হ্যালো 2441139 পর্ব ৫২
রাজিয়া রহমান
অনেকক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে পিয়াসা।কিন্তু ঘুম আসছে না কিছুতেই।
বরং ভেতরে কেমন অস্বস্তি লাগছে ওর।সে কি অযথা আষাঢ়কে ভিলেন বানিয়ে রাখছে!
আষাঢ় খেয়াল করলো পিয়াসা ভীষণ নড়াচড়া করছে।মনে হচ্ছে কোনো অস্বস্তি হচ্ছে ওর।উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কোনো সমস্যা?”
পিয়াসার গলায় কাঁটার মতো একটা ব্যাপার কেমন খচখচ করছিলো।তাই মন আর বিবেকের যাতনায় পিষ্ট হওয়া পিয়াসা উপান্তর না পেয়ে উল্টো আষাঢ়কে জিজ্ঞেস করে, “একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“নির্দ্বিধায়।”
“যেহেতু আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে,মানি আর না মানি আপনি এখন আমার স্বামী।আমার কি এখন থেকে যেকোনো ব্যাপারে আপনার পারমিশন নিতে হবে?”
আষাঢ় মুচকি হাসে।
“না,নিতে হবে না।”
পিয়াসা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।আষাঢ় উঠে গিয়ে জানালা খুলে দেয়।চাঁদের আলো রুমে আসতেই মুহূর্তেই পুরো রুম কেমন স্বর্গের মতো মনে হয় পিয়াসার।
“কেনো নিতে হবে না?এটাই তো অলিখিত নিয়ম।”
“হ্যাঁ, এটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আদেশ, আই থিংক তুমি এটুকু জ্ঞান রাখো। কিন্তু তোমার ভয় পেতে হবে না এই ব্যাপারে। উত্তর তোমার প্রশ্নেই আছে।”
পিয়াসা বুঝতে না পেরে আষাঢ়ের দিকে তাকায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“যেখানে আমাকে তুমি তোমার স্বামী হিসেবেই মানতে পারো না সেখানে আমার কাছে অনুমতি চাওয়া ভীষণ ছেলেমানুষি ব্যাপার। বরং আমাকে অপমানিত করা হবে তখন।একটা সম্পর্কে দুজনের মনের মিল যখন না হয় তখন এসব ফর্মালিটি মেইনটেইন করা সম্পর্কেরই অপমান পিয়াসা।”
পিয়াসা চুপ করে যায় কিংবা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে যায়।আষাঢ় কিছু ভুল বলে নি।
পিয়াসা জানে,পিয়াসা বুঝে কিন্তু মনকে বুঝাতে পারে না।
নিজের মনই পিয়াসার সবচেয়ে বড় শত্রু এখন।
তবুও মিনমিন করে বললো, “আমি একটা রেস্টুরেন্টে জব করতে চাইছি।”
আষাঢ় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
পিয়াসা খেয়াল করে আষাঢ়ের চেহারায় একটা সুক্ষ্ম পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
তবে কি আষাঢ় ও ওর বাবার মতো!
পিয়াসা ভাবতে পারে না। সে রজনী আন্টির মতো কখনো হবে না।মন থেকে যদি না আসে তাহলে জোর করে কখনোই অন্যের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারবে না পিয়াসা।
“কোন রেস্টুরেন্ট?কোন পজিশন?”
পিয়াসা রেস্টুরেন্টের নাম বললো। মুহুর্তেই আষাঢ় গম্ভীর হয়ে বললো, “আমি বেঁচে থাকতে এসব রেস্টুরেন্টে এই টাইপের জব আমি তোমাকে করতে দিবো না পিয়াসা।”
পিয়াসা হেসে উঠে।
“একটু আগেই না বললেন আপনার অনুমতি নিতে হবে না! এক মুহুর্তেই স্বামীর অধিকার জন্মে গেলো!”
