হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৬

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৬
রাজিয়া রহমান

সন্ধ্যা থেকে বাসার সবাই আষাঢ়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। কোনো আয়োজন,জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ছাড়াই ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়ে গেলো। পিয়াসা বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাকে ভীষণ আনন্দিত লাগছে।
“জীবনে একটা বার শুধু মন ভরে বাবা ডাকার অধিকার চেয়েছিলাম বাবা,তুমি আমাকে হাজার বার মন ভরে বাবা বলে ডাকার সুযোগ দিয়েছো।
ছায়ার মতো আমার পাশে থেকেছো বাবা।তোমার মনের সুপ্ত ইচ্ছেই আমার কাছে শিরোধার্য। তুমি বললে আমি হাসতে হাসতে আগুনে ঝাঁপ দিতে রাজি ছিলাম বাবা।”

মনে মনে কথাগুলো বলে পিয়াসা মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মা মনে হয় একটু বেশি কষ্ট পেয়েছে।
মিনির মনে হলো সে ও কিছুটা চিন্তামুক্ত হলো।নির্জন যেখানে এখন পর্যন্ত তার সাথে কথা বলে না সেখানে আষাঢ় হলে হয়তো মিরাকে খুন করেই ফেলতো।
রাতে সবার জন্য রজনী তেহারি রান্না করলো।আষাঢ়ের খুশি হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সে খুশি হতে পারলো না।
বিয়ে মিটে যাওয়ার পর পরই শারমিনরা তৈরি হলো চলে যাওয়ার জন্য। স্কুল থেকে শারমিন এক দিনের ছুটি নিয়েছিলো সেখানে আজ দুই দিন হয়ে গেছে।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই শারমিনের বুকের ভেতর কেমন দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো।
এতো যন্ত্রণা কেনো হয়!
কন্যা বিদায় এতো যন্ত্রণার কেনো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শারমিন মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো, “আমার জীবনে প্রতি নামাজে,প্রতি দোয়ায় একটাই নাম থাকে মা,তা হলো পিয়াসা। আমি সবসময় চাই আমার মেয়ে সুখী হোক।আজকে থেকে নতুন আরেকটা জীবন তোর,মায়ের দোয়া ভালোবাসা সবসময় রইবে তোর উপর। আজীবন যাতে সুখে থাকতে পারিস মা এটাই চাইবো।”
মা’য়ের পর বাবা এসে দাঁড়ায় মেয়ের সামনে। মেয়ের কপালে চুমু খায় আনোয়ার চৌধুরী। তারপর শান্ত সুরে বললো, “মা,আজকে তোমার বিয়ে হয়েছে। আজ থেকে তুমি এই বাড়ির সদস্য হলে।তবে মনে রেখো,সংসার জীবনে যতোই অশান্তি হোক,টানাপোড়েন হোক,কখনো যদি তোমার মনে হয় তোমার পক্ষে আর সম্ভব না।তোমার রাজপ্রাসাদের দ্বার তোমার জন্য আজীবন খোলা আছে মা।মনে রেখো,তোমার বাবার রাজ্যে তুমি একমাত্র রাজকন্যা, আজীবন তাই থাকবে।কখনো কোনো অন্যায়ের সাথে কম্প্রোমাইজ করবে না।একটা প্রবাদ আছে জানো নিশ্চয়, যেমন বুনো ওল,তেমনি বাঘা তেঁতুল কিংবা যেমন কুকুর তেমন মুগুর।
নিচুতে সবসময় পানি জমে।তুমি যখন সবাইকে ছাড় দিবে তখন দেখবে সবাই তোমাকে আরো বেশি কোণঠাসা করতে চাইবে।

নিজের মনের কথা শুনবে সবসময়।
আর হ্যাঁ, পড়ালেখার কোনো বিকল্প নেই।তোমাকে কেউ যদি তোমার কাজে এক ফোঁটা বাঁধা দেয়,কখনো তা টলারেট করবে না।অন্যের ভরসায় না,তোমার নিজের ভরসা নিজেকে করতে হবে।
যার হাতে তোমাকে বাবা তুলে দিলাম আজকে,একদিন বুঝবে বাবা সবসময় সন্তানের ভালো চায়।আর তাই তোমার জন্য সর্বোত্তম মানুষকে বাবা বেছে নিয়েছি।সে সবসময়ই তোমার জন্য ঢাল হয়ে থাকবে,এটুকু নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি চোখ বন্ধ করে।”

