হ্যালো 2441139 পর্ব ৬২
রাজিয়া রহমান
পিয়াসা আষাঢ়ের হাত ধরে বসে আছে। ভীষণ ঘামছে বসে বসে।আষাঢ় এক হাতে পিয়াসার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।সূর্য মামা ডুবে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। বিকেলের নরম আলো এসে পিয়াসার মুখে পড়ছে।অপ্সরা কেমন হয় আষাঢ় জানে না তবে তার মনে হয় তার পাশে বসে থাকা মেয়েটা অপ্সরা থেকেও কোনো অংশে কম নয়।
তার বিষন্ন,মলিন চেহারায় রাজ্যের বিষাদ জমিয়ে রেখেছে সে।
“এভাবে কতোক্ষণ বসে থাকবে?”
“আমার ভীষণ ভয় লাগছে।আমি কীভাবে ওনার মুখোমুখি হবো?”
“সময় নষ্ট করো না পিয়াসা।মুখোমুখি যখন হতেই হবে তাহলে দেরি করে কী লাভ?তুমি সাহসী মেয়ে।”
পিয়াসা গাড়ি থেকে নামে।আষাঢ় গাড়িতে বসে অপেক্ষা করে। মা মেয়ের মুখোমুখি হওয়ার এই মুহূর্তে আষাঢ় সামনে থাকলে পিয়াসা তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারবে না।
গাড়ি থেকে নেমে পিয়াসা শারমিনকে কল করে।
শারমিন বাসায় ছিলো। দুইদিন পর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে।তার ছুটোছুটির কমতি নেই।
আজকে রাতেই পিয়াসার আসার কথা বাড়িতে।
কল রিসিভ করতেই পিয়াসা জিজ্ঞেস করে, “মা,আমি যে ওনার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তুমি কী কষ্ট পাচ্ছো?তুমি কষ্ট পেলে আমি যাবো না মা।”
শারমিন হাসে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বোকা মেয়ে,আমি কেনো কষ্ট পাবো বল?পারভীন তোকে পেটে ধরেছে, জন্ম দিয়েছে, তার সাথে তোর নাড়িরটান রে মা।মুখে যতোই অস্বীকার করিস তুই,সে তোর মা।তুই ওর মেয়ে এটাই ধ্রুবসত্যি।”
পিয়াসা ঝরঝর করে কাঁদে।
“আমি শুধু তোমার মেয়ে হয়ে থাকতে চাই মা।আমি আর কারো মেয়ে হতে চাই না।৮ বছর বয়সে যিনি আমাকে ছেড়ে গেছেন সেই থেকে এই পর্যন্ত আমার প্রতিটি কষ্টে, দুঃস্বপ্নে,যন্ত্রণায় ভাগিদার তো শুধু তুমি ছিলে মা।”
“তুই যে আমাকে মা বলে ডাকিস,এইটুকুই আমার চাওয়া ছিলো। কেউ তো আমাকে মা বলে কখনোই ডাকে নি।তুই আমাকে মা বলে ডেকে যেই সুখ দিয়েছিস তার কাছে পৃথিবীর সব কিছু তুচ্ছ!তাছাড়া ওর সাথে তোর নাড়ির সম্পর্ক। এই বন্ধন কেউ মুছতে পারবে না।”
“শুধু কী রক্তের সম্পর্কই সব?মায়ার সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক, ভালোবাসার সম্পর্ক কী কিছুই নয়?”
“অনেক কিছু মা।অনেক কিছু বলেই তো আমার কোনো শঙ্কা নেই,ভয় নেই। তুই পারভীনের কাছে গেলেও আমার ভয় নেই,আমি জানি আমার মেয়ের সাথে আমার যেই ভালোবাসার বন্ধন তা কেউ-ই ভাঙতে পারবে না।তাহলে কিসের এতো ভয় তোর বল?”
পিয়াসা ফোন রেখে সামনে এগিয়ে যায়।
কলিং বেলের শব্দে পারভীন এসে দরজা খোলে ।হুট করে পিয়াসাকে দেখে পারভীন কেমন ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। বুকের ভেতর সমুদ্রের উত্তালতায় মেতে উঠে মুহূর্তেই।
দিশেহারা পারভীন ভুলে যায় সে কি করবে বা কি বলবে?