“না,অধিকার আমার জন্মায় নি।অধিকারবোধ কি তা তুমি জানো না হয়তো।”
“তাহলে এখন যা প্রকাশ করছেন তা কি?”
“তোমার নিরাপত্তা।”
পিয়াসা বুঝতে পারে না। বুঝতে পারার কথা ও না।
আষাঢ়ের দিকে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পিয়াসা।
এক মুহূর্তের জন্য আষাঢ়ের মনে হয় কি এমন হতো যদি এই মানবীর উপর তার ক্ষুদ্র একটু অধিকার থাকতো?
তাহলে এমন তাকিয়ে থাকতে দেখে ছোট্ট করে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলতো, “এমন করে তাকিও না,কলিজায় লাগে বউ।”
পিয়াসা জিজ্ঞেস করলো, “কই বললেন না তো!”
“ওই রেস্টুরেন্টের ২৫% শেয়ার আমার শত্রু রাশেদের। এর চাইতে বেশি বিস্তারিত আশা করি বলা লাগবে না।”
পিয়াসা জবাব দেয় না। রাশেদকে পিয়াসা জানে।আষাঢ় হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে আস্তে আস্তে জানতে পেরেছে।
পিয়াসা হতাশ হয়ে পড়ে। এমন নয় যে চাকরি না করলে ওর চলছে না।কিন্তু ওর দরকার মহুয়া বেগমের অহংকার মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া।
আষাঢ় জিজ্ঞেস করলো, “ওরা নিশ্চয় তোমার মেইলের রিপ্লাই করেছে?”
“হ্যাঁ, করেছে তো।আগামীকাল যেতে বললো।”
আষাঢ় হেসে বললো, “আরেকটু মাথা খাটালে তুমি বুঝতে পারতে এতো রাতে ওরা কেনো একটা মেয়ের মেইলের রিপ্লাই করলো।এই দুনিয়ার সব মানুষ আষাঢ় না পিয়াসা।”
পিয়াসার বুক ধড়ফড় করে।
আষাঢ়ের কথার মানে ও বুঝতে পেরেছে।
হুট করে পিয়াসার মনে পড়ে ঠিকই তো।অফিসিয়াল কাজ কেনো অফিস আওয়ারের বাহিরে এতো রাতে রিপ্লাই করবে এরা!
“তোমাকে একটা জিনিস দেখাই,ওয়েট”
আষাঢ় তার অন্য নামের একটা মেইল থেকে ওদের মেইল করে জবের জন্য। পিয়াসাকে বলে ওদের নক দিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে।
পিয়াসা ইতস্তত করে নক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ওদের রেস্টুরেন্টের নিজস্ব কোনো ড্রেসকোড আছে কি-না।
দুই মিনিটের মধ্যে পিয়াসাকে রিপ্লাই দেয়।
কিন্তু আষাঢ় কোনো রিপ্লাই পায় না।
আষাঢ় হেসে উঠে।
পিয়াসা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর থমথমে সুরে বললো, “এমন নয় যে চাকরি করতেই হবে।কিন্তু আমি আপনার দাদীকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। ওই অহংকারী মুখটা যাতে লজ্জায় এতটুকু হয়ে যায় তার জন্য। জমিদার বাড়ির বউ যখন বাহিরের মানুষের জন্য খাবার সার্ভ করবে ব্যাপারটা তার কেমন লাগবে তা দেখতে চেয়েছিলাম।
আজীবন যেই অহংকার তাকে সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করে রেখেছিলো তা মাটিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু আপনি আমাকে ভুল ভাববেন না।আমি কখনো আপনার অমতে কিছু করবো না।আপনাকে নিয়ে আমার মনে একটু আধটু সমস্যা থাকতে পারে কিন্তু তার জন্য আপনাকে অসম্মান করার মতো চিন্তাভাবনা আমার নেই।কিন্তু আপনার মনে হয় না আপনার দাদীর একটা শিক্ষা হওয়া ভীষণ দরকার!”
