হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২২

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২২
সানা শেখ

আলভীর ঘুম ভাঙ্গলে শোয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ রেখেই মোরামুড়ি করে। হাতের সাথে কারো দেহ ছোঁয়া লাগতেই ফট করে চোখ মেলে তাকায়। মায়া ওর পাশেই এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। দুই হাতে চোখ ডলে শোয়া থেকে উঠে বসে। এলোমেলো চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করে মায়ার শরীর ঘেঁষে বসে।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ঘুমন্ত মায়ার মুখশ্রী। হাত বাড়িয়ে মায়ার মেদুর গালে হাত ছোঁয়ায়।
মায়ার ডান হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। কিছু সময় ধরে রাখার পর হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায়। এলোমেলো মায়া কে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে টাওয়েল হাতে।
শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে মায়া ঘুম থেকে উঠে ঝিম ধরে বসে আছে । আলভীর আগমণ টের পেয়ে চোখ তুলে তাকায় মায়া। সাদা টাওয়েল কোমড়ে পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেজা এলোমেলো চুল গুলো কপাল চোখ ঢেকে দিয়েছে প্রায়।

আলভী কিছু না বলে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। ভেজা ট্রাউজার আর টিশার্ট মেলে দিয়ে রুমে ফিরে আসে। জানালার পর্দা সরিয়ে সাদা থাই গ্লাস সাইট করে দেয়। পুরো রুম আলোতে ঝলমলিয়ে ওঠে।
মায়ার দিকে তাকিয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
“ঘুম শেষ?”
মায়া বলে না কিছু। আলভী আলমারি খুলতে খুলতে বলে,
“উঠে ফ্রেস হয়ে নাও।”
“দরজা খুলে দিন।”
“না।”
“কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এখন থেকে তুমি এই রুমেই থাকবে।”
“আমার কাপড় চোপড় প্রয়োজনীয় সব কিছু আমার রুমে রয়েছে।”
“সব কিছু এনে দেব এই রুমে।”
“প্রয়োজন নেই, আপনি দরজা খুলে দিন।”
“দরজা খুললেই তো উড়াল দেবে পাখি।”
“দরজা খুলবেন না আপনি?”
“না।”
“আমি আজকে গোসল করবো না, ওয়াশরুমেও যাব না।”
“ছোট বেলার মতন বেডে বসে কাজ সারতে চাইছো নাকি? সমস্যা নেই সেরে ফেলো পরিষ্কার করে দেব।”
পাশ থেকে বালিশ তুলে ছুঁড়ে দেয় আলভীর গায়ে। আলভী বালিশ টা ক্যাচ ধরে বলে,
“আরে রেগে যাচ্ছো কেন?”

“ফালতু লোক, জীবনে বউ জুটবে না কপালে।”
“না চাইতেও তেরো বছর আগে জুটে গেছে।”
পাশ থেকে আরেক টা বালিশ তুলে ছুঁড়ে দেয়। এটাও ক্যাচ ধরে নেয় আলভী।
“কথা বলবেন না আপনি আমার সাথে।”
“তুমি কি মনের ভাষা বুঝতে পারো?
তাহলে আর কষ্ট করে বলবো না মুখে কিছু।
যা বলার তা বলবে আমার চোখ,
শুনবে তুমি তোমার নীরব দৃষ্টিতে।
চোখে চোখে হবে আজ কথা,
নীরবতায় গাঁথা এক মধুর ব্যথা।”

আলভী এমন ভাবে বলে কথা গুলো যে পরবর্তীতে মায়া আর একটা কথাও বলতে পারে না। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আলভীর দিকে। আলভী বালিশ দুটো বেডের উপর ছুঁড়ে দেয়। আলমারির ভেতর থেকে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বের করে পড়ে নেয়। টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আবার বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়।
টাওয়েল মেলে দিয়ে রুমে এসে মায়ার সামনে দাঁড়ায়। মায়ার দিকে একটু ঝুঁকে গিয়ে বলে,
“তুমি যদি চাও চোখে চোখে হবে আলাপন,
নীরবতা হবে আমাদের ভাষা।
মনের সঙ্গে হবে মনের বন্ধন,
হৃদয়ের সাথে হৃদয় লেগে যাবে জোড়া।
ভালোবাসা আর বলা লাগে না বার বার,
গাঁথবে এক আত্মিক আশা।”

