হ্যালো 2441139 পর্ব ১৪

হ্যালো 2441139 পর্ব ১৪
রাজিয়া রহমান

রজনীর ঘুম ভাঙে সেই কাকভোরে।আজকে শারমিন আসবে তাদের বাসায়।রজনী ঘুম থেকে উঠে আগে ছাদে গেলেন।ছাদের গাছগুলোতে পানি দিয়ে এসে নামাজ পড়লেন।ততক্ষণে সিরাজুল ইসলাম ও ঘুম থেকে উঠে গেছে।
চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে রজনী ফ্রিজ থেকে মাছ আর মুরগী বের করে। গরু মাংস সে রাতেই মেরিনেট করে রেখে দিয়েছিলো।
আষাঢ়কে গিয়ে রজনী তুলে দিলো বাজারে যাওয়ার জন্য। কিছু ফ্রোজেন স্ন্যাকস আনার জন্য আষাঢ়কে ডেকে তুললেন।
আষাঢ় ঘুমঘুম চোখে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “মা,একটু ঘুমাতে দাও।সকালে ঘুমিয়েছি,সারারাত পড়েছি।”
রজনী জোর করলেন না।এই ছেলেটার উপর তিনি রাগ করতে পারেন না।সে যতোই এলোমেলো, ছন্নছাড়া হোক,নিজের সবকিছু সে সময় মতো করে।
তাকে কখনো পড়ার জন্য বকাবকি করতে হয় নি।এতো অল্প পড়ে ও কিভাবে যেনো সে ঠিকই ফার্স্ট বয় হয় ক্লাসের।নির্জন সেকেন্ড।

ফার্স্ট আর সেকেন্ড পজিশন দুটোই দুই ভাইয়ের জন্য বরাদ্দ।
রজনী ছেলের রুম থেকে বের হয়ে বাহিরে আসতেই দেখে নির্জন বসে নাশতা খাচ্ছে দোতলায় সোফায় বসে।
রজনী নির্জনকে ডেকে বললো, “নির্জন,বাবা একটু বাজারে যেতে পারবি।”
নির্জন জবাব দেওয়ার আগেই নার্গিস বললো, “কেনো ভাবী,আষাঢ়কে পাঠাও।”
“ওকেই ডেকেছি প্রথমে, ও রাতভর পড়েছে না-কি, নামাজ পড়ে শুয়েছে।তাই যেতে চাচ্ছে না।এজন্যই নির্জনকে বললাম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“না ভাবী,নির্জন যেতে পারবে না।ও পড়বে এখন।তুমি অন্য কাউকে দেখো।”
তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, “এখনো বসে আছিস কেনো,যা পড়তে যা।”
নার্গিসের কর্কশ স্বরে নির্জন কেমন মিইয়ে গেল।মা যে কেনো তার আর আষাঢ়ের মধ্যে সবসময় একটা বিভেদ করে নির্জন বুঝতে পারে না। অথচ বড় মা তাদের চার ভাইবোনকে নিজের সন্তানের চোখে দেখে। নির্জন বুঝতে পারে তার মা বড় মা’কে ও অপছন্দ করে, বৈশাখী আপা,আষাঢ়, বর্ষা তাদেরও অপছন্দ করে।
রজনী বুঝতে পারলো নার্গিস ভীষণ বিরক্ত হয়েছে তার ছেলেকে বাজারে পাঠানোর কথা বলাতে।রজনীর মন খারাপ হয়ে যায়। একান্নবর্তী পরিবারের মানে কি তাহলে!
রজনী বুঝতে পারে না।
নির্জন লজ্জিত মুখে উঠে যায়।বড় মা’র চোখের দিকে তাকাতেও নির্জনের লজ্জা লাগছে।বড় মা মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন নির্জন জানে।

নির্জন উঠার আগেই দেখলো আষাঢ় বের হয়েছে। গায়ে টিশার্ট চাপাতে চাপাতে মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো, “দাও মা,কি কি আনতে হবে আমাকে লিস্ট দাও।আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আর ঘুম আসবে না।”
রজনীর বুক কেঁপে উঠে। তার ছেলেটা এতো ভালো কেনো?
নির্জন অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় আষাঢ়ের দিকে।
সে কেনো আষাঢ়ের মতো হতে পারছে না?
আষাঢ় যেমন ব্যক্তিত্ববান তেমনই দায়িত্ববান।
দুজন সমবয়সী হলেও নির্জন জানে আষাঢ়ের মতো ম্যাচুরিটি আসতে নির্জনের আরো দশ বছর লাগবে।
নির্জন চলে গেলো নিজের রুমে পড়তে।নার্গিস মেয়েদের নাশতা দিতে গেলো।
রজনী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জা’য়ের দিকে।
আষাঢ় মা’য়ের হাত ধরে বললো, “মন খারাপ করো না মা।আমি আছি তো।তোমার ছেলে যতক্ষণ আছে,আল্লাহ ছাড়া এই পৃথিবীর কারো কাছে তোমার কোনো ঠ্যাকা নেই মনে রেখো।তোমার সব না পাওয়া, সব হতাশা আমি দূর করে দিবো মা।”

