অনুভবে তুই পর্ব ১২

অনুভবে তুই পর্ব ১২
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

আদ্রিশ আর রোজার রুমের ব্যলকনি মুখোমুখি, কিন্তু কয়েক গজ দূরে। এক ব্যলকনি থেকে অন্য ব্যলকনিতর সবকিছুই দেখা যায়। একটা সময় রোজাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফেলে আদ্রিশ। আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রোজা সেটা ধরতে পেরেই এমন একটা ভান করে যেন আদ্রিশকে সে দেখতেই পায় নি, ধীরস্থিরভাবে চুপ করে রুমে আসার জন্য পা বাড়ায়। তখনই আদ্রিশ গমগমে স্বরে ওকে ডাক দেয়, ‘এইযে, পালাচ্ছো কোথায়?’

রোজা সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। চেহাতার কাঠিন্যভাবটা বজায় রেখে থেমে থেমে বলে, ‘কো-থা-য় পালাচ্ছি?’
ভ্রু কুঁচকে আদ্রিশ জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যিই পালাচ্ছো না?’
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রোজা উত্তর দেয়, ‘উহু, একদম-ই নয়।’
‘তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো।’
রোজা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, ‘কেন দাঁড়িয়ে থাকবো? এখানে তো আমার কোনো কাজ নেই।’
আদ্রিশ হাতের নিউজ পেপারটা চারভাগ করে ভাঁজ করে রাখে কোলের ওপর। তারপর বলল, ‘তুমি আজ ভার্সিটিতে যাও-নি?’
‘না।’
‘কোনো সমস্যা?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রোজা বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই যাই নি। এসব বিষয়ে প্রশ্ন করার মানে দেখছি না। আর হুটহাট এভাবে ডাকবেন না আমাকে। আপনি ছোট বাচ্চা নন। আর আমিও বাচ্চা নই যে, আপনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই আমার সঙ্গে ব্যবহার করবেন। এটা অন্তত মাথায় রাখুন, আমার উপকার হবে। একটু ম্যানার্স শিখুন।’

আদ্রিশ থমথমে চেহারা নিয়ে তাকায়। কিছু বলতে গেলেই রোজা অন্যদিকে দৃষ্টি দেয়। ইচ্ছে করেই আর ব্যলকনি থেকে যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে, গুনগুন করে কবিতা আবৃত্তি করে। আদ্রিশও পলক সরায় না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ যেন বেড়েই চলেছে। কিছু গঙ্গাফড়িং এদিক-সেদিক ওড়ে বেড়াচ্ছে। নিষ্কর্মা অলস প্রহরের এই পরিবেশটা নিরবে-নিভৃতে ঢেকে আছে। রোজা রেলিঙের দিকে একটু ঝুঁকে ভাঙা ছোট একটা কুঠুরির ফাঁক থেকে কি যেন একটা বের করে আনে। আদ্রিশ মনোযোগ দিয়ে পরখ করতে থাকে তার একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের রমণীটিকে। গালে হাত রেখে ভাবনার জগৎে বিচরণ করে সে। জ্বলজ্বল করা নয়নদুটো নিবদ্ধ থাকে রোজার ওপর। কিছু মুহূর্ত পর রোজা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দু-হাতের তালুতে ছোট্ট একটা চড়ুইপাখির ছানা। আকুলিবিকুলি করছে রোজার হাতের চামড়ায়। আদ্রিশ অবাক হয়ে দেখে রোজার ঠোঁটের কোণের এক চিলতে হাসি। সামান্য একটা ছানা দেখে এত খুশি? কোনোদিন তো এত উৎফুল্লতা মেয়েটির চোখেমুখে দেখতে পায় নি সে!

ফুলের ওপর ওড়াওড়ি করা একটি কালচে-বাদামি ছোপ ছোপওয়ালা একটি প্রজাপতি অকস্মাৎ রোজার গাল ছুঁয়ে কাঁধের ওপর বসে পড়ে। বিস্মিত দৃষ্টিতে রোজা সেটা দেখে মুচকি হেসে ফেলে। চড়ুইয়ের ছানাটিকে আগের জায়গায় রেখে সে ঘরের ভেতর চলে আসে। ততক্ষণে প্রজাপতি জানালা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেছে। রোজা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর আদ্রিশের ধ্যান ভাঙে। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটা দেখতে না পেয়ে মনে মনে রোজার ওপর নারাজ হয়।

পরমুহূর্তেই সে ওঠে দাঁড়ায়। নিজ ঘরে যে অবস্থায় ছিল, সেভাবেই বেরিয়ে চলে আসে রোজার ঘরে। নেহা-ফিহা কেউ তখন রুমে ছিল না। রোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছার চেষ্টা করছিল। ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে নিজের পেছনে যখন আদ্রিশকে দেখতে পেল, ভয়ানক চমকে ওঠলো সে। দ্রুতগতিতে বিছানার ওপর থেকে নিজের ওড়নাটা গায়ে জড়াতে জড়াতে ক্রুদ্ধ কন্ঠে রোজা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আপনি এ-ঘরে কী করছেন?’