মায়া কিছু না বলে একটু পিছিয়ে যায়। মায়ার সামনে থেকে সরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“ওয়াশরুমে যাও আমি তোমার সব কিছু নিয়ে আসছি।”
“আপনি হাত দেবেন না আমার আলমারিতে।”
“তাহলে আনবো কিভাবে?”
মায়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আনতে হবে না।”
আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকেই হাসে আলভী। ভেজা চুল আঁচড়ে ডোর খুলে রুম থেকে বেরিয়ে আবার লাগিয়ে দেয় বাইরে থেকে।
মায়ার রুমে এসে আলমারির সামনে দাঁড়ায়। আলমারি খুলে দেখে ওর দেওয়া ড্রেস গুলো এখনো আগের মতোই প্যাকেটের ভেতরেই রয়েছে। তবে চকলেট গুলো খুজে পায় না। ওর দেওয়া প্যাকেটের ভেতরে মায়ার আগের কয়েক টা ড্রেস ভরে নেয়। ওয়াশরুম আর ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে মায়ার প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো নিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে।

রুমে এসে দেখে মায়া এখনো আগের মতোই বসে আছে বেডের উপর। প্যাকেট গুলো বেডের উপর রেখে বলে,
“দেখো সব কিছু আছে নাকি। যদি আরো কিছু লাগে তাহলে বলো।”
মায়া চুপ করে বসে থাকে। আলভী ওকে একা ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে রুমে ফিরে আসে আলভী। মায়া রুমে নেই, ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। শপিং ব্যাগ, ড্রেস, ক্রিম, লোশন, আরো যা যা আছে সব কিছু পুরো বেড জুড়ে ছড়িয়ে রাখা।
বেড কভার তুলে নিচে ফেলে রেখেছে। বালিশ তিন টা তিন জায়গায় পড়ে আছে।
খাবারের ট্রে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে ড্রেস গুলো ভাঁজ করে গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে। বাকি সব কিছু তুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দেয়। বেড কভার তুলে টান টান করে বিছিয়ে দেয়। বালিশ ঠিক করে রাখে। সব কিছু করে বেডে বসে পা দুটো ঝুলিয়ে।

এখনো বের হচ্ছে না কেন? শাওয়ার নিতে নিতে ঘুমিয়ে গেল নাকি?
আরো কয়েক মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হয় মায়া। দেখে সব কিছু গুছিয়ে ফেলেছে আলভী। কিছু না বলে নিজের ড্রেস গুলো বেলকনিতে মেলে দিয়ে আসে। হাত মুখে একটু ক্রিম লোশন লাগিয়ে বেডে উঠে পা দুটো গুটিয়ে বসে পড়ে।
আলভী খাবারের ট্রে থেকে প্লেট তুলে মায়ার সামনে দেয় একটা। অন্য টা নিজে সামনে নিয়ে বসে।
“খাওয়া শুরু করো।”

খাওয়া শুরু করে মায়া। আলভী নিজেও খাওয়া শুরু করে। খেতে খেতে ইচ্ছে করে সাদা বেড কভারে তরকারির ঝোল ভরিয়ে দেয়। আলভী দেখে, কিছু বলে না। ভাত খেতে খেতে বাচ্চাদের মতো ভাতও ফেলে দেয়। আলভী তবুও কিছু বলে না। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের খাওয়া চালিয়ে যায়।
খাওয়া শেষ করে আগের মতোই বসে থাকে মায়া। এদিক ওদিক একটু নড়েও না। আলভী নিজের খাওয়া শেষ করে প্লেট দুটো নিচে নামিয়ে রাখে। বেডে পড়ে থাকা ভাত একটা একটা করে তুলে প্লেটে রেখে দেয়।
“একটু নিচে নেমে দাঁড়াও।”
মায়া অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। আলভীর কথা যেন ওর কানেই পৌঁছায়নি।
কোলে তুলে নিচে নামায়। দার করাতে গেলে মায়া আর দাঁড়ায় না। নিজের পায়ে শক্তিই করে না। মনে হচ্ছে সাত আট মাসের একটা বাচ্চা।
ফ্লোরে বসিয়ে দিয়ে বেড কভার তুলে অন্য একটা বিছিয়ে দেয়।
“উঠে আসো।”