রজনী ছেলেকে বাজারের লিস্ট দেয়।নার্গিস নিচে এসে আষাঢ়কে বললো, “আষাঢ়, মুচির দোকানে একটু যেতে পারবি?তোর কাকা থাইল্যান্ড থেকে আমার জন্য একজোড়া জুতা এনেছিলো।এতো আরামদায়ক জুতা,অনেক দামী।কিভাবে যেনো একটা পায়ের আঠা খুলে গেছে।”
আষাঢ় মাথা নাড়িয়ে বললো, “দাও ছোট মা।আমি ঠিক করে আনবো।”
নার্গিস চলে গেলো জুতা আনতে। রজনী মুখ গোমড়া করে বললো, “তুই কেনো রাজি হলি এখন?”
“মা,তাহলে আমার আর নির্জনের মধ্যে তফাত কি রইলো বলো?তাছাড়া,ও তোমার কথা শুনে নি তাই বলে কি আমি ও ছোট মা’য়ের কথা শুনবো না?আমি মানুষ মা,আমার শিরদাঁড়া আছে।কোনটা উচিত কোনটা উচিত না তা আমি বুঝতে পারি।তুমি দোয়া করো মা,তোমার ছেলে যাতে একজন পুরুষ হতে পারে। কাপুরষ নয়।”
রজনী আর কথা বাড়ায় না।তাই বলে নার্গিস তার ছেলেকে জুতা সেলাই করতে পাঠাবে এটা রজনীর ভালো লাগছে না।

মা’য়ের গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আষাঢ় বললো, “ব্যাপারটা যদি এটাই হয় যে জুতা সেলাই করতে দিচ্ছে বলে তোমার মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তাহলে আমি বলবো মা,তুমি মন বড় করতে শেখো।কোনো কাজ ছোট না মা।যিনি জুতা সেলাই করেন তিনি যেমন মানুষ তেমনই আমি ও মানুষ। মসজিদে যখন জামাতে দাঁড়ায় মানুষ তখন মুচি,নাপিত,মেথরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হয় চাকরিজীবী কিংবা ধনী লোকটাকেও।যেখানে আমাদের ধর্মে এসব ভেদাভেদ নেই সেখানে তুমি কেনো এসব ভেবে মনে কষ্ট পাও মা?তোমার ছেলের মধ্যে এসব জড়তা নেই যে আমার বাবা সচিব বলে জুতা সেলাই করতে গেলে আমি ছোট হয়ে যাব।সচিব আমার বাবা,আমি না মা।”
“তুই বুঝতে পারছিস না আষাঢ়। তোর চাচী তোকে ছোট করতেই তোকে জুতা নিয়ে পাঠাচ্ছে। আমার কষ্ট হচ্ছে সেখানেই বাবা।”

আষাঢ় মুচকি হেসে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা,আমাকে ছোট করতে চাইলেই কি আমি ছোট হয়ে যাবো?আল্লাহ যদি আমাকে বড় করতে চায় তাহলে ছোট করার ক্ষমতা কার বলো?মা’য়ের কাজ করলে সন্তান কখনো ছোট হয় না।আমি তো ছোট মা’কে মা’য়ের স্থান দিয়েছি কিন্তু উনি যদি আমাকে সন্তান না ভাবতে পারে তাহলে সেটা আমার না মা,ছোট মা’য়ের ব্যর্থতা।”
রজনী আর কথা বাড়ায় না,নার্গিস চলে এসেছে। একজোড়া জুতার কথা বলে নার্গিস আষাঢ়কে চার জোড়া জুতা এনে দিলো।আষাঢ় হাসি মুখে জুতা নিয়ে বের হয়।এতো সকালে মুচির দোকান খুলবে না।তবুও নিয়ে বের হলো।
নার্গিস মুচকি হাসতে হাসতে চলে যায় ঘরে।তার ছেলেকে বাজার করতে পাঠাবে নিজের ছেলেকে ঘরে রেখে!
উচিত শিক্ষা দিয়েছে তাই সে ও।

রজনী হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জা’য়ের দিকে। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে যায়।
লোকে বলে বড় হলে সংসারে গাধা হতে হয়।ভুল বলে নি।
মহুয়া বেগম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে আছেন। সংসারের চাবি এখনো অদৃশ্যভাবে হলেও মহুয়া বেগমের হাতে।
রজনী এসে শাশুড়ীকে ঔষধ খাইয়ে গেলো।রজনী যেতেই মহুয়া বেগম জীবনের হিসেবের খাতা খুলে বসেন।
বড় বউ এনেছেন বড় খান্দানের, শিক্ষিত মেয়ে।ছোট বউ এনেছেন তিনি মেট্রিক পাশ করা।
বড় বউ এনে বুঝেছেন জা দুজনেই যদি শিক্ষিত হয় তাহলে মহুয়া বেগমের মাথায় উঠে নৃত্য করবে।
বেশি শিক্ষিত হয়ে রজনী রান্নাঘরের জীবন মানতে পারছে না। তেমনি নার্গিস মানতে পারছে না জা বেশি শিক্ষিত বলে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ১৩

রজনী মানতে পারছে না পুরো সংসারের সব দায়িত্ব একা তার উপর বলে।
মহুয়া বেগম বুদ্ধিমতী মহিলা। দুই জা’য়ের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বে দুজনের পক্ষে থাকেন সবসময়। এক জনের সামনে ইনিয়ে বিনিয়ে অন্য জনের বদনাম করেন।এতে করে বউয়েরা একে অন্যের উপর সবসময় ক্ষিপ্ত থাকে।তাকে আর তার মেয়েদের প্রতি প্রসন্ন থাকে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ১৫