অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫৩
লিজা মনি
ইয়ানাকে অগ্নি গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে। ইয়ানা গাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করে উঠে। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়তে নিবে এমন সময় অগ্নি ইয়ানাকে হেচকো টানে পুনরায় সিটে বসিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। এরপর একটা হ্যান্ডকাফ দিয়ে হাত বেঁধে দেয়। গম্ভীর হয়ে বসে গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রাখে।
ইয়ানা — পাগল হয়ে গিয়েছেন? রাত একটার সময় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? পাগলামি না করে বাড়িতে দিয়ে আসুন।
ইয়ানার কোনো কথায় অগ্নি উত্তর দেয় নি। যেন কথা কানেই প্রবেশ করে নি। গম্ভীর আর নিস্তব্দ হয়ে বসে আছে। দৃষ্টি হুডির আড়ালে বুঝা মুশকিল। গাড়ি শাঁ শাঁ করে গন্তব্যে এগিয়ে যেতে থাকে। অগ্নিকে গম্ভীর দেখে ইয়ানা আর প্রশ্ন করে নি। চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে রাখার কারনে বাবা – মায়ের সব স্মৃতি ভেসে উঠে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে আচমকা। ইয়ানা বাম হাত দিয়ে পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। ভিতরে ভিতরে ফুঁপিয়ে উঠছে বার বার। ধীরে ধীরে অগ্নির গাড়িটা অন্ধকারের ভিতরে প্রবেশ করতে থাকে। ইয়ানা বাহিরে চোখ রাখতেই আতকে উঠে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করেছে। মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। ধীরে ধীরে গাড়িটি গভীর অরন্যে প্রবেশ করে ঝোঁপের আড়ালে থামে।
ইয়ানার অবাক কন্ঠ,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” এত রাতে কোথায় নিয়ে এসেছেন?
অগ্নি গাড়ি থেকে নেমে এতক্ষনে গম্ভীর আওয়াজে বলে,,
” ভয় পাচ্ছো?
ইয়ানা– ভয় পাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? যেখানে আপনার পুরো অস্তিত্বটাকেই ভয় পায় সেখানে আপনার সাথে একাকী এই গভীর জঙ্গলে এসেছি। ভয় পাবো না বলছেন?
অগ্নি হুডির আড়ালে বাঁকা হেসে বলে,,
” যখন এতটা ভয় পাও তাহলে তার বুকে শান্তির স্থান খুঁজো কেনো? তার জন্য এত ব্যাকুল কেনো সুইটি?
ইয়ানা শ্বাস টানে ধীর ভাবে। নিম্ন আওয়াজে বলে,,
” প্রশ্নটা আমি নিজেই নিজেকে করি হাজার বার। সেখানে আপনি উত্তর চাওয়াটা বোকামি। কেনো নিয়ে এসেছেন এখানে?
অগ্নি ইয়ানার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামায়। এরপর ঝোঁপ আড়াল করে সেই পুরনো বাড়িটার সামনে দাঁড়ায় যেটা টর্চারসেল নামে পরিচিত। ইয়ানা আশ্চর্য হয়ে সব জায়গায় চোখ দিয়ে পরখ করে। অস্ফূর্ত আওয়াজে জিজ্ঞাসা,করে,,
” আপনার টর্চার সেল এইটা?
