হ্যালো 2441139 পর্ব ১৮
রাজিয়া রহমান
পুরো বাড়ি ঝলমল করছে মরিচ বাতির আলোতে।বিসমিল্লাহ খাঁনের সানাই সেই সাথে যেনো অন্য রকম আমেজ এনে দিচ্ছে। সানাইয়ের সুর যেনো কোনো অপার্থিব জগৎ থেকে ভেসে আসছে।প্রতিটি সুর যেনো কোন এক অজানা গল্প বলে যায়।বুকের ভেতর খুব গভীরে গিয়ে কেমন এক অন্য রকম অনুভূতির জন্ম দেয়।প্রভাতকিরণের মতো কেমন আদুরে,মোলায়েম একটা অনুভূতি অথচ বুকের খুব গভীরে গিয়ে কেমন বিষাদে আচ্ছাদিত করে দিচ্ছে পিয়াসাকে। আনন্দ-বিষাদের গল্প মিশে আছে যেনো প্রতিটি সুরে।
পিয়াসা মুগ্ধ হয়ে সানাইয়ের সুর শুনছে।
এরকম সুর পিয়াসা এর আগে শুনে নি।এ যেনো পিয়াসাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে। অথচ নেশার মতো শুনতেই ইচ্ছে করছে।
সিরাজুল ইসলাম ব্যান্ড পার্টি ও এনেছেন। বর আসবে যখন তখন ব্যান্ড পার্টি ব্যান্ড বাজাবে।
নির্জন এক প্লেট তেহারি নিয়ে পিয়াসার দিকে এগিয়ে এলো।নির্জনকে আসার পর থেকে এই প্রথম দেখেছে পিয়াসা।
একেবারে আগের মতো আছে নির্জন।সবুজ পাঞ্জাবি পরনে ছেলেদের সবার।
নির্জন তেহারির প্লেটটা পিয়াসার হাতে দিয়ে বললো, “সবাই খাচ্ছে, তুমি না খেয়ে বসে আছো যে।”
পিয়াসা সানাই শুনতে এতোটাই মগ্ন ছিলো যে আশেপাশের কোনো কিছুই পিয়াসার কানে যায় নি,চোখে পড়ে নি।
পিয়াসা অন্য জগতের মায়ায় ডুবে ছিলো এতোক্ষণ।
নির্জনের কথায় পিয়াসার হুঁশ এলো।
তাকিয়ে দেখে সবাই খেয়ে নিচ্ছে সে ছাড়া। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পিয়াসা বললো, “আমি আসলে সানাই এর আগে শুনি নি।সানাইয়ের প্রতিটি রাগিনী যে বুকে এতটা বিষাদের ঢেউ তুলে মানুষকে নস্টালজিক করে দিতে পারে আমার কোনো আইডিয়া ছিলো না।”
নির্জন হেসে বললো, “হ্যাঁ, আমি ও খেয়াল করলাম তুমি কেমন ঘোরাছন্ন হয়ে বসে আছো।তাই তোমার জন্য খাবার নিয়ে এলাম।আচ্ছা, খেয়ে নাও।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পিয়াসা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে খেতে বসলো।
আষাঢ় নির্জনকে বললো,”পিয়াসাকে দিয়ে এসেছিস?”
নির্জন বললো, “হ্যাঁ, দিয়েছি।”
আষাঢ় দূর থেকে তাকায় পিয়াসার দিকে। এই মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে, অথবা লজ্জা পাচ্ছে। অথচ আষাঢ় সেসবের কিছুই মনে রাখে নি।
তবুও পিয়াসা যেহেতু লজ্জা পাচ্ছে, লুকিয়ে থাকতে চাইছে তাই আষাঢ় নিজেই ঠিক করলো সে নিজেই আড়ালে থাকবে পিয়াসার থেকে।নয়তো মেয়েটা একটু আনন্দ, উপভোগ করতে পারবে না।
বিয়েতে এসে ও যদি তাকে বন্দী হয়ে থাকতে হয় রুমে তাহলে আর বিয়ের মজা কি উপভোগ করলো!
এজন্যই আষাঢ় পিয়াসাকে কেমন মোহগ্রস্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে নির্জনকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিলো।
নির্জন আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “কিরে ভাই,এরকম লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিস যে?কাহিনি কি?”
“কাহিনির কিছু নেই,ও আমাদের গেস্ট। সবার চাইতে একটু বেশি স্পেশাল ও।এজন্য দেখছি।তাছাড়া কে খায় নি তার দেখা শোনা করার দায়িত্ব আমাদের। ”
মিনি মিরাকে বললো, “আপা দেখলি?নির্জন ভাইয়ের কান্ড দেখলি?”