পিয়াসার চোখ ভিজে আসে। এক নজর আষাঢ়ের দিকে তাকায়। আষাঢ় গম্ভীর হয়ে বসে আছে সোফায়।
মেয়ের থেকে বিদায় নিয়ে স্বামী স্ত্রী দুজন রজনীর কাছে যায়।রজনী কেঁদে ফেলে।আজ তার ভীষণ আনন্দের দিন।জীবনে এই প্রথম কোনো কিছু তার ইচ্ছে মতো হয়েছে।
শারমিন রজনীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।
কে বলে পেটে ধরলেই মা হতে পারে! তাহলে শারমিনের কেনো পিয়াসার জন্য এতো অন্তর পুড়ে যায়।
“আমার কলিজা পুরোটা আজকে থেকে তোর হাতে দিয়ে গেলাম।যেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার মেয়েকে নিজের ছেলের জন্য নিয়েছিস,সেটা আশা করি রাখবি।
আমার মেয়ের কখনো এক ফোঁটা অসম্মান হবে তো মনে রাখিস,তোদের জমিদারির অহংকার আমি মাটির সাথে মিশিয়ে দিবো।”
রজনী মুচকি হাসে।এটুকুই চেয়েছিলো রজনী। একটা মিথ্যা অহংকার আঁকড়ে ধরে এরা বেঁচে আছে। সেই অহংকার এবার ঘুচবে।

আষাঢ় তাদের এগিয়ে দিয়ে যেতে এলো।
আষাঢ় বের হয়ে যেতেই শিরিন যেনো বোমা ফাটালো।এতোক্ষণ সে চুপ করে ছিলো আষাঢ় সামনে ছিলো বলে। তা না হলে পিয়াসার বাবা মাকে সে বেইজ্জত করে দিতো।
সাপের পায়ে পাড়া দিয়েছে পিয়াসা,বিষ কামড় খেলে বুঝবে কতো বড় ভুল করেছে সে এই বাড়ির বউ হয়ে।
শারমিন পিয়াসার সামনে রাখা টাকার বান্ডিল হাতে নিয়ে বললো, “তোমার পেটে পেটে কিন্তু অনেক বুদ্ধি আছে পিয়াসা।ঠিকই ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দিলে।অথচ তোমার মা’য়ের কতো বড় বড় কথা শুনেছি কিছুদিন আগেই।ছি!
লজ্জা করে নি এখন আমার ভাইয়ের ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে?”
পিয়াসা শান্ত সুরে বললো, “আমার বাবা মা’য়ের লজ্জা লাগে নি ফুফু,কারণ আমার শ্বশুর শাশুড়ী আমার বাবা মা’য়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেছে,আমার বাবা মা বিয়ের প্রস্তাব দেয় নি আগে।
সবাইকে আপনি আপনার নিজের মতো ভাবলে তো চলবে না ফুফু।

আপনি যেমন আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে কোমর বেঁধে লেগেছেন,আমার বাবা মা কিন্তু তা করে নি।বরং আপনার ভাই,ভাইয়ের বউ,ভাইয়ের ছেলে সবাই আমাকে বউ করে আনার জন্য এক পায়ে খাঁড়া ছিলো।”
নিরা গজগজ করে বললো, “দেখলে মা,এতো দিন কেমন ভান করে ছিলো যেনো ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না।অথচ কবুল বলতে না বলতে কেমন নাগিনীর মতো ফোঁস ফোঁস করতে শুরু করে দিয়েছে।”
রজনী কথা বলতে যাবে তার আগে হাত ইশারা করে পিয়াসা তাকে থামিয়ে নিরাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আপা,আমি শুধু যে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানি তা না,মাছকে মচমচে করে ভাজতে ও জানি।আর সবচেয়ে ভালো প্রতিভা কি আমার জানেন আপা,নাগিনী থেকে মাঝেমাঝে আমি সাপুড়ে হয়ে গিয়ে আপনার মতো নাগিনীকে বিন বাজিয়ে বন্দী করতে ও জানি।আস্তে আস্তে আরো অনেক প্রতিভা বিকাশিত হবে আমার, দেখার অনুরোধ রইলো।”
রজনী মুখে কাপড় চেপে হাসতে শুরু করে। এই মেয়েটা এতো মজার কথা বলতে পারে!
অথচ দেখলে মনে হয় ভীষণ শান্ত একটা মেয়ে।

