অনুভবে তুই পর্ব ২৯

অনুভবে তুই পর্ব ২৯
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হয়ে গেলো সেটা বুঝতে পারলো না রোজা। কিন্তু উক্ত কথাটি শুনে সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই আদ্রিশকে দেখতে পেয়ে থমকে গেলো সে। সুলতানা রোজার দৃষ্টি অনুসরণ করে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। তাঁর চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম যেন। তিনি হতভম্ব হয়ে আমতাআমতা করতে লাগলেন। গ্রামের রক্ষণশীল পরিবারের আটপৌড়ে বউ তিনি। আচার-আচরণের দিক দিয়ে খানিকটা কঠোর হলেও সেটা শুধু নিজের পরিবার আর মেয়ের জন্য।

অন্যকেউ কি করেছে, তাঁর কতটুকু দোষ সেটা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। সবসময় নিজের মানুষগুলোর দোষ খুঁজে সংশোধন করতেই শিক্ষা দিয়েছেন বাড়ির মেয়ে-বউদের। সুলতানা খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। নিজের মেয়েকে শাসন করা প্রয়োজন বলেই প্রশ্নটা করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে এসে প্রেম-ভালোবাসা সংক্রান্ত একটি বিষয়ে আদ্রিশ এভাবে হস্তক্ষেপ করবে ভাবেননি তিনি। খুব ভালোভাবেই তিনি জানেন যে আদ্রিশ সবার মতো নয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একটু অন্যরকম, ওর মধ্যে প্যাঁচগোচ নেই। সোজা কথা সরাসরি বলে দিতেই সে পছন্দ করে। রোজা মায়ের ভাবমূর্তি লক্ষ্য করছে কুটিল চোখে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোজা খুব ক্ষুন্ন হলো। রাগ হলো আদ্রিশের ওপর। কি দরকার ছিল, সরাসরি এ কথাটা সুলতানাকে বলে দেওয়া? রোজা না হয় বুঝিয়ে বলতো সবকিছু! এর আগেই লোকটা ঝামেলা পাকিয়ে বসলো। এদিকে আদ্রিশের জবাবেই সুলতানা তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে তার ফর্সা মুখখানা ঢাকা পড়লো। মায়ের গম্ভীর চেহারা দেখে রোজা বেশ আন্দাজ করতে পারছে সুলতানা মোটেও খুশি হয়নি এতে। দ্রুতপদে সেখান হতে চলে যেতেই রোজাও গেল মাকে সামলাতে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রোজা মিনমিন করে বলল, ‘আমার কথাটা একবার শুনবে প্লিজ? একবার…’

সুলতানা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘তোর মুখ থেকে একটা কথাও শুনতে চাইনা আমি। আগেই আন্দাজ করেছিলাম তোদের মধ্যে কিছু আছে। তুই আমার মেয়ে হয়ে এসবে জড়াতে পারলি?’
রোজা মাকে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি ভুল ভাবছো আম্মু।’
‘ওহ আমি ভুল ভাবছি? তুই বলতে চাইছিস ওর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই? ছেলেটার বলা কথাটা মিথ্যা?’
রোজা নিভে যাওয়া গলায় বলল, ‘আমি সেটা বলছি না। ও ওনি আমাকে পছন্দ করেন সেটা একান্তই ওনার ব্যাপার। আমার খেয়াল রাখেন নিজের ইচ্ছেতেই, আমার সব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেন নিজে থেকেই। আমি ওনাকে কখনো বলিনি যে সে আমাকে ভালো…’

সুলতানা রাগ সামলে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে কাল রাতে বাগানে ওর সাথে কি করছিলি? সকালে ওর ঘরে কি করছিলি? কাল রাতে এত ঘনিষ্ঠভাবে ছিলি যে…’
রোজা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এসব কথা সুলতানা জানলো কীভাবে? কোনো অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে একঘরে দেখাসাক্ষাৎ করবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তিনি। কাল রাতের ঘটনা আর সকালে যে আদ্রিশের ঘরে কফি নিয়ে গিয়েছিল সেটা তো কেউ জানে না? তাহলে? রোজা অসহায় ভঙ্গিতে মা’কে যা কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করলো না কেন, সুলতানা ওর একটা কথাও বিশ্বাস করলেন না।

রোজার জন্য নিজের বোনের সংসারে অশান্তি হতে দেবেন না। ভীষণ রাগারাগি করে রোজাকে অনেক কথা শোনালেন এবং রুম থেকে বের করে দিলেন। তখন রোজার মনে বেজায় রাগ৷ কারণ সুলতানা কখনো ওর সাথে এত রুক্ষ হয়ে কথা বলে নি। ওর সব রাগ-আক্রোশ গিয়ে পড়লো আদ্রিশের ওপর। আশপাশ একবার দেখে পা বাড়ালো আদ্রিশের ঘরের দিকে। আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে ও। সবসময় বাড়াবাড়ি করা? জানে না যে, রোজার মা কতটা রক্ষণশীল? কিন্তু ঘরে আদ্রিশকে পাওয়া গেল না।