মিরা বিরস মুখে বললো, “দেখলাম তো।সাদা চামড়া দেখলে আর হুঁশ থাকে না এদের বুঝলি।কেমন আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে এই মেয়েটাকে।”
“মেয়েটাও তো,নিজেরে মনে করে ডানাকাটা পরী।কেমন একটা এক্সট্রা ভাব নিয়ে বসে আছে।”
মিরার ভালো লাগছে না পিয়াসাকে দেখে। মেয়েটা কেমন নিরিবিলি, শান্ত হয়ে বসে আছে অথচ তার বসার স্টাইলের মধ্যে ও একটা আভিজাত্য আছে।
মিরা নিজের দিকে তাকায়। ভারী কাজের লেহেঙ্গা পরেছে সে আর পিয়াসা পরেছে একটা সিম্পল হলুদ জর্জেট থ্রিপিস। চুলগুলো ফ্রেঞ্চ বেনি করা।
দুই কানে বড় এক জোড়া কুন্দনের বড় ঝুমকা।
মিরা নিজের দিকে তাকায়। হঠাৎ করেই মিরার কনফিডেন্স লেভেল ডাউন হয়ে যায় যেনো।সে গায়ে হলুদের ফ্লাওয়ার জুয়েলারি পরেছে।কানে,গলায়,হাতে চুড়ি,মাথায় টায়রা,ঝাপটা অনেক কিছু পরেছে।
মিরার মনে হলো তাকে বোধহয় ক্লাউনের মতো লাগছে।
হঠাৎ করেই মিরার মনে পড়লো সন্ধ্যার কথা। অপমানে মিরার মুখটা নিচু হয়ে গেলো।
মিরা আজকে ভারী মেকাপ করেছে।গালে ইচ্ছেমতো ব্লাশঅন দিয়েছে।ব্লাশ দিতে মিরার ভীষণ ভালো লাগে।
ছাদে উঠার পথে আষাঢ় দেখে বললো, “কিরে, তোর গালে কি হয়েছে?”
মিরা না বুঝে বললো, “কোথায়?”
“তোরে এতো থাপড়াইছে কে?থাপড়াইয়া গাল লাল করে দিছে কে এভাবে? ”
মিরা লজ্জা পেয়ে বললো, “কি বলেন এসব,আমাকে থাপড়াবে কে?মেকাপ করেছি।”
“ভাইরে,যেসব মেকাপ করছস,মনে হইতেছে আলিফ লায়লার মালেকা হামিরা।পিয়াসারে দেখছস?কতো সিম্পল সাজছে।কবে যে তোদের রুচি চেঞ্জ হবে।”
মিরার উঠে এলো ছাদ থেকে।আষাঢ়ের বলা কথাগুলো তখন পাত্তা দেয় নি।এখন মনে হচ্ছে তাকে সত্যি খারাপ লাগছে দেখতে।
রুমে এসে দেখে নিরা আপা মুখে ফাউন্ডেশন দিচ্ছে।
মিরাকে দেখে বললো, “শোন,আরো সুন্দর করে সেজে নে।ছেলেদের বাড়ি থেকে হলুদ দিতে আসবে আপাকে।অনেক ছেলেরা আসবে।”
মিরা আপার কথা শুনে ভাবলো, “দূর,আষাঢ়ের কথা শুনে নিজের সাজ নষ্ট করবে কেনো।কতো ছেলেরা আসবে।বৈশাখী আপার বিয়ে হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার পাত্রের সাথে। পাত্র ফরেন ক্যাডার।ওর শ্বশুর বাড়ির সবাই অনেক উঁচু মহলের লোক।ওদের কাউকে পটাতে পারলেই কেল্লাফতে। মা’য়ের কথা মতো আষাঢ়ের পিছনে পড়ে আর কতো অপমানিত হবে!
মিরা মিনিকে ও ডেকে আনলো।মিনির ইচ্ছে করলো না সাজতে।সে নির্জনকে পছন্দ করে। মায়ের কথাতেই প্রথমে আগ্রহী হয়েছিলো কিন্তু আস্তে আস্তে কেনো জানি নির্জনের প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আরো বেশি।
নিরা বললো, ” আরে গাধী,হাঁদারাম কোথাকার বুঝতেছিস না কেনো?নির্জন তো আছেই হাতে,এর চাইতে ভালো অপশন যদি পেয়ে যাস তাহলে অসুবিধা কোথায়? মা খুশি ই হবে দেখিস।”
মিনি বললো, “না আপা,আমার বেটার অপশন লাগবে না।আমি নির্জনকে ভালোবাসি।ওকে হলেই হবে।”
মিরা বললো, “বাদ দে তো আপা।ওর মাথায় যেটা ঢুকেছে ও সেটা নিয়েই থাক।সবে তো ইন্টারে পড়ছে,বুঝবে আরো কিছু দিন পরে।”
কিছুক্ষণ পর নিরা আর মিরা যখন সেজে বের হলো আষাঢ়ের পিলে চমকে গেলো।
এরা এসব কি সেজেছে? শরীরের প্রতিটি অঙ্গে কৃত্রিমতা। নিজস্বতা কিছুই নেই।
এদের ফ্যাশন সেন্স এতো জঘন্য কেনো?