অগ্নির রহস্যময় হাসে। ইয়ানার হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করে। ইয়ানা শুধু সব কিছু খুঁটিয়ে দেখছে। বাহির থেকে যতটা পুরনো মনে হয়েছিলো ভিতরে কিছু নতুনত্ব আছে। ইয়ানার ভাবনার মধ্যেই তাকে নিয়ে একটা বিশাল বড় গোপন কক্ষে প্রবেশ করে। টর্চার সেলের লোহার দ্বারটি কর্কশ গর্জনের মতো বিকট শব্দে খুলে যায়। সেই শব্দ সময়ের জীর্ণ শিরায় ধ্বনিত হয়ে এক অশরীর প্রতিধ্বনির মতো প্রতিক্রিয়া ছড়ায় চারদিকে। ইয়ানা আশে – পাশে তাকিয়ে সামনে তাকাতে যাবে এমন সময় আচমকা পিছিয়ে যায়। অভ্যন্তরে প্রবেশ করামাত্র, দেহস্নায়ুতে ছুরি চালানো শীতলতা যেন হাড়ের শিরায় গেঁথে বসে। বাতাসে স্রোতের মতো ভেসে বেড়ায় জীর্ণ রক্ত ও জ্বালানি তেলের গন্ধ, যার মধ্যে মৃত আত্মার আর্তনাদ মিশে এক প্রকার অশুভতা সঞ্চার করে।
চোখ বন্ধ করে অগ্নির হাত শক্ত করে চেপে ধরে। তার চোখের সামনে স্টিলের উপর শক্তিপোক্ত দেহের আলবার্টকে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ তুলে নেওয়া হয়েছে দুইটা। চোখ থেকে রক্ত পড়ছে গড়িয়ে। শরীরের গোপন জায়গা থেকে শুরু করে ভিবিন্ন জায়গায় এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরো শরীরে অসংখ্য ক্ষতের দাগ। মুখের ভিতর থেকে লালা সহ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কেন্দ্রে স্থাপিত শীতল স্টিল নির্মিত নির্যাতন-শয্যা, যার উপর বিবর্ণ এক মানবদেহ শায়িত রক্ত ও মাংসের অবশেষমাত্র। সেই দেহে দৃষ্টিপাতমাত্রই স্পষ্ট হয়। মানবতা এখানে কেবল তামাশা। শিরা-উপশিরার ভেতর দিয়ে যন্ত্রণার নদী বয়ে গেছে বারবার।
ইয়ানা এক নিঃশব্দ বিস্ময়ে দণ্ডায়মান, জড়তায় আচ্ছন্ন নয় বরং অভ্যন্তরের প্রতিটি স্নায়ুতে বিস্ফোরিত রক্তচাপ পাথরে খোদাই হয়ে যাচ্ছে।
ইয়ানা অগ্নির দিকে তাকিয়ে আগুনঝরা চোখে তাকিয়ে বলে,,
‘ আমাকে কেনো এনেছেন এখানে? এমন বিকৃত জিনিসের স্বাক্ষী করবেন বলে?
অগ্নি ইয়ানার সেই চোখে চোখ রেখে গম্ভীর আওয়াজে শুধায়,,
” বাবা – মায়ের বিকৃত লাশ যখন দেখেছো তখন ভয় করে নি? সেটা তো এর চেয়ে ও জঘন্য ছিলো।
ইয়ানা চোখ নামিয়ে নেয়। অগ্নি ইয়ানাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা চেয়ারে বসে।
ইয়ানার দিকে তাকিয়ে আলবার্টের দিকে ইশারা দিয়ে বলে,,
“স্টিলের তীক্ষ্ণ শীতলতায় শায়িত, ক্ষীণ নিঃশ্বাসে মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা যে অর্ধমৃত দেহটি, সে-ই ব্যক্তি তোমার বাবা-মায়ের রক্তে হাত রাঙিয়েছে। এখন বলো তুমি কী করতে চাও তাকে? তোমার সামনে বিছানো রয়েছে প্রতিশোধের সমস্ত সম্ভাব্য উপকরণ– চিকচিকে ধারালো দা, ধাঁরালো করাত, নৃশংস ছুঁরি,উত্তপ্ত চা-পাতির ছ্যাঁকা দেওয়ার যন্ত্র, এমনকি অভিশপ্ত অ্যাসিডে পূর্ণ কাঁচের শিশি
যা কেবল চামড়া নয় বরং অস্তিত্ব পর্যন্ত গলিয়ে দিতে সক্ষম। তোমার হাত এখন ন্যায়বিচারের অস্ত্র।
সময় সীমিত। দয়া, করুণা, বা সহানুভূতির জন্য এখানে স্থান নেই। এই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো মানবিকতা আঁকড়ে ধরবে নাকি পশুত্বে স্নান করে প্রতিশোধের পূর্ণতা ঘটাবে? তোমার রাগ এখন পরিণতির ভাষা চায়।
সে ভাষা কি বাঁচিয়ে ছেড়ে দেওয়া নাকি যন্ত্রণার প্রতিটি উপকরণ দিয়ে তাকে শূন্যতার দিকে ঠেলে দেওয়া? বলো কী শাস্তি প্রাপ্য তার যে তোমার অস্তিত্বের জন্মদাতাদের নিঃসংশয় হাতে হত্যা করেছে? শুরু করো ক্ষতবিক্ষতের আদিম খেলা।
অগ্নির প্রতিটি শব্দ শব্দমাত্রা নয় বরং বিষাক্ত বিদ্যুত্স্পর্শ। যা ইয়ানার স্নায়ুর গহীনে প্রবেশ করে রক্তকে দহন করিয়ে তোলে। তার শরীর একপ্রকার অনিচ্ছাসম্পন্ন কাঁপন জর্জরিত হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। ঠিক তার শরীর নয় আত্মা কাঁপছে।
