হ্যালো 2441139 পর্ব ৪
রাজিয়া রহমান
চারদিকে মায়াবী চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সব।খুব জোরে বাতাস ছুটেছে হুট করে। এখন বৈশাখ মাস চলছে।হুটহাট ঝড় শুরু হয়। প্রচন্ড ঝড়ের তাণ্ডবে গাছপালা সব যেনো ভুতুড়ে নৃত্য শুরু করেছে। একজন আরেকজনের গায়ে হেলে পড়ছে।বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে পিয়াসার গলা শুকিয়ে আসছে।
পিয়াসা বাড়ি থেকে বের হয়েছে অনেকক্ষণ হলো।উদ্দেশ্যহীন হাঁটছে সে।
এরমধ্যে কতো সময় পার হয়ে গেছে পিয়াসা জানে না।কোথায় এসেছে তাও জানে না।নিজের স্কুল পার হয়ে হাটতে হাটতে কোথায় যেনো চলে এসেছে।
এতোক্ষণ ভয় করছিলো না কিন্তু যেই ঝড় শুরু হয়েছে অমনি পিয়াসার গলা শুকিয়ে উঠেছে। কোথায় যাবে এখন এতো রাতে?
কাউকেই চেনে না পিয়াসা।
একটা দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসলো পিয়াসা।ক্ষিধেয় পেট জ্বলছে।
পিয়াসা বড় করে শ্বাস নিচ্ছে বসে বসে।সকালে পান্তা ভাত খাওয়ার পর এখন পর্যন্ত আর কিছু খাওয়া হয় নি।
নিজেকে ভীষণ দুর্বল লাগছে।পেট চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে পিয়াসা।ঝড়ের বেগ আরো বাড়ছে।বাতাসের সাথে ধুলোকণা উড়ে আসছে।পিয়াসা উঠে দাঁড়ায়। এই ঝড়ের ভয়ে যদি যে বসে থাকে তাহলে তার জীবনে যে ঝড় এসেছে তাকে মোকাবিলা করবে কিভাবে?
একদিন সবাইকে জবাব দিতে হবে।মা’কে,বাবাকে পিয়াসা কখনোই ক্ষমা করবে না।যারা নিজের জীবনের সুখ খুঁজতে গিয়ে পিয়াসাকে নিক্ষেপ করেছে আস্তাকুঁড়ে। যারা নিজে সুখে থাকার জন্য পিয়াসার কথা ভুলে গেছে তাদের পিয়াসা কখনোই ক্ষমা করবে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছুদূর যাওয়ার পর পিয়াসা একটা বাড়ির গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাতটা এখানেই থাকবে।
সকাল হলে না হয় অজানার উদ্দেশ্য হাঁটতে থাকবে।ভাগ্য কোথায় নিয়ে তাকে থামায় দেখা যাক।
গেইটের সাথে হেলান দিয়ে বসতেই পিয়াসা টের পায় সে কতটা ক্লান্ত।চোখ বন্ধ করতেই ঘুমে তলিয়ে গেলো।
পিয়াসার সকাল শুরু হলো এক রাশ বিস্ময় নিয়ে। চোখ খুলতেই দেখে মুখের উপর শারমিন ম্যাডাম ঝুঁকে আছেন।পিয়াসা চোখ কচলায়।শারমিন ম্যাডাম এখানে আসবে কোথা থেকে।ভালো করে তাকাতে দেখে না ভুল দেখে নি।সত্যি শারমিন ম্যাডাম।
শারমিন সুলতানা রাধাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। সকালে ঝড়ে গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি দেখতে বের হয়েছিলেন।গেইট খুলতেই দেখে পিয়াসা হেলান দিয়ে বসে আছে।
পিয়াসাকে দেখে শারমিন অবাক হয়। পিয়াসা এখানে কোথা থেকে এলো!
পিয়াসার বাম পা থেকে রক্ত পড়তে পড়তে শুকিয়ে গেছে। মেয়েটা সম্ভবত খেয়াল ও করে নি।ঘুমন্ত পিয়াসার মুখের দিকে তাকাতেই শারমিনের বুকে না পাওয়ার আগুন জ্বলে উঠে। পিয়াসার মা তো পিয়াসাকে ফেলে চলে গেছে। শারমিনের কান্না পায়।কেউ পেয়েও মূল্য দেয় না আর কেউ একটা সন্তানের আশায় বুকে পাথর চাপা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকে।
পাখির মতো হালকা পিয়াসাকে শারমিন কোলে করে বাড়িতে নিয়ে যায়। পিয়াসার ঘুম ভাঙে তার আরো কিছু সময় পরে।
শারমিন ম্যাডামকে স্কুলের সবাই অপছন্দ করে। পিয়াসা ও পছন্দ করে না।
তাই শারমিন ম্যাডামকে দেখে পিয়াসার কিছুটা ভয় লাগে।কিন্তু পিয়াসাকে অবাক করে দিয়ে শারমিন কোমল সুরে বললো, “এখানে কিভাবে এলে পিয়াসা?কোথায় যাচ্ছিলে মা?”
পিয়াসা অবাক হয়। শারমিন ম্যাডাম তাকে মা বলে ডাকছে।উনি এরকম কোমল গলায় কথা বলতে পারেন?পিয়াসা পায়ের দিকে তাকায়।পায়ে ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। কি হয়েছে পায়ে!
