অনুভবে তুই পর্ব ৩১

অনুভবে তুই পর্ব ৩১
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

রজনীর আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। চারপাশে বইছে হিমেল হাওয়া। বাড়ির বাগান থেকে আসছে ফুলের মৃদু সুবাস। রোজা আকাশের দিক হতে নজর সরিয়ে ধ্যান দিলো মনের গহীনে, কিছু উন্মত্ত ভাবনায়। মাঝেমধ্যে যাবতীয় নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু উদ্ভট ভাবনা ওর মস্তিষ্কে জেঁকে বসে। ভিন্নরকম ইচ্ছা-অনিচ্ছা জেগে ওঠলেও সেগুলো আর পূরণ করা হয়ে ওঠে না। ওর ঘোলাটে দৃষ্টি আঁধার ঢাকা অন্তরিক্ষে। রাতের আকাশের গায়ে জ্বলজ্বল করছে ফুটিফুটি তারা।

বাইরে পক্ষীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে মাত্র। চিন্তা, অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে রোজার চোখ কখন যে লেগে এসেছিল বুঝতেই পারে নি৷ দরজায় টোকা পড়তেই ও সচকিত হলো। ঘুমের রেশ থেকে যাওয়ার চোখমুখ ফুলে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চেঞ্জ করে নিয়েছে সেই কখন! এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা বেঁধে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললো রোজা। ঘরে ঢুকলো ফিহা আর ইশা। ওদের দু’জনকে দেখেই লিভিংরুমের ঘটনার কথা মনে হলো ওর। ফিহাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবার আগেই ও ফ্রেশ হতে চলে গেলো। আর ইশা ড্রয়ার থেকে ওর জামাকাপড় বের করছিলো চেঞ্জ করার জন্য। দুরুদুরু মন নিয়ে রোজা ইশার কাছে গিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। ইশা মুহূর্তেই ওর ভাবগতিক বুঝতে পারে। ঠোঁটে হাসি এঁকে বলে, ‘মনে হয় খুব শ্রীঘ্রই আরেকটা বিয়ে খেতে যাচ্ছি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিস্ময়ে রোজার মুখ ‘হা’ হয়ে গেলো। এর মানে একটাই, বাবা-মা সবটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু এত সহজে? যেখানে সুলতানা কোনোক্রমেই আত্মীয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না সেখানে কিভাবে এত সহজে রাজি? ও হতবিহ্বল হয়ে গেলেও আর কোনো প্রশ্ন করলো না ইশাকে। সবাই ভালোয় ভালোয় মেনে নিলেও রোজার খুব লজ্জা লাগতে শুরু করলো। সুলতানা এ নিয়ে ওর সঙ্গে হালকাপাতলা আলাপও সেরে নিলো কিন্তু অবান্তর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সেদিন রাত সাড়ে এগারোটায় ডিনারে বসলো বাড়ির সকলে। ডাইনিংয়ে খেতে বসেও রোজা অস্বস্তিতে ভুগছিলো। তবে আদ্রিশ আসে নি খেতে, ও তখন নিজের ঘরে ঘুমিয়েছিলো। রাতের খাবারদাবার সারার পরে ক্লান্ত সবাই যখন ঘুমাতে গেল তখন রোজা ফিহার কাছে গেলো একরাশ দ্বিধা নিয়ে। আদ্রিশের অসুস্থতার কথাটা তখনই ফিহা জানতে পারলো। ও উদ্বিগ্ন হয়ে জানালো, আদ্রিশ রাতে কিছুই খায় নি। আর বাড়ির কেউ জানেও না আদ্রিশের জ্বর হয়েছে। অগত্যা ফিহা রোজাকে বলল, ‘তুই কি আগে থেকেই জানতিস ভাইয়ার জ্বর?’

রোজা নিচু স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ। সকালেই জেনেছিলাম। কিন্তু ওনি কাউকে জানাতে নিষেধ করেছে।’
ফিহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাধ্য বরের বাধ্য বউ। ভাইয়া বলুক আর না বলুক, তোর তো উচিৎ ছিল বিষয়টা কাউকে জানানো। এটলিস্ট উৎস ভাইকে? এখন গিয়ে দেখ, মরার মতো পরে আছে। ঔষধ নিয়েছে কিনা কে জানে! তুই যে কি করিস না!’
বলেই গটগটিয়ে হেঁটে সামনে পা বাড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে রোজাও এলো। ব্যগ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কি করবে আপু?’
ফিহা চিন্তিত স্বরে বলল, ‘কি আর করবো? গিয়ে দেখি তোর হবু বর মহাশয় কি করছে। ঘুম ভাঙলো কি-না কে জানে৷ বাই দ্যা ওয়ে, তুই প্লেটে করে খাবার নিয়ে আয়। কিছু একটা পেটে দিয়ে ঔষধটা তো নিতে হবে তাইনা?’