আদ্রিশ রোজাকে রাগতে দেখে গম্ভীর গলায় বলে, ‘ঘরে চলে আসলে কেন? আমি বারান্দায় বসে তোমাকে দেখছিলাম। আমি বলি নি দাঁড়িয়ে থাকতে? কোনো কথা শুনো না কেন তুমি? আচ্ছা, বেয়াদব তো!’
রোজা চোখ পাকিয়ে তাকায়। কাঠ কাঠ গলায় সে হুকুমজারি করে, ‘এক্ষুনি বেরিয়ে যান বলছি৷’
আদ্রিশ শক্তপোক্ত কন্ঠে জবাবে দেয়, ‘যাবো না।’

বলে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। রোজার মাথা ঘুরতে থাকে। কেউ এখন ওপরতলায় নেই। এখন যদি কেউ এসে ওকে আর আদ্রিশকে একসাথে, একঘরে দেখে ফেলে তাহলে কী হবে? সবাই তো খারাপ ধারণা করবে। রোজা দু-পা এগিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকায় আদ্রিশের পানে। মুখ কালো করে কঠোর গলায় বলে, ‘চলে যান বলছি। আপনি কিন্তু আমার ধৈর্যের সীমারেখা ভেঙ্গে ফেলছেন। আমি বিচার দিতে বাধ্য হবো খালুজান আর আপনার আব্বুর কাছে। ‘
আদ্রিশ ছোট ছোট চোখ করে বলে, ‘আমি কী ভয় পাই না-কি?’

এই একটা কথা শুনেই রাগে তিরতির করে কাঁপতে থাকে রোজা। মাথা ক্রমশই গরম হয়ে ওঠছে। এ বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যে কতবড় ভুল সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ওর জীবনের অন্যতম ভুলের মধ্যে অন্যতম ভুল নেহাদের বাসায় থাকা। ভেবেছিল আদ্রিশকে ওয়ার্ন করার পরে ও ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে। কিন্তু লোকটার মধ্যে উন্নতির কোনো লক্ষণ তো দূর ব্যবহারটা পর্যন্ত ঠিক করতে পারে নি। উলটো আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। আচ্ছা, ভালোবাসা কী জোর করে আদায় করে নেওয়ার জিনিস? রোজার দিক থেকে ও-তো কোনো ইঙ্গিতই দেয় নি আদ্রিশকে, তাহলে?

লোকটা ওর পিছু ছাড়ছে না কেন? গ্রামে যদি ওর বাবা জানতে পারে তাহলে রোজাকে এক্ষুনি নিয়ে যাবে। তিনি তো এসব প্রেম-ভালোবাসা পছন্দই করেন না। আদ্রিশ কেন বুঝতে চাইছে না এসব? রোজা হতাশ দৃষ্টিতে দী-র্ঘ-শ্বাস ফেলতেই চোখ পড়লো আদ্রিশের দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। মুখটা অল্প-বিস্তর ‘হা’ হয়ে গেল। এতক্ষণ ও পুরোপুরি খেয়ালই করে নি লোকটাকে। বারান্দায় যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই ওর ঘরে চলে এসেছে! রোজা হতবিহ্বল গলায় বলল, ‘লজ্জা-শরম সব বিকিয়ে দিয়েছেন না-কি? আপনার লজ্জা নেই বলে কী দুনিয়ার সবার মধ্যে থেকে লজ্জা ওঠে গেছে? আপনি মানুষ? না-কি ভিনগ্রহের উজবুক এলিয়েন?’

বলেই বারান্দায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো। আদ্রিশ প্রথমে বোকার মতো বোঝার চেষ্টা করলো কথাটির মর্মার্থ। পরক্ষণেই নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো। এ বিষয়টা মাথায় ছিল না, যেভাবে পেরেছে চলে এসেছে। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে বসে থাকতে পারবেও না। নিজস্ব একটা প্রাইভেসি আছে। মুখ কালো করে ওঠে বেরিয়ে যেতে যেতে সে গলা উঁচু করে বলল, ‘হবু বৌ-য়ের কাছে এভাবে আসতে লজ্জা কী-সে-র? আমি তো মেয়ে না।’

রোজা ব্যলকনির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল কখন লোকটা যাবে। কিন্তু আদ্রিশের মুখ থেকে ‘হবু-বৌ’ ডাকটি শুনতে পেয়ে অজানা কারণেই কান গরম হয়ে ওঠলো রোজার। হাত-পা শিরশির করে ওঠলো। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে নিষ্পলক দৃষ্টিতে বেহায়া লোকটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিক। আমার পিছু ছাড়ুন।’