বুঝতে পারে না পিয়াসা।
শারমিন আবারও জিজ্ঞেস করে পিয়াসাকে। পিয়াসা জবাব দেয় না।
শারমিন আর চাপাচাপি না করে পিয়াসাকে বেসিনে নিয়ে যায়। একটা নতুন ব্রাশ হাতে দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে বলে শারমিন চলে যায়।
পিয়াসা আড়চোখে তাকায় চারদিকে। সে দাঁড়িয়ে আছে একটা বেসিনের সামনে। এরকম চকচকে সাদা এতো সুন্দর বেসিন হতে পারে পিয়াসার জানা ছিলো না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পিয়াসা।
নিজেদের ঘর ছিলো চারপাশে দেয়ালে উপরে টিন দেওয়া।
সেখানে এরকম আভিজাত্য ছিলো না।
শারমিন ম্যাডামের কোমল সুর পিয়াসার কানে বাজছে।ম্যাডাম এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে?
কেমন আশ্চর্য লাগছে ব্যাপারটা পিয়াসার কাছে।
দাঁত ব্রাশ করে পিয়াসা বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।কি করবে এখন?
ম্যাডাম তো নেই,এই সুযোগে পালিয়ে যাবে?
এদিক ওদিক তাকিয়ে পিয়াসা দৌড় লাগায়।ডাইনিং রুম পার হতেই শারমিন ম্যাডামের ধমক ভেসে আসে পিয়াসার কানে।জমে যায় পিয়াসা।
এইতো আগের চেনা ম্যাডাম। এতোক্ষণ তাহলে কেনো চিনতে পারছিলো না পিয়াসা?
শারমিন পিয়াসাকে ধমকে নিয়ে আসে।পিয়াসা বাধ্য মেয়ের মতো সোফায় বসে।
এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসে শারমিন। দুধ দেখে পিয়াসার ক্ষিধের কথা মনে পড়ে যায়।
শারমিন বললো, “নে,দুধটা খেয়ে নে।তোকে এতো ক্লান্ত লাগছে কেনো?কি হয়েছে আমাকে বল সবটা।”
পিয়াসা ঢোক গিলে।কি বলবে ম্যাডামকে সে?
ম্যাডাম চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে কথা বলছিস না কেনো?বল কি হয়েছে?”
পিয়াসা আর চুপ থাকে না।যা যা হয়েছে সবটা জানায় শারমিনকে।শারমিন হতভম্ব হয়ে যায় শুনে।
আনোয়ার চৌধুরী মর্নিং ওয়াক করে ফিরে দেখেন পিয়াসা বসে শারমিনের সাথে কথা বলছে।পিয়াসার পাশে বসে হেসে জিজ্ঞেস করলেন,”হ্যালো পিয়াসা,কেমন আছো এখন?”
পিয়াসা তাকিয়ে থাকে জবাব না দিয়ে। আনোয়ার হেসে বললো, “আমাকে চিনতে পারো নি তাই না?আমি তোমার ম্যাডামের হাজব্যান্ড।”
পিয়াসা মাথা নাড়িয়ে বললো, “ভালো আছি।”
“দেখে তো তা মনে হচ্ছে না মা।জানো না বোধহয় আমি একজন পেডিয়াট্রিশিয়ান।মানে শিশু বিশেষজ্ঞ।”
পিয়াসা চুপ করে থাকে।
শারমিন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে যায়। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি জানো না চৌধুরী, এই মেয়েটার উপর দিয়ে এই দুই দিন কি ঝড় গিয়েছে। এই মেয়েটা আমার স্টুডেন্ট। ওর মা সম্ভবত সংসার জীবনে সুখী হতে না পেরে অন্য কারো কাছে চলে গেছেন।ওর বাবা ওকে পছন্দ করে না ও মেয়ে বলে। ওর দাদী ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে গতরাতে। মেয়েটা হাটতে হাটতে এখানে চলে এসেছে। তুমি ভাবতে পারছো ও একটা ১২ বছরের শিশু। এই বাচ্চার সাথে ওর দাদী কিভাবে এই অন্যায় করতে পারে? ”
পিয়াসা মুচকি হেসে বললো, “দাদীর দোষ নেই ম্যাডাম।আমি আসলে সবার কাছে এখন ঝামেলা। মা তো চলে গেছেন।বাবা ও আমাকে পছন্দ করেন না।নানী ও চায় না আমাকে নিতে।দাদী ও আমাকে পালতে চায় না।আমি সবার জন্য ঝামেলার হয়ে গেছি এখন।”
শারমিন কেঁদে উঠে স্বামীকে ধরে। আনোয়ার স্ত্রীকে শান্ত করে বলে, “তুমি অস্থির হইও না শারমিন।সবকিছুর সল্যুশন আছে।”
“আল্লাহ আমাদের একটা সন্তান দেয় নি অথচ ওরা সন্তান পেয়েও ছুঁড়ে ফেলে দিছে। ওকে আমি কোথাও যেতে দিবো না।আল্লাহ ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছে।”
“তাই হবে শারমিন।আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে পিয়াসাকে আমাদের মেয়ে করে আনবো।ও আমাদের মেয়ে হয়ে বড় হবে।”
হ্যালো 2441139 পর্ব ৩
শারমিন চোখ মুছে পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুই আমার মেয়ে হবি পিয়াসা?আমার মেয়ে।আমার কোনো সন্তান নেই,তোর ও বাবা মা নেই।তুই আমার সন্তান হবি মা?আমাকে মা বলে ডাকবি?”
পিয়াসা কি বলবে বুঝতে পারছে না।