প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি ধ্বনি।একেকটি ভয়াবহ সিদ্ধান্তের নিঃশব্দ সংকেত। সময় থমকে যায়। শব্দ থেমে যায়।
ইয়ানার চোখে-মুখে রক্তক্ষরণময় আগুনের প্রতিচ্ছবি জ্বলে ওঠে এক এমন দীপ্তি।যা ভয় নয় বরং প্রতিশোধের উন্মত্ততা।
ধীরে ধীরে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় সেই অর্ধ-মৃত দেহটির দিকে—আলবার্ট।সেই পিশাচ যে তাদের বাবা-মায়ের করুণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল। যার নির্মমতার তাপে দু’টি বোনের শৈশব স্মৃতি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ইয়ানা আজ যে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতিটি ব্যথার ভিত্তিপ্রস্তর এই মানুষরূপী দানবটি।
তার মনে এখন মানবিকতা, সহানুভূতি বা মনুষ্যধর্মের লেশমাত্র নেই। বরং তার ভেতরের নীরব প্রতিবাদের ভূত জেগে উঠেছে ভয়ংকর রূপে।
এমন সময়ে অগ্নি সামনে আসে। অগ্নি এসে দাঁড়ায়। মুখে এক রহস্যময় হাসি নয়ন যুগলে যেন ক্ষুব্ধ দাবানলের বিভীষিকা। তার সেই নিরব জ্বলন্ত দৃষ্টির মধ্যে য এক অদৃশ্য পরোয়ানা মিশে আছে হত্যার অনুমোদন।
ইয়ানা তাকায় ধীরে ও নিঃশব্দে। মুখে ভাষাহীনতা আর চোখে ঝড়। তার দৃষ্টি জিজ্ঞাসু নয় বরং জাগ্রত। এই মুহূর্তে তার সামনে দুটি পথ ক্ষমা অথবা নির্মূল। ঘরের নিঃশব্দতা ঘনীভূত হয়। শুধু দূরে, টর্চার টেবিলের পাশে রাখা করাতটা ধাতব কণ্ঠে ঠুকঠুক শব্দ তোলে অপরাধীর জন্য তার ফাঁস রচিত হচ্ছে।
— আপনি আমাকে খুন করতে বলছেন? ইয়ানার অবাক কন্ঠ।
ইয়ানার কণ্ঠস্বর বিস্ময়ের অতল থেকে উঠে আসা এক অপ্রস্তুত প্রশ্ন।নিজের শোনা শব্দগুলোই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। বাক্যের প্রতিটি শব্দ তার ঠোঁটে জমে উঠছে। তবু উচ্চারিত হচ্ছে স্তব্ধতার ভেতর দিয়ে।
অগ্নির জবাব আসে এক নিঃশব্দ আর নিরাসক্ত স্বরবেগে,
” প্রতিশোধ নিতে বলছি। আর সেটা তোমাকে করতেই হবে।
ইয়ানার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। মুখে হাত দিয়ে হাটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসে পড়ে।
— আমি পারব না এমন কাজ করতে।
অগ্নি — তোমাকে তো পারতেই হবে বেইবি।
ইয়ানা — এমন জঘন্য কাজ আমি কিভাবে করব? আমি পারব না মি, চৌধুরি। আমি আপনার মত নয়। কারোর বুকে ছুঁরি চালানোর ক্ষমতা আমার নেই। এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে আমি অক্ষম।
তার কথায় আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাকুলতা নেই। আছে এক গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। যেখানে সে বোঝে প্রতিশোধ এক নির্মম ন্যায়ের আরেক নাম।কিন্তু সেই ন্যায়ের ভার বহনের মত হৃদয় তারা সকলেই পায় না।
অগ্নির গম্ভীর আর ভয়ানক নিশ্বাস। অগ্নি দাঁড়িয়ে থাকে। নড়েও না। গলাটি ঠান্ডা লৌহশীতল স্বরে সরে আসে,,
“আজ তুমি এখানে এসেছো অগ্নি চৌধুরির স্ত্রী হয়ে।
কোনো করুণা-আচ্ছন্ন, ছলনামুক্ত অবলা নারীর ছায়া হয়ে নয়। স্টিলের নির্মম কঠোরতায় জর্জরিত ছিন্নভিন্ন যে দেহটা পড়ে আছে সে-ই তো সেই নরাধম। যে তোমার পিতামাতাকে নিষ্ঠুরতার সংজ্ঞায় পুনর্লিখন করে মরণযন্ত্রনায় নিমজ্জিত করেছিল।তুমি আজ শুধুমাত্র একজন স্ত্রী নও।তুমি সেই মৃত পিতামাতার জীবিত সন্তান
যার রক্তে এখনো অনুচ্চারিত কান্না ও চিৎকার প্রবাহমান।
ভেবে দেখো এ প্রতিশোধ আমার নয়। কারণ আমার পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেনি।তাদের হৃদয় আজো ধকধক করছে।তবে তোমার…? তাদের হৃদয় তো নিষ্পেষিত, নির্বাক।তাদের রক্ত তো আজ মৃতু্যর কণ্ঠে চিরতরে নির্বাসিত।এখন বলো এই নির্মমতা কি তুমি ক্ষমা করে দেবে? তুমি কি এই দানবকে স্পর্শহীন রেখে ফিরে যাবে?
