অনুভবে তুই পর্ব ৩

অনুভবে তুই পর্ব ৩
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

রোজা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ওঠে দাঁড়ালো। দুই ভাইয়ের মনোযোগ ওদের দিকে নেই। রোজা ধীরপায়ে দরজা পেরুতে গেলেই আদ্রিশ পেছন থেকে রাগী স্বরে বলল, ‘এই মেয়ে এই, তোমাকে যাওয়ার পারমিশন কে দিয়েছে? চুপচাপ এখানে বসে থাকো, তোমার সাথে হিসাব-নিকাশ বাকি আছে আমার।’

রোজা চমকে ওঠলো। আদ্রিশের ধমকি শুনে চুপচাপ নেহার পাশে গিয়ে বসল। নেহাও অসহায় চোখে তাকালো। ভাইয়ের মাথায় কী চলছে সেটা উৎসও বুঝতে পারলো না। রোজার চেহারা রক্তশূণ্য। ওর সাথে এই যমদূতটার কীসের হিসাব-নিকাশ? ও তো ভালো করে চেনেই না আদ্রিশকে। শুধু জানে নেহার বড় চাচার ছেলে। শাখাওয়াতের সাথে রোজা যে জোর গলায় কথা বলেছে এজন্য ওকে চড়-থাপ্পড় মারবে নাকি?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘তোমাকে কী যেতে বলেছিলাম?’
আদ্রিশের প্রশ্ন শুনে রোজা ইতস্তত করে বলল, ‘না মানে শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছিলেন তাই আরকি!’
‘শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছি? দেখছো না এখানে কথাবার্তা চলছে।’
‘জি দেখছি।’
‘বসে থাকো এখানে।’
‘না মানে আমার ঘুম পেয়েছে, জরুরি কথা থাকলে বলতে পারেন।’

রোজার কথায় আদ্রিশের ভ্রু জোড়া আপনাআপনি কুঁচকে এলো। কুটিল চোখে চেয়ে থাকলো কতক্ষণ ওর দিকে। রোজা ভয় পেয়ে নেহার পাশে গুটিশুটি মেরে বসলো। আজকে ওর কী হয়েছে নিজেই বুঝতে পারছে না। এমনভাবে ঠাস ঠাস করে মাঝেমাঝে কথা বলে ওঠছে যেন ও কত এক্সট্রোভার্ট। কিন্তু তা তো সে নয়। আদ্রিশকে এমনভাবে দেখে উৎস বলল, ‘ভাই কি বলবা ওরে? ও তো ঘুমকুমারী, ওরে ঘুমাইতেই যাইতে দাও।’
আদ্রিশ উৎসের দিকে তাকালো। চিন্তিতমুখে উত্তর দিল, ‘নেহা-ফিহা আমাদের বোন হয়েও এত দুর্বল, আর এই মেয়েটা, এই তোমার নামটা যেন কী?’

রোজা বলার আগেই উৎস বলল, ‘ভাই, ওর নাম রোজা। আমার ছোট খালামনির মেয়ে।’
‘ওর বাবা স্কুলমাস্টার? হরষপুর গ্রামে যে তোর একজন খালু ছিল? ওনার মেয়ে?’ জিজ্ঞেস করল আদ্রিশ।
উৎস খানিকটা অবাক হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুম। কিন্তু তুমি দেখি ডিটেইলস এ বলে দিলা?’
‘আরে, ডিটেইলস এ বলেছি কারণ আমি ওখানে গিয়েছিলাম তোর আব্বু মানে ছোট চাচার সাথে। এই মেয়েটা..রোজার দ্বিতীয় জন্মদিন ছিল বোধহয়।’

