হ্যালো 2441139 পর্ব ২

হ্যালো 2441139 পর্ব ২
রাজিয়া রহমান

পিয়াসা নানীর দিকে তাকায়। নানীর ফর্সা মুখটা কেমন মা মা অনুভূতি দেয়।টুকটুকে লাল দুটো গাল।নানা বেঁচে থাকতে নানীকে কইতরি বলে ডাকতো তার রূপের জন্য।
সবাই বলে পিয়াসা তার নানীর মতো হয়েছে দেখতে।নানী ও তো তাকে কতো আদর করতো এই কথা বলে অথচ আজকে মা চলে যেতেই কি-না সব আদর হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো ফুরিয়ে গেলো!
আদর,ভালোবাসা,স্নেহ,মমতা সব কিছু ওই আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো তুলোর মতো মেঘ যেনো।চোখের পলকেই হারিয়ে গেলো পিয়াসার জীবন থেকে।পিয়াসা অবুঝ তবে বোকা না।

বৈশাখের এই রৌদ্রস্নাত দিনে ও পিয়াসার জীবনে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে টের পেয়ে যায় পিয়াসা।
বুকেতে যে বিরহ শ্রাবণ তার খোঁজ কেউ জানে না।কেউ জানে না ফুলের মতো কোমল প্রাণটা ভয়ে আধখানা হয়ে আছে।সবাই ব্যস্ত কে কার ঘাড়ে ফেলে নিশ্চিন্ত হবে সেই চিন্তায়।
পিয়াসা দাদীর বাচ্চাওয়ালা মুরগির দিকে তাকায়। কি সুন্দর করে তার সবগুলো বাচ্চাকে তার বুকের নিচে নিয়ে চুপটি করে বসে আছে কালো মুরগিটি।
পিয়াসাকে এরকম আদরে মুড়ে রাখার মানুষ আর নেই।পিয়াসা নানীর কাছ থেকে দূরে সরে যায়।
এই পৃথিবীর সব মানুষ স্বার্থপর, প্রতারক।
জন্মদাত্রী মা যেখানে তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারলো নিজের সুখের সন্ধানে সেখানে দাদী,নানীর আশা করা পিয়াসার জন্য অলীক কল্পনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কাউকে চাই না আর পিয়াসার।কি জানি কিসের অভিমানে হুট করেই পিয়াসা সিদ্ধান্ত নিলো সে আর একটুও কাঁদবে না।বাকি জীবনে সব আঘাতে সে হেসে যাবে।
তাকে যখন আপন করে নেওয়ার মতো কেউ নেই তখন সে নিজেই নিজেকে আপন করে নিবে।
মা’কে দেখতো সবসময় খুব সুন্দর করে সেজেগুজে থাকতো।বাবার সাথে মা’য়ের মনোমালিন্য পিয়াসা টের পেতো।দাদী তো সবসময়ই কটাক্ষ করে বলতো,”যার স্বামী তারে ভালোবাসে না সে আবার এরকম ফুটানি করে চলে কার লাইগা?”
মা শান্ত সুরে জবাব দিতো,”আমি আমাকে ভালোবাসি আম্মা।আপনার ছেলের ভালোবাসা না পেলে নাই তাই বলে কি আমি সেই দুঃখে সন্নাসী হবো?
নিজেকে ভালোবাসা ভীষণ জরুরি এই দুনিয়ায় বাঁচতে হলে,ভালো থাকতে হলে।যে নিজেই নিজেকে ভালোবাসতে পারে না অন্য কেউ তাকে আর কি ভালোবাসবে।নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসা থাকলে এই দুনিয়ার কেউ ভালো না বাসলেও আমার কোনো আফসোস নেই।”