আষাঢ় হেসে বললো, “ওকে,সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে একটা রেস্টুরেন্টে জব পাইয়ে দিতে পারি।”
“ওয়েটার পোস্টে?”
আষাঢ়ের বলতে ইচ্ছে করলো, না ওয়েটার না,মালিক পোস্টে।
কিন্তু বলতে পারলো না।পিয়াসা যদি জানতে পারে ওটার ৭০% শেয়ার আষাঢ়ের তাহলে হয়তো ওখানে জব করতে চাইবে না।
কিন্তু পিয়াসার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এর চাইতে বেস্ট অপশন আর দ্বিতীয় কিছু নেই।সর্বক্ষণ আষাঢ় চোখে চোখে রাখতে পারবে।
আষাঢ় মাথা নাড়িয়ে বললো, “শুধু ওয়েটার কেনো,ক্যাশ সেকশনে ও বসতে পারবে।”
পিয়াসা মাথা নাড়িয়ে বললো, “আপনি বুঝতে পারছেন না কেনো,ওরকম কাজ হলে আপনার দাদীর যতটা রাগ হবে অন্য পোস্টে কি হবে!”
অগত্যা আষাঢ় মাথা নাড়িয়ে বললো, “জো হুকুম মহারাণী।”
পিয়াসা হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে পিয়াসার মনে প্রশ্ন জাগে আষাঢ় কিভাবে তার জবের ব্যবস্থা করছে!
হাসি বন্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তে।
“আপনি কিভাবে আমার জবের কনফার্মেশন দিচ্ছেন?”
আষাঢ় আমতাআমতা করে বললো, “না মানে,আসলে আমার একটা ক্লোজ ফ্রেন্ডের রেস্টুরেন্ট,ও বলেছিলো আরকি যে পোস্ট খালি আছে।তাই বলছি।”
“আমার একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“বাহিরের কাউকে আপনি জানাতে পারবেন না যে আমি আপনার বউ।”
আষাঢ় হেসে মাথা নাড়ায়।
জানানোর প্রশ্ন আসে না।যেখানে রেস্টুরেন্টের আরেক পার্টনার আর আষাঢ়ের বাবা মা ছাড়া কেউ জানে না ওই রেস্টুরেন্টের মালিক সে,সেখানে সে কাকে বলতে যাবে!
রেস্টুরেন্টের অন্যান্য সব স্টাফরা জানে সে ওখানের রেগুলার কাস্টমার। মালিকের সাথে ওর ভীষণ ভালো সম্পর্ক আছে এটুকুই।
সকালে নাশতার টেবিলে পিয়াসা আষাঢ়ের সাথে এলো।পাশাপাশি দুই চেয়ারে বসে পিয়াসা মহুয়া বেগমের দিকে তাকায়।
আষাঢ় মুচকি হেসে পিয়াসাকে সাহস দেয়।
একে একে সবাই এসেছে।
রজনী আর নার্গিস দ্রুত সবাইকে খাবার দিচ্ছে।আজকের মেন্যু লেটকা খিচুড়ি আর গরুর মাংস।
খিচুড়ির সুগন্ধে পিয়াসার ক্ষিধে আরো বেড়ে গেলো।
পিয়াসা রজনীকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আন্টি,আমার একটা চাকরি হয়েছে। আজকেই জয়েনিং।”
ডাইনিং টেবিলে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো।মহুয়া বেগ্মের গলায় খাবার আঁটকে গেলো।রজনী দ্রুত পানি এগিয়ে দিলেন।
পিয়াসার হাসি পেলো।
কি চাকরি করছে এটা জানলে তো বুড়ি স্ট্রোক করবে।
মহুয়া বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে সিরাজুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বললেন,”ওর চাকরি হয়েছে মানে?কি বলছে ও?এই বাড়ির বউয়েরা কবে থেকে বাহিরের পুরুষের সাথে কাজ করা শুরু করলো?”