‘এত আগের কথা তোমার মনে আছে ভাইয়া? তোমার বয়স কত তখন?’ ফিহা বিস্মিত চাহনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘আট বছর। আর মনে না থাকার তো কোনো কারণ নেই, আদ্রিশ কখনো কিছু ভুলে না।’
রোজা শুধু ওদের কথা শুনছে। এই ছেলেটা ওর জন্মদিনে গিয়েছিল? ওর গ্রামের নামও জানে? বাহ! এত আগের ঘটনা কত অবলীলায় বলে দিলো যেন কালকের ঘটনা। আদ্রিশ তীক্ষ্ণ চোখে রোজাকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কীসে পড়ো তুমি?’
এবারও উৎস জবাব দিল, ‘ভাই, ও তো ফার্স্ট ইয়ারে এডমিশন নিয়েছে আমাদের এখানকার একটা ভার্সিটিতে। গ্রামে ভালো কলেজটলেজ নেই বলে খালু ওরে এখানে পাঠায়া দিসে।’

‘এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে না-কি?’
‘হ্যাঁ। হোস্টেলে দিতে চেয়েছিল, আম্মু জোর করে এখানে নিয়ে আসছে।’
‘সেটাই। খালার বাড়ি থাকতে হোস্টেল কেন!’ নেহা আনমনা হয়ে বলল।
আদ্রিশ রোজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পড়াশোনায় কেমন তুমি? ভালো না খারাপ?’
রোজা বিরক্ত হলো। লোকটা এত কথা বলছে কেন? বাচাল নাকি? যেভাবে একটার পর একটা প্রশ্ন করছে মনে হচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে বসেছে। ও বলল, ‘জানি না।’

‘জানো না? পড়াশোনা করো না তুমি?’
‘জি করি।’
‘তাহলে বলতে পারছো না কেন?’
অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রোজা উত্তর দিল, ‘এমনি বলতে পারছি না।’
‘তুমি পড়াশোনায় কেমন সেটা তো তুমিই বলতে পারবে। অন্য কেউ কী তোমার পড়া পড়ে দেয় যে, তুমি জানো না? নিজের ওপর কনফিডেন্স নেই?’
রোজা বিড়বিড় করে বলল, ‘আছে তো!’
‘তাহলে?’

রোজা বিরক্ত হলো। বলল, ‘আমি পড়াশোনায় তেমন ভালো নই।’
আদ্রিশ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘ভালো না? এই উৎস , তাহলে একটা গাধা মেয়েকে চাচী আমাদের বাসায় নিয়ে আসছে? ফেলটেল করলে তো মানসম্মান যাবে আমাদের!’
উৎস ধৈর্যহীন কন্ঠে বলল, ‘ভাই ওরে যেতে দাও। ও ঘুমাক, তোমার ইন্টারভিউর চাপে পইড়া সে চ্যাপ্টা হইয়া যাইতেসে। পরে আর খুঁইজা পাওয়া যাইবে না।’

আদ্রিশ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না পেয়ে চোখ গরম করে তাকালো উৎসের দিকে। আমতাআমতা করে বলল, ‘না মানে ভাই, রাত অনেক হয়েছে। সেজন্যই বলছিলাম আর কি। নেহা-ফিহা-রোজা’র তো কাল সকালে এক্সারসাইজ আছে।’
‘এক্সারসাইজ?’
উৎস ফিচেল হেসে বলল, ‘না মানে..’
‘স্টপ দিস ননসেন্স।’

