অনুভবে তুই পর্ব ৩৩

অনুভবে তুই পর্ব ৩৩
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

শুক্রবার, ছুটির দিন। ভোরের ট্রেনে রোজারা গ্রামে ফিরে গেলো। রাতে দেরি করে ঘুমাতে যাওয়ায় আদ্রিশ ইচ্ছে থাকলেও তখন ঘুম ভেঙে ওঠতে পারে নি। আদ্রিশের উদ্ভট রাগের কারণে বাড়ির কেউ ওকে ডাকার সাহসও করে না। যখন ঘুম থেকে ওঠলো প্রথমেই রোজার কথা মনে পড়লো। বেড সাইড টেবিলে থাকা ঘড়িটা তড়িঘড়ি করে হাতে নিয়ে দেখলো বেলা বারোটা। বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে একটা আছাড় মারলো ঘড়িটাকে।

তিক্ত মেজাজে টি-শার্টটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বিছানা থেকে নামতেই ঘড়িতে পা পিছলে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়লো। নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে সেখানেই বসে থাকলো আদ্রিশ। ওঠলো না সেখান থেকে। হাত বাড়িয়ে নিজের ফোনটা নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে ডায়াল করলো একটা নাম্বারে। দু’তিনবার রিং হয়ে যাওয়ার পরেও যখন ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না তখন দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা নিজের কপালে বারি দিয়ে যেভাবে ছিলো সেভাবেই বসে রইলো। ফোনটা ভাঙলো না; কারণ রোজা যদি পরে ফোন করে তাহলে আদ্রিশের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। যদিও আদ্রিশের যথেষ্ট সন্দেহ আছে, রোজা ওকে ফোন দেবে কি-না! এই মেয়ে যে ওকে ফোন দেবে এটা খুব ভালোমতোই জানে। আদ্রিশ হতাশ কন্ঠে আনমনে বলল, ‘মেয়ে মানুষ যে কেন এত নিষ্ঠুর হয় কে জানে?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দরজার ওপাশ থেকে ফিহার কন্ঠ শোনা গেল, ‘ভাইয়া? এই ভাইয়া? ওঠেছ? আমি কী খাবার নিয়ে আসতে বলবো? ভাইয়া?’
আদ্রিশ শুনতে পেয়েও জবাব দিলো না। মৌনতা অবলম্বন করে আগের ন্যায় বসে রইলো। সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিহা কী করবে বুঝে ওঠতে পারলো না। ঘরের ভেতরে থাকা আদ্রিশ একপর্যায়ে কিছু একটা চিন্তা করে অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আছিস তুই? ফিহা?’
বাইরে থেকে ফিহার কোনো সাড়া না পাওয়া গেলেও উৎসের গলা শোনা গেল। উচ্চস্বরে বলে ওঠল, ”ফিহা নেই। আমি আছি।’
আদ্রিশ হন্তদন্ত পায়ে ওঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। উৎস ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘তোমার কিছু প্রয়োজন আছে নাকি?’
আদ্রিশ অবাক হয়ে বলল, ‘তুই কীভাবে বুঝলি?’

উৎস হেসে বলল, ‘কমনসেন্সের প্রশ্ন ভাই। বাই দ্যা ওয়ে, তোমাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে? আমাকে বলবে নাকি ফিহাকে? আফটার অল ফিহা তোমার অনুগত বোন।’
‘তুই কী আমার সঙ্গে ফাজলামো করতে এসেছিস?’
‘মোটেও না। আমি তো তোমার সাহায্য লাগবে কি-না জিজ্ঞেস করতে এলাম।’
আদ্রিশ খানিকক্ষণ থেমে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর খালার বোন ঠিকঠাকমতো বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছে? জানিস এ ব্যাপারে কিছু?’
আদ্রিশের ঘোরালো-প্যাঁচালো কথাবার্তা শুনে উৎস মনে মনে হাসলো। তারপর বলল, ‘বাড়ি পৌঁছে খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছে। ইভেন আমি তাঁদের পৌঁছে দিয়ে বাড়িতেও ফিরে এসেছি।’