পিয়াসা এসব ভারী ভারী কথার মানে বুঝতে পারতো না।অথচ কি অদ্ভুত!
এক রাতেই পিয়াসা যেনো বুঝে গেছে সব এখন।সে নিজেই নিজেকে রক্ষা করবে,নিজেই নিজেকে দেখে রাখবে।
দাদী,নানীর তর্কাতর্কির মধ্যে পিয়াসা থমথমে সুরে বললো, “আমি এখানেই থাকবো।কোথাও যাবো না আমি।”
জমিরন অবাক হয়। এইটুকু মেয়ের গলায় হঠাৎ করে এতো তেজ এলো কই থেকে?
আবার এইখানে থাকতে চায়?
মা নেউ,বাপ নেই,ভাই বোন কেউ নেই।জমিরন তো এই মেয়েকে দুই চোখে দেখতে পারে না। সেইখানে এই মেয়ে বলে কিনা এখানে থাকবে?
শেফালী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।পিয়াসা যদি কান্না করতো তার সাথে যাওয়ার জন্য তাহলে তিনি বিশাল বিপদে পড়তেন।

এগিয়ে গিয়ে পিয়াসার হাত ধরতেই পিয়াসা হাত ঝাড়া দিয়ে সরে গিয়ে বললো, “তুমি আর কখনো এখানে আসবা না নানী।আমার মা’য়ের সাথে সাথে এই দুনিয়া থেকে আমার সব আপন মানুষ ও হারিয়ে গেছে। কারো ভালোবাসা,আদর লাগবে না আমার। ভালোবাসলে তো মা-ই থাকতো আমাকে ভালোবাসার জন্য। বাবা-ই ভালোবাসতো।আমার কারো আদর লাগবে না।চলে যাও।”
শেফালী চমকায়।পিয়াসা এরকম ভারী ভারী কথা কিভাবে বলছে?
জমিরন ও অবাক হয়।
এক রাইতেই পিয়াসার এতো বদল কেমনে হইলো!
পিয়াসা সোজা ঘরে ঢুকে যায়। গতকাল দুপুরের পর আর কিছু খায় নি সে।রান্নাঘরে ঢুকে সব পাতিলের ঢাকনা উল্টায়।একটা পাতিলে পান্তাভাত রাখা আছে।গতকালের ভাতে পানি দিয়ে রাখা। আর কিছুই নেই।
মা থাকলে এখন একটা ডিম ভেজে পিয়াসাকে ভীষণ মজা করে পান্তাভাত খাইয়ে দিতো।পিয়াসা জানে দাদী তাকে ডিম দিবে না।
রাগে, ক্ষোভে পিয়াসার চোখে জল এলো।একটা প্লেটে পান্তাভাত নিয়ে পিয়াসা একটা পেয়াজ কেটে নেয়।ভাতের প্লেট নিয়ে বারান্দায় এসে গাপুসগুপুস করে পেয়াজ কামড়ে ভাত খায়।শেফালীর কলিজা ছিড়ে যায় যেনো এই দৃশ্য দেখে।

কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই।সহ্য করতে না পেরে শেফালী চলে যায়।
জমিরন এবার আর অবাক হয় না। পারভীনের মেয়ে যে এই মেয়ে তার প্রমাণ এটাই।কোনো অবস্থায় যাকে টলানো যায় নি।পারভীন ছিলো জমিরনের জীবনে সাক্ষাৎ অভিশাপ যেনো।
তার মেয়ে ও খুব একটা সহজ হবে না।
জমিরন ও সোজা মানুষ না।ভুলুর ঘরে এক রাত হাত পা বেঁধে ফেলে রাখবে,সব তেল বের হয়ে যাবে এই মেয়ের।দুই আঙ্গুলের মেয়ের দশ আঙুল সমান নখরা।
পিয়াসা ভাত খায় সেই মুহূর্তে কাদের আসে শ্বশুর বাড়ি।এসেই ডাকতে থাকে মালিহাকে।
মালিহা বড় দুলাভাইয়ের গলার স্বর শুনে ছুটে বের হয়ে আসে।হাসিমুখে বলে, “কি দুলাভাই, খালি হাতে সাত সকালে শ্বশুর বাড়ি চলে আসছেন?শালীর জন্য মোড়ের দোকান থেকে নাশতা নিয়ে আসলেন না ক্যান?”
বড় ফুফাকে দেখে পিয়াসার গত রাতের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়তেই পিয়াসার গা গুলিয়ে উঠে। ভাতের প্লেট সরিয়ে পিয়াসা বমি করে দেয়।

কাদের এগিয়ে গিয়ে পিয়াসার হাত ধরে বলে, “কি হইছে পিয়া?শরীর অসুস্থ? ”
লাফ দিয়ে পিয়াসা কাদেরের হাত থেকে হাত সরিয়ে নেয়।এই লোকটা খুব খারাপ লোক।এর থেকে দূরে থাকতে হবে।মা তো বলেছে যারা ব্যাড টাচ করে তাদের কাছে না যেতে।
চিৎকার করে পিয়াসা বলে, “আপনি আমাকে ধরবেন না।আপনি ব্যাড টাচ করেন আমি জানি।”
কাদেরের লেখাপড়ার দৌড় প্রাইমারির গন্ডি পেরোয় নি।ব্যাড টাচ বুঝার মতো ক্ষমতা তার নেই।তাই জিজ্ঞেস করলো, “ও কি বলে এসব?”
মালিহা বিরক্ত হয়। ছোট ভাবীর এই এক সমস্যা। মেয়েরে পাকনা বানিয়ে ফেলছে।এই টুকু মেয়ে কিভাবে ব্যাড টাচ চেনে?
আর ওর তো কোনো কিছুই জানার কথা না।
হয়তো বড় দুলাভাই ওর হাত ধরায় ব্যথা পেয়েছে তাই এই কথা বলছে।এসব বাল পাকনা কথা বলে বলেই মালিহা এদের মা মেয়েকে পছন্দ করে না।আধুনিক মায়ের আধুনিক মেয়ে।মেয়েরে শুদ্ধ ভাষা শিখায়।এখন কোথায় সব ঢং মা মাইয়ার?

বিরক্তিকর যতসব!
দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে মালিহা বললো, “ও ছোট মানুষ, আপনি ধরছেন যে ব্যথা পাইছে।সেটাই বলছে।”
পিয়াসা অবাক দৃষ্টিতে ফুফুর দিকে তাকায়। ফুফু ইচ্ছে করে ব্যাপারটা গোপন করছে?ফুফু কেনো ফুফার সাথে এরকম মিষ্টি সুরে কথা বলছে!
পিয়াসা বুঝতে পারে ছোট ফুফু কাউকে বলতে চায় না।মা বলেছে অনেক মেয়েই এই ব্যাপারে ভয় পায়।ভয় পেয়ে তারা কাউকে জানায় না।পিয়াসা যাতে কখনো ভয় না পায় এই ব্যাপারে। খারাপ লোকটার সংস্পর্শে যাতে না যায়।ভয় পাবে সে যে এই বাজে কাজ করে।
পিয়াসা কি সবাইকে বলে দিবে?
বলে দিলে যদি ছোট ফুফু রাগ করে?
মালিহা এগিয়ে গিয়ে বলে, “চলেন দুলাভাই, দোকান থেকে নাশতা খেয়ে আসি।তারপর আপনাদের বাড়িতে যাবো।”
জমিরন বললো, “না এখন কোনোখানে যাবি না।ঘরে যা।আমি রুটি বানাই দিতেছি।”
কাদের বিগলিত হেসে বললো, “আম্মা কেনো নিষেধ করতেছেন?ও আমার শালী,আধা ঘরওয়ালী তো ও আম্মা।আসুক না আমার সাথে। অসুবিধা নাই তো।”
জমিরন কি বলবে বুঝতে পারে না। উভয় সংকট তার।এক মেয়ের কুকীর্তি গোপন করতে গেলে অন্য মেয়ের প্রতি অন্যায় করা হবে।আবার লোক জানাজানি হলে নিজের মান সম্মান শেষ হবে।ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবেন কিভাবে পরে?

