হ্যালো 2441139 পর্ব ৬৩
রাজিয়া রহমান
আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে আজ।রাত প্রায় দুটো বাজে।পিয়াসা বসে আছে বাবার কাঁধে মাথা রেখে।
কিছুক্ষণ আগেই খবর পেলো শাহেদ মারা গেছে।
আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “কষ্ট হচ্ছে মা?”
পিয়াসা চুপ করে রইলো।কী উত্তর দিবে সে?কষ্ট হচ্ছে এটা সত্যি কথা। কিন্তু কেনো কষ্ট হচ্ছে তা পিয়াসা বুঝতে পারছে না।
আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের কপালে চুমু খান।
“সকাল ১০ টায় জানাজা। সকালে আমার সাথে গিয়ে একবার দেখে আসবি?”
“আমার ভয় লাগছে বাবা।আমি সব কিছু ভুলে যেতে চাই।ওখানে যেতে চাই না আমি।”
“মৃত মানুষের উপর রাগ করে থাকতে নেই।ক্ষমা করে দিতে হয়।”
“আমার কারো উপর কোনো রাগ নেই বাবা।আমি আমার আল্লাহর কাছে সব অভিযোগ জানিয়ে রেখেছি।আমি ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাগরে ভাসানোর জন্য আল্লাহ ক্ষমা করবেন কী কখনো?”
“তাকদীরে যা আছে তা হবেই।আল্লাহ যখন যেই অবস্থায় রাখে আমাদের সেই অবস্থায় শুকরিয়া করা উচিত।
আল্লাহ চাইলে তোমার অবস্থা আরো করুন হতে পারতো। হতে পারতো আমরা তোমাকে আমাদের মেয়ে করে পেলাম না,তখন?
কিংবা হতে পারতো তোমার বাবা মা একসাথে থাকতো কিন্তু তুমি সারাজীবন ওদের মধ্যকার ঝামেলা,ওখানকার অসুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠতে তখন?”
পিয়াসা মাথা নাড়িয়ে বলে, “আমি জানি বাবা।আমি ও প্রায় সময় ভাবি কী হতো আমার যদি তোমরা আমার বাবা মা না হতে?আমি খড়কুটোর মতো ভেসে যেতাম বাবা।হারিয়ে যেতাম এই পৃথিবী থেকে।আমি আল্লাহর কাছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করি এর জন্য।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তাহলে কাল আমার সাথে যাবে।”
“ঠিক আছে বাবা।”
পরদিন সকালে পিয়াসা আনোয়ার চৌধুরীর সাথে যায়। কতো দিন পর পিয়াসা সেই চিরচেনা আঙ্গিনায় প্রবেশ করে!
সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ জন্মায় পিয়াসার।
আশেপাশের লোকজন সবাই ফিসফিস করে বলতে থাকে, “ওই দেখ, দেখ,শাহেদের মাইয়ারে দেখ!”
“একেবারে মা’য়ের মতো চেহারা হইছে মাইয়ার।”
“আহারে, মাইয়াডার জন্য মায়া লাগে।”
“তবুও ভালো, ডাক্তার সাবে নিজের মাইয়ার মতো পালছে।”
এক একটা মন্তব্য পিয়াসাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় যেনো।
একজন শাহেদের মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে পিয়াসাকে দেখতে দিলো।
পিয়াসা চুপচাপ তাকিয়ে রইলো।
মন বলছে, “দেখে নে ভালো করে নিজের জন্মদাতাকে।এরপর হাশরের ময়দানে আবারও দেখা হবে।তার আগে আর দেখবি না।ঘৃণা করার জন্য ও আর পাবি না খুঁজে। এই জায়গায় একবার গেলে আর আসা যায় না।”
পিয়াসা একেবারে খাটিয়ার কাছে হাটু গেড়ে বসলো।নিজের ডানহাত দিয়ে শাহেদের একটা গাল স্পর্শ করলো।
ভেতর থেকে কে যেনো বলছে, “তুমি আমার জন্মদাতা তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তোমার উপর আমার কতো রাগ,অভিমান তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না।পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ আমার কাছে তুমি ছিলে।একটা সময় কতো কেঁদেছি তোমাকে একবার একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য। বাবার স্পর্শ কেমন হয় তা আমি জানতাম না।
অথচ দেখো,আজ তোমাকে আমি ছুঁয়ে রেখেছি বাবা।
বাবা,তুমি কী তোমার পিয়াসাকে অনুভব করতে পারছো?
আজকের পর আমাদের আর কখনো দেখা হবে না বাবা।আমি আর কখনো তোমাকে স্পর্শ করতে পারবো না।
তুমি আমার জন্মদাতা অথচ তুমি জানো না সন্তানকে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি কেমন হয়!
আর আমি জানতাম না নিজের জন্মদাতা পিতার স্পর্শ কেমন হয়!
