হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৪

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৪
রাজিয়া রহমান

সিরাজুল ইসলাম আষাঢ়কে ডাকতে গেলেন। যাই হোক না কেনো,তার অসুস্থ মেয়েটাকে তো না খাইয়ে রাখতে পারবেন না তিনি।
সিরাজুল ইসলামের ডাক শুনে আষাঢ় বের হলো। পিয়াসা তৈরি হচ্ছিলো বের হওয়ার জন্য।
সিরাজুল ইসলাম আমতা আমতা করে বললো, “তোর আপা রাগ করে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।একবার আয় তো তুই।তুই ডাকলে হয়তো দরজা খুলবে।”

আষাঢ় যেতে উদ্যত হতেই পেছন থেকে ঝুনি খালা বললো, “যাইয়েন না মামা,আপনার বোইন কইছে আপনি আর পিয়াসা গিয়ে ওর কাউয়ার মতো ঠ্যাং ধরে মাফ না চাইলে ও দরজা খুলবো না।”
সিরাজুল ইসলাম রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই ঝুনি সরে গেলো।আষাঢ় বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “তাই নাকি বাবা?”
সিরাজুল ইসলাম চুপ করে রইলেন।এতো অশান্তি আর সহ্য হচ্ছে না তার।
আষাঢ় স্পষ্ট করে বললো, “আমি অথবা আমার বউ,কেউ-ই যাবো না বাবা।তোমার মেয়ে আগ বাড়িয়ে আমার বউয়ের পেছনে লেগেছে। তাই আমার কোনো দায় পড়ে নি ওর অন্যায় আবদার মেটাতে ওর কাছে যৌথভাবে ক্ষমা চাওয়ার।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোর বোনটা অসুস্থ আষাঢ়। তুই এটুকু বুঝতে পারছিস না কেনো?”
আষাঢ় চমকায়।এই খবরটা ওর জানা ছিলো না। ওকে কেউ জানায় নি।
আষাঢ় ভাবলো যাওয়া উচিত তাহলে। তবে পিয়াসা যাবে না।সে একা যাবে।বৈশাখীর রুমের সামনে এসে দেখে রজনী বসে আছে চুপ করে। আষাঢ়কে দেখে উঠে এসে বললেন,”তুই কেনো এসেছিস?”
“আপা নাকি দরজা বন্ধ করে বসে আছে।”
“বসে থাকুক।সারাদিন বসে থাকুক ও।নাটক করছে ও।তোদের বংশটাই এমন নাটক করার বংশ।আমার একটা জীবন শেষ করছে তোর বাপ,দাদী,ফুফু মিলে নাটক করে করে। এখন আবার আমার ছেলের বউয়ের জীবন নষ্ট করবে তোর বোইন।তোর বাপের মতো ছ্যাবলামি করবি না।যা,পিয়াসারে নিয়ে বের হ।ওর আজকে প্রথম দিন কাজের।তুই ওর কাছে যা।”

আষাঢ় মা’য়ের কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সে না আসলে মা যদি মনে করতো বিয়ে করতে না করতেই সে বোনদের পর করে দিয়েছে।
এখন দেখছে এসেও বিপদে পড়লো।মা’য়ের এমন অগ্নিমূর্তি আষাঢ় আগে খুব একটা দেখে নি।
সিরাজুল ইসলামের মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেলো রজনীর কথা শুনে।
ধমকে বললো, “ফালতু কথা বলবে না রজনী। তুমি এমন কোনো রসগোল্লা না যে তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচার দরকার ছিলো। আমার মা বোনদের সবকিছুতে টানবে না।সব কিছুর একটা লিমিট থাকে।”
রজনীর আজকে ধৈর্য শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।তার দুই মেয়েই দাদী,ফুফুর সব স্বভাব পেয়েছে। বড়জন তো মহুয়া বেগমের কার্বন কপি একেবারে।
রজনী ভেবেছিলো বৈশাখীর বিয়ে হয়ে গেছে যেহেতু তাহলে বৈশাখী আর খুব একটা ঝামেলা করার সুযোগ পাবে না।সে থাকবে তার শ্বশুর বাড়ি।

কিন্তু রজনীর হিসেব ভুল ছিলো। এদের জাতটাই এমন মনে হয়।
কিছুক্ষণ আগে বৈশাখীর হাজব্যান্ড কল করে জানিয়েছে তার স্ত্রী এখানেই থাকবে শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে।ওখানে না-কি বৈশাখীর কষ্ট হয়।সে যেহেতু দেশের বাহিরে থাকে তাই বৈশাখীর জন্য বাবার বাড়ি সবচেয়ে নিরাপদ।
মেয়ের জন্য মনে যেই আদর,ভালোবাসা ছিলো সেটা হুট করে কেমন বিরক্ততে রূপ নিলো।
এই তিরিক্ষি মেজাজে আগুনে ঘি ঢাললো সিরাজুল ইসলামের বলা কথাগুলো।
রজনী গুটিগুটি পায়ে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, “লিমিট ক্রস করলে কী করবে তুমি? কী করতে পারবে?ডিভোর্স দিবে?সেই দরজা ও খোলা আছে।অন্তত আমি মুক্তি পাবো।”
সিরাজুল ইসলাম হেসে বললেন,”না,এসব তোমাদের বংশে হতে পারে। আমাদের বংশে ডিভোর্স হয় না।আমরা আমাদের বংশমর্যাদা মেনে চলি।”