‘তাও বটে। আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি।’
ফিহা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এনে দিচ্ছি মানে? তুই ভাইয়ার ঘরে নিয়ে আয়।’
রোজা শুকনো কন্ঠে বলল, ‘না। আমি ওনার ঘরে যাবো না।’
‘কেন?’
রোজা দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘ওনার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছে মাত্র। আমি ওনার বউ হইনি এখনো। ওই ঘরে যাওয়ার অধিকার এখনো আমার হয়নি, যার ফলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখাবে। সকালে তো না পারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার যতটুকু করা প্রয়োজন ততটুকুই করবো ফিহা আপু।’

ফিহা হতাশ হয়ে বলল, ‘তোর যা অভিমত। কিন্তু খাবারটা এনে দে। আমিই নিয়ে যাই।’
রোজা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘অবশ্যই।’
বলেই তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে এলো রোজা। আর ফিহা গেলো উৎসের ঘরে ঔষধ আনার জন্য। যেহেতু সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কাউকে আর ডাকলো না রোজা। ফ্রিজ থেকে কিছু তরকারি নামিয়ে গরম করে নিলো। ভাত খুব বেশি ঠান্ডা ছিলো না। প্লেটে করে খাবার নিয়ে আদ্রিশের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো ফিহার জন্য।

আচমকা কৌতূহলবশত পর্দাটা অল্প একটু সরিয়ে আদ্রিশের ঘরে উঁকি দিতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। আদ্রিশ খালি গায়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আর ওর আধখোলা দৃষ্টিজোড়া ঠিক রোজার মুখেই নিবদ্ধ। একদৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে রোজার মুখপানে। ভুল দেখছে ভেবে রোজা চোখ কচলে আবারও তাকালো। কিন্তু বাস্তবেই যে আদ্রিশ পর্দার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখছে বুঝতে পারলো তখনই। অস্বস্তিতে মিইয়ে গেল ও। ওর হতবিহ্বল অবস্থা অবলোকন করেই আদ্রিশ দুর্বল অথচ শান্ত স্বরে বলল, ‘যেটা আমার সেটা শুধুই আমার, যদি একটুও অন্য কারো হয় সেটা আমার দরকার নেই। কিন্তু আমি কারোর ভাগ কেড়ে নিই না এবং আমার ভাগের জিনিস কাউকে কেড়ে নিতে দিইও না।’

কথাটুকু শ্রবণ করা মাত্রই রোজা ঝট করে পর্দা ফেলে দিলো। ফলে দু’জনের কেউই আর কাউকে দেখতে পেলো না। ফিহা এসে পড়লো মিনিট খানিকের মধ্যেই, সঙ্গে উৎসও আছে। খাবারের থালা আর ঔষধের বক্সটা হাতে নিয়ে ফিহা-উৎস আদ্রিশের ঘরে ঢুকতেই রোজা হাফ ছাড়লো। অতঃপর বড় বড় পা ফেলে নেহার ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ওর বা-পাশে ইশা তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। রোজা অন্যপাশে শুয়ে আনমনে খানিকক্ষণ আগের ঘটনাগুলোর কথা ভাবছে।

অস্বস্তি ও লজ্জার সংমিশ্রণের সাথে ওর মনের কোণে বারবার আরও একটি প্রশ্ন জাগ্রত হচ্ছে। আদ্রিশ আর ওর এক হওয়ার মাঝে তো আর কোনো বাঁধা নেই। তাহলে কেন একটু আগে সে এই কথাটি বললো? সেটা কি শুধুই কথার কথা? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো ব্যাপার? অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের কোনো কূল-কিনারা খুঁজে না পেয়ে চিন্তা করা বাদ দিলো রোজা। অতঃপর একরাশ সুখ, ভালোলাগা, নতুন কিছু স্বপ্ন আর মনের কোণে জেগে ওঠা কিছু সুপ্ত প্রশ্ন নিয়ে একসময় নিদ্রাগত হলো সে। আচ্ছা, পৃথিবী কি জানে, রোজা তাঁর আদ্রিশকে কতটা ভালোবাসে?

একটা সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেলো। এর মধ্যে নেহার বৌ-ভাতের আয়োজনও সম্পন্ন হয়েছে। বাড়িতে এসে বেড়িয়েও গেছে নেহা-রিজভী আর ওর বোন ইমা। নেহা তো বিয়ের মতো চমকপ্রদ ব্যাপারটা শুনে খুবই পুলকিত হলো। ওর ভাইয়ের কান্ডকারখানা শুনে আর রোজার প্রতি ওর ভালোবাসা দেখে বিমোহিত। কিন্তু এই ক’টা দিন রোজা যে কতটা অস্বস্তি নিয়ে কাটিয়েছে সেটা শুধু সে-ই জানে। জ্বর থেকে সুস্থ হবার পর আদ্রিশের ব্যবহার যেন আরও পালটে গেলো।

