অনুভবে তুই পর্ব ১৫

অনুভবে তুই পর্ব ১৫
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

ভাবনার প্রহর কাটিয়ে ডাইনিংয়ে বসা সকলকে উদ্দেশ্য করে সুহানা শেখ গম্ভীর গলায় বলে ওঠলেন, ‘যার ক্ষিধে পাবে সে-তো নিজে থেকেই খাবে। তোমরা এত চিন্তা করছো কেন? খাওয়ায় মন লাগাও।’
এতক্ষণ যাবৎ ধৈর্যসহিত মেয়েদের অতিরিক্ত কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে আদ্রিশ। গম্ভীর মুখভঙ্গি করে বসে থাকা আদ্রিশ এ পর্যায়ে নিজের প্লেটটা সশব্দে পাশে সরিয়ে রাখলো। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।

চোখে এক সমুদ্র তৃষ্ণা, কাউকে না দেখার জ্বালাপোড়া। রোজাকে সন্ধ্যা থেকে একপলকের জন্যও সে দেখে নি। ব্যস্ততার ভিড়ে ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও খোঁজ নিতে পারে নি। হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ। কি হলো রোজার? খেতে নামে নি কেন আজ? কিছু কি হয়েছে? নাকি শরীর খারাপ? ওর তো আবার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে কাউকে বলে না। আর ওকে দেখলেই তো পালিয়ে বেড়ায়, রাগ দেখায়, ক্যাটকেট করে একগাদা উপদেশ শুনিয়ে দেয়। এককথায় ওকে নিয়ে দু-দন্ড ভাবেও না নিষ্ঠুর রোজানুটা। কেন যে ওর জন্যই মন-মস্তিষ্ক আজকাল উত্তপ্ত হয়ে থাকে জানে না আদ্রিশ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অনুভূতিগুলোর যন্ত্রণায় বেঁচে থাকাটাই যেন অর্থহীন মনে হয় ওর। প্রতিটি নিঃশ্বাসে, অনুভবে মায়াবী রমণীটাই ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করে। কিন্তু যার জন্য এসবকিছু অনুভব করে, হয়তো সে মেয়েটার অনুভবের মধ্যে আদ্রিশ নেই। মনে মনে রাগ হয় ওর। কিন্তু রাগ হলেও সেই মুহূর্তে সামলে নিলো নিজেকে। পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে রিজভীকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো প্রবলেম হলে ভনিতা না করে যে কাউকে জানাবে। আজ রাতটা আমাদের বাসায় কাটিয়ে যাও! তোমার কোনো প্রবলেম আছে?’
রিজভী ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘আজ না। কাজের প্রেশার ইদানীং খুব বেশি৷ কাল সকালেই অফিসে ছুটতে হবে। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার বিষয়টিও কনফার্ম করতে হবে। তাছাড়া… ‘

রিজভী আরকিছু বলতে নিলেই ইশা নেহার গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে, ‘নেহা আপু, তুমি কিছু বলো। আজ থেকে যাক না আমাদের সদ্য হওয়া হবু দুলাভাই।’
ইশার বেসামাল কথাবার্তায় নেহা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। রিজভী আড়চোখে সেটা লক্ষ্য করেই অমায়িক হেসে বলল, ‘এখনো হবু-ই। পুরোপুরি দুলাভাই যেদিন হয়ে যাব, সেদিন থেকেই শ্বশুরবাড়ির ওপর পরিপূর্ণ অধিকার পেয়ে যাব। তখন থেকে যাওয়ার জন্য জোর করতে হবে না। থাকব, গল্প করব, আড্ডা দেব সবার সাথে। ওটাই থাকার উপযুক্ত সময়। বাই দ্যা ওয়ে, আমার আরেক শালিকে তো এখনো দেখতে পেলাম না।’

পাশ থেকে ইমতিও কথায় সায় মিলিয়ে বলল, ‘তাই তো!’
সুহানা শেখ মুখ গোজ করে সেখান হতে চলে গেলেন। অসহ্য লাগছে তার। ফিহার খাওয়া শেষ পথে। রোজাকে ডাকার জন্য চেয়ার ছেড়ে ওঠতে নিলেই আদ্রিশ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘তুই বস। খাওয়া ছেড়ে ওঠার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমি তো এখন ওপরেই যাচ্ছি, ডেকে দেব। আসছি।’