আমি পথ সহজ করে দিয়েছি। শুধু শেষ আঘাতটি তোমার হাতে রেখে দিয়েছি।শেষ রক্তবিন্দুটুকু ঝরানোর অধিকার তোমারই প্রাপ্য।তুমি যদি সেই নারী হও।যে নিজ চোখের সামনে পিতামাতার হত্যাকারীকে দেখে ফিরে যায়
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়সে কেমন নারী? কেমন সন্তান?এই কি তবে সেই ভালোবাসা? যা তুমি এতকাল ধরে বলে এসেছো?”
ইয়ানার কান্না মিশ্রিত সুর, গলা কাঁপছে,
” এমন ভয়ংকর ইমোশনাল ব্লেকমেইল কেনো করছেন? আমি পারব না কাউকে ক্ষতবিক্ষত করতে। আমি কাউকে ক্ষতবিক্ষত করার মতো নির্মম নই।এই ধরনের বর্বরতা আমার হাতে মানায় না। আমি পারি না… আমি পারব না।
অগ্নির বাঁকা হাসি,,
” সেটা আমি পারি না খুব ভালো করেই জানো। যদি এইসব পারতাম তাহলে আজ তোমার চোখে ঘৃনার বদলে ভালোবাসা থাকত। এইসব ফাকিং মেলোড্রামা কাজ আমি করি না জান। তোমাকে যা আদেশ করেছি সেটা করো। নিজের বাবা – মায়ের খুনের বদলা নাও। খুনী চোখের সামনে যাস্ট শিকার করো। আর এই মুহূর্তে আমার দিকে না তাকিয়ে সেদিকে ফোকাস করো। যতটা নির্মম হওয়া লাগে হও।
ইয়ানা বিরবির করে উঠে,
” পারব না আমি। এত বড় কাজ আমি করতে পারব না।
অগ্নি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ইয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে বাহু ধরে হেচকা টানে দাড় করায়। ইয়ানা অগ্নির রাগান্বিত চোখের দিকে তাকায়। অগ্নি দাঁত কিড়িমিড়িয়ে উঠে,,
” তর ইমোশনাল নাটক দেখার জন্য এখানে এসেছি হ্যা? কথা কানে যাচ্ছে না আমার? বলছিনা এই অজ্ঞান দেহটাকে ক্ষত – বিক্ষত করতে? কার জন্য মায়া হচ্ছে তর? আমার বউ হয়ে অন্য পুরুষের জন্য মায়া কেনো হবে তর?
অগ্নির প্রতিটা ধমকে ইয়ানা কেঁপে উঠে। ভয়ে চোখ নামিয়ে নেয় সে। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস টানে। চোখের সামনে আসাদ হোসেন আর সেলিনা হোসেনের বিকৃত পুড়ে যাওয়া লাশ ভেসে উঠে। কত নির্মমভাবে মৃত্যু হয়েছে তাদের । আর তাদের মেরেছে স্টিলের উপর পড়ে থাকা লোকটা। কেনো মারতে পারছি না আমি? কিসের এত দিধাবোধ?
নিজের বাবা – মায়ের খুনির প্রতি তুই ভালোবাসা দেখাচ্ছিস ইয়ানা? ছিহহহ! হাতে করাত তুলে নে আর দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেল। আগে করিস নি তো কি হয়েছে। আগে তো আর তর বাবা- মাকে কেউ মারে নি। আগে পরিস্থিতি তকে এমন পর্যায়ে দাড়া করায় নি। তর জীবন পাল্টে গিয়েছে। তর অতীত যা ছিলো ভুলে যা। তর ভবিষ্যতে কি হবে তার ও নিশ্চয়তা নেই। নিজের বাবা – মায়ের খুনের প্রতিশোধ নে। ব্যাস দেহটাকে দুইটা টুকরো কর।শুরু হয় এক ধাতব বিকট ঘৃণা-ভরা শব্দ।
আলবার্টের গলায় আটকে থাকা কান্নার ঢেউ শব্দহীন চিৎকারে রূপ নেয়। তবে সেই চিৎকার, সেই অনুনয়, সে আর ইয়ানার কাছে কিছুই নয়। তাতে নেই ক্ষমার আবেদন।
নেই মানবিক আর্তি।আছে কেবল কৃত অপরাধের শেষ।
ইয়ানার চোখ ঝলঝল করে উঠে। অগ্নির দিকে এক পলক তাকিয়ে ধীর পায়ে চলে যায় স্টিলের কাছে। স্টিলের উপরে জ্ঞন হারিয়ে অর্ধমৃত হয়ে পড়ে আছে আলবার্ট। চারদিকে আজ খুব পরিষ্কার। আজ কোনো দুর্গন্ধ, গলিত পচা মাংস, রক্ত নেই। হয়ত ইয়ানা এইসব সহ্য করতে পারবে না তাই।
ইয়ানা আলবার্টের পুরো দেহের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে অগ্নির দিকে তাকিয়ে বলে,,
” ওর জ্ঞান ফিরাবেন না?