মা’কে উপেক্ষা করে মালিহা বের হয়ে গেলো।
পিয়াসা ভাত খেয়ে নিজেদের রুমে গেলো।
গতকাল দুপুরের পর থেকে আর রুমে আসে নি পিয়াসা।মা’কে ছাড়া এই রুমটা কখনো ভাবতে পারে না পিয়াসা।এই রুমের প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চিতে মা’য়ের মমতা মিশে আছে।
এই রুমের এই ফ্লোরটা মা দিনে তিনবার মুছতো।
পিয়াসা ফ্লোরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে মায়ের স্পর্শ পাওয়ার লোভে। দুই চোখ ভিজে উঠে পিয়াসার।
ঠান্ডা ফ্লোরে শুয়ে আনমনে বলে, “কেনো চলে গেলে মা?আমার কাছে যে কেউ নেই এখন।তুমি তো জানতে তুমি ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসে না।আমার কথা একটুও মনে পড়লো না মা?”
খানিকক্ষণ কান্না করে পিয়াসা উঠে দাঁড়ায়। স্কুলে যেতে হবে।পিয়াসা এবার সেভেনে পড়ে।
যদিও ক্লাস শুরু হবে ১০ টা বাজে।এখন সবেমাত্র ৮ টা বাজে।তবুও পিয়াসা তৈরি হয় স্কুল ড্রেস পরে। আজকে আগেই গিয়ে বসে থাকবে স্কুলে।বাড়িতে তার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।
কিছুতেই থাকতে পারছে না পিয়াসা।
এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে।কিন্তু এটা তো মিথ্যা না।
বাড়ি থেকে বের হতেই পাশের বাড়ির রাব্বি পিয়াসাকে ডেকে বললো, “কিরে পিয়াসা?তোর মা না-কি ভাগছে তোগো মাস্টরের লগে?”

পিয়াসা আর রাব্বি এক ক্লাসে পড়ে। রাব্বির কথা শুনে পিয়াসা কিছু না বলে হাঁটতে থাকে।রাব্বি মজা পেয়ে যায়। পাশে পাশে যেতে যেতে বলে, “কি খারাপ বেডি তোর মা।আমার মা কইছে এইজন্যই তোর মা সাইজাগুইজা ঘুরতো নাকি মাস্টররে দেখাইতে।হিহিহি।আমার মা কইছে তোর মা’য় নষ্ট বেডি আছিলো।”
পিয়াসার সহ্য হলো না আর মা’য়ের নামে এসব অপবাদ। রাব্বিকে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দেয় পিয়াসা।রাব্বি চিৎকার করে উঠে মাটিতে পড়ে গিয়ে। পায়ের থেকে জুতা খুলে রাব্বির দুই গালে ঠাস ঠাস করে মারতে মারতে বলে, “আমার মা’য়ের নামে যদি আর জীবনে একটা কথা বলতে শুনছি আমি তাহলে মনে রাখিস তোকে আমি আমাদের ভুলুর ঘরে বেঁধে রাখবো।আমার মা আমার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। তুই, তোর মা আমার মা’য়ের নখের যোগ্য ও না।তোর মা’কে বলে দিস গিয়ে কথাটা।”

হ্যালো 2441139 পর্ব ১

রাব্বি জুতার বারি খেয়ে মাটিতে শুয়ে কান্না করতে থাকে।পিয়াসা জুতা পায়ে দিয়ে আবারও হাঁটতে থাকে।
ভীষণ হাপাচ্ছে পিয়াসা।মাথায় যেনো আগুন ধরে আছে।
দশ কদম এগিয়ে গিয়ে পিয়াসা আবারও পিছনে ফিরে তাকায়।রাব্বি এখনো মাটিতে শুয়ে কান্না করছে।
পিয়াসা আবারও পেছনে আসে।রাব্বির মুখে এক দলা থুথু ছিটিয়ে দেয়।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৩