হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৬
রাজিয়া রহমান
ভরা পূর্ণিমার রাতটাও আজকে কেমন মেঘাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে।মিনি অপলক তাকিয়ে আছে নির্জনের দিকে।
সিরাজুল ইসলাম শিরিনকে
নির্জন কী বলছে মিনির কানে ঢুকছে না।
নির্জন ৩ বার তালাক শব্দটা উচ্চারণ করলো।ভীষণ ভারী এই শব্দগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে নির্জনের যতটা গলা কাঁপলো,অস্বস্তি হচ্ছিলো,নির্জন খেয়াল করলো বলে ফেলার পর আর গলা কাঁপছে না।শরীর ভীষণ হালকা লাগছে।গলায় বিঁধে থাকা কাঁটাটা যেনো নেমে গেছে।
যেই মিথ্যে অপবাদ, লজ্জা,অস্বস্তি নিয়ে নির্জন এতো দিন বেঁচেছিলো আজ আর তার কিছুই নেই।
নির্জন চলে যেতেই মিনি মাথা নিচু করে ফেলে।দুই চোখ আপনাতে ভিজে উঠেছে।
আজ বহুদিন পরে নির্জন বুক ফুলিয়ে নিজের বেডরুমে প্রবেশ করলো।এতো দিন নিজের রুমে থেকেও চোরের মতো থেকেছে।
বিছানায় শুতেই নির্জনের মিনির কথা মনে পড়লো।
বেঈমান!
দুই দিন আগেও নির্জন যখন কান্না করছিলো,জীবন নিয়ে হতাশায় সুইসাইড করার জন্য নানা উপায় খুঁজছিলো, পাগলের মতো নিজের চুল নিজে টানছিলো তখনও মিনি পাশে বসে ছিলো। মিনি সব বুঝতে পেরেছিলো।নির্জনের লজ্জা,আত্মগ্লানি, অভিমান,অভিযোগ, হতাশা।
রাতভর নির্ঘুম নির্জনকে বসে বসে দেখেছে মিনি।
দিনের পর দিন অভুক্ত থাকতে দেখেছে।তবুও একবারের জন্যও সত্যিটা জানায় নি মিনি।
একবার তো জানাতে পারতো তাকে।
নিজের কাছে নির্জন নির্দোষ থাকতো। মিনি যদি সত্যিটা একবার স্বীকার করে নিতো,ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতো তবে নির্জন হয়তো মিনিকে ক্ষমা করে দিতো।
কিন্তু মিনি তা করে নি। যে সম্পর্ক শুরু হয় মিথ্যা দিয়ে তার পরিণতি তো বিচ্ছেদ- ই হবে।
আজ আর কোনো পিছুটান নেই নির্জনের।কারো মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে আজ থেকে আর লজ্জায় রুমে বন্দী থাকতে হবে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শিরিন রীতিমতো গর্জন শুরু করে দিয়েছে।নাক ফুলিয়ে বললো, “মশকরা পাইছো তোমরা? আমি তোমাদের কাউকে ছেড়ে দিবো না। আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতেছো?
না হয় আমি ষড়যন্ত্র করে নির্জনকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে দিছি তাই বলে সেই সম্পর্ক তোমরা ভেঙে দিবা?আমি মামলা করবো তোমাদের সবার নামে।নারী নির্যাতনের এমন মামলা সাজামু যে তোমাদের দুই ভাই,ভাইয়ের ছেলেদের বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হবে।”
নার্গিস হেসে বললো, “তবুও কি তোমার এই মেয়ে আমার ছেলের বউ হতে পারবে?নাকি তোমার জায়গা এই বাড়িতে হবে?”