আদ্রিশ হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে? তুইও গিয়েছিলি নাকি? আমি তো জানি না।’
উৎস বলল, ‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আংকেল-আন্টি এতগুলো ব্যাগপত্র নিয়ে এতদূর যাবে, তাই আমি সাথেই চলে গেলাম।’
আদ্রিশ রুক্ষ স্বরে বলল, ‘আর এই কথাটা তুই আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?’
উৎস কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘তোমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করি নি। আফটার অল রোজার সাথে আমার চেনাজানা বা সম্পর্কের বয়স তোমার চেয়েও বেশি। তুমি ওর ফিয়ন্সে, আর আমি ওর ভাই। পার্থক্যটা বুঝো ভাই।’
আদ্রিশের ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে এলো। হাতের মুঠো কিলবিল করতে লাগলো। উৎসের নাক বরাবর ঘুষি দিতে ইচ্ছে করলো। তবুও সে চড়া গলায় প্রশ্ন করল, ‘এই, তোর গার্লফ্রেন্ড নেই?’

উৎস সোজাসুজি উত্তর দিল, ‘না ভাই।’
আদ্রিশ রেগে বলল, ‘কেন নেই? তোর মতো এত সুদর্শন একটা ছেলের কেন গার্লফ্রেন্ড থাকবে না?’
উৎস ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘কারণ রোজার মতো কাউকে পাই নি।’
ওর কথা শুনে আদ্রিশ হতভম্ব হয়ে গেলো। রাগে ফুঁসতে থাকা অবস্থায় মাথা ঝিমঝিম করতে করতে একপর্যায়ে ব্যথাও শুরু হলো। ওর মনে হচ্ছে গায়ে কেউ মরিচের গুঁড়ো পেস্ট করে লাগিয়ে দিয়েছে। পুরো চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। উৎস নিজের হাতদুটো আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করল, ‘আর ইউ জেলাস?’
আদ্রিশ ছুটে গিয়ে উৎসকে ঘুষি মারতে যাবে তার আগেই উৎস ওর হাত ধরে ফেললো। তারপর বলল, ‘এত জ্বলো কেন? রিল্যাক্স। নাকি আমার বোনের জন্য মন আঁকুপাঁকু করছে বলে আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছো? দিস ইজ নট ফেয়ার ভাইয়া।’

‘তোর বোন না; ভাবি বলবি। ওকে?’
উৎস দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘নেভার। ও আমার বোন।’
আদ্রিশ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু তুই ওকে বোনের নজরে দেখিস বলে মনে হয় না।’
উৎস এবার হু হা করে হেসে ফেললো। বলল, ‘আর ইউ ম্যাড? জোক্স বুঝো না তুমি? ইদানীং এত বাচ্চা বিহেভিয়ার করো কেন? রোজা যথেষ্ট বুঝদার; ইম্প্রেসিভ। আর তুমি? অবুঝের মতো কথাবার্তা বলছো। তোমাদের তো মানাবেই না। এর চেয়ে তুমি নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করো। মানাবে ভালো।’

আদ্রিশ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘বেশি সাহস তোর। আমার সাথে মজা করিস ডাফার? ছোট আব্বুকে যদি না বলি তো আমার নামও আদ্রিশ নয়।’
উৎস নিজের কান ধরে বলল, ‘স্যরি ভাই। আর এমন ভুল করবো না, আব্বুকে বলো না।’
আদ্রিশ শান্ত হয়ে বলল, ‘তোর ফোন আর পাসওয়ার্ড দে। আর ভাগ এখান থেকে।’
‘কেন?’
‘আমি বলেছি তাই। দিবি? নাকি ছোট আব্বুকে বলব?’

উৎস তড়িঘড়ি করে ফোনটা বের করে আদ্রিশের হাতে তুলে দিলো। আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘নাও গেট আউট।’
উৎস ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বিষন্ন গলায় বলল, ‘বোনটা আমার, অধিকার বেশি তোমার। কি দিনকাল যে পড়লো! মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।’

উৎস বেরিয়ে যেতেই আদ্রিশ নিচতলায় গেলো। রান্নাঘর থেকে ব্রেড আর কফি নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে পায়ের ওপর পা তুলে বসলো। তারপর নিজের ফোন থেকে রোজার ফোনে কল দিলো। কিন্তু প্রায় বারোটা কল দেওয়ার পরেও যখন রোজা ফোন ধরলো না তখন ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পরক্ষণেই রাগ সামলে শান্ত মেজাজ আর ঠান্ডা মাথায় উৎসের ফোনটা হাতে নিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে কফির মগে চুমুক দিয়ে ডায়াল করলো রোজার নম্বরে। সেকেন্ডের মাঝেই রোজা ফোন রিসিভ করে বলল, ‘ভাইয়া তুমি? বাঁচালে। আর কিছুক্ষণ হলেই নির্ঘাত আমার ফোনটা আ-ত্ম-হ-ত্যা করতে চাইতো।’