তারপর আচমকা ছুটে এসে ঝড়ের বেগে আছড়ে পড়ে পিয়াসার বুকে।নীরব অশ্রুপাতে পিয়াসার পিঠ ভিজে উঠে।
সাদেক আলী ভেতরে বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন। উঠে এলেন কে এসেছে দেখতে।
পিয়াসাকে দেখে থমকে যান তিনি।
পারভীন কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকেথেকে।
সাদেক আলী নিঃশব্দে আবারও সরে যান।
৬/৭ বছর ধরে যেই কান্না পারভীনের নিত্যসঙ্গী। যার জন্য হাপিত্যেশ করতে করতে পারভীন অস্থির হয়ে যেতো আজ তাকে জড়িয়ে ধরে মন ভরে কাঁদুক।
সাদেক আলীর নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।কেনো সেদিন পিয়াসাকে সাথে নিয়ে এলো না এই অপরাধবোধ তাকে ও যন্ত্রণা দেয়।
কিন্তু সে জানে সে পিয়াসাকে ও মন থেকে নিজের আরেক সন্তান বলে মেনে নিয়েছে।সে যখন আনতে গিয়েছে তখন দেরি হয়ে গেছে।
এতোটাই দেরি হয়েছে যে সেই ক্ষতিপূরণ সাদেক কোনোকিছু দিয়ে দিতে পারে নাই।নিজের স্ত্রীর চোখে সে আজও কাপুরষ।
পিয়াসার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে কিন্তু দুই চোখে চৈত্রের খরা যেনো।
পারভীন পিয়াসার মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “কতো দিন পর!কতো দিন পর তোর সামনাসামনি হতে পারলাম?এতো বছর তো আড়াল থেকেই তোকে চোখের দেখা দেখে এসেছি শুধু। লজ্জায় সামনে যেতে পারি নি।সন্তানের চোখে ঘৃণা দেখার মতো কঠিন এই দুনিয়ায় কিছু নেই।”
“কেনো এভাবে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন?”
পারভীন চোখ মুছে মুচকি হাসে।হেসে বলে, “তোর কাঠগড়ায় আমি আজীবন অপরাধী। তবুও বলবো আমি কিছুই জানতাম না।আমি যখন বুঝেছি ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভাগ্য আমাকে একটু ও দয়া করে নি।আমাকে আজীবনের যন্ত্রণা দিতেই সে তোকে ম্যাডামের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।আমি হতভাগী আমার পিয়াসাকে পেলাম না আর।”
পিয়াসা চুপ করে বসে থাকে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “আপনার উপর আমার অনেক ক্ষোভ ছিলো, অভিমান ছিলো।আমি হয়তো ভুল ছিলাম অথবা আমি আমার জায়গায় ঠিক ছিলাম।যতোদিন পর্যন্ত আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসতে না পারছিলাম ততদিন আপনার অনুভূতি, আপনার যন্ত্রণা আমি বুঝি নি।আমাকে যেদিন আমার মা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলো সেদিন আমি বুঝেছি আপনি হয়তো ততটাও অপরাধী না।
আজ যখন আমি আমার স্বামীকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি এই মুহূর্তে এসে আমার মনে হচ্ছে স্বামীর ভালোবাসা ছাড়া একটা মেয়ের জীবন বৃথা।ধূধূ মরুভূমির মতো নারী জীবন স্বামীর ভালোবাসাতে সুখী হয়ে উঠে।
আপনি তো অনেক ধৈর্য্য ধরে ছিলেন তবুও।আপনার উপর তারপর থেকে আমার আর কোনো অভিমান নেই।একটা সময় বলতাম আপনাকে কখনো ক্ষমা করবো না।আজ আর সেসব নেই।আমি এসেছি আপনাদের ইনভাইট করতে।আমার বিয়ের অনুষ্ঠান আর দুইদিন পর। আপনি আর স্যার আসবেন বাবুদের নিয়ে।”
পারভীন চোখ মুছে বললো, “নিশ্চয় যাবো আমি।”
পিয়াসা উঠে দাঁড়ায়। বের হতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায়।
পারভীনের হাত ধরে বলে, “আপনি যেদিন আমাকে রেখে চলে এলেন,সেদিন আমি সারারাত বাহিরে কাটিয়েছি। আপনার জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। আমার দুনিয়া বলতে তো আপনি ছিলেন শুধু।আমি ঠিক করেছি আপনাকে মা বলে ডাকবো না কখনো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একবার মা বলে ডাকা দরকার। তা না হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না।”
পারভীন কাঁদে।
“মা,ভালো থেকো।”
পিয়াসা বের হয়ে এলো।বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেছে মনে হচ্ছে তার।বের হয়েই পিয়াসা শারমিনকে কল দিয়ে বললো, “মা!”