সিরাজুল ইসলামের মনে হচ্ছে তিনি মাইনকা চিপায় ফেঁসে গেছেন। না পারবেন মায়ের হয়ে কথা বলতে, না পারবেন পিয়াসার বিরুদ্ধে কিছু বলতে।
রজনী জিজ্ঞেস করলো, “কিসের চাকরি?”
“একটা রেস্টুরেন্টের ওয়েটার।”
মহুয়া বেগম এবার সত্যি চমকান।এক মুহুর্তের জন্য তার মনে হলো তিনি ভুল শুনছেন।
ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,”এটা একটা ভদ্র বাড়ি,এখানের বউয়েরা বাহিরের পুরুষের সাথে চাকরি করবে তা কখনোই হবে না।”
আষাঢ় গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “আমার বউ দাদী।আমি ওকে পারমিশন দিয়েছি।এখানে আপনার মতামত জানতে চাই নি।”
মহুয়া বেগম সিরাজুল ইসলামের দিকে তাকান।
সিরাজুল ইসলাম কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে নাশতা করতে থাকেন।
মিনি ফোঁড়ন কেটে বললো, “বাড়িতে কাজ করতে পারে না,রাস্তায় কাজ করতে যাইতে চায়।”
পিয়াসা হেসে বললো, “আমি না হয় রাস্তায় গিয়ে কাজ করলাম,বাড়ির কাজটা তুমি আর তোমার গুণধর দুই বোন মিলে করে নাও।”
শিরিন মিনিকে চোখ রাঙ্গায়।এই মেয়ের সাথে কোনোভাবে লাগতে যাওয়া উচিত নয়।
মহুয়া বেগম অসহায়ের মতো বসে রইলেন নাশতা না করে। তিনি এই মেয়ের ডানা ভেঙে এদের মা মেয়েকে শিক্ষা দিবেন ভেবে ওকে এই বাড়ির বউ করেছেন।অথচ সেই মেয়ে কি-না তাকে গোনায় ধরে না।
কলিং বেল বেজে উঠার শব্দে মহুয়া বেগমের ভাবনার জাল কাটলো।কেউ এসেছে বোধহয়!
ঝুনি গিয়ে দরজা খুলে দেখে বৈশাখী আর বর্ষা এসেছে।
বৈশাখীর মুখটা থমথমে ভীষণ। রজনী মেয়েদের দেখে এগিয়ে গেলো।
বিশেষ করে বৈশাখীকে দেখে।
মেয়েটা কনসিভ করেছে।
গতকাল বিকেলেই তিনি জানিয়েছেন আষাঢ় আর পিয়াসার বিয়ে হয়েছে।
নিষ্ফল আক্রোশে বৈশাখীর মাথা থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত ফেটে যাচ্ছে যেনো।
রাত থেকে অপেক্ষায় ছিলো কখন সকাল হবে,কখন বাবার বাড়ি আসবে।সকাল হতেই নাশতা না করে চলে এসেছে বোনকে সাথে নিয়ে।
রজনী দুই মেয়েকে খেতে দিলেন।
বৈশাখী খাওয়া বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পিয়াসার দিকে।
পিয়াসার কিছুটা অস্বস্তি হয় এমন করে তাকিয়ে থাকায়।তাই কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো, “আপু,কিছু বলবেন?”
বৈশাখী থমথমে সুরে বললো, “তোমার বাবার নাম কী পিয়াসা?”
হ্যালো 2441139 পর্ব ৫১
পিয়াসা চমকে তাকায় বৈশাখীর দিকে।বৈশাখীর দুই চোখে আগুনের গোলা যেনো।
পিয়াসা বুঝতে পারে ঝড় উঠবে এখন বড়সড়। আফসোস তার,এই ঝড়ে তাকে আবারও একবার ছিন্নভিন্ন হতে হবে বিনা দোষে।
বুকের ভেতর কম্পন টের পায় পিয়াসা।