এজন্যই লোকে বলে, চকচক করলেই সোনা হয় না।
পাত্রপক্ষ থেকে মেহমান এলো দশটার দিকে।দুই মাইক্রো মেহমান এলো।খাওয়া দাওয়ার পর ছাদে সবাই মিলে ঠিক করলো ছাদে সবাই মিলে কাপল ডান্স করবে।
পিংকি পিয়াসাকে বললো, “এই পিয়াসা,তুই আষাঢ় ভাইয়ার পার্টনার।আষাঢ় ভাইয়ের পার্টনার আমরা কেউ-ই হবো না।বাবারেও,সারাক্ষণ সবাইকে যে হুমকি ধামকি দেয়।ওর ধারেকাছেও কেউ নেই।”
পিয়াসাকে শারমিন নাচ শিখিয়েছে। বাড়িতে সে প্রায় সময়েই ছাদে বৃষ্টি এলে নাচ করে। বৃষ্টি এলে পিয়াসার মন ময়ুরের মতো হয়ে যায়। কিন্তু সবার সামনে এভাবে নাচার কথা পিয়াসা কখনোই ভাবে নি।আর আষাঢ়ের সাথে নাচা তো অসম্ভব।
পিয়াসা পিংকিকে বললো, “না রে,আমার মাথা ব্যথা করছে।আমি যাই।ঘুমাবো কিছুক্ষণ। তাছাড়া বাবাকে দেখি না অনেকক্ষণ হলো। বাবার কাছে যাবো একটু।”
পিয়াসা ছাদ থেকে নামতে যাবে যখন তখনই কারেন্ট চলে গেলো। সিড়িতে অন্ধকারে পিয়াসা দাঁড়িয়ে গেলো।পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে।
আষাঢ় ছুটলো জেনারেটর চালু করার জন্য।নিজের মোবাইল সে রুমে রেখে এসেছে।এই বাড়ির প্রতিটি কোণ আষাঢ়ের মুখস্থ। তাই আলোক হোক বা অন্ধকার, আষাঢ়ের তাতে অসুবিধা নেই।
ছুটে এসে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে কয়েক ধাপ নামতেই আষাঢ় কারো সাথে ধাক্কা খেলো।
ধাক্কা খেয়ে পিয়াসা পড়ে যেতে নিলো, আষাঢ় বুঝতে পেরে সামনে থাকা মানুষটাকে অন্ধকারে জড়িয়ে ধরলো।
কারো শক্ত আলিঙ্গনে পিয়াসার বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় করতে লাগলো। পুরুষালি বুনো একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে বিপরীত মানুষটার থেকে।পারফিউমের স্মেলটা দারুণ তো।মানুষটা ছাড়ছে না পিয়াসাকে।
পিয়াসা কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, “কে?”
আষাঢ় পিয়াসাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“তুমি যার দৃষ্টি থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইছো,সে-ই।”
মুহুর্তেই পিয়াসার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো।ভয়ে আরেকবার পিয়াসা পা হড়কে পড়ে যেতে নিলো।
অন্ধকার আষাঢ়ের চোখ সয়ে এসেছে। হাত বাড়িয়ে আবার ও বুকে টেনে নিয়ে বললো, “এতো ভয় পাচ্ছো কেনো আমাকে?রিল্যাক্স পিয়াসা।অন্ধকারে পড়ে যাবে তুমি। আমি না যাওয়া পর্যন্ত জেনারেটর আসবে না।তুমি আমার সাথে আসো।আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে নিচে।”
“আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো।আপনি যান এখান থেকে।”
“শান্ত হও,আমি তোমার সাথে নাচ করবো না।তুমি নিশ্চিন্তে অন্য কাউকে পার্টনার করে নাচতে পারো।আমি জানি আমার ভয়েই পালিয়ে যাচ্ছো তুমি। ”
“না আমি নাচ করবো না।আমি বাবার কাছে যাবো।”
আষাঢ় বুঝতে পারলো এই মেয়ে এখনো ভয় পাচ্ছে তাকে।
একে এখানে অন্ধকারে রেখে যেতে ও পারছে না আষাঢ়। অন্ধকারে আবার কে নেমে আসে আর ধাক্কা খায়।কিংবা অন্ধকারে কেউ যদি খারাপ ব্যবহার করে!
পিয়াসার অনুমতি না নিয়েই পিয়াসাকে কোলে তুলে নিলো আষাঢ়। ভয়ে পিয়াসা চিৎকার করে উঠলো।এই লোকটা আস্ত অসভ্য একটা লোক।
হ্যালো 2441139 পর্ব ১৭
আষাঢ় হেসে বললো, “মা আমাকে বলেছিলো তোমার খেয়াল রাখি যাতে।আমি আমার দায়িত্বে অবহেলা করবো না পিয়াসা।তাতে তুমি লজ্জা পেলেও আপাতত আমার কিছু করার নেই।এই অন্ধকারে যে কেউ নেমে আসতে পারে। সবাই তো ভালো হয় না।আমি তোমাকে এখানে একা রেখে যেতে পারছি না তাই।”
পিয়াসার হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো অনেক বছর আগের একটা রাতের কথা। এক জোড়া মানব মানবীর করা কিছু জঘন্য কার্যক্রম ভাবতেই পিয়াসার গা শিউরে উঠে।
একেবারে নিরব হয়ে যায় পিয়াসা।