অগ্নি — প্রয়োজন নেই। আমি চাই না ও তোমাকে দেখুক।
ইয়ানা মুচকি হাসে। কি জানি আজ কি হয়েছে। আজ এই হাত রক্তাক্ত করতে খুব ইচ্ছে করছে। মনের ভিতর যেন কোনো হায়েনা ডুকে পড়েছে। এমন এক বিকৃত অবস্থা দেখেও একটুও মায়া হচ্ছে না।
আগের ইয়ানা হলে হয়ত অগ্নির পায়ে পড়ত। লোকটাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য হয়ত মিনত করত। কিন্তু লোকটা তার বাবা- মাকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
ইয়ানা নিশ্বাস টেনে সবচেয়ে ধারালো করাত দুই হাতে তুলে নেয়। পুরোটা করাতে তাকিয়ে দেখে ভালোভাবে। করাতের প্রতিটা খাঁজ ছুঁরির চেয়ে ও ধারালো।
— আমার চোখটা বেঁধে দিবেন মি, চৌধুরি?
অগ্নি গম্ভীর হাসে। এতক্ষন ইয়ানার ভাবভঙ্গি দেখছিলো। ইয়ানার ডাকে এগিয়ে যায় সেদিকে। ইয়ানার গলায় থাকা উড়নাটা চোখে ভালোভাবে বেঁধে দেয়। এরপর সরে আসে ইয়ানার থেকে।
ইয়ানা নিশ্বাস টেনে করাতটা একদম আলবার্টের বুকের মাঝ বরারবর বসিয়ে দেয়। করাত আর হাড্ডির সংঘর্ষে একটা সব্দ হয়। আলবার্ট এতক্ষন অজ্ঞান ছিলো। নিজের শরীরে আঘাত পেয়ে ক্ষুধার্ত বাঘের মত ছটফটিয়ে উঠে। ইয়ানা এত শক্তি প্রয়োগ
করে আঘাত বসিয়েছে কিন্তু আহামরি কিছু করতে পারে নি। আঘাতটা গিয়ে একদম বক্ষের মধ্যে লাগে। আলবার্ট ইয়ানার দিকে তাকাতে যাবে কিন্তু তার আগেই অগ্নি সামনে চলে আসে। পিছনে হাত দিয়ে ইয়ানা দুরে সরিয়ে দেয়।
অগ্নি– আমার বউয়ের দিকে তাকানো এখন তর জন্য নাজায়েজ। যদিও তর চোখ নেই তবুও তর সাথে বিশ্বাস নেই। মনের চোখ দিয়ে ও দেখে ফেলতে পারিস। কোনো রিস্ক নিতে চাই না।
এরপর ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে,,
” নিজের শরীরে উড়না টেনে নাও। যদি ওকে মারো তাহলে চোখ স্বাক্ষী রেখে মারবে।
অগ্নির গম্ভীর আওয়াজ পেতেই ইয়ানা চোখের বাঁধন খুলে নেয়। এরপর ভালোভাবে মাথায় উড়না পেচালে অগ্নি সামনে থেকে সরে আসে। ইয়ানা আলবার্টের মুখের দিকে তাকায় না। এই ভয়ংকর রক্তক্ত চোখ সে সহ্য করতে পারবে না। যে কোনো সময় জ্ঞান হারাতে পারে।
ইয়ানা এখন কোনো দিকে তাকায় না। করাতটা হাতে নিয়ে একদম গলা বরাবর বসিয়ে দেয়। ফেঁচ ফেঁচ শব্দ কানে আসতেই নিশ্বাস টানে পুনরায়। হাত কাঁপছে, ভিতরে কাঁপছে কিন্তু ভিতরে প্রতিশোধের আগুন ঝলঝল করছে। ইয়ানা এক কোঁপে থামে নি । এম শত শত অজস্র কোঁপ বসায় আলবার্টের শরীরে। জানা নেই কি হয়েছে শরীরের অবস্থা। নিজের চোখ শক্তভাবে বন্ধ করে রেখেছে। ইয়ানা থামে। হাঁপিয়ে উঠে সে। বড় বড় নিশ্বাস টেনে করাত রাখে স্টিলের উপর শব্দ করে । নিজের চুল খমচে ধরে সরে আসে সেখান থেকে। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে শুধু শ্বাস টানছে।
অগ্নি এতক্ষন চেয়ারে বসে ছিলো গম্ভীর হয়ে। আলবার্টের ক্ষত – বিক্ষত লাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে ইয়ানার কাছে যায়।
— বাব্বাহ! তুমি তো দেখছি আমার থেকে ও বড় কিলার। পুরো শরীর রক্তে মাখা- মাখি করে ফেললে। মাত্র একবারের মাথায় এত নির্মম অবস্থা করলে বউ? একটু মায়া কাজ করে নি ব্যক্তিটার উপর? কি করে পারলে তুমি ইয়ানা এমন বিকৃত কাজ করতে। একজনের জীবন নিয়ে নিতে কলিজা কেঁপে উঠলো না জান?
