হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ৩৫
সানা শেখ
মেরিনা আলভীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আসছি তাহলে, মিটিং রুমে দেখা হচ্ছে।”
“ওকে।”
মেরিনা আলভীর কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের কেবিনে আসে। আগে মেরিনার বাবা অফিসে আসলেও এখন মেরিনা আসে। ওর বাবার দায়িত্ব এখন মেরিনার।
মেরিনা ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল লিস্ট থেকে একটা নাম্বার খোঁজে। হয়তো অনেক নিচে পড়ে গেছে নাম্বার টা।
প্রায় দুই মিনিট পর নাম্বার টা খুঁজে পায়।
একবার রিং হয়ে কে টে যায় রিসিভ হয় না। দ্বিতীয় বার কল করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতে আবার ডায়াল করে আর সাথে সাথেই রিসিভ হয়।
ফোনে স্পিকার দিয়ে মুখের সামনে ধরে রাখে ফোন। ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে আসে গমগমে পুরুষালি গলার স্বর,
“হেই মেরিনা কেমন আছো?”
“ভালো।”
“এত গুলো দিন পর আমার কথা মনে পড়ল?”
মেরিনা বলে না কিছু। ফোনের অপর পাশ থেকে বলে,
“কিছু বলবে? বলার থাকলে বলে ফেলো।”
“বলার ছিল কিছু।”
“আমি তো শোনার জন্যই অপেক্ষায় আছি।”
“আপনি আপনার ফ্যামিলি নিয়ে রাতে আমাদের বাড়িতে আসুন।”
অপর পাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ আসে না। হয়তো মেরিনার কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে গেছে।
“কথা বলছেন না কেনো মিস্টার চৌধুরী?”
“আপনি আমার ফ্যামিলি কে ইনভাইট করছেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু কেন?”
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি। আপনার ফ্যামিলি কে নিয়ে রাতে আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে যাবেন। আমি এই মাসেই বিয়ে করতে চাই।”
“সত্যি?”
“একদম।”
“তাহলে রাতেই বউ সেজে অপেক্ষা করো, একে বারে তুলে নিয়ে যাব আমার বাড়ি।”
“ভালো থাকবেন, রাতে দেখা হচ্ছে তাহলে।”
লাইন বিচ্ছিন্ন করে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় মেরিনা।
হুট করে কি হয়েছে কে জানে! ওরো এখন বউ সাঁজতে ইচ্ছে করছে, আলভীর জন্য সাঁজতে পারেনি তো কি হয়েছে? অন্য কারো জন্য সাজবে। আলভী কে দেখিয়ে দেবে, আলভী কে ছাড়া মেরিনাও সুখে থাকতে জানে অন্য কারো সাথে।
অফিস থেকে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বিকেল সাড়ে পাঁচ টা যায় আলভী আর মায়ার। ওদের দুজন কে বাড়িতে রেখে শুভ নিজের বাড়িতে চলে যায়।
রুমে এসে দুজনেই ফ্রেস হয়ে নেয়।
মায়া ভেজা চুল গুলো না শুকিয়েই বেডে উঠে শুয়ে পড়ে। আলভী মায়ার কাছে এসে ওকে টেনে তুলে বসায়। এলোমেলো চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে মায়ার চেহারায় ক্রিম লাগিয়ে দেয়।
কোলে তুলে এনে ডিভানের উপর বসিয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল গুলো শুকিয়ে দেয় নিজেই। তারপর চুল গুলো ব্রাশ করে বেঁধে দেয় উঁচু করে।
মায়ার ভালো লাগে আলভীর এই কেয়ার গুলো। বিয়ের পর থেকে মায়া নিজের হাতে চুল ব্রাশ করে না, মুখে ক্রিম লাগায় না, চুল গুলো শুকায়ও না। সেই ছোট বেলার মতন এলোমেলো হয়ে থাকে। আলভী নিজেই পরিপাটি করে নেয় নিজ দায়িত্বে। মায়া রুমও এলোমেলো করে রেখে দেয়, আলভী নিজেই রুম গোছায় রুম। আলভী কে বিরক্ত করার একটা চান্সও মিস করে না মায়া কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কোনো ভাবেই আলভী কে বিরক্ত করতে সক্ষম হয় না মায়া।
এই ব্যাটা চুপ চাপ সব কিছু মুখ বুজে বিনা বাক্যে মেনে নেয়।
আলভী নিজের চুল গুলো শুকিয়ে ব্রাশ করে নেয়।
একটু পরেই রুমের ডোর নক হয়, আলভী ডোর খুলে কফির মগ দুটো হাতে নিয়ে রুমের ভেতরে চলে আসে।
মায়া আলভীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমরা কেউ তো কফি চাইনি, তাহলে কফি দিয়ে গেল কেন?”
