হ্যালো 2441139 পর্ব ৬৪

হ্যালো 2441139 পর্ব ৬৪
রাজিয়া রহমান

দুপুরের দিকে প্রচন্ড গরম পড়তে শুরু করে। আষাঢ়ের বুকে মাথা রেখে পিয়াসা শুয়ে আছে বিছানায়।
আষাঢ় চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো, “মন ভালো এখন?”
পিয়াসা উত্তর দেয় না।এই মানুষটা পিয়াসাকে যতটা খেয়াল করে পিয়াসার মনে হয় সে নিজেও ততটা খেয়াল করে না নিজেকে।পিয়াসার আজকে মন খারাপ থাকবে আষাঢ় জানে।তাই লাজ লজ্জা ভুলে সে পিয়াসার কাছে ছুটে এসেছে। নয়তো একদিন পরে বিয়ের অনুষ্ঠান সেখানে আষাঢ় এভাবে আসতো না কখনোই। কিন্তু যখনই বুঝতে পেরেছি শাহেদের মৃত্যুর খবর পিয়াসাকে আবারও দুমড়ে মুচড়ে দিবে তখনই সিদ্ধান্ত নিলো পিয়াসার কাছে আসার।
আষাঢ় দুপুরের দিকে চলে গেলো। আষাঢ় যতক্ষণ ছিলো পিয়াসার নিজেকে ভীষণ নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছিলো।আষাঢ় চলে যাওয়ার পর পিয়াসার আবারও একাকী মনে হতে লাগলো নিজেকে।এতো মানুষের ভীড়ে ও কেমন অজানা যন্ত্রণা বুকের ভেতর তুফানের মতো আছড়ে পড়ছে বারবার।

বিকেলের দিকে পারভীন এলো।শাহেদের মৃত্যু সংবাদ জেনে পারভীন বিচলিত হলো না।যে তার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছে সে বেঁচে থাকলেও পারভীনের কিছু আসে যায় না মরে গেলেও না।
সময় যেনো চোখের নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। শারমিন রান্নাঘরের মেঝেতে বসে নীরবে চোখের জল মুছছে।
দুনিয়ায় কন্যা বিদায় দেওয়ার মতো এতো নিষ্ঠুর একটা নিয়ম কেনো হলো?
কেনো আদর করে বড় করে তোলা জীবন্ত পুতুলটাকে তুলে দিতে হয় অন্যের হাতে!
এতো কঠিন কাজ কেনো বাবা মা’কে করতে হয়।
পিয়াসা মা’য়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পিয়াসার চোখ ও ভেজা।
কেমন এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার।
ডাইনিং টেবিলে বসে পারভীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিয়াসা আর শারমিনের দিকে।আজকে শারমিনের জায়গায় সে থাকতো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পিয়াসা তার গলা জড়িয়ে ধরে থাকতো।
পারভীনের কষ্ট হয়,ভীষণ কষ্ট!
বুকের ভেতর জ্বলুনি বাড়তে থাকে।১০ মাস ১০ দিন সে পিয়াসাকে পেটে রেখেছে। ১২ বছর ধরে আগুনে পুড়েছে পিয়াসাকে নিরাপদ রাখার জন্য। অথচ আজকে পিয়াসা মা বলে গলা জড়িয়ে ধরছে অন্য কারো!
পারভীন ভেবে পায় না তার কী অপরাধ ছিলো!
তাকে কেনো এতো কিছু সহ্য করতে হচ্ছে।
পিয়াসা শারমিনের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।মা’য়ের কান্না পিয়াসাকে অস্থির করে তুলছে।এতো অস্থিরতা পিয়াসা নিতে পারছে না।
সাদেক আলী আসে নি। পারভীন ও জোর করে নি আসার জন্য। পারভীন জানে না সে কীভাবে এই সংসার করছে।বুকের ভেতর কতো যত্নে পিয়াসাকে আগলে রেখেছিলো সে।
এই মানুষটার জন্য মেয়েটাকে পারভীন হারিয়ে ফেলেছে। হারানো রতন যে একবার হারালে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

পারভীন জানে না আজ কেনো তার এতো কষ্ট হচ্ছে!
সে তো এতো বছর পিয়াসাকে ছাড়াই বেঁচে ছিলো। বুকের ভেতর পিয়াসা আজীবনের জন্য কাঁটার মতো আটকে আছে,ছিলো,থাকবে।
তার এতো আদরের পিয়াসা আজ অন্য কারো কোলে মাথা রেখে কাঁদছে।
পারভীন ভেবে পায় না তার এতো হিংসা হচ্ছে কেনো!এতো বছর পর এসে কেনো মন এতো বিদ্রোহ করছে?
পারভীন আর সহ্য করতে পারছে না। মনের সাথে লড়াই করতে না পেরে পারভীন সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।
নিজের এই অবাধ্য অনুভূতির সাথে পারভীন আগে পরিচিত ছিলো না।
ছাদে গিয়ে পারভীন চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।নিজের এমন ছোটলোকি ব্যবহারের জন্য নিজেই লজ্জায় মরে যায়।

বিয়ের দিন অঘটনটা ঘটে গেলো।সকাল সকাল সবাই রওয়ানা হলো পিয়াসাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বরের গাড়িতে আষাঢ় আর নির্জন দুই ভাই যাচ্ছে। বাকি গাড়িতে বাকিরা সবাই।
গাড়িতে উঠেই পিয়াসাকে কল দিয়ে বললো, “তৈরি থেকো,আমার খাঁচায় তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দী করে নিয়ে যেতে আসছি।সময় গুণতে থাকো কইতর,আজকের পর থেকে তোমাকে আর এক মুহুর্তের জন্য এই খাঁচা থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই।”

পিয়াসার মন খারাপ। বাবা মা’কে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আজকে বাবা মা তাকে বিদায় দিবে।কী ভয়ংকর একটা দিন।
কাউকে ছেড়ে কাউকে আপন করে নিতে হবে।
বরপক্ষ আসতে আসতে বেলা ১২টা বেজে গেলো।পথে বরের গাড়িটা একটু সমস্যা হওয়ায় পিছিয়ে যায়।
বরের গাড়ি এলো আরো মিনিট বিশেক পরে।
ড্রাইভার তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে এলো। ড্রাইভারের সাথে সাথে নির্জন ও বের হলো গাড়ি থেকে।
নির্জনকে দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
নির্জনের কপাল ফেটে র ক্ত বের হচ্ছে।
মহুয়া বেগম অস্থির হয়ে বললো, “কি হয়েছে দাদুভাই কোথায়?”

“দাদী,সর্বনাশ হয়ে গেছে। আষাঢ়কে কারা যেনো পথ থেকে তুলে নিয়ে গেছে আমাকে আহত করে।”
মুহুর্তেই পুরো বিয়ে বাড়ির আনন্দ মাটি হয়ে গেলো। পুরো বাড়িতে মরিচ বাতি জ্বলজ্বল করছে। চারদিকে যে উৎসবের আমেজ ছিলো এক নিমিষে তা হারিয়ে গেলো।
পিয়াসা স্টেজে অপেক্ষা করছিলো আষাঢ়ের জন্য।
লাল শাড়িতে পিয়াসাকে কেমন লাগছে পিয়াসা জানে না।এখন পর্যন্ত আয়না দেখে নি পিয়াসা।আষাঢ়ের চোখে নিজেকে দেখবে বলে অপেক্ষা করে আছে সে।
আনোয়ার চৌধুরী নিষেধ করলেন পিয়াসাকে যাতে কিছু না জানানো হয়।নয়তো পিয়াসা ভেঙে পড়বে।
কিন্তু কথা বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিয়াসার কানেও পৌঁছে গেলো আষাঢ়কে কারা তুলে নিয়ে গেছে গাড়ি থেকে।
ছাদেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।

পিয়াসা ছুটে নেমে এলো ছাদ থেকে। আষাঢ়দের বাড়ির সবাই উপস্থিত শুধু আষাঢ় নেই।
পিয়াসা হতভম্ব হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে বাবা?”
আনোয়ার চৌধুরী মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন,”চিন্তা করিস না।আষাঢ়কে আমরা ঠিকই খুঁজে পাবো।”
সিরাজুল ইসলাম ততক্ষণে চারদিকে লোক লাগিয়ে দিয়েছেন।থানা,পুলিশ সব জানানো হয়ে গেছে। সিরাজুল ইসলাম আর মিরাজুল ইসলাম ঢাকার দিকে রওয়ানা দিলেন আবার মেহমানদের রেখে।
পিয়াসার বুক কাঁপছে ভীষণ।
আষাঢ়কে কী সে হারিয়ে ফেলবে চিরতরে?
কতো কথা বলার আছে তার আষাঢ়কে।সেসব কী আর বলা হবে না?

দুই হাত চেয়ারের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে আষাঢ়ের।পা বাঁধা হয় নি।চারদিকে ভ্যাপসা গন্ধ। মাথার জোরে শব্দ করে একটা ফ্যান ঘুরছে।অল্প আলোর একটা লাইট জ্বলছে মাথার উপর।
আষাঢ় এদিক ওদিক তাকায়।
জায়গাটা কোথায়?
কে এনেছে তাকে এখানে?
রাশেদ?
যে-ই আনুক,কাঁচা কাজ করেছে।তার উচিত ছিলো আষাঢ়কে সুযোগ পাওয়া মাত্রই শেষ করে দেওয়া।
আষাঢ় সচেতন হয়।

দুই হাত ভীষণ শক্ত করে বেঁধে রাখা। দড়ির জোর বাঁধনে আষাঢ়ের হাত কেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে তার।
আষাঢ় হাতটা উপর নিচ করে চেয়ারটা ভালো করে অনুভব করতে চায়।
পুরনো ঘুণধরা একটা চেয়ার।
উপর নিচ করতে করতে আষাঢ় টের পায় একটা পেরেকের কিছুটা বের হয়ে আছে।
আষাঢ় এক নাগাড়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।
বিপদে আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই আষাঢ় ছোট বেলা থেকে বিশ্বাস করে। যখন যেখানে আটকেছে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছে।
আল্লাহ না চাইলে সে পিয়াসাকে পেতো না।সে আর আল্লাহ জানে কতো প্রার্থনা করেছে সে পিয়াসাকে আপন করে পাবার জন্য।

আর আজ সেই আনন্দের দিনে কি-না তাকে কেউ আটকে রাখবে?
আষাঢ় বিশ্বাস করে আল্লাহ সহায় থাকলে কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।
দুই হাতের মাঝখানের দড়িটা পেরেকের সাথে ঘষতে থাকে আষাঢ়।
একবার, দুইবার, তিনবার…
অনবরত ঘষতে ঘষতে ঘেমে যায় আষাঢ়।
টুপটাপ করে ঘাম ঝরে পড়ে। আষাঢ় থামতে পারে না। সকালে যখন পিয়াসার সাথে কথা বলছিলো পিয়াসা তখন বলছিলো আষাঢ় গিয়ে তাকে না দেখা পর্যন্ত পিয়াসা আয়না দেখবে না।আষাঢ়ের চোখেই সে নিজেকে দেখবে আজ।
আষাঢ়ের বুকটা ভারী হয়ে আসে।
পিয়াসা কী করছে এখন?

সে যে কষ্ট পেলেও কাঁদতে পারে না। যন্ত্রণায় ছটফট করে শুধু।
ভাবতে ভাবতে আষাঢ়ের দুই হাত তার গতি বাড়ায় আরো।
সময় কতো এখন আষাঢ় জানে না।
পেরেকের সাথে দড়ির সাথে সাথে মাঝেমধ্যে নিজের হাত ও কেটে যাচ্ছে।
আষাঢ় সেসব নিয়ে ভাবে না।আজকে তার প্রেয়সী তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।
তাকে সে কষ্ট দিতে পারবে না।
অনেকক্ষণ পর আষাঢ় টের পায় হাতের বাঁধন হালকা একটু ঢিলে হয়েছে।
আষাঢ় আবারও চেষ্টা করতে থাকে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৬৩

অনেকক্ষণ পর আষাঢ়ের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।
বাহিরে কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আষাঢ় প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
দরজা খুলে ভেতরে যেই মানুষটা প্রবেশ করে তার জন্য আষাঢ় প্রস্তুত ছিলো না।
হতভম্ব হয়ে যায় আষাঢ় দেখে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ৬৫