বিরক্ত রোজা নিচে এসে খুঁজলো, সেখানেও নেই। বাড়ির লোকজন যার যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। দারোয়ানের কাছ থেকে রোজা জানতে পারলো আদ্রিশ বাইরে বেরোয়নি। তার মানে বাড়িতেই কোথাও আছে। মানে ছাদে! রোজা দ্রুতপায়ে ছাদে পৌঁছালো। বেহায়া লোকটা ইটের ওপর পা তুলে বসে আছে৷ আকাশে ভেসে থাকা শুক্লাদশীর চাঁদ আর ঝিমতে থাকা তারাদের ভিড়ে চারপাশটা মোহময় হয়ে আছে৷ সেই মায়াবী আলোতে দৃষ্টি বিনিময় হলো দু’জনার। এক পলকের দেখায়ই রোজা বুঝে গেল মানুষটার জ্বর এখনো কমেনি, কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে। তবুও একটু আগের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়তেই ধুপধাপ পা ফেলে আদ্রিশের সামনে এসে দাঁড়ালো। আদ্রিশ নিশ্চুপ থেকে রোজার কর্মকাণ্ড দেখায় মগ্ন হতেই রোজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘জ্বর কমেনি আপনার? ঔষধ খাননি?’

আদ্রিশ জবাবে বলে, ‘তোমাকে দেখলেই জ্বর বেড়ে যায়।’
অবান্তর কথায় বিরক্ত হয়ে রোজা সোজাসুজি প্রশ্ন করল, ‘আপনি মাকে এটা কী বললেন? কোনো ধারণা আছে আপনার এতে মা কতটা রেগেছে? মায়ের সামনে নিজেকে বেহায়া প্রমাণ না করলে কি হতো না?’
আদ্রিশ কথাটা আমলে নিয়েছে এমন ভাব করেই বলল, ‘শ্বাশুড়ির কাছে বেহায়া প্রমাণিত হলেই বা কী আসে- যায়?’
রোজা ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘আসে-যায়। মা কতটা ফালতু ভাববে জানেন আপনি? লাজ-লজ্জাহীন একটা ছেলে আপনি। ওফ…’
আদ্রিশ হাসলো। আপাদমস্তক রোজাকে পরখ করে ঘোর লাগা গলায় বলল, ‘হাবুডুবু খাচ্ছো তুমি।’

রোজা আশেপাশে তাকিয়ে তেমন কিছু বুঝতে না পেরে কড়া গলায় বলল, ‘মানে? জ্বর হয়ে মাথা গেলো নাকি আপনার? আমি কোথায় হাবুডুবু খাচ্ছি?’
আদ্রিশ গাঢ় শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো।’
এতক্ষণে ওর কথার মানে বুঝতে পারলো রোজা। আর তাতেই ওর রাগ হলো। লোকটাকে শাঁসাতে এসে নিজেই ফেঁসে গেল সে। সাজানো কথাগুলো তালগোল পাকিয়ে ফেললো। রাগী স্বরে বলল, ‘মাথা খারাপ হলে সবারই এমন মনে হয়। অবশ্য এটা দোষের কিছু নয়। কারণ, আমি তো আগে থেকেই জানি আপনার মাথায় যে গণ্ডগোল আছে।’

আদ্রিশ হাসলো। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘সেটা তো তোমাকে দেখার পর থেকেই৷ এইযে, আমার ভীষণ চু-মু খেতে ইচ্ছে করছে সেটা তুমি সামনে আছো বলেই। আচ্ছা, তুমি এত বোকা কেন মেয়ে? আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো আর ভাবছো, আমি সেটা বুঝতে পারবো না? নো নো, নো ওয়ে! এটা ভাবা নিছকই তোমার ভুল।’

রোজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই আদ্রিশ ওর মুখে আঙুল দিয়ে বুঝালো ও চুপ থাকবে। অসুস্থ লোকটাকে কথা শোনানোর ইচ্ছে হলো না বলে রোজা কপট রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই আদ্রিশ পেছন থেকে বলল, ‘তুমি এত অদ্ভুত কেন রমণী? আমার মতো ছেলেকে কেউ এভাবে কষ্ট দেয়? ইগনোর করে? আমি যে তোমাকে ভালোবাসি কেন বুঝো না?’