ইতোমধ্যে আজিজুর সাহেব তো খুবই পছন্দ করে ফেলেছে ওকে। সুলতানাও একটু গলে গেছে। সচরাচর রোজাকে একটু স্পেসে পায় না আদ্রিশ। সারাক্ষণ কেউ না কেউ ওর সঙ্গেই আছে। মনমতো দুটো কথা বলারও সুযোগ পায় না সে। সেদিন এক গোধূলি সন্ধ্যা। বাড়ির সকলে মিলে আড্ডা বসিয়েছে ছাদের কোণের ঘরটিতে। বসে থাকতে থাকতে পা ঝিমঝিম করছিলো বলে রোজা একটু ছাদে হাঁটাহাঁটি করছিলো। আদ্রিশ অফিস থেকে ফিরে বাড়ি সুনশান দেখে একগ্লাস পানি নিজেই নিয়ে খেলো। এরপর সোজা ছাদে চলে এলো। রোজাকে আনমনে পায়চারি করতে দেখে ও এগিয়ে গেলো। হঠাৎ সামনে আসায় রোজা একটু হকচকিয়ে যায়। নিজেকে ধাতস্থ করতে না করতেই আদ্রিশ ওর হাত টেনে চুমু খেয়ে বলে, ‘এই হাতদুটো আমার। আমি ছাড়া কাউকে ছুঁতে দেবে না কখনো।’

রোজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘বললেই হলো? আমার হাত আমি কাকে ধরতে দেব না দেব সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।’
আদ্রিশ সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আগে তো চুপচাপ ছিলে। এখন মুখে এত খই ফুটে কেন তোমার? সব কথায় অহেতুক রিয়েক্ট করো। দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো। আর তাও না হলে, মেনে নিলাম। আদ্রিশের বউ তাঁর সাথে এক-আধটু বেয়াদবি করতেই পারে। কিন্তু একবার ভুল করেও তো ‘ভালোবাসি’ বলতেই পারো, কেন সেটা ভুল করেও উচ্চারণ করো না?’

রোজা শক্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনার সমস্যা কী হ্যাঁ? আমি যে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি এতে কি আপনি সন্তুষ্ট নন? যে ভালোবাসি শুনতে চাচ্ছেন? এসব ব্যাপার মনে ঘটে, মুখে নয়; যে সারাদিন ন্যাকামু করে ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’ বলে আপনার থেকে ফেভার পাওয়ার আশায় থাকবো। আমি ও ধরনের মেয়ে নই।’
আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘আমি জানি তুমি এধরণের মেয়ে নও। তুমি শুধু এই একটাই, আর এই একটার মালিক শুধু আমি। সেজন্যই তোমাকে আমার কলিজার ভেতরে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। যদি কেউ হাত বাড়িতে তোমার হাত ধরতে আসে তাহলে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে ফেলতে কিন্তু দু’বার ভাববো না।’

রোজা অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে?’
আদ্রিশ চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘ভালোবাসি বলতে হবে না। কিন্তু তুমি শুধু আমার দিকেই তাকাবে, আমাকেই ভালোবাসবে।’
রোজা নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘এর মানে কী? আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি অন্য কারো দিকে তাকাবো?’
আদ্রিশ ক্রোধিত স্বরে উত্তর দেয়, ‘তুমি হয়তো তাকাবে না। কিন্তু অনেকেই তোমার দিকে তাকাবে। তাই যথাসম্ভব নিজেকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করবে।’

রোজা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আমার জানামতে, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু আপনি বারবার অহেতুক একটা বিষয়ে ইঙ্গিত করছেন কেন? রোজা নিজেকে নিজে প্রটেক্ট করতে জানে।’
আদ্রিশ বাস্তবতা বোঝানোর চেষ্টা করে বলল, ‘তারপরেও তুমি একজন মেয়ে।’
রোজা ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘মেয়ে বলে কি আমরা দুর্বল? এমন মনে হয় আপনার?’

আদ্রিশ রুক্ষ স্বরে বলল, ‘অনেকক্ষেত্রেই মেয়েরা যেমন পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে আছে, তেমনি অনেকদিক থেকেই তাঁরা পুরুষদের থেকে পিছিয়ে আছে। এই দিকটা একটু চিন্তা করলেই তুমি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’
রোজা হতাশ হয়ে বলল, ‘আপনি হয়তো কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত। তাই এরকম বলছেন। আমাকে কি বিষয়টা বলা যায়?’
আদ্রিশ ওর নাক টেনে দিয়ে বলল, ‘তোমাকে বলে অহেতুক ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি ঝামেলা বাঁধানো মেয়ে।’
রোজা গম্ভীর গলায় বলল, ‘তাহলে বিয়ে করতে চান কেন আমাকে?’

অনুভবে তুই পর্ব ৩০

‘ভালোবাসি বলে।’
‘কেন?’
আদ্রিশ উত্তর না দিয়ে নিরব রইলো। রোজাকে সে কেন ভালোবাসে এটা সে নিজেই জানে না তো উত্তর দেবে কি! আর ভালোবাসায় সবসময় কারণ খুঁজতে হয় না। আদ্রিশ অফিসের স্যুট’টা খুলে হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নেমে গেলো। রোজা ওর যাওয়ার পানে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো।

অনুভবে তুই পর্ব ৩২