আজ এই মুহূর্তে তোমাকে ছুঁয়ে আমি বলছি তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই বাবা।তুমি জন্ম না দিলে এই দুনিয়া দেখতাম না।আমার সাথে অন্যায় অবিচার যাই করেছো সবকিছুর উর্ধ্বে তুমি আমার জন্মদাতা।তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই।
ও আল্লাহ, তুমি শুনে রাখো আজীবন আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা এই মানুষটার উপর থেকে আমি আমার সব অভিযোগ তুলে নিলাম।তার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই।তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা।ও আল্লাহ, তুমি ও আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিও।
আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিও আল্লাহ।
আল্লাহ আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিও।”
পিয়াসার পাথরের মতো অনুভূতিহীন মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও ফিসফিস শুরু হয়ে গেলো।
“দেখ দেখ,বাপটা মরছেবথচ মাইয়ার চোখে এক ফোঁটা পানি নাই।”
“দেইখাই বুঝে যায় শাহেদ মইরা যাওয়ায় খুশি হইছে।”
“ঢং দেখাইতে আসছে এখানে।”
“মানুষ কতো নিষ্ঠুর দেঝ,একটু ও কানলো না!আমরা হইলে কাইন্দা বুক ভাসাইতাম।”
“আরে বুঝস না,বড় লোকের কাছে থাকে,বিয়া ও হইছে বড় বাড়িতে।তাই এখন গরীব বাপের জন্য চোখে পানি আসে না।”
পিয়াসা সব শুনলো।অথচ কেউ জানে না এই মেয়েটা হাজার চেষ্টা করে ও কান্না করতে পারে না।
অথচ বুকের ভেতর কান্নারা জমতে জমতে পাহাড় সমান হয়ে গেছে। সেই পাহাড়ের চাপে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে পিয়াসা।
পিয়াসা পুকুর ঘাটে নিশ্চুপ বসে থাকে।শাহেদকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানাজার জন্য।
পুরো বাড়ি খাঁখাঁ করছে।
আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে। জমিরন মারা গেছে কিছু মাস আগে।
মালিহা,সাবিহা কেউ-ই নেই।জমিরন মারা যাওয়ার আগে মালিহা মা’য়ের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে।
আর সাবিহার বিয়ে হয়েছে অন্য বিভাগে।সে হয়তো খবরও পায় নি।
পিয়াসা ধীর পায়ে হেটে যায় পুকুরের উত্তর দিকে ঘন জঙ্গলের ভেতর।
পেয়ারা গাছটা আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।
পিয়াসা কিছুক্ষণ পেয়ারা গাছটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে সবদিকে।
জানাজা শেষ করে আনোয়ার চৌধুরী পিয়াসাকে খুঁজতে আসেন।পুরো বাড়িতে কোনো মানুষ নেই।পিয়াসা ও নেই।আনোয়ার চৌধুরীর বুক কেঁপে উঠে।
চিৎকার করে পিয়াসার নাম ধরে ডাকতে থাকে।
বাবার ভয়ার্ত স্বর শুনে পিয়াসা ছুটে আসে।আনোয়ার চৌধুরীর দুই চোখ ভিজে উঠে।
তার শুকনো মরুভূমির মতো জীবনে এই তো সেই শীতল ছায়া।
পিয়াসা বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাগ্য এক বাবাকে তার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
আরেক জনকে পিয়াসা হারাতে চায় না।
আনোয়ার চৌধুরী যেতে যেতে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “শাহেদের উপর এখনো ক্ষোভ আছে?”
“না বাবা।আর কারোর উপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই।আমার আল্লাহ ও যেনো ওনাকে ক্ষমা করে দেন।”
আনোয়ার চৌধুরী হাসেন।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা ১১টা বেজে গেছে। পিয়াসা নিজের ফোনটা রেখে গেছে।
এসে দেখে ৩০+ মিসড কল আষাঢ়ের।
পিয়াসার মন ভীষণ এমনিতেই খারাপ ছিলো। আষাঢ়ের কল দেখে পিয়াসার মনটা আনন্দিত হয়ে উঠে কিছুটা।
পিয়াসা কল ব্যাক করার আগে আবারও কল আসে।
পিয়াসা কল রিসিভ করতেই আষাঢ়ের ব্যতিব্যস্ত গলার স্বর শোনা গেলো, “কেমন আছো?”
“আমি একটুও ভালো নেই।আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমার বুকের ভেতর ভীষণ ঝড় জানেন।আপনি কী আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন?আমার অশান্ত হৃদয়টা তাতে যদি একটু শান্ত হয়!”
“আচ্ছা, তুমি ছাদে যাও।ওখানে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
পিয়াসা ফোন কানে নিয়ে ছাদের দিকে গেলো।ছাদের দরজার ছিটকিনি খুলে পিয়াসা দরজা খুলে ছাদে পা রাখতেই ভয়ানক চমকায়।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণনাথ!
এলোমেলো চুল,আয়রন ছাড়া পাঞ্জাবিটা কুঁচকে আছে।অথচ তবুও মনে হচ্ছে সে যেনো কোনো অজানা রাজ্যের রাজকুমার।
পিয়াসা আর এগুতে পারছে না।এই হঠাৎ পাওয়া সারপ্রাইজে পিয়াসার আনন্দ আর ধরে না।
আষাঢ় ছাদের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।পিয়াসাকে জমে যেতে দেখে আষাঢ় ছুটে এলো।কোলে তুলে নিয়ে ঘোরাতে লাগলো নিজের স্ত্রীকে।
পিয়াসা শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে।
বুকের ভেতরের যন্ত্রণা আস্তে আস্তে ফিঁকে হয়ে আসছে।
আষাঢ় পিয়াসার কপালে চুমু খায়।
“কখন এলেন?”
“ সকাল ৮টার দিকে।”
“কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ?”
হ্যালো 2441139 পর্ব ৬২
“জানাজায় অংশ নিতে এসেছিলাম।ভাবলাম তোমাকেও সেই সাথে একটু চমকে দিই।আমার কইতরটাকে ছাড়া বুকের ভেতরের জায়গাটা কেমন খাঁখাঁ করছে।এই বিয়েসাদীর অনুষ্ঠান ক্যান্সেল। চলো না বউ,সবাইকে ফাঁকি দিয়ে দুজন দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি?”
পিয়াসা চোখ বন্ধ করে বললো, “আপনার সাথে আমি দুনিয়ার সবখানেই যেতে রাজি।”
আষাঢ় পিয়াসাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে।