অতঃপর তুমি আমি পর্ব ১৯

অতঃপর তুমি আমি পর্ব ১৯
লেখিকা: ইশা আহমেদ

রাত দশটার সময় বাড়িতে প্রবেশ করে শেহজাদ। আজ দিনটা তার প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেটেছে। রোগীর সংখ্যা যথেষ্ট বেশি ছিলো আজ অন্যদিনের তুলনায়। ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে উপরে নিজের রুমে আসলো।রুমে প্রবেশ করতেই ক্লান্তিরা সব উবে গেলো।চোখ মুখে ধরা একরাশ মুগ্ধতা।তার প্রেয়সী বিছানায় ঘুমিয়ে আছে গুটিসুটি মেরে। প্রেয়সীর মুখখানা দেখে বুঝি এতো প্রশান্তি লাগে। হৃদয় জুড়িয়ে যায়। শেহজাদ দিন দুনিয়া ভুলে দেখতে ব্যস্ত প্রেয়সীকে। ওয়ামিয়া হালকা নড়েচড়ে উঠে। শেহজাদ নিজেও নড়েচড়ে উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ওয়ামিয়া এখনো ঘুমাচ্ছে। মিষ্টি হেসে রুম ত্যাগ করে শেহজাদ। সকাল বিকাল প্রেয়সীর মুখটা তো দেখতে পাচ্ছে এটাই অনেক তার কাছে। নিচে নামতেই মেহবুবা খান শেহজাদকে দেখে বলেন,
‘কিরে ওয়ামিয়া কোথায়?সন্ধ্যায় সেই উপরে গিয়েছে এখন ও আসলো না যে’
শেহজাদ মনে মনে ভাবলো,,’তাহলে ম্যাডাম না খেয়ে ঘুমিয়ে আছেন।আর আমি ভাবলাম আমাকে ইগনোর করার জন্য ঘুমিয়েছে’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ফুপি তুমি খাবার রেডি করো আমি ডেকে নিয়ে আসছি। ও ঘুমিয়ে ছিলো তাই ভেবেছি খেয়েই ঘুমিয়েছে’
শেহজাদ রুমে আসে।ওয়ামিয়া এখনো ঘুমিয়ে আছে। শেহজাদ ওয়ামিয়ার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে ফ্লোরে বসে পরে।বিড়বিড় করে বলে,

‘তুমি আমার! একান্তই আমার।তোমাকে এভাবে দেখার অধিকার ও শুধু আমার। ভালোবাসি প্রেয়সী। ভীষণ ভালোবাসি’
ওয়ামিয়া নড়েচড়ে উঠে পিটপিট করে চোখ খুলল। সামনে শেহজাদকে দেখে ঘাবড়ে যায়। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে।শেহজাদ দাঁড়িয়ে পরে। ওয়ামিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে।শেহজাদ শান্ত কন্ঠে বলে,
‘না খেয়ে ঘুমিয়েছ কেনো?হাত মুখ ধুয়ে এসো খেতে যাবে’

ওয়ামিয়া উঠে শাড়ি ঠিক করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে শেহজাদ যাইনি নিচে। সে চুলগুলো হাত খোপা করতে যাবে তখনই তার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ বলে উঠেন,
‘তোমাকে খোলা চুলেই ভালো লাগে প্রেয়শী। আমার কেশবতী তুমি।’

শেহজাদ আনমনেই কথাটা বলে ফেলেছে। নিজেই থতমত খেয়ে যায় নিজের কাজে।ওয়ামিয়া হতভম্ব হলেও দ্রুত খোঁপা করে রুম ত্যাগ করে। শেহজাদের কন্ঠে কিছু একটা আছে যা শুনলে ওয়ামিয়ার হৃদয়ে ঝড় উঠে। শেহজাদ ও পা বাড়ায় নিচে যাওয়ার জন্য।নিচে আসতেই দেখে সবাই একসাথে হাসি ঠাট্টা করে খাচ্ছে। শেহজাদ ও বসে পরে। ইফাজ শেহজাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। হাসার কারণ তার কঠোর ব্যক্তিত্বের ভাই যে কিছুদিন ধরে খুশিতে আছে। না হাসলেও ইফাজ বুঝতে পারে তার ভাই ভালোবাসার মানুষ, নিজের প্রেয়সীকে পেয়ে আনন্দে আছে।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই নিজের রুমে চলে আসে। ওয়ামিয়ার ঘুম আসছে না। অনেকটা সময় ঘুমিয়েছে সে। ধীর পায়ে হেঁটে বারান্দায় আসলো।বারান্দায় মানি প্লান্ট গাছ দিয়ে সাজানো। দুটো চেয়ার রাখা একপাশে। সেখানের একটায় বসে পরলো ওয়ামিয়া। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় আলোকিত চারপাশ। ওয়ামিয়া শরীর এলিয়ে দিলো চেয়ারে। কবে এসবের অবসান ঘটবে কে জানে! হাঁপিয়ে উঠেছে সে এইসব জিনিসে।

শেহজাদ হাঁসফাঁস করছে প্রেয়সীর কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কোথাও একটা বাঁধছে। এতো অবহেলা করেছে সে তাকে। যে এখন চাইলেও তার সামনে দাঁড়াতে অস্বস্তি হচ্ছে। নিজের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করেই শেষে বারান্দায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। যেই শেহজাদ কাউকে ভয় পায় না সে আজ নিজের প্রেয়সীর সামনে যেতে অস্বস্তি বোধ করছে। ধীর পায়ে বারান্দায় আসলো শেহজাদ। ওয়ামিয়া এক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
শেহজাদ প্রেয়সীর থেকে কয়েক হাত দূরে বসলো চেয়ার টেনে। ওয়ামিয়া না তাকিয়েই বললো,,,,

‘আপনি এখানে যে?’
‘তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি’
‘কথা!কি বলবেন ডাক্তার সাহেব’
এই প্রথম ওয়ামিয়া তাকে ডাক্তার সাহেব বলে সম্মোধন করছে। শেহজাদ ভাই শুনতে শুনতে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পরেছিল সে। তবে আজ প্রেয়সীর মুখে অন্য ডাক শুনে হৃদয়ে শীতল ঢেউ বয়ে গেলে।প্রেমে তো সে আজ থেকে কত বছর আগেই পরেছে তার সামনে থাকা রমনীতে। সে যে এই নারীতেই নিবদ্ধ। শেহজাদ করুন কন্ঠে বলে,

‘ক্ষমা! হ্যাঁ ক্ষমা করে দাও প্রেয়সী। তোমার অবহেলা আমায় ভীষণ ভাবে পোড়াচ্ছে।’
ওয়ামিয়া হাসলো। এই হাসিতে ছিলো এক বুক অভিমান।যা সে তার শখের পুরুষের উপর করেছে। লোকটা তাকে বুঝে না কেনো। ওয়ামিয়ার হাসিটা দেখলো শেহজাদ। বুকে চিন চিন ব্যাথা করছে। প্রেয়সীকে কি তাহলে সে গভীর ভাবে আঘাত করে ফেলেছে। ওয়ামিয়া চাঁদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকালো তার পাথর মানবের দিকে।

‘আমার দু’দিনের অবহেলা সহ্য করতে পারছেন না ডাক্তার সাহেব আর আমি গত এক বছর যাবত আপনার দেওয়া প্রত্যাখান মেনেও বার বার ছুটে এসেছি আপনার কাছে। তখন আমি পুড়িনি। আমার হৃদয়টাও ছাড়খার হতো।’
‘আমি জানি প্রেয়সী আমি ভয়ংকর ভাবে আঘাত করে ফেলেছি তোমায়।আমি সত্যি পারছি না। আমায় একবারে কোনো শাস্তি দেও এমন ক্ষণে ক্ষণে পুড়িও না’

‘ আপনার শাস্তি এটাই।প্রেয়সীকে নিজের বউ রূপে পেয়েও তাকে স্পর্শ করতে পারবেন না আর না তার সাথে দু দন্ড ভালো কথা বলতে পারবেন’
চারপাশ নিস্তব্ধ। শেহজাদ নিজেও স্তব্ধ। মেয়েটা তাকে এই শাস্তি দিলো তবুও ভালো দূরে তো যাইনি। এতোগুলো বছর গভীর যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সে। মনে হতো প্রেয়সী বড় হয়ে যদি অন্য কাউকে মন দিয়ে ফেলে তখন! ভরসা ছিলো তার তবুও মনের এক কোনে কোথাও না কোথাও একটু ভয় করতো।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। দু’জনের কেউই কথা বলছে না। ওয়ামিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আর শেহজাদ মাতা নিচু করে আছে।অনেক সময় পার হওয়ার পর যখন সে ওয়ামিয়ার দিকে তাকায় তখন দেখে প্রেয়সী ঘুমিয়ে আছে। শেহজাদ হাসে।দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে।