“ওরা জানে আমি কখন কি খাই, তাই আলাদা করে বলতে হয় না।”
মায়া ঠোঁট দুটো গোল করে “ওওও” বলে।
আলভী একটা কফির মগ মায়ার হাতে দেয়। তারপর মায়ার পাশে বসে বাম হাতে মায়ার কোমড় পেচিয়ে ধরে কফির মগে চুমুক দেয়।
কফি খাওয়া শেষ করে বাংলাদেশে কল করে মায়া।
মেয়ের কল পেয়ে খুশি হয়ে রিসিভ করেন আহনাফ মাহমুদ।
বাবার মুখ দেখতেই মায়ার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। মনের জমানো কথা গুলো কেমন যেন দলা পাকিয়ে যায়।
আহনাফ মাহমুদ ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে হাসি মুখে বলেন,
“কেমন আছিস মা? আলভী কোথায়?”
আলভী আবার মায়ার সাথে ঘেঁষে বসে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়।
মায়া ধরা গলায় বলে,
“ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“আম্মু কোথায়?”
মেহবুবা মেহের স্বামীর হাত থেকে ফোন নিয়ে মুখের সামনে ধরেন। মা কে দেখেই মায়ার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
মেয়ের চোখে পানি দেখে মেহবুবা মেহের এর চোখেও পানি চলে আসে।
কান্না চেপে রাখতে না পেরে কেঁদেই দেয় মায়া।
মায়ার হাত থেকে ফোন নেয় আলভী। মায়া কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে। ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে বলে,
“তোমাদের কথা মনে করে আর একটু পর পর কাঁদে।”
“আমাদের ছেড়ে তো দূরে কোথাও কখনো থাকেনি।”
“মাত্র তিন মাস, তার পর তো আবার ফিরেই যাবে।”
“ফিরে আসার পরেও দেখবে আবার কাদঁছে।”
“এখন আবার তুমি কাদঁছো কেন?”
মেহবুবা মেহের এর হাত থেকে ফোন নেন আহনাফ মাহমুদ। ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে বলেন,
“গত কাল সারা রাত কেঁদেছে, আজকেও সারা দিন একটু পর পর নাকি কেঁদেছে। মায়ার সাথে কথাও বলেছে কয়েক বার তার পরেও কেঁদেছে। এখন আবার কাদঁছে।”
আলভী কিছু না বলে ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে রইলো। এপাশে মেয়ে কাদঁছে অপর পাশে মা কাদঁছে।
ঐশী রহমানও ছেলের জন্য একটু পর পর কাদছেন। তেরো বছর পর ছেলে কে কাছে পেয়েছিলেন, এক মাস বারো দিন থেকেই চলে এসেছে আবার। শুধু মাত্র মায়ার ভিসা আর টিকেটের জন্য বারো দিন বেশি থেকেছে। নাহলে এই বারো দিন বেশিও থাকা হতো না।
অল্প কথা বলে কল কে টে দেয় আলভী।
ফোন রেখে মায়ার মুখোমুখি হয়ে বসে। মায়ার মুখ আগলে ধরে বলে,
“এভাবে কাদতে হয়?”