একথা বলে আদ্রিশ সেখান থেকে চলে আসে। দোতলায় ওঠে রোজার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দু-বার নক করার পরে কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ঠেলতেই পূর্ণরূপে দরজাটা খুলে যায়। আদ্রিশ ভেতরে ঢুকে রোজাকে দেখতে পায় না৷ পা বাড়ায় ব্যলকনির দিকে। রোজা মগ্ন ছিল নিজের চিন্তার জগতে। নিজের পেছনে আকস্মিক কারোর অস্তিত্ব টের পেয়ে পেছনে ঘুরতেই কারো বুকের সাথে ধাক্কা খায়। নিজেকে সামলে সামনে তাকাতেই লম্বাটে এক সুদর্শন পুরুষের চোখের গভীরে হারিয়ে যায়। পরক্ষণেই রাগ মাথায় চড়ে বসে, চোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা। দু-হাত একসাথে করে এক ধাক্কা দিয়ে আদ্রিশকে সরিয়ে দেয়। হন্তদন্ত হয়ে রুমে ছুটে আসে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জোরালো গলায় বলে, ‘রুমে আসুন এবং এ ঘর থেকে বেরিয়ে যান।’
আদ্রিশ রুমে এসে অবাক হয়ে বলে, ‘রাগার মতো কিছু করেছি কী?’

‘জানি না।’
‘খেতে যাওনি কেন?’
রোজা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। সেভাবে থেকেই কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘আপনাকে বলতে হবে?’
আদ্রিশ শান্ত থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘নিচে সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। ওদিকে ফিরে আছো কেন? আমার দিকে ঘুরো।।’
রোজা ব্যগ্র কন্ঠে বলে ওঠল, ‘আপনার মুখদর্শন করতে চাই না কখনো।’

আদ্রিশ আহত হয়। জ্বলজ্বল করে ওঠে রক্তিম চোখজোড়া। তবুও শান্ত গলায় বলে, ‘কি করেছি আমি? এভাবে কথা বলছো কেন?’
রাগে টগবগ করছে রোজা। আদ্রিশের কথা শুনে যে কেউ-ই ওকে নিরীহ ভাববে। কিন্তু লোকটা তা নয়। এতদিন চুপ করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু আজ ওকে বলতেই হবে কিছু শক্তপোক্ত কথা। রোজার ধৈর্যের সীমারেখা অতিক্রম করে জিজ্ঞেস করল, ‘মিস্টার আদ্রিশ, আপনি কী করেছেন জানতে চান?’
আদ্রিশ দৃঢ় গলায় বলল, ‘অবশ্যই।’

রোজা দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুরু করল, ‘সেই প্রথম থেকে স্পাইয়ের মতো আমার পিছু লেগে আছেন। ভালোবাসার কথা বলে বলে প্রতিনিয়ত আমার মাথা খাচ্ছেন। যখন আপনার প্রস্তাবে রাজি হচ্ছি না তখন মানুষকে দিয়ে আমাকে অপমান করেছেন, নিজেও হ্যারজ করছেন। আপনি সারাক্ষণ বুঝাতে চান না যে আমার প্রতি আপনার আলাদা অনুভূতি আছে? আসলে সেসব মিথ্যে। বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এই অন্যায় কাজটা করতে পারতেন না। ওপরে ওপরে যতই ভালো সাজার অভিনয় করুন না কেন আপনার মতো নিচু মানসিকতার জঘন্য লোক আমি দুটো দেখি নি। আপনি আমার ওপর নিজের কর্তৃত্ব, অধিকার ফলান সবসময় অন্যায়ভাবে।

যেটা আমার মোটেও পছন্দ নয়, সেজন্য আপনাকে যথেষ্ট এড়িয়ে চলতে চাই। কিন্তু আপনি সেসব গ্রাহ্যই করেন না, নিজের মর্জিমতো চলছেন আর সবার চোখে আমাকে খারাপ, লোভী, স্বার্থপর প্রমাণ করছেন। খুব বড় অন্যায় করেছেন। কোনোদিন মাফ করবো না আমি। এই বাড়িতে থাকতে আসাটাই আমার পাপ হয়েছে। আপনি হীরা, হীরার পেছনে ছুটুন৷ সামান্য সোনার সাথে হীরাকে মানায় নাকি? জানতে চান না সবসময় আমি আপনার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি কি-না? আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার জন্য আমার মনে কোনো অনুভূতি নেই, আপনাকে নিয়ে কিছু অনুভব করি না আমি। তাই এসব বন্ধ করুন। আমাকে মুক্তি দিন অসহ্য যন্ত্রণা থেকে। দয়া করুন।’