ইয়ানা এতক্ষনে অগ্নির দিকে তাকায়। অগ্নি ঠোঁট কামড়ে হাসে।ইয়ানার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। অগ্নির দিকে তাকিয়ে অস্ফুর্ত আওয়াজে বলে,,
” কথা দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছেন অগ্নি চৌধুরি। আমার কথা আমাকেই ফিরে দিচ্ছেন। আমি কোনো বিনা কারনে কারোর বুকে ছুঁরি চালাই নি। আমার বুকের ভিতরে বয়ে চলে আগুন আর কষ্ট যদি একবার অনুভব করতে পেরেছেন? স্বামীর প্রতারনা, বাবা – মায়ের খুন সব মিলিয়ে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। ধরে রাখুন নিজের সাথে ভালোভাবে আমাকে। নাহলে গভীর সাগরে তলিয়ে যাব।
ইয়ানা আলবার্টের দিকে তাকিয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি। এত তরল রক্ত আর বিকৃত ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে জ্ঞান হারায় অগ্নির বুকে। অগ্নি ইয়ানার শরীরটাকে নিজের বুকের সাথে আগলে নেয়।
কপাল কুচকে আলবার্টের দিকে তাকায়। পুরো শরীরে ক্ষতের দাগ। রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে মেঝেতে। কোনো অঁঙ্গ আলাদা হয় নি। শরীর থেকে মাংস উঠে এসেছে। অগ্নি মোবাইলের মাধ্যমে কাউকে মেসেজ দিয়ে ইয়ানাকে পাজা কোলে তোলে নেয়। ইয়ানার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,,,
” একটা মানুষ এতবার জ্ঞান কিভাবে হারায়? থাপ্পর দিলে ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে । আদর করলেও জ্ঞান হারিয়ে পড়ে। কাউকে খুন করতে দেখলেও অজ্ঞন হয়ে পড়ে। তাহলে করবটা কি আমি?
অগ্নি ইয়ানাকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মানবদেহের প্রতিটা লোহিত কণিকা টগবগিয়ে উঠে। নিশুতি এই নিস্তব্দ রাতে পুনরায় আবার সেই টর্চার সেলে প্রবেশ করে। স্টিলের উপর ক্ষতবিক্ষত আলবার্টকে দেখে এক পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ে। অগ্নির সেই হাসি টর্চার সেলের প্রতিটা ইটকে জাগিয়ে তুলে। অগ্নি হাসতে হাসতে আলবার্টের কাছে এসে হিসহিসিয়ে বলে,,,
” ব্লাডি বিচ! নিজেকে চালাক ভেবে কাজ করাটা তো বোকামি আলবার্ট। কি ভেবেছিস তুই মেরেছিস? তুই যে বোম ফিট করেছিস সেটা আমার আগের থেকেই জানা। চৌধুরি বাড়ি থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় আমার গোপন বডিগার্ড রাখা। প্রতি মুহূর্তের আপডেট আমার সম্মুখে এসে হাজির হয়। আমি মারার সুযোগ করে দিয়েছি তাই মারতে পেরেছিস। যদি আমি চাইতাম তাহলে সেই আগুনে তারা নয় তুই পুড়ে মরতি আলবার্ট। যারা আমার থেকে আমার বউকে ছিনিয়ে নিতে যাবে তাদের কে আমি নরকের দোয়ারে ও নিয়ে যেতে পারি। আমার অনুপস্থিতিতে আসাদ হোসেন ডিভের্সের কাজ করছিলো ভাবতে পারছিস একবার আলবার্ট। লোকটাকে জানে আমি কখনো মারতে চায় নি। কিন্তু মাঝ পথে এসে তুই এইভাবে মারার পরিকল্পনা করবি কে জানত? ভালোই হয়েছে মেরেছিস। কিন্তু তর এমন ভুল পদক্ষেপে আমার বউটা কষ্ট পাচ্ছে। প্রচন্ড কান্না- কাটি করছে। কিন্তু সেই কান্না আমার একদম সহ্য হচ্ছে না।