আদ্রিশ গলার স্বর নিচু করে বলল, ‘কেন? তোমার ফিয়ন্সে ফোন করেছিল বলে?’
ওপাশ থেকে আদ্রিশের গলা শুনতে পেয়ে রোজা জিভ কাটলো। তারপর আমতাআমতা করে বলল, ‘ওহ আপনি? কিন্তু ভাইয়ার ফোন আপনার কাছে কেন?’
‘ভাইয়ের খোঁজ পরে নিও। আমার ফোন রিসিভ করো নি কেন?’

রোজা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘না মানে আমি ঘরে ছিলাম না। ধরার আগেই কল কেটে গিয়েছিল।’
‘তুমি ঠিকঠাক মিথ্যাও বলতে শেখো নি। আমাকে ভয় পাও? নাকি লজ্জা?’
রোজা রেগে বলল, ‘আপনি একটা গার্বেজ। আপনাকে ভয় পাবো আমি? আপনি জানেন আমি রোজা? আর রোজা কাউকে ভয়টয় পায় না।’

আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘সেদিন চু-মু দেওয়ার সময় যেভাবে রিয়্যাক্ট করেছিলে তাতেই প্রুফ হয়ে যায় তুমি আমাকে লজ্জা-ভয় দুটোই পাও। কিন্তু প্রকাশ্যে আনতে চাও না। আর যদি বলো আমি কীভাবে বুঝলাম তাহলে বলবো, যাকে ভালোবাসি তাঁর সবটা জেনে-বুঝে-চিনে নিয়েই ভালোবাসি। আর কাল রাতে তোমার দেওয়া খানিকটা সময়ের জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা।’
প্রসঙ্গটাতে রোজার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো। তাই সে কথা ঘুরাতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করছেন এখন?’
আদ্রিশ হেসে বলল, ‘তোমাকে ভাবা ছাড়া আমার আপাতত কোনো কাজ নেই।’

‘আপনি সবসময় এভাবেই কথা বলেন। একটু তো বদল আনুন।’
‘বোধহয় সেটা পারবো না। আফটার অল জীবনে প্রথম কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছি, তাঁর সাথে ফ্লাট করতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’
রোজা হতাশ গলায় বলল, ‘যা ভালো বুঝুন, করুন। রাখছি।’
আদ্রিশ লাফিয়ে ওঠে বলল, ‘ওয়েট ওয়েট।’
‘আবার কী?’
আদ্রিশ বলল, ‘বাড়ি থেকে একা একা কোথাও বের হবে না কিন্তু। সাবধানে থাকার চেষ্টা করবে। ওকে?’
রোজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

আদ্রিশ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘তোমাকে তো গ্রামের একটা ছেলে বিরক্ত করে। সেজন্য বললাম। ও কিন্তু মোটেও সুবিধের নয়।’
রোজা আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুতে চাইলো না। রাফির কথা মিন করছে আদ্রিশ। কিন্তু ও কীভাবে জানলো? রোজার নিজের মাথায়ই তো নেই কথাটা। ও তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল, ‘আ আপনি কীভাবে ওর কথা জানলেন? ওকে চেনেন আপনি? ম মানে আপনি ও…’

আদ্রিশ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এসব কথা রাখো। আমি ফোন দিলে অবশ্যই ধরবে। আর যেন অন্য কারো ফোন থেকে যোগাযোগ না করতে হয়। আমি আবার এতটাও ফালতু ছেলে না যে, সারাদিন তোমাকে ফোন দিয়ে কথা বলতে চাইবো। যদি এটা করতেই আমার ইচ্ছে করে। কিন্তু সেল্ফ-রেস্পেক্ট বলে একটা কথা আছে না!’

অনুভবে তুই পর্ব ৩২

রোজা হাসি চেপে বলল, ‘আপনার আবার সেল্ফ-রেস্পেক্টও আছে নাকি? বাহ!’
আদ্রিশ রেগে বলল, ‘আমি কিন্তু ফালতু প্রেমিক নই।’
রোজা বিগলিত কন্ঠে বলল, ‘কারণ আপনি রোজাকে ভালোবেসেছেন।’

অনুভবে তুই পর্ব ৩৪