রজনী ক্রুর হেসে বললো, “না প্লিজ,এসব খান্দানী বংশের দোহাই দিও না আর।বরং এটা বলো এই বয়সে ডিভোর্স দিলে ফুল টাইম কাজের বুয়া হাতছাড়া হয়ে যাবে তোমাদের।
বিনা বেতনে শুধু ভাত কাপড় দিয়ে এমন কাজের লোক তো পাবে না।”
বৈশাখী সব শুনতে পেলো। তার ভীষণ আশ্চর্য লাগলো তার মা সে যে না খেয়ে আছে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ও কনসার্ন না।তিনি নিজের কথা বলে যাচ্ছেন কেমন!
এজন্যই মায়ের উপর বৈশাখীর রাগ উঠে।
কোথায় তাকে তেলমালিশ করবে সবাই মিলে তা না করে তারা নিজেদের কথা বলছে।
আষাঢ় বিরক্ত হয়ে বললো, “বাবা কথায় কথায় তোমার এই জাত বংশের বড়াই আর করো না।তোমাদের মতো এই টক্সিক জমিদারি বংশ আর কারো না হোক।যেখানে শান্তিতে নিশ্বাস নেওয়া যায় না।”
“ষ্টুপিড,হয়েছিস তো মা’য়ের মতো।”

“থ্যাংকস আল্লাহ যে আমি আমার মায়ের মতো হয়েছি।তোমার মা’য়ের মতো হই নি তুমি তো হয়েছ তোমার মায়ের মতো। আর তার সুফল তো আমি দেখতেই পাচ্ছি।
মা চলো,এখানে আর থাকার কোনো মানে হয় না।”
রজনী আষাঢ়ের সাথে চলে গেলো। সিরাজুল ইসলাম ও চলে গেলো।একে একে সবাই-ই চলে গেলো। বন্ধ দরজার ও পাশে বৈশাখী চুপ করে বসে রইলো।পেটের ভেতর ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। ক্ষিধেয় জান যায় তার।
কেনো যে রাগ দেখাতে গেলো।
খিচুড়িটা কি দারুণ ছিলো।
এখন খাবে কিভাবে সে!
রেস্টুরেন্টে পা দিতেই ঠান্ডা বাতাসে পিয়াসার মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেলো।ভীষণ ছিমছামভাবে সাজানো রেস্টুরেন্টটি কিন্তু আকর্ষণীয়।

ঘুরে দেখতে দেখতে পিয়াসা দেখতে পেলো অনেকগুলো কবুতরের ছবি।কবুতরের ছবি দেখে পিয়াসার আষাঢ়ের কথা মনে পড়ে গেলো।
আষাঢ় পিয়াসাকে এখানে পরিচয় করিয়ে দিয়েই চলে গেছে।
হুট করেই পিয়াসার মনে হলো বাবা তার জন্য ভুল মানুষ সিলেক্ট করে নি।
নিজের পরিবারের সব নিয়ম নীতির উর্ধ্বে গিয়ে যে মানুষটা সর্বদা তার খুশি/অখুশি নিয়ে ভাবে সে আর যাই হোক,ভুল মানুষ হতে পারে না।

কিন্তু পিয়াসা এটা বুঝতে পারে না সব জেনে বুঝেও কেনো সে আষাঢ়কে আপন করতে পারছে না!
কবে সব ঠিক হবে পিয়াসা জানে না কিন্তু আজকে পিয়াসা খুব করে চায় যাতে সব ঠিক হয়ে যায়।
ম্যানেজার এসে পিয়াসাকে তার কাজ বুঝিয়ে দিলো।পিয়াসা সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিলো।সে ছাড়া ও আর ১২ জন ওয়েটার আছে এখানে।এরমধ্যে ৪ জন মেয়ে,পিয়াসা সহ ৫ জন হলো।
পিয়াসার ডিউটি হলো দ্বিতীয় তলায়।
একজনের অর্ডারের কফির মগ আনতে আনতে পিয়াসার মনে হলো কখনো কি ভেবেছে সে এই কাজ করবে?
না-কি বৈশাখী আপার কথাটাই সত্যি!
তার শেকড়টা যেমন তার কাজে তাই প্রতিফলিত হচ্ছে।
কিন্তু কোনো কাজ -ই কী ছোটো?
কেনো তাহলে কর্ম দিয়ে মানুষকে পরিমাপ করা হয়?
বিকেলের চা-টা আজকে নার্গিস নিয়ে গেলো মহুয়া বেগমের জন্য।
মহুয়া বেগম সকালে ঝামেলার পর থেকে রুমেই বসে আছেন।মনের ভেতর অস্থিরতা। এতো বছর ধরে যেই অহংকার নিয়ে বেঁচে ছিলেন সেই অহংকার মুহুর্তেই গুড়িয়ে দিলো একটা বাহিরের মেয়ে।আর তাকে কি না উড়তে দিয়েছে তার নিজের নাতি।