মায়া ওঠে না। আগের মতোই বসে রইলো। আলভী এগিয়ে এসে আবার কোলে তুলে বেডে বসিয়ে দেয়।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“কোলে উঠবে বললেই হয়, এভাবে চুপ চাপ বসে থাকার কি দরকার?”
মায়া তবুও কিছু না বলে চুপ চাপ বসে রইলো।
“চুল থেকে টাওয়েল খুলে চুল শুকিয়ে নাও। এভাবে থাকলে সর্দি লেগে যাবে।”
মায়া কিছু না বলে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। টাওয়েল চুলের সাথে পেঁচানোই রয়েছে।
“এত জেদ? এই জেদের নিচে পড়ে তো আমি চিরে চ্যাপ্টা হয়ে যাব।”
মায়া কে টেনে শোয়া থেকে তুলে বসায়। মায়া আবার শুয়ে পড়ার জন্য উদ্যত হতেই বলে,
“এখন শুয়ে পড়লে একশো টা চুমু খাব।”

মায়া না শুয়ে বসে রইলো। এই লোক কে একটুও বিশ্বাস করে না মায়া। শুয়ে পড়লে দেখা যাবে সত্যি সত্যিই একশো টা চুমু খাবে। শক্তিতে তো পারবে না এই লোকের সাথে।
চুল থেকে টাওয়েল খুলে হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে আসে। মাল্টি প্লাগে লাইন দিয়ে চুল গুলো শুকিয়ে দিতে শুরু করে।
চুল শুকানো শেষে ব্রাশ করে দেয়।
“এখন শুয়ে থাকো।”
মায়া বসে রইলো। মাল্টি প্লাগ আর হেয়ার ড্রায়ার সরিয়ে রেখে আসে আলভী। প্লেট দুটো ট্রের উপর তুলে রুমের বাইরে রেখে আসে। মায়া আক্তার এসে পরে নিয়ে যাবে। বেড কভার আর বালিশের কভারও রেখে দেয়। গিটারের সুর শুনে মাহিদ এর রুমের দিকে আগায়। বেডের উপর বসে মাহিদ গিটারে টুংটাং শব্দ তুলছে।
“ভেতরে এসে বসো ভাইয়া।”
“তুই গিটার বাজাচ্ছিস, আমি আরো ভাবছি কে বাজাচ্ছে!”
“তুমি বাজাতে পারো?”
“হুম।”
“তাহলে একটা গান গাও আমি শুনি।”

বসা থেকে উঠে আলভীর হাতে গিটার ধরিয়ে দেয় মাহিদ। আলভী গিটার হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে দ্রুত। রুমের ডোর খোলা রেখেই চলে এসেছে। মায়া রুমে আছে নাকি চলে গেছে কে জানে! গিটারের সুর শুনলে আর হুশ থাকে না। বাজানোর জন্য হাত নিশপিশ করে।
মাহিদ পেছন থেকে কয়েক বার ডাকে। আলভী রুমের দিকে আগাতে আগাতে বলে,
“পরে আসছি।”
বলেই রুমের ভেতর প্রবেশ করে। মায়া এখনো আগের মতোই বসে আছে। স্বস্তির নিশ্বাস নেয় আলভী। ডোর লক করে মায়ার পেছনে এসে দাঁড়ায়। গিটার সেন্টার টেবিলের সাথে ঠেকিয়ে দার করিয়ে রাখে।
মায়া কে জোড় করে ঘুরিয়ে বসায়। হাটু মুড়ে বসে মায়ার সামনে। মায়ার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলে,

“কি করলে তোমার রাগ কমবে? কি করলে তুমি আমাকে একসেপ্ট করবে? তুমি যা বলবে আমি তাই করবো, শুধু আমার কাছ থেকে আলাদা হওয়ার কথা বলবে না।”
মায়া কিছু না বলে অন্য দিকে তাঁকিয়ে থাকে।
“কথা বলছো না কেন? কিছু তো বলো।”
মায়ার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয় না।
“মায়া।”
মায়া একবার তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয়।

“আচ্ছা কথা না বললে, গান শোনো।”
গিটার হাতে নিয়ে মায়ার পাশে বসে,
“নারে নান নারে নান নারে না
নারে নান নারে নানা নারে না
রে নান নারে নানা নারে না
একাকী মন আজ নিরবে,
বিবাগী তোমার অনুভবে।
ফেরারী প্রেম খোঁজে ঠিকানা,
আকাশে মেঘ মানে বোঝ কিনা।
একাকী মন আজ নিরবে,
বিবাগী তোমার অনুভবে।
ফেরারী প্রেম খোঁজে ঠিকানা,
আকাশে মেঘ মানে বোঝ কিনা।
বিরহ নীলে নীলে বাঁধে বাসা,
অজানা ব্যথায়…….

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২১

অধরা তারাগুলো কাঁদে বেদনায়,
খেয়ালি তুমি কোথায়…….
নারে নান নারে নান নারে না
নারে নান নারে নানা নারে না
রে নান নারে নানা নারে না”

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২৩