অগ্নি হাতে একটা ধাঁরালো ছুঁরি নেয়। এরপর সেটা আলবার্টের পেটের ভিতরে ডুকিয়ে ঘুরাতে থাকে। হিংস্র জানোয়ারের মত ব্রাউন কালারের চোখগুলো ঝলঝল করছে। ঠোঁটে এক তৃপ্তিময় পৈশাচিক হাসি। ছুঁরির আঘাত নাড়িভুঁটি কেটে যায়। পেট ফাকা করে কলিজাটা বের করে স্টিলের উপর রাখে। এরপর কলিজাটাকে অসংখ্য টুকরো করে। শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। এরপর শরীরের প্রতিটা অঙ্গকে কেটে আলাদা আলাদা স্থানে রাখে। বর্তমানে আলবার্টের দেহটা ছোট ছোট টুকরোতে ভিবক্ত।
সকালের আবহাওয়ায় থাকে এক অনন্য স্বচ্ছতা। এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি। সূর্য তখনও পুরোপুরি উত্তাল হয়ে ওঠেনি কিন্তু তার কোমল রশ্মি আলতোভাবে ছুঁয়ে যায় গাছের পাতা, ঘাসের ফোঁটা, জানালার কাঁচ। বাতাসে থাকে শিশির ভেজা হালকা ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ। প্রকৃতির এক মৃদু চুম্বন। চারপাশ নিস্তব্ধ শুধু পাখির কলতান সেই নীরবতাকে ভেঙে জাগিয়ে তোলে এক সুরম্য সংগীতে। দূরের কোন গাঁয়ে হয়তো বাজছে আজানের ধ্বনি বা মন্দিরের ঘণ্টা ধর্ম-বর্ণ সব পেরিয়ে সকালের এই মুহূর্ত হয়ে ওঠে এক সার্বজনীন শান্তির বার্তা।
এই সময়টাতে প্রকৃতি থাকে এক অদ্ভুত সাজে নীরব অথচ প্রাণবন্ত একঘেয়ে নয় বরং জীবন্ত। মনে হয় নতুন করে শুরু করার শক্তি যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে প্রতিটি আলো-ছায়ার খেলায়। এমন সকালের আবহাওয়ায় হৃদয়ের গভীর ক্লান্তিও যেন ধুয়ে যায়। নতুন দিনের স্বপ্নগুলো পাখা মেলে উড়ে যায় নীলাকাশের দিকে। সকাল নয়টার কাছাকাছি সময়টাতে সূর্যের আলোক রশ্মি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জানালার কাউচ ভেদ করে ইয়ানার চোখের উপর পড়তেই ইয়ানা চোখ মেলে তাকায়। বিছানা থেকে উঠে বসতে চায় কিন্তু মাথা ব্যাথার কারনে সেটা সম্ভব হয় নি। দুর্বলতা আর মানসিক চাপের কারনে শরীর কেঁপে উঠে। বালিশে হাতের চাপ প্রয়োগ করে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে রাখে। পর মহূর্তে রাতের সব ঘটনা মনে পড়তে থাকে। সে একটা মানুষরুপী নরপশুকে খুন করে করে এসেছে। সে বর্তমানে একজন খুনি। ইয়ানা বড় বড় নিশ্বাস টানে। মন বলছে নিজ হাতে আইন তুলে নেওয়া উচিত হয় নি। মস্তিষ্ক বলছে যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস। ইয়ানার ভাবনার মধ্যে দরজা খুলার শব্দ কানে আসে। চোখ খুলে সেদিকে তাকায়। অগ্নি রুমে ডুকে ডিভানের উপর গিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে।
ইয়ানা চুপচাপ বসে থাকে।চোখে ধোঁয়াটে বিস্ময়। নিজের ভিতরের কণ্ঠস্বরকে সামলাতে না পেরে ধীরে প্রশ্ন করে,,,
” আমি কি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম?