এই যন্ত্রণা মহুয়া বেগম কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না।
সব ভেঙে চুরমার করে দিতে ইচ্ছে করছে তার।কখনো কি ভেবেছিলেন তার সাম্রাজ্য কেউ এভাবে ভেঙে দিবে?
মহুয়া বেগম ভীষণ অসহায় হয়ে গেলেন।
নার্গিস চা’য়ের কাপ রেখে মহুয়া বেগমের পায়ের সামনে ফ্লোরে বসলো।মহুয়া বেগম রকিং চেয়ারে বসে আছেন।
নার্গিস কোমল গলায় বললো, “আম্মা,কেমন লাগছে আপনার?”
“কেনো?”

“এই যে একটা মেয়ে এই বাড়ির বউ হওয়ার সাথে সাথে দুদিনেই আপনার বাড়ির সব নিয়ম কানুন ভেঙে দিলো।ঢ্যাংঢ্যাং করে চাকরি করতে চলে গেলো। আরো কি যে সেই চাকরি?
একটা হোটেলে মানুষকে খাবার এনে নিয়ে দিবে।মানুষ খেয়ে উঠে ৫-১০ টাকা হাতে গুঁজে দিবে তার।আপনার এই জমিদার বাড়ির বউ হাত পেতে মানুষের থেকে ৫/১০ টাকা নিবে।
কেমন লাগবে আম্মা?”
নার্গিস হাসতে লাগলো। মহুয়া বেগমের কাছে ভীষণ ভয়ংকর লাগলো সেই হাসি।
মহুয়া বেগম নিজের দুই কান চেপে ধরলেন।নার্গিস হাসতে হাসতে বললো, “নিয়ম ভাঙা সবে শুরু হলো আম্মা।পিয়াসা শুরু করে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে এর পরের নিয়ম আমি ভাঙবো আম্মা।কি করবো জানেন?”
মহুয়া বেগম ভীত চোখে তাকালেন।

নার্গিস হেসে বললো, “ডিভোর্স হবে আম্মা।আপনার এই খানদানি বংশে এতো বছর যাবত যা হয় নি তাই হবে।কার ডিভোর্স জানেন আম্মা?মিনির সাথে আমার নির্জনের।
আপনারা মা মেয়ে যেই নোংরা ষড়যন্ত্র করে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়েছেন তা আমি জেনে গিয়েছি আম্মা।কার সুবাদে জেনেছি জানেন?আপনার অপছন্দের পিয়াসার থেকে জেনেছি আমি।কেমন লাগবে আম্মা?লাথি মেরে আপনার মেয়ে,নাতনিদের এই বাড়ি থেকে বের করে দিবো।”
কথাগুলো বলে নার্গিস আর দাঁড়ালো না।সোজা চলে গেলো।
মহুয়া বেগম পরাজিত সৈনিকের মতো তাকিয়ে রইলেন।
চোখ না বন্ধ করেই তিনি দেখতে পাচ্ছেন তার অহংকারের পাহাড় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
মহুয়া বেগম বৈশাখীর রুমে গেলেন।নাতনির সাথে পরামর্শ করতে হবে।
সেখানে গিয়ে দেখেন বৈশাখী কেমন গুম মেরে বসে আছে।

রাগ অভিমান ভুলে বৈশাখী দুপুরে নিজেই খেতে বের হয়েছিলো।খাওয়ার টেবিলে মা তাকে সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছে সে যদি তার ফুফুর মতো আজীবন এই বাড়িতে থাকার চিন্তা করে তাহলে যাতে তা ভুলে যায়।
বিয়ে হয়েছে যখন তাকে শ্বশুর বাড়িতেই থাকতে হবে।এখানে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
বৈশাখী ভেবেই রেখেছিলো মা খুশি হবে।সেও ভবিষ্যতে শিরিন ফুফুর মতো থাকবে।পিয়াসার হাড় মাংস জ্বালিয়ে খেয়ে ওকে বের করে ছাড়বে।
কিন্তু এখন দেখছে মা তাকেই মাঠের বাহিরে বের করে দিতে চাইছে।
মহুয়া বেগম সব শুনলেন।শুনে তার মনে হলো সে আর রজনী দুজনেই শাশুড়ী হয়েছেন।অথচ তাদের চিন্তাভাবনায় অনেক পার্থক্য।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৩

ছেলের বউয়ের সুখের কথা তিনি কখনো ভাবেন নি যা রজনী ভাবছে।
কে তাহলে ভালো শাশুড়ী হতে পেরেছে!
উত্তর খুঁজে পান না মহুয়া বেগম।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৫