‘তুমি আমার সেই যন্ত্রণা প্রেয়সী যা আমাকে ক্ষণে ক্ষণে পোড়ায়।ভয়ংকর ভাবে পোড়ায়’
শেহজাদ উঠে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় নিজের প্রেয়সীকে। এরপর নিজে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে শুয়ে প্রেয়সীর মায়াবী মুখখানা দেখতে থাকে। সে হাজার বছর পার করতে পারবে এই মুখ খানা দেখে।
‘ অতঃপর এতো কিছুর পরে আমি তোমায় পেলাম তবুও দূরত্ব রয়ে গেলো আমাদের মাঝে যোজন যোজন’

রামিশা আর মাহিম দুজনে নিজেদের ছোট্ট বারান্দায় বসে আছে।রামিশা মাহিমের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে।দুজন বেশ কিছু ক্ষন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছে।তাদের সম্পর্কটা এখন স্বাভাবিক।রামিশা মাহিম নামক লোকটির প্রেমে পরেছে,ভালোও বাসে।রামিশা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মাহিম আপনার পরিবারের সবাইকে তো চিনি না কে কে আছেন মানে এই ধরুন আপনার চাচাতো চাচা,খালামনি মামা?’
‘আমার খালামনি আছেন একজন।খুব ভালো তিনি। বিয়েতে কিছু কারণে আসতে পারেননি।আর আমার বাবার তিনজন চাচাতো ভাই আছেন।ইমন শেখ,তার বড় ভাই আফজাল শেখ আর আরেক চাচাতো ভাই হামজা শেখ। আর মামা নেই আমার’

‘আচ্ছা ইমন শেখ আফজাল শেখ হামজা শেখ কোথায়?’
‘তারা এই গ্রামেই থাকে।তবে ইমন শেখের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। সে এক বছর যাবত কোথাও নেই।মানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে উড়ো কথা শুনেছি সে নাকি দুই গ্রাম পরে এক জায়গায় থাকেন। তবে তিনি বিয়ে করেননি’
‘আপনার কি ওয়ামিয়ার কথা মনে পরছে না’

‘বাদ দাও রামিশা চলো ঘুমিয়ে পরবে।অনেক রাত হয়েছে।’
মাহিম উঠে চলে যায়।রামিশা বুঝতে পারে মাহিম ইগনোর করলো কথাটা।বোনকে যে সে প্রচন্ড মিস করছে এবং চিন্তায় আছে তা ভালোই বুঝতে পারছে।সে নিজেও উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরে। কাল সকাল সকলই ওয়ামিয়াকে খবরটা জানাতে হবে। হয়তো কাজে লাগতে পারে তার।

ইফাজ রুমে বসে ফোনে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো।তখনই অজিফার একটা ছবি সামনে আসে। ছবিটা দেখে বেশ ভালো লাগে তার।আইডির ভেতরে ঢুকে। আইডিতে ঢুকতেই ভীষণ বিরক্ত হয় সে। মেয়েটা এতো পোস্ট শেয়ার করে। ফটো অপশনে গিয়ে ছবিগুলো দেখে। বেশ ভালো লাগে তার। মেয়েটা দুষ্ট হলেও মনটা ভালো আছে। অজিফার সাথে দেখা হওয়ার দিনগুলোর কথা ভাবলো সে। মেয়েটা সুন্দরী আছে। তাকে পছন্দ করে মনে হয়।ইফাজের সেদিনের কথা মনে পরলো।

প্রেমিকা আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই সে আছে বলে গটগট করে হেঁটে চলে এসেছিলো। তবে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিলো একবার অজিফার দিকে।তখন সে দেখতে পায় মেয়েটা ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে আছে। হেসেছিলো বেশ।তখনই ফোনে টুং করে মেসেজ আসে।মেসেজ ওপেন করতেই দেখে তাতে লেখা,

অতঃপর তুমি আমি পর্ব ১৮

‘কি ইফাজ সাহেব রাত জেগে কি আমার কথা ভাবছেন’
ইফাজ দুষ্টমি করে বলে,,,,’তোমার কথা!মজা পেলাম’

অতঃপর তুমি আমি পর্ব ২০