সিরাজুল ইসলাম শান্ত সুরে বললেন, “যা,মামলা কর।যা ইচ্ছে কর।তবে এটুকু মনে রাখিস আমি একজন সচিব। আর আমার ভাই একজন এডভোকেট।উকিলের ফি তোর লাগবে, মিরাজের কিন্তু লাগবে না।
থানার এই বারান্দা থেকে ওই বারান্দায় তোকে দৌড়াতে হবে, আমি শুধু একটা কল করলেই যথেষ্ট হয়ে যাবে।
সবচেয়ে বড় কথা এতোক্ষণ যা বলেছিস সবকিছু আমার কাছে ভিডিও করা আছে।তোর নিজের মুখেই স্বীকার করা বিয়েটা তোরা নির্জনকে ফাঁদে ফেলে করিয়েছিস।মামলায় জেতা খুব একটা সহজ হবে না।তোর যা ইচ্ছে কর,এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে বের হ তুই।”
মহুয়া বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজ শিরিন একা যাবে না।ও বের হলে আমি ও বের হয়ে যাবো আমার মেয়ের সাথে। তোরা শান্তি চাইছিলি,শান্তিতে থাক।”
সিরাজুল ইসলাম এতো ড্রামা আর সহ্য করতে পারলেন না।উঠে দাঁড়িয়ে ঝুনিকে বললো, “যা ড্রাইভারকে ডেকে আন।বল শিরিনরা যেখানে যাবে নিয়ে যেতে।মা’র যা যা লাগবে নেয়ার সব গুছিয়ে দে।উনি চলে যেতে চাইলে আমাদের কিছু করার নেই।সারাজীবন আর এতো অশান্তি ভালো লাগে না। যেদিন ফিরে আসতে ইচ্ছে করবে ফিরে আসবেন।”
মহুয়া বেগম এতটা আশা করেন নি।
সত্যি সত্যি সে রাতের ১১টায় শিরিন মেয়েদের আর মা’কে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এলো।
শিরিনরা চলে যেতেই বৈশাখী ফুঁসতে লাগে রাগে।এই মেয়েটা এই বাড়িতে আসার সাথে সাথেই এই বাড়ির যত অমঙ্গল হতে লাগলো।
এই মেয়েটা আসলেই অপয়া।এ সবার মধ্যে ভাঙন ধরাতে চায়।এতো বছর ধরে ফুফু এই বাড়িতে আছে।অথচ এই মেয়ে কাল বউ হয়ে আসতে না আসতে আজকেই ফুফু আর দাদীকে বাড়িছাড়া করে দিলো!
ও এই বাড়িতে থাকপে এই বাড়িতে কোনো শান্তি থাকবে না।
বৈশাখী হনহনিয়ে আষাঢ়ের রুমের দিকে গেলো।পিয়াসা আষাঢ়ের শার্ট-প্যান্ট আয়রন করতে বসেছে।
বৈশাখী রুমে ঢুকেই বললো, “ভালোই তো পরিকল্পনা করলি তুই।”
পিয়াসা পেছনে তাকিয়ে বৈশাখীকে দেখতে পায়। মুচকি হেসে বললো, “আপা আপনি! বসুন।”
“তোএ উদ্দেশ্য কী?”
পিয়াসা হেসে বললো, “আমার উদ্দেশ্য আবার কি হবে?”
“তুই এই বাড়িতে পা দেয়ার সাথে সাথে এই বাড়ির অমঙ্গল শুরু হয়েছে তুই জানিস?”
“না আপা,জানতাম না।তবে এখন জানলাম।”
পিয়াসার শান্ত স্বর বৈশাখীর সহ্য হয় না।বৈশাখী চিৎকার করে উঠে বললো, “একদম কুল সাজার চেষ্টা করবি না তুই আমার সাথে। আমাকে বোকা ভাবিস না তুই।তুই কি ভেবেছিস তুই এই বাড়ির সব নিয়ম বদলে দিবি?”
