হ্যালো 2441139 পর্ব ১৬
রাজিয়া রহমান
মহুয়া বেগম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন ইজি চেয়ারে। ঝুনি আজকে আসে নি টিভি দেখতে। চাচী আম্মা মাঝেমাঝে এমন ব্যবহার করে ঝুনির কলিজা ছেঁড়া যন্ত্রণা অনুভব হয়। নিজেকে মনে হয় রাস্তার নেড়ি কুত্তার মতো যার কোনো মূল্য নেই।
তখনই ঝুনি বুঝে যায় সে এই পরিবারের একজন কাজের লোক ছাড়া কিছু না।মালিক কখনো কাজের লোকের আপন হতে পারে না। যতোই আদর করুক না কেনো দিন শেষে রাস্তার কুকুরের জায়গা কখনোই মালিকের ঘরে হয় না।
ছাদের এক কোণে বসে ঝুনি চোখ মুছে।এই বিভেদের দুনিয়ায় ধনী আর গরিবের পার্থক্য কখনো মুছবে না।অথচ হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দাস-দাসিরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যার অধীনস্থ করে দিয়েছেন, তার উচিত তাদেরকে তা খাওয়াবে- যা সে নিজে খায়। আর তাদেরকে তা পরাবে, যা সে নিজে পরে।তাকে ততটুকু কাজ করার দায়িত্ব দেবে, যতটুকু কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব হয়। আর অর্পিত কাজ তার দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব না হলে, সে কাজে তাকে সহযোগিতা করতে নিজেও অংশগ্রহণ করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আষাঢ় এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝুনিকে দেখে এগিয়ে এলো।ঝুনি খালা কেমন বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন ছাদের দোলনায়।
বিশাল বড় চারটা বিল্ডিং এর অনেক বড় ছাদ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আষাঢ়দের বাড়ির ছাদ দেখার মতো একটা জায়গা। কি নেই এখানে?
ভাবতেই আষাঢ়ের আজকে দুপুরের কথা মনে পড়ে গেলো।আনমনে হেসে ফেলে আষাঢ়। মেয়েটা কি ভয় পেয়েছে ভীষণ!
ঝুনি আষাঢ়কে হাসতে দেখে বললো, “কারো পৌষ মাস,কারো সর্বনাশ। আমি এইখানে কানতাছি আর আপনি হাসতাছেন মামা?”
“না খালা,একটা কথা মনে পড়ছে তাই হাসি।তোমার কি হইছে?এভাবে বসে আছো কেনো?”
ঝুনি মুখ গোমড়া করে বললো, “আমার আবার কি হইবো?গরিবের কষ্ট কি খুশি কি?”
আষাঢ় প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, “খালা,তোমার লিপস্টিক এটা কোন ব্র্যান্ডের? কালারটা সুন্দর তো!টকটকে লাল!”
ঝুনি উৎসাহী হয়ে বললো, “লাল লিবিস্টিক আর সোন্দরের কি দেখলেন,সোন্দর হইছে গোলাপি রঙের লিবিস্টিক।আমার গোলাপি লিবিস্টিক থাকলে দেখাই দিতাম আপনেরে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে খালা,আমি আপনাকে গোলাপি একটা লিপস্টিক এনে দিবো।”
“আইচ্ছা ঠিক আছে মামা,লগে একটা কাজল আর মশকরা ও আইনা দিয়েন।”
আষাঢ় অবাক হয়।মশকরা!
মশকরা কি আবার!
আষাঢ় জিজ্ঞেস করলো, “মশকরা কি খালা?মশকরা তো করার জিনিস, মশকরা কিনমু কিভাবে আমি? কে বিক্রি করে? ”
ঝুনি বিরক্ত হয়ে বললো, “মশকরা ও চিনেন না?কোন দুক্ষে যে মাইয়ারা আপনেরে চিডি দেয়!”
আষাঢ় সচেতন হয়।চিঠির কথা আসছে কোথা থেকে!
খালা জি বলছে!
আষাঢের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ঝুনি বললো, “আপনের পকেটে আমি একটা চিডি পাইছি।কে দিছে চিডি আমি ওইটাও জানি বুঝলেন মামা।এক রেট ৫০০ টেকা দিবেন আমি চিডি আপনের হাতে তুইলা দিমু।”
আষাঢ় হেসে বললো, “যদি না দিই?”