আদ্রিশের কন্ঠে কি যেন একটা ছিল, রোজা পুরোপুরি থেমে গেলো। বুকের মধ্যে তীব্র একটা যন্ত্রণা শুরু হলো তখনই। আসলেই তো, কেন সে এত ইগনোর করে লোকটাকে? সে নিজেই তো লোকটার প্রেমে পড়ে গেছে। তাহলে? দু-একটা ভালোমন্দ কথা তো বলতেই পারে। ও অন্যরকম এক ঘোরে থেকেই উত্তরে বলল, ‘সবসময় আমরা যা চাই, তা পাই না। তাই যেটা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই সেদিকে হাত বাড়িয়ে কী লাভ বলুন তো? তাতে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আরকিছুই নেই। তাই বোঝার ক্ষমতাটার চর্চা করা ইদানীং বন্ধ করে দিয়েছি।’
আদ্রিশ জ্বর নিয়েই দু-পা এগিয়ে এসে বলল, ‘তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমি মন পড়তে পারি। এত ভালোবাসো, তবুও কেন অস্বীকার করো? কেন এত কষ্ট পাও? কেন বুঝতে চাও না তোমার কষ্টগুলো তীক্ষ্ণ ফলার মতো আমার বুকে আঘাত দেয়? তোমার চোখেরজলের একেকটা ফোঁটা আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়; কেন বুঝো না?’

রোজা শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষটা ওকে এত বুঝে কেন? আদ্রিশ ওর ঘাড়ে চিবুক রাখতেই প্রচন্ড গরম অনুভত হলো রোজার৷ শক্ত কাঠের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে আদ্রিশকে বলল, ‘দেখুন, আপনার আমার পরিবারের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আপনারা যতটা আধুনিক, আমরা ঠিক ততটাই রক্ষণশীল। স্রোতের দু’প্রান্তের কখনো মিল হতে পারে না।’
আদ্রিশ অস্ফুটস্বরে বলল, ‘আমার তো একটাই অভাব, সেটা একমাত্র তোমার ভালোবাসা। আর এই অভাব নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে আমার একটা অপূর্ণ আক্ষেপ থেকে যাবে। একবার বলো না, ভালোবাসি! আমি সব ঠিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।’
রোজার যে কি হলো তখন, সে বুঝে ওঠতেই পারলো না। আদ্রিশের কাকুতিভরা কথাগুলো ওর মনে ঝড় বইয়ে দিচ্ছিলো। দু’ফোটা জল জমেছিল বোধহয় চোখের কোণে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো সেটা। রোজা খুব আস্তে নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতেই ও বলল, ‘ভালোবাসি বললেই তো আর আমরা এক হয়ে যাবো না।’

তারপর! একটা মিনিটের মধ্যে আরও অদ্ভুত এবং ভয়ানক কান্ড ঘটিয়ে বসলো আদ্রিশ। রোজাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর কপালে শক্ত একটা চুমু বসিয়ে ধুপধাপ করে নিচে চলে গেলো। ঠিক তখনি হুঁশ ফিরলো রোজার। যে ব্যাপারটা মিটমাট করার উদ্দেশ্যে ছাদে এসেছিল, এখন ওরই দৌলতে আরও ঘেঁটে গেলো সেটা। আদ্রিশের কথাগুলো ওকে এতটা ঘায়েল করে দিবে জানতো না ও। নিজেকে তো সামলে রেখেছিলই, তাহলে কেন ও দুর্বল হয়ে পড়লো এবং অজান্তেই মনের কথাটা প্রকাশ করে দিলো আদ্রিশের সামনে? কেন?

অনুভবে তুই পর্ব ২৮

হৃদপিণ্ড ট্রেনের গতিতে ছুটছে রোজার। মনটা বড্ড অস্থির লাগছে ওর। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিচে নামলো ও। কিন্তু লিভিংরুমে পৌঁছাতেই ও হতভম্ব হয়ে গেলো। সোফায় বসেছিলো আদ্রিশ। ইনায়েত সাহেব, ইমতিয়াজ সাহেব আর আজিজুর রহমান, বাড়ির গিন্নিরা এমনকি রোজার মা-ও ছিল। উৎস, ওর বন্ধুরা, ইশা-ফিহা কেউই বুঝতে পারছিলো না আদ্রিশকে এত উচাটন কেন দেখাচ্ছে। ইনায়েত সাহেবের পাশ থেকে সরে তাঁর পায়ের কাছে বসে আদ্রিশ অনুরোধের সুরে বলছে, ‘রোজাকে আমার চাই আব্বু। ওকে হারালে আমি মরে যাবো দেখো। একমাত্র ওকেই আমি ভালোবাসি। ওকে আমার করে এনে দাও না আব্বু…’

অনুভবে তুই পর্ব ৩০