আদ্রিশের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রোজার কথাগুলো দহনক্রিয়ার ন্যায় বক্ষপিঞ্জর পুড়াচ্ছে। চোখের কোণে জলরাশি জমা হয়েছে। এতদিন পরেও রোজার মনের কোথাও জায়গা নিতে পারে নি সে? কিছুই অনুভব করে না? অথচ অনুভবের অনুভূতির যন্ত্রণায় কাতর সে। রোজার শক্ত কথাগুলোর বিপরীতে আদ্রিশ রেগে ওকে টেবিলের সাথে ঠেসে ধরলো৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে তাচ্ছিল্যের কন্ঠে বলল, ‘কিছু অনুভব করো না? কিছু না? এতদিন সব অনুভূতি অপাত্রে দান করেছি? আহ, কি বোকা আমি! আগেই বোঝা উচিৎ ছিল তোমার মতো পাষাণীর হৃদয় কখনো গলবে না। ভুল আমি। বারবার অন্যায় অন্যায় করেছি বলছো যে, কি অন্যায় করেছি আমি যে ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছো? কী করেছি?’

আদ্রিশের ব্যবহারে হতভম্ব রোজার গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। রোজা এই প্রথম, আদ্রিশের চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল, ‘জোরজবরদস্তি করার স্বভাবটা আজও গেলো না। আমাকে জিজ্ঞেস না করে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন মিস্টার আদ্রিশ।’
কথাটুকু শেষ করার পরেও আদ্রিশ ছাড়লো না রোজাকে৷ প্রেয়সীর চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পেয়ে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে মন। মস্তিষ্ক ঘোলাটে হয়ে নষ্টরুপ ধারণ করতে চাইছে। ঠিক সেসময় অভাবনীয় একটি কান্ড করে বসলো আদ্রিশ৷ রোজার মাথার পেছনে বা-হাতটি দিয়ে চেপে ধরে ওর মুখটা সামনে নিয়ে আসলো।

রোজার ওষ্ঠজোড়ায় আচমকা কামড়ে ধরলো আদ্রিশ। হতভম্ব রোজা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ওকে কিল-ঘুষি মারতে থাকলেও নিজের একান্তে করা কাজটি থেকে সরে আসে নি আদ্রিশ। কামড়ের দাপটে রোজার যখন মনে হলো সে জ্ঞান হারাবে, তখনই বিষাক্ত কামড়গুলো সিক্ত হলো অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়ায়। এক তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের ওষ্ঠচুমুতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল রোজা। ওর চোখের পানি দেখেও সরে নি আদ্রিশ।

নিজের কার্যটুকু শেষ করে মাথা উঁচিয়ে রোজার কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাগে জর্জরিত কন্ঠে বলল, ‘অকারণে দোষারোপ করে চলেছো আমাকে, যেখানে জানিই না আমার দোষটা কোথায়! কিন্তু আজ, এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমার সব অনুভূতিকে মেরে ফেললাম। আর কখনো আদ্রিশ কাউকে চাইবে না, কারো অনুভবে সিক্ত হবে না, পাগল প্রেমিকের ন্যায় ছুটে যাবে না। মুক্তি দিয়ে দিলাম তোমাকে। প্রতিনিয়ত দহনে পুড়ে মরবে, কারোর দীর্ঘশ্বাসের কারণ হবে। আমার সম্পত্তির অধিকার বুঝে নিতে জানলেও আর কখনো চাইবো না তোমাকে, কখনো না, কোনোদিন না।’

ত্রাসিত, শঙ্কিত রোজা বোবা বনে গেল। আদ্রিশ ওর দু-বাহু ছেড়ে দিতেই কয়েক কদম পিছিয়ে গেল রোজা। আদ্রিশ ওর না প্রেমিক-না স্বামী, অথচ আজ অচেনা অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছে সে। ততক্ষণে আদ্রিশ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। বাড়ির লোকজন নিচে কাজে ব্যস্ত থাকায় দোতলার এক কোণের ঘরটিতে কি-কান্ড ঘটে গেছে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় নি। বিস্মিত রোজা ধীরপায়ে হেঁটে দরজাটা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়লো।

অনুভবে তুই পর্ব ১৪

কোনো পুরুষের ছোঁয়া ওর ঠোঁটে লেগে আছে ভাবতেই নিজের চুল খামচে ধরলো। দু-হাত দিয়ে পাগলের মতো ঘষতে লাগলো ঠোঁটজোড়া। রাখবে না সে আদ্রিশের মতো কোনো বেপরোয়া মানুষের ছোঁয়া, কোনো অনুভূতি। রোজা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ওষ্ঠজোড়া ঘষতে থাকে, একসময় চামড়া ছিলে রক্ত বেরিয়ে আসে। ভাবান্তর হয় না রোজার, নিজের কার্যে সফল হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ কামড়ের দাগগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেছে ফরসা মুখশ্রীতে। ব্যর্থ রোজা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়লো একসময়।

অনুভবে তুই পর্ব ১৬