“তাইলে আর কি,এই চিডি আমি বাড়ির সদর দরজায় লাগাই দিমু।সবাই দেখবো।”
“ঠিক আছে খালা,আমি তোমাকে ফেবিকল এনে দিবো,তুমি দরজায় আঠা দিয়ে আটকে দাও।সবাই দেখুক।”
ঝুনি মুখ গোমড়া করে বললো, “আপনেরে আমি অনেক বেশি ভালো পাই মামা।এইজন্য এখনো এই চিঠি আমি পেটের ভিত্রে লুকাইয়া রাখছি।যান টেকা লাগবো না,আপনের চিডি আপনি নিয়ে যাইয়েন রাইতে।”
“আমার কোনো আগ্রহ নেই খালা ওই চিঠির প্রতি।”
“আপনে একটা কথা কইলেন মামা?মানুষ পেরেম পত্রর লাইগা অস্থির হইয়া থাকে আর আমি এমনি ফিরি দিমু তাও নিবেন না?এতো রসকষহীন ক্যান আপনে?”
“কে বলছে খালা?আমি রসকষের ভান্ডার বুকে নিয়ে বেঁচে আছি,শুধু জীবনে আমার মানুষটা আসুক।দেখবা প্রেম,পিরিতি, ভালোবাসা কতো প্রকার ও কি কি।তার চিঠি কেনো শুধু, সে যে পথে হেটে যাবে সেই পথের বালু ও আমি মুঠো ভরে নিজের বুক পকেটে লুকিয়ে রাখবো যাতে তার পায়ের স্পর্শ ও কেউ না পায়।তার চিঠি পত্র সবকিছুর জন্য আমি কতো অস্থির হই তখন বুঝবা।সে শুধু আমার হবে,একান্তই আমার।”
ঝুনি শুনে হাসে।আষাঢ় মুগ্ধ হয়ে ঝুনি খালার দিকে তাকায়। এই মানুষটার মুখ গোমড়া দেখলে আষাঢ়ের ভালো লাগে না। আষাঢ় চায় যাদেরকে সে পছন্দ করে তারা সবাই সবসময় খুশি থাকুক।আষাঢ়ের প্রিয় মানুষের লিস্টে ঝুনি খালার নাম প্রথম দিকে আছে।
মিরাজুল ইসলাম সবে চেম্বার থেকে ফিরেছেন।বাসায় আসতেই দেখেন স্ত্রীর মুখ ভার।মিরাজুল ইসলামের মনটা বিষিয়ে যায়।একটা মানুষ কতটা নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা নিয়ে বেক্বচে আছে তা নার্গিসকে যারা কাছ থেকে জানে তারাই বুঝতে পারবে শুধু।
বিশেষ করে মিরাজুল ইসলাম নিযে আর তার চার ছেলেমেয়ে জানে।
পোশাক পালটে স্ত্রীকে বললেন,”যাও আমার জন্য এক কাপ আদা চা আনো।গলাটা কেমন ধরে আছে।”
“আমি পারবো না।এই সংসার যার তারে গিয়ে বলো।আমি এই সংসারে হচ্ছি ভাঙা কুলা।আমারে শুধু ছাই ফেলার সময় লাগে।এছাড়া আমার দাম কি?”
“কি হয়েছে? সোজাসাপটা বলো এতো নাটক না করে। প্রতিদিন এসব ঝামেলা ভালো লাগে না।ঘরে আসে মানুষ শান্তির জন্য, অথচ আমি আসি আতংকিত হয়ে। ২৪ ঘন্টা তোমার মুখে অসন্তোষ দেখা যায়। ”
“অসন্তোষ হবো না কি খুশিতে বগলদাবা হবো?আমার এই সংসারে কি দাম?সব তো তোমার বড় ভাবীরই।আজকে তোমার মা ও তাও বললো এই সংসার তার।”
“মা যদি এই কথা বলে থাকে তাহলে ভুল বলে নি।বড় ভাবী এই সংসারে এসে অনেক স্যাক্রিফাইস করেছে। এতো ভালো রেজাল্ট হওয়ার পরেও জব করতে পারে নি। আলাদা সংসার হয় নি এখনো। সমস্ত দায়িত্ব বড় ভাবী যতটা পালন করে তুমি কতটা করো?তুমি তোমার ছেলে মেয়ে ছাড়া আর কার কোন ব্যাপারে কখনো চিন্তা করেছো?