“বাড়ির সকলের কথা ভীষণ মনে পড়ছে।”
“তিন মাসই তো।”
“তখন তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকব?”
“সামনের বোর্ড মিটিং এ সকলের সাথে কথা বলবো। যত দ্রুত সম্ভব এখানের সব কিছুর দায়িত্ব শুভ কে দিয়ে আমিও বাংলাদেশে ফিরে যাব তোমার কাছে। এখানে তখন বছরে দুই তিন বার আসবো শুধু কয়েক দিনের জন্য। এখন কান্না বন্ধ করো।”
জার্মানিতে এসেছে আজ আজ পঞ্চম দিন।
আলভীর বাড়িতে আজ জাঁকজমক পূর্ণ বিরাট বড় পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়েছে আলভীর বিজনেস পার্টনার সহ আরো অনেক বিজনেস ম্যানরা সাথে ওর অফিসের সকল স্টাফ।
সন্ধ্যার মধ্যে সকল অতিথিরা এসে উপস্থিত হয়েছে আলভীর বাড়ির হল রুমে।
অতিথিরা আলভীর ওয়াইফ কে দেখতে চাইলে আলভী সবাই কে ওয়েট করতে বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে। নিজের রুমে এসে দেখে মায়া চুপ চাপ বসে আছে। মায়ার পাশে বসে আছে শুভর ওয়াইফ। মায়ার পরনে হোয়াইট বার্বি গাউন। সাথে অফ হোয়াইট হিজাব বাঁধা। মায়া কে দেখতে আজ পুরোপুরি পরীর মতোই লাগছে। মায়ার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায়।
আলভী মায়ার হাত ধরে দাঁড় করায়। গাউনের ভারে মায়া ঠিক ভাবে হাঁটতেও পারছে না। এর আগে এত ভারী ড্রেস কখনো পড়েনি। একে তো ভারী গাউন তার উপর পড়েছে হিল। আস্তে আস্তে হেঁটে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় দুজন। নীচ থেকে সবাই তাঁকিয়ে আছে দুজনের দিকে। আজ আলভীর গায়ে হোয়াইট স্যুট প্যান্ট। মায়া নিচে থাকা সকলের দিকে একবার তাকায়। অনেক মেয়ের ড্রেস অনেক খোলামেলা।
হাতে গোনা কয়েকজন বাঙ্গালী তাছাড়া বাকি সবাই জার্মান নাগরিক নয়তো অন্য দেশের।
আলভীর হাত ধরে ধীর পায়ে হেঁটে নিচে নেমে আসে মায়া।
আলভী সকলের সাথে পরিচয় করায় মায়ার। অনেকে মায়ার সাথে টুকটাক কথা বলে। ইচ্ছে না থাকলেও কথা বলে মায়া।
এত অপরিচিত মানুষের মধ্যে অস্বস্তি ফিল হচ্ছে মায়ার। তার মধ্যে মেয়ে গুলোর ড্রেস কেমন, আবার অনেক ছেলে ওর দিকে তাকাচ্ছে একটু পর পর। আলভী বুঝতে পারে মায়ার অবস্থা।
পার্টি শেষ হতে হতে রাত বারোটা বেজে যায়। এগারোটার পর থেকেই গেস্টরা চলে যেতে শুরু করেছিল। বারোটার মধ্যে সবাই চলে যায়। আলভী সকল কে বিদায় দিয়ে মায়ার কাছে আসে।
মায়া সোফায় বসে পড়েছে পায়ের ব্যাথায়। হিল খুলে নিজের পা দুটো দেখছে। আলভী আসায় গাউন ছেড়ে আলভীর মুখের দিকে তাকায়।
আলভী মায়ার পায়ের কাছে বসে গাউন উঁচু করে পায়ের দিকে তাকায়। পা দুটো লাল হয়ে গেছে।
“অনেক ব্যাথা করছে?”