পিয়াসা আলমারিতে কাপড় রাখতে রাখতে খিলখিল করে হেসে বললো, “ও মা,বদলে দিবো কেনো ভাবতে যাবো।আমি তো বদলে দিয়েছি। দেখলেন না আমি চাকরি করতে যাচ্ছি, আপনার ফুফু এই বাড়ি থেকে আউট হয়ে গেছে, নির্জন ভাইয়ের ডিভোর্স হয়েছে।”
পিয়াসার নির্লিপ্ততা বৈশাখীর মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়।এই মেয়েটা আসলেই সবকিছু করতে পারছে।সব নিয়ম কানুন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে।বৈশাখীর সহ্য হয় না।জীবনে সে ও অনেক কিছু পায় নি এই নিয়ম কানুনের খেলার জন্য।
কোনো দিন বন্ধুদের সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে পারে নি, কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় থাকতে পারে নি,দূরে কোথাও যেতে পারে নি,একটা নিজস্ব ফোন ব্যবহার করতে পারে নি, অনলাইনে ছোট একটা বিজনেস শুরু করেছিলো তা ও রান করাতে পারে নি।
কখনো প্রতিবাদ করতে পারে নি।বাবার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কথা ও বলতে পারে নি কখনো।
দাদীর আদরের জন্য প্রতিবাদ করতে চেয়েও করে নি।
নিজের অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে। অথচ এই মেয়েটা সব পাচ্ছে।
তার উপর তার স্বামীর এতো টাকা ঋণ, অথচ ওর খালাতো ননদের সাথে ভাইয়ের বিয়ে দিতে না পারলে এতো টাকা পরিশোধ করতে হবে।অথচ তার স্বামী তাকে বলে দিয়েছে যদি ভাইয়ের সাথে ওর ননদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে না পারে তাহলে বৈশাখীর সংসার সুখের হবে না।
বৈশাখী এতো পেরেশানি আর নিতে পারছে না।
বৈশাখীর উচ্চস্বর শুনে রজনী আর সিরাজুল ইসলাম দুইজনই বের হয়ে এলেন রুম থেকে।
আষাঢ়ের রুমের দরজার সামনে এসে দু’জনেই শক খান।
বৈশাখী গরম আয়রনটা হাতে তুলে নিয়ে পিয়াসার দিকে এগিয়ে যায়।এই মেয়েকে সে সব পেতে দিবে না।ক্রোধে অন্ধ বৈশাখী আয়রনটা পিয়াসার হাতে লাগানোর মুহূর্তেই সিরাজুল ইসলাম টান দিয়ে ছিনিয়ে নেন আয়রনটা।
রজনী সহ্য করতে না পেরে বৈশাখীর গালে চড় মারেন।
এই মেয়ের এতো অধঃপতন!
আষাঢ়ের ফিরতে আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেলো। ঘড়িতে প্রায় ১২টা বেজে গেছে। কলিং বেল বাজার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো।
পিয়াসা দরজা খুলে দিয়েছে।
পিয়াসার কি কিছু হয়েছে? কেমন যেনো লাগছে পিয়াসাকে আজকে।
আষাঢ় পিয়াসার হাত টেনে ধরে। পিয়াসা কোনো প্রতিক্রিয়া করে না আজকে। বিয়ে হয়েছে দুইদিন হয়েছে অথচ পিয়াসার মনে হচ্ছে দুই যুগ পেরিয়ে গেছে যেনো।ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।
এই বাড়ির মানুষজন এতটা জঘন্য!
পিয়াসার হাত লাল হয়ে আছে।আষাঢ়ের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় মুহুর্তেই।কি হয়েছে এখানে?
বৈশাখী আয়রন মেশিনটা ভালো করে লাগানোর আগেই সিরাজুল ইসলাম ছিনিয়ে নিয়ে যান।তবুও হালকা একটু লেগে যাওয়ায় পিয়াসার হাত ওইটুকু পুড়ে যায়।
আষাঢ় শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোমার হাতে?”
“কিছু হয় নি।হালকা পুড়ে গেছে।”
“কীভাবে পুড়লো?”
পিয়াসা হেসে বললো, “রান্না করতে চেয়েছিলাম শখ করে।শখের তোলা ৮০টাকা।তাই এমন হলো।”
রজনী আর সিরাজুল ইসলাম বসে আষাঢ়ের অপেক্ষায় ছিলো। পিয়াসাকে মিথ্যা বলতে দেখে রজনী বললো, “সত্যি বলার সাহস নেই কেনো পিয়াসা?কেনো মিথ্যা কথা বলছো?আমি বলছি শোন।তোর বোন পিয়াসার হাত পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো বুঝলি।আমি জানি না ওর কিসের এতো ক্ষোভ পিয়াসার উপর।”
আষাঢ় থেমে গেলো।আপা এতো জঘন্য একটা কাজ করেছে?