এই যে সারা বছর আমাদের বাড়িতে এতো অতিথি থাকে তুমি কি এক বেলা তাদের এক কাপ চা করে খাইয়েছো?
এমনকি আমার সকালের চা ও বড় ভাবী করে দেয়।
তুমি বাচ্চাদের খাইয়ে,তারপর ওদের নিয়ে স্কুলে চলে যাও।সারাদিন সেঝানে থেকে বিকেলে ফিরো।ভাবী তো এক দিন ও বাচ্চাদের নিয়ে যায় নি।
নার্গিস, আমি বাড়িতে থাকি না ঠিকই কিন্তু আমি অন্ধ না।সব খবরই আমি পাই।”
নার্গিস ফুঁসে ওঠে।
“আমি কেনো কাজ করবো?এই সংসারে আমার স্বামী বেশি খরচ করে। আমি কেনো করবো?”
“তোমার ব্যবহার সংযত কর নার্গিস। তুমি ভেবো না বড় ভাইজান টাকা পয়সা খরচ করে না।আমি নিজে একজন উকিল নার্গিস। সবসময় ভুল ঠিক নিয়ে আমাকে কাজ করতে হয়।নিজের জীবনের হিসেবে যদি ভুল করি তাহলে কর্মক্ষেত্রে ও ভুলই হবে।আমার শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার কোনো প্রাইভেট টিচার ছিলো না।বড় ভাই আমাকে পড়িয়েছেন।
মুখচোরা ছিলাম বলে সব আবদার ভাইজানের কাছেই করতাম।কখনো ভাইজান না বলেন নি।
এমন না যে আব্বার টাকা দিয়ে ভাইজান আমার শখ পূর্ণ করেছে। নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে, নিজের উপার্জন দিয়ে ভাইজান আমাকে সবসময় সবকিছু দিয়েছে। আমার বিয়ের সময় আমার হাতে টাকা পয়সা ছিলো না।বিয়ের সম্পূর্ণ খরচ, তোমার গহনা সব বড় ভাই দিয়েছেন। আম্মা বড় আপা আর তারিনকেই সব গহনা দিয়ে দিয়েছেন। কোনো পুত্রবধূর জন্য একটা নাকফুল ও তিনি রাখেন নি।
ভাবী নিজে গিয়ে ঘুরে ঘুরে পছন্দ করে তোমার জন্য শাড়ি গহনা কিনেছেন। গহনার লেটেস্ট মডেলের জন্য এক বারের জায়গায় দশবার গেছেন দোকানে।
আমার ধারণার চাইতে ও বেশি গহনা কিনেছেন ভাবী নিজে পছন্দ করে তোমার জন্য।
ভাবীর ভাই বোন নেই,আমাকে বলতো জা নয়,বোন আনবে সে।
আমার জন্য যারা এতো কিছু করেছে তাদের জন্য আমি কি করেছি?সংসারের বাজার খরচ কিছুটা বেশি দিতে তাই আমি বড় ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছি।তুমি আমার স্ত্রী নার্গিস। তাই বলে তুমি ভেবো না যে তুমি এমন কথা বলবে যা আমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব হবে আমি সেই কথা শুনে নাচবো।
আমি তোমার হাতের পুতুল নই।আমার ভাই ভাবী কেমন মানুষ তা আমি জানি।তোমার আগে তারা এসেছে আমার জীবনে। তাই তোমার থেকে আমার জানতে হবে না তাদের ব্যাপারে।”
নার্গিসের রাগ সপ্তমে উঠে গেলো। এই মানুষটা কখনো তার কোনো কথাকে পাত্তা দেয় না।যদি একবার স্বামীকে সে বশ করতে পারতো তাহলে সবাইকে দেখিয়ে দিতো।
হ্যালো 2441139 পর্ব ১৫
মহুয়া বেগম নার্গিসকে ডেকে পাঠালেন।মিনি গিয়ে ছোট মামীকে বলল নানী ডাকে।
নার্গিস এলো কিছুটা দেরি করে। ইচ্ছে করেই সে দেরি করে এসেছে।
মিরাজুল ইসলামের সাথে কথা কাটাকাটি করে তার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে।আল্লাহ দুনিয়ায় সব পুরুষ বউদের আঁচলে বান্ধা থাকে অথচ আল্লাহ তার কপালে এটা কেমন পুরুষ জুটিয়ে দিলো!