আদ্রিশ নিজের রাগটা চেপে নিলো। তিনবোনের দিকে ফিরে বলল, ‘বাই দ্যা ওয়ে নেহা। তোরা শহরে থেকেও যতটা ভীতু, এই মেয়েটা তা নয়। তোর ওই সো কল্ড হবু বরটার মুখের ওপর যেভাবে প্রতিবাদ করেছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু আরেকটু স্ট্রং হওয়ার দরকার ছিল, শেষ মুহূর্তে ওই কুত্তার বাজে কথা শুনে যেভাবে চোখের জল নাকের জল এক করছিল সেখানেই আউট…. ‘
রোজা অবাক। সেই সাথে উৎস আর নেহাও। ওই ঘটনার পুরোটা তো আদ্রিশকে বলে নি ওরা, আর না তো ও সেখানে ছিল। কিন্তু যেভাবে রোজার অবস্থা বর্ণনা করছে যেন ও সত্যিই সেখানে ছিল আর গভীর পর্যবেক্ষণের সহিত দেখছিল ওদের কান্ডকীর্তি! তাহলে কি ফিহা-ই ডিটেইলস বলেছে? কিন্তু কখন? বাড়ি আসার পর থেকে ওরা তো একসাথেই ছিল! নেহা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘এসব তোমায় কে বলেছে ভাইয়া?’
‘বলেছে না, লাইভ দেখেছি। তোরা কী আমায় বোকা ভাবিস?’
নেহা থতমত খেয়ে বলল, ‘না না..’
আদ্রিশ রেগে বলল, ‘ফিহার ফোনে দেখেছি। লাইভ টেলিকাস্ট। আমার তখন ইচ্ছা করছিল তোর গাল চড়ায়া লাল করে দিই নেহা। এত ন্যাকামি কোথা থেকে শিখেছিস তুই? দিতে পারিস নাই ওই কুত্তার মুখের ওপর ঘুষি?’

নেহার মুখ চুপসে গেল। ফিহা এতটা পাজি ও ভাবতেই পারে নি৷ তখন তো নিজে কিছু করলোই না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল আবার আদ্রিশকেও নাকি এসব দেখিয়েছে। কখন করলো এই মেয়েটা এসব? নেহা রাগ নিয়ে ফিহার দিকে তাকিয়ে দেখল ও মিটিমিটি হাসছে। নিজে ভালো সাজা হচ্ছে এখন! যত্তসব। আদ্রিশ ওদেরকে আরো খানিকক্ষণ ধমকাধমকি করলো। অতঃপর উৎসের কথায় ওদেরকে ছেড়ে দিলো। রোজা একছুটে সবার আগে ঘরে চলে গেল। বিছানায় বসে হাফ ছাড়তে ছাড়তে বিড়বিড় করল, ‘পাগলছাগল কোথাকার। হিসাবনিকাশ তো নয় যেন যমদূত এসেছে শেষ নিঃশ্বাসটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য!’

নেহা রাগান্বিত হয়ে ঘরে এসেই ফিহার সাথে ঝগড়া লেগে গেল। ওদের এসবে বিরক্ত হয়ে রোজা বলল, ‘তোমাদের বাসায় থাকব না আমি আপু, এরকম অদ্ভুত যমদূতের সাথে এক বাড়িতে থাকা অসম্ভব।’
নেহা অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছিস তুই রোজা?’
রোজা মিনমিন করে বলল, ‘ আমি তোমাদের বাসায় থাকব না আপু, কালই হোস্টেলে চলে যাব। এই লোকটার সামনে দ্বিতীয়বার পরতে চাই না। এভাবে কারো সাথে কেউ কথা বলে?’
নেহা ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বলল, ‘আরে তুই নতুন তো, তাই ভাইয়া এমন করেছে। আমাদের ভাইয়া এতোটাও খারাপ নয়, যতটা তুই ভাবছিস।’

অনুভবে তুই পর্ব ২

‘এত খিটমিটে কেউ হয়? যেভাবে কথা বলছিল যেন, এক্ষুনি থাপ্পড় মেরে দেবে আমাকে।’
‘আজব, তোকে কেন থাপ্পড় দিবে?’ ফিহা বললো।
‘তোমার ভাইয়ের চাহনি দেখলেই মনে হয় গলা টিপে ধরবে। উৎস ভাইয়া তো এমন নয়। ওনাকে কী ছোটবেলায় করল্লার রস খাইয়ে দিয়েছিল? মধু দেয় নি মুখে?’
রোজার কথা শুনে ফিহা হেসে বলল, ‘ভাইয়ের সামনে গিয়ে বল না, থাপ্পড় দিয়ে তোর গালের মাংস ফাটিয়ে দেবে।’
‘থাপ্পড় খাওয়ার শখ নেই ফিহা আপু।’

অনুভবে তুই পর্ব ৪