রজনী আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি কী করবো বল আমাকে?বৈশাখী তো ছোট বাচ্চা না যে ওকে আমি ভয় দেখাবো,শাসন করবো,মারবো।আমি কিছুই তো করতে পারছি না।তার উপর ওর হাজব্যান্ড বলে দিয়েছে ওকে এখানে রাখতে। ওর শ্বশুর বাড়িতে নাকি ও থাকতে পারছে না।ওকে আমি জন্ম দিয়েছি ঠিকই কিন্তু আমার মতো করে গড়ে তুলতে পারি নি।”
সিরাজুল ইসলাম মিনমিন করে বললেন, “তুমি এসব কি বলছো?মেয়েটা এখন অসুস্থ। এই সময় মানুষের কতো রকম চেঞ্জ আসে তোমার তো ভালো জানার কথা। তুমি তো ওর মা।সেখানে তুমি ওর সম্পর্কে এমন কথা বলছো?তাছাড়া আমি নিজেও চাই আমার মেয়ে এখানে থাকুক।তাতে তোমার এতো সমস্যার কীসের?”
“ও আমার মেয়ে আমি জানি।তাই বলে ও আরেক জনের ক্ষতি করার অধিকার ওকে কে দিয়েছে?
আজ যদি তুমি আমি একটু দেরিতে যেতাম কী হতে পারতো তোমার ধারণা আছে?
আর এই সময় মেয়েদের মুড চেঞ্জ হয় বলে কী কাউকে সে খুন করে ফেলবে?সেটা কেমন মুড?তুমি চাও তোমার মেয়ে থাকুক এই বাড়িতে কিন্তু আমি কক্ষনো চাই নি আর চাইবো ও না।যেই আগুনে আমি পুড়েছি পিয়াসাকে সেই আগুনে পুড়তে দিবো না।”
সিরাজুল ইসলাম উত্তর দিতে পারেন না।মাঝেমাঝে তার মনে হয় সন্নাসী হয়ে যাওয়াই সর্বোত্তম উপায় শান্তিতে থাকার।
এই অশান্তি কতো সহ্য করা যায়! রজনী কেনো অবুঝের মতো কথা বলছে তিনি বুঝতে পারেন না।মেয়েটার মুড চেঞ্জ হলে ও তো এমন করবে না।
আষাঢ় চুপ করে পিয়াসার দিকে তাকায়। এই মেয়েটার ভালো খারাপ সবকিছুর জিম্মাদার এখন সে।এই মেয়েটা তার বউ।সবে দুই দিন হয়েছে বিয়ে করেছে অথচ এখনই কি-না ওর উপর নির্যাতন শুরু হয়ে গেছে।
‘“তোমাকে কিছু করতে হবে না মা।আমার বউকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমার যা করার করবো।”
সিরাজুল ইসলাম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”কি করবি?”
আষাঢ় জবাব দিলো না।পিয়াসাকে রেখে নিজে চলে গেলো উপরে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ছোট একটা ট্রাভেল ব্যাগ হাতে নিয়ে।
বাবার সামনে দাড়িয়ে বললো, “বহু বছর আগে মা’কে এই জমিদার বাড়ি নামক বন্দীশালা থেকে উদ্ধার করার জন্য তোমার যা করা উচিত ছিলো কিন্তু তুমি তা করো নি।তোমার কাছে বংশ,নিয়ম,কানুন,তোমার মা’য়ের মিথ্যে অহংকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো নিজের স্ত্রীর চাইতে। আমার কাছে আমার সবকিছুর উর্ধ্বে বাবা।তাই আমি ওর আর কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারবো না।আমি বের হয়ে যাচ্ছি এই বাড়ি থেকে।তোমাদের জমিদার বাড়ির মিথ্যা অহংকার ভেঙে আমি যাচ্ছি।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৫
এসো পিয়াসা।”
পিয়াসার কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে!
কি হচ্ছে এসব!
না-কি সে স্বপ্ন দেখছে!