা ঠিকই বলে রে, আম গুড ফর নাথিং। ”
” এমন কিছু না আকাশ। নিজেকে শান্ত কর। ”
রনি আকাশকে জড়িয়ে ধরল। রিনভি বলে,
” আচ্ছা এভাবে হুট করে বিয়ে হলো কেন? তা-ও চুপচাপ! সাধারণভাবে বিয়ে হলে অরা আমাদের বলত,অবশ্যই বলত। অরা কি আদৌও নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছে? ”
রিনভীর কথাগুলো আকাশের মস্তিষ্কের ভেতর আন্দোলিত হতে লাগল। রিনভী ভুল কিছু বলেনি। রনিকে ছেড়ে দিয়ে আকাশ বলল,
” ঠিক বলেছিস তুই। বিশ্বাস কর, অরা যদি এই বিয়েতে খুশি না হয়, আমি অরাকে ওখান থেকে নিয়ে আসব। ”
রিনভী ও রনি চমকাল আকাশের কথায়। ছেলেটা এখন কতটা দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে, অথচ এতদিন মুখ ফুটে ভালোবাসি কথাটাও বলতে পারেনি৷
” আগে গিয়ে দেখতে হবে, অরা কেমন আছে। তারপর এসব। কিন্তু সবকিছু জেনেশুনে, বুঝে তারপর। ওকে আকাশ? ”
” ওকে। ”
রিনভীর কথায় সহমত দিলো রনি ও আকাশ।
দুপুরের সময়, কিছুটা ধুলো জমে আছে ফুটপাতে, আর সড়কগুলোতে যানবাহন চললেও সংখ্যা কম। সড়কের ধারে কিছু দোকানপাটের শাটার অর্ধেক উঠানো। রাস্তায় গাড়ির হর্নের শব্দ আর কখনো কখনো সাইকেলের চাকার সাঁই সাঁই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
বসার ঘরে সোফায় বসে আছে অরা। টিভি চলছে। তামান্না দুপুরের রান্না করতে ব্যস্ত। অরা বিরক্ত হচ্ছে। টিভি দেখতেও ভালো লাগছে না। রান্নাঘরের দিকে এগোল সে।
” কিছু লাগবে ভাবি? ”
তামান্না হেসে জিজ্ঞেস করলো। অরা রান্নাঘরের সবকিছু দেখতে দেখতে বলে,
” না। এমনি এলাম। ভালো লাগছিল না। ”
” আমার সাথে কথা বলুন তাহলে। আমার রান্না প্রায় শেষের দিকে। ”
” আমি আসার আগে এই বাড়িতে, সারাদিন তুমি একা থাকতে? ”
অরা কৌতূহল নিয়ে শুধালো। তামান্না চুলো থেকে তরকারি নামিয়ে রেখে বলল,
” না। জলিল ভাই ছিলো, আর জয়নাল চাচা। ”
” তাহলে উনারা এখন নেই কেনো? ”
” জয়নাল চাচার শরীর খারাপ একটু। তাছাড়া কিছু কাজ থাকায় গ্রামে গিয়েছেন। আর জলিল ভাই! ”
তামান্না চুপ করে গেলো। মুখটাও কেমন মলিন হয়ে গেছে। অরা বুঝতে পারছে না কিছু।
” কী হয়েছে উনার? ”
” উনাকে, আরিশ ভাইয়া অন্য কাজ দিয়েছেন। ”
অরার হঠাৎ প্রথম দিনের কথা মনে পড়লো। জলিল! হ্যাঁ। উনিই রুমে এসেছিলেন, খাবার দিতে। তারপর তার জন্য অরার ওপর রাগারাগি করেছিল আরিশ। তাহলে কি অরার জন্যই জলিলের এই বাড়িতে থাকা হলোনা? অরার মেজাজ খারাপ লাগছে। একটা মানুষ এতটা টক্সিক হয় কীভাবে! মাঝে মধ্যে তো মনে হয় লোকটার মাথায় সমস্যা আছে।
” ও আচ্ছা। ”
তামান্না সব খাবার বাটিতে রেখে, ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোল। অরাও তামান্নার সাথে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
” রান্না তো শেষ। আপনি গোসল করে নিন। খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে তো। ”
” জুতো মেরে গরু দান। ”
অস্পষ্ট স্বরে কথাটা বলল অরা। তামান্না ঠিক শুনতে পায়নি।
” কিছু বললেন ভাবি? ”
” কিছু না গো। আমি গোসল করব না এখন। সকালে… ”
হামিংবার্ড পর্ব ৭
অরা চুপ করে গেলো। তামান্না মুচকি মুচকি হাসছে। নিজের বোকামি দেখে অরা নির্বাক। কী বলে ফেলত!
” ঠিক আছে। তাহলে খেতে দিয়ে দিচ্ছি ভাবি। ”
” হুম। ”
অরা চুপচাপ খেতে বসে। তামান্নার সাথে আপাতত আর কথা বলা যাবে না।