শারমিনের কলিজা জুড়িয়ে যায়। যে বলেছে সে বন্ধ্যা!
সে ও মা।
পিয়াসা আসার পর পারভীনের কান্না দ্বিগুণ হয়ে গেলো। সাদেক আলী এক কোণে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিজের ভালোবাসার জন্য, ভালো থাকার জন্য পিয়াসাকে এক জন্মের কষ্ট দিয়েছে।
গাড়িতে উঠে পিয়াসা আষাঢ়ের দুই হাত চেপে ধরে।
আষাঢ় হেসে উঠে বলে, “ভয় পেও না।তুমি আমার আজীবনের জন্য।আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না মরণ না আসা পর্যন্ত।”
“আমি আপনার সাথে আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত থাকতে চাই।”
পিয়াসা ভীষণ অস্থির হয়ে থাকে পুরো রাস্তা।
“একটু কান্না কর,ভালো লাগবে তোমার।”
“আমি অনেক চেষ্টা করেছি কান্না করার। পারছি না।আমার বুকের ভেতর ঝড় বইছে অথচ আমি প্রকাশ করতে পারছি না।”
আষাঢ় বউয়ের কপালে উষ্ণ চুমু খায়। চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।”
রাতের আষাঢ় পিয়াসাকে দিয়ে আসে তাদের বাসায়।আষাঢ় আর থাকে না।পিয়াসাকে রেখে চলে আসে।
পিয়াসার শূন্য শূন্য লাগতে শুরু করে আষাঢ় চলে যাওয়ার পর থেকে।
চারদিক থেকে আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করেছে দুই বাড়িতেই।
পিয়াসা বরাবরই সবার সাথে খুব একটা সহজ হতে পারতো না।
এই প্রথমবার পিয়াসা বাবা মা দুজনের দিকের আত্মীয়ের সাথে মন ভরে গল্প করলো।
আসার সময় আষাঢ় তাকে বলেছিলো জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত একটা জার্নি।এই জার্নিটা যতটা পারা যায় উপভোগ করে নিতে হবে।আর একা একা কোনো কিছুই উপভোগ্য হয় না যতক্ষণ না সবার সাথে একাত্ম হওয়া যায়।
পিয়াসা এবার থেকে আর সেই ভুল করবে না।
রাতে কাজিনদের সাথে ডিসাইড করলো হলুদের সময় কোন গানে নাচ করবে,কেমন আউটফিট হবে।
সবার সাথে গল্প করতে গিয়ে ও পিয়াসা বুঝতে পারলো ভেতরে ভেতরে আষাঢ়ের অনুপস্থিতিতে সে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।
রাতে আষাঢ় কল করে। পিয়াসার কাজিনরা সবাই জোর করে কল লাউডে দিয়ে দেয়।লজ্জায় পিয়াসার চেহারা লাল হয়ে যায়।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৬১
আষাঢ় শুকনো গলায় বললো, “এই বিয়ের অনুষ্ঠানের গুল্লি মারি আমি।আমি এক্ষুণি আসছি,তুমি তৈরি হও।আমার কইতরটাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।”
মুহুর্তেই পিয়াসার কাজিনরা সবাই চিৎকার করে হেসে উঠে। আষাঢ় নিজেও নিজের রুমে হেসে উঠে।