“হুম।”
“রুমে চলো।”
মায়া আলভীর হাত ধরে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আলভী মায়া কে পাঁজা কোলে তুলে নেয়।
“হেঁটেই যেতে পারব আমি।”
“হাঁটতে হবে না।”
মায়া কে নিয়ে রুমে আসে। নিজেই মায়ার হিজাব খুলে দেয়। হালকা ড্রেস এনে ডিভানের উপর রাখে তারপর মায়ার গাউন খুলতে সাহায্য করে। পড়তে এক কামলা, খুলতে এক কামলা লাগে।
গাউন খুলে কটনের সফট একটা ফ্রক গায়ে জড়ায় মায়া। আলভী নিজের স্যুট খুলতে খুলতে বলে,
“হাত মুখ ধুয়ে আসো।”
দুজনেই ফ্রেস হয়।
মায়া বেডে উঠে শুয়ে পড়ে। আলভী অলিভ অয়েল এর বোতল নিয়ে বেডে বসে মায়ার পায়ের কাছে। হাতের তালুতে অয়েল নিয়ে মায়ার পা দুটো নিজের কোলের উপর তুলে নেয় ম্যাসাজ করার জন্য। মায়ার চোখ লেগে এসেছিল, পায়ে ছোঁয়া পেতেই ফট করে চোখ মেলে তাকায়। দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে বলে,
“কি করছো তুমি? পায়ে হাত দিচ্ছ কেন?”
“ম্যাসেজ করলে ব্যাথা দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে, পা দাও এখন।”
“ম্যাসাজ করতে হবে না, ব্যাথা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“বেশি কথা না বলে পা দাও।”
নিজেই মায়ার পা দুটো টেনে সোজা করে কোলের উপর তুলে নেয় আবার। তারপর ম্যাসাজ করতে শুরু করে। মায়া কিছু না বলে আলভীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ম্যাসাজ করায় আরাম লাগছে এখন।
আলভী খেয়াল করে মায়ার দুই পায়ের দুই আঙ্গুলে ফোসকা পড়ে গেছে হিল পড়ে থেকে।
বিয়ের সময় যেই হিল গুলো পড়েছিল সেগুলো পড়ে তো ফোসকা পড়েনি এভাবে, তাহলে এগুলো পড়ে এমন পা ব্যাথা হয়েছে কেনো আর ফোসকা পড়েছে কেন? কয়েক সেকেন্ডেই কারণ উদঘাটন করে ফেলে আলভী।
কিছু সময় পর আলভী মায়ার মুখের দিকে তাকায়। দেখে মায়া একদৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আলভী কপাল ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“আসবো?”
মায়া কপাল ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কোথায়?”
“আদর করতে।”
বলেই হাসে আলভী। মায়া পাশ থেকে আলভীর বালিশ টা তুলে নিজের মুখ ঢেকে নেয়। দুই হাতে বালিশ টা জড়িয়ে ধরে বলে,
“আদর লাগবে না আজ।”
হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ৩৪
আলভী অলিভ অয়েল এর বোতলের ছিপি লাগিয়ে নিচে রেখে দেয়। তারপর মায়ার মুখের উপর থেকে টেনে বালিশ টা সরিয়ে নিয়ে নিজেই মায়ার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। মায়ার ঘাড়ে মুখ গুজে বলে,
“বালিশ কে জড়িয়ে না ধরে আমাকে জড়িয়ে ধরো। তুমি বালিশ জড়িয়ে ধরলে আমার ভীষণ হিংসে হয়। ওদের জন্য তুমি মাঝে মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরো না। ব্যাটা দের কালকেই এই রুম ছাড়া করবো আমি। তখন ওদের না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমাকেই জড়িয়ে ধরবে প্রতিবার।”