নিচে নেমে আসতেই রোজা অবাক হয়ে যায়। পুরো ড্রইংরুমের চেহারাই যেন পালটে গেছে। সোফাসেট-টি’টেবিল, ফ্লাওয়ার ভাস, টিভি সবকিছুর জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কার্পেট বিছানো হয়েছে। একপাশের দেওয়ালের রঙটাও বদল হয়েছে। বুয়া ফ্লোর মুছছে। সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে রোজা বুয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বাড়িতে কী কোনো অনুষ্ঠান আছে আন্টি?’
বুয়া হেসে বলল, ‘না গো।’

‘সবকিছু অন্যরকম লাগছে। হঠাৎ এত পরিবর্তন?’
‘আমাগো নেহা-রে আইজ দেখতে আইবো পাত্রপক্ষ।’
বিস্মিত হয়ে রোজা বলল, ‘কী বলছেন? হুট করেই নাকি?’
‘পাত্রপক্ষ হঠাৎ আইজ সকালে ফোন কইরা কইছে নেহারে দেখতে আইবো, বাড়ির কেউ-ই জানতো না তো। তো পাত্রের কি কাজ পইরা গেছে হের লাইগা ছয়মাসের লাইগা দেশের বাইরে যাইব। অহন, তাড়াতাড়ি কইরাই সব করতে চায় যদি নেহারে পছন্দ হয় আরকি!’

রোজা নিচু স্বরে বলল, ‘ওহ। কিন্তু আমাকে কেউ জানালো না কেন?’
বুয়া আবার ঘর মোছায় ধ্যান দেয়। বলে, ‘আপনের শরীরডা ভালা না দেইখা ভাবি আপনারে ডাকতে মানা করছে। তাই কেউ বলে নাই।’
‘নেহা আপু কোথায়?’
‘ইশাদের বাসায় লইয়া গেছে।’
‘কেন?’

‘ও-তো রাজিই না এহন বিয়াটিয়া করতে। ছোট আপা আইসা নিয়া গেছে ওরে বুঝানোর জন্য। লইয়া আইব একটু পরেই।’
রোজা জিজ্ঞেস করে, ‘ছোট আপা কে?’
‘ইশার মা। তোমার লগে মনে হয় এহনো দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই?’
রোজা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুম। আচ্ছা, আন্টি কোথায়?’
‘রান্ধাঘরে।’

রোজা সেদিকে পা বাড়ায়। মিতালি রান্নায় ব্যস্ত, নিশিতা আন্টি অন্য আরেকজন বুয়াকে সঙ্গে নিয়ে কুটনো কাটছে। রোজাকে দেখেই তিনি ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিচে নেমে এলি কেন? ব্যথা কমেছে?’
রোজা হেসে বলল, ‘কমেছে। ব্যস্ত হয়ো না। আজ নাকি নেহা আপুকে দেখতে আসবে?’
নিশিতা নত কন্ঠে জবাব দেয়, ‘হুম। হুট করেই আদ্রিশ এসে জানালো ছেলেপক্ষ আজই আসতে চায়। পছন্দ হলে আজই এনগেজমেন্ট করে রাখতে চায়।’

রোজা বলে, ‘এতো ফার্স্ট? খোঁজখবর নিয়েছো তো? এর আগের লোকটার তো…’
এবার আদ্রিশের মা মিতালি হেসে বলল, ‘সব খোঁজখবর নিয়েই দেখাদেখির পর্ব ঠিক হয়েছে মেয়ে। আর কোনো ভুল নেই। পরিবারের লোকজন যথেষ্ট অমায়িক, বেশি না হলেও আমাদের মতোই অবস্থা সম্পন্ন, ছেলেটাও ভালো, নম্র-ভদ্র। তাছাড়া আমার ছেলে নিজে খোঁজ নিয়েছে বলে কথা! বোনকে তো যার-তার হাতে তুলে দেবে না।’
নিশিতা জা’য়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছো বড় ভাবি। এজন্যই তো আমি এত নিশ্চিন্ত। সবকিছু আল্লাহর রহমতে ভালোভাবে মিটলেই হয়।’

রোজা বুঝতে পারলো আদ্রিশ আজ বাসায় কেন!
ঘটকের দায়িত্ব নিয়েছে না-কি? আর নিলেই বা ক্ষতি কী। রোজা ওর ব্যাপারে ভাবছে কেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। বাসায় কেউ-ই নেই বিধায় নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, সিঁড়ি দিয়ে আদ্রিশ নামছিলো তখন। রোজাকে দেখেই বলল, ‘আমাদের বিয়েটাও অতি শ্রীঘ্রই হবে।’

অনুভবে তুই পর্ব ১১

রোজা কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘কখনোই হবে না।’
‘হতে বাধ্য।’
‘বললেই হলো? আমি রাজি না থাকলে আপনার সাধ্য কী আমায় বিয়ে করার?’
আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘সেটা তো সময়ই বলে দেবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সী!’

অনুভবে তুই পর্ব ১৩