পিয়াসা আগুন দৃষ্টিতে শিরিনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, “এতো দিন তোমাদের অনেক নাটক দেখেছি,রজনী আন্টিকে অনেক নাচিয়েছো।এবার আমি বিন বাজাবো,তোমরা মা মেয়ে নাচবে ফুফু।আমার পোড়া অতীত আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে,আমার বাবা মা আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে তাতে তোমাদের হাত থেকে রজনী আন্টিকে শান্তি দিতে আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না।”
এতো কিছুর মধ্যে মহুয়া বেগম ভীষণ শান্ত হয়ে ছিলেন।হিসেবে এতো বড় গন্ডগোল করে ফেলবেন আগে বুঝতে পারেন নি।
আষাঢ় কাজ সেরে একটা কফিশপে গিয়ে বসে।তার মাথা ধরেছে ভীষণ।
কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার হঠাৎ করে।
যাকে চেয়েছিলো তাকে আজীবনের জন্য হয়তো পেয়েছে কিন্তু এই পাওয়ার চেয়ে না পাওয়াই ভালো ছিলো বোধহয়।

পিয়াসা যতোই বাবা মা’য়ের চাপে পড়ে বিয়ে করুক এতো সহজে সে সবটা মানতে পারবে না।আর না আষাঢ় পারবে পিয়াসার দিকে এক পা আগাতে।
দুপুরে পিয়াসার বলা কথাগুলো এখনো কেমন দগদগে তাজা ক্ষতের মতো অনুভব হচ্ছে আষাঢ়ের।
দুকাপ ব্ল্যাক কফি শেষ করে আষাঢ় উঠলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত্রি এগারোটা প্রায়।
আজও পিয়াসা দরজা খুললো।হুট করেই পিয়াসার দিকে তাকাতেই আষাঢ়ের মনে হলো পিয়াসাকে যেনো আগের চাইতে বেশি সুন্দর লাগছে।
কবুল বলার সাথে সাথে স্কিন গ্লো করছে যেনো আরো বেশি করে।
পিয়াসা দরজা খুলে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসে।
ঝোঁকের মাথায় বিয়েতে তো রাজি হয়েছে কিন্তু এখন তো চিন্তায় পড়ে গেছে সে।তার সব জামাকাপড়, বইখাতা সবকিছু ঝুনি খালা আষাঢ়ের রুমে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। এই লোকের সাথে এক রু থাকতে হবে মনে পড়লেই পিয়াসার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
জীবন নাটক সিনেমা হলে সে তাকে সোফায় ঘুমাতে বলতো।কিন্তু দুঃখের কথা ওই লোকের রুমে কোনো সোফা নেই।
সবাই খাওয়া দাওয়ার পর রজনী পিয়াসাকে সাথে নিয়ে আষাঢ়ের রুমে গেলো।আষাঢ় রুমে ঢুকে টি-শার্ট চেঞ্জ করছিলো।

পিয়াসা আর রজনীকে দেখে দ্রুত টি-শার্ট চাপিয়ে নিলো গায়ে।
রজনী হাসিমুখে বললো, “এই রুম আজ থেকে তোমার, এই বাড়িটাও আজ থেকে তোমার।তোমরা সুখী হও,এটাই চাই আমি।”
রজনী দুজনকে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
আষাঢ় বড় করে হাই তোলে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৫

পিয়াসা বরফের মতো জমে আছে মনে হচ্ছে। আষাঢ় হেসে বললো, “ভয় পেও না,তুমি আমাকে ক্যারেক্টারলেস ভাবলেও আমি তেমন কিছু করবো না তোমার সাথে।তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো।ঘুমের মধ্যে আমার হাত পা ছোড়াছুড়ির অভ্যাস নেই।এক পাশে শুয়ে থাকবো তোমার সাথে একটু ও টাচ হবে না।নিশ্চিন্তে থাকো তুমি।”
পিয়াসার মনে হলো আষাঢ়ের কথাগুলোর মধ্যে ভীষণ তাচ্ছিল্য মিশে আছে।
আষাঢ়ের না হয় ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করার অভ্যাস নেই কিন্তু পিয়াসার তো আছে।সে কি করবে?

হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৭