অগ্নি চোখ তুলে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে,,
‘ কি মনে হচ্ছে গান – বাজনা করে এসেছো?
ইয়ানা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ছুঁড়ে দেয় কথাগুলো। বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বলে,,
” কোনো প্রশ্নের সোজা উত্তর দিলে কি আপনার এলার্জির সমস্যা হয়?
অগ্নি ঠোঁট কামড়ে হাসে।অগ্নি চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। গলার স্বর গভীর ও ভারী হয়ে ওঠে,
“তোমার কি তাই মনে হয়? তোমার সাথে আজকাল কথা বললে ও ভয় কাজ করে। এক খুন করে এসেছো বলা যায় না কবে আমার বুকে ছুঁরি চালিয়ে দিবে।
ইয়ানা দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাগ চেপে ফুঁসে উঠে,,
” ঠাট্টা করছেন আমার সাথে হ্যা? বলা যায় না একদিন সত্যি চালিয়ে দিতে পারি। বর্তমানে আপনি আমাকে যে পরিস্থিতির সাথে সাক্ষাত করিয়েছেন তাতে সামান্য ছুঁরি চালালে ও বন্দুমাত্র হাত কাঁপবে না। আপনি নিজেই তো বলেছেন আমি অগ্নি চৌধুরির বউ। মনের ভিতরে দয়া – মায়া রাখা উচিত নয়।
ইয়ানার রাগ দেখে অগ্নি ঠোঁট কামড়ে সামান্য শব্দ করে হাসে।সে হাসি তামাশার নয় বরং ভয়াবহ ও কৌতুকপূর্ণ। এই আগুনেই সে নিজেকে পোড়াতে চায়।
ইয়ানার কণ্ঠ এবার কোমল কিন্তু কাঁপা। চোখে বিস্ফোরিত জল। যেটা এই মুহূর্তে গড়িয়ে পড়তে চাইছে না।
ইয়ানা — বাচ্চাগুলোকে দেখে আপনার কখনো মায়া কাজ করে নি?
অগ্নি — আমার ভিতরে মায়া- মমতা বলতে কিছু নেই সুইটি।
ইয়ানার কণ্ঠ বাষ্পভেজা অথচ লড়াকু। সে পিছু হটে না। বুক সোজা করে বলে,,
“তাদের করুন চাহনি আপনার হৃদয়কে কি একবার ও নাড়িয়ে তুলে নি অগ্নি চৌধুরি?
অগ্নি — দেখিনি কখনো?
ইয়ানার কণ্ঠে সেই মুহূর্তে চিৎকার নেই কিন্তু এমন তীব্রতা আছে যা পাথরও চিরে দিতে পারে।
” না দেখেই ফুলের মত নিষ্পাপ প্রানগুলোকে নরকে ঢেলে দেওয়ার আদেশ দেন? যদি এই বাচ্চাগুলোর জায়গায় আপনার সন্তান থাকত তখন ও কি এইভাবে বসে থাকতেন। এতটা জানোয়ারে পরিনত হতে পারতেন?
অগ্নির ঠান্ডা কন্ঠে,,,
” ও আমার সন্তান হত। অগ্নি চৌধুরির রক্ত তার শরীরে প্রবাহিত হত। কেউ আঘাত করতে আসলে সেই রক্ত টগবগিয়ে উঠে জানান দিত সে অগ্নি চৌধুরির রক্ত। আমার সন্তানের গায়ে কেউ সামান্য বাজে স্পর্শ করার আগেই তাকে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে গেড়ে দিয়ে আসতাম।
ইয়ানা বিদ্রুপ হাসি দিয়ে বলে,,,
” নিজের সন্তানের জন্য এত ভালোবাসা আর অন্যের সন্তান বুঝি আপনাদের কাছে পন্য? আপনাদের পাপের রাজত্যে এই নিষ্পাপ প্রান গুলোকে বলি দেন। মনে রাখবেন অগ্নি চৌধুরি উপরওয়ালা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। এখনও সময় আছে সঠিক পথে ফিরে আসুন। কিছু করতে হবে না। আপনি মাফিয়া হয়েই বাঁচেন কিছু বলব না। শুধু মাত্র শিশু- নারী পাচার থেকে ফিরে আসুন। শিশুর ভক্ষক না হয়ে রক্ষক হন।
অগ্নি ডিভান থেকে উঠে আসে। সামান্য ঝুকে ইয়ানার গালে সামান্য চাপ প্রয়োগ করে বলে,
” আই’ম নট ইন্টারেস্টেড ইন হিয়ারিং অল দিস ফা* কিং রোজ। সামান্য একটা কথা তোমাকে আমি সহ্য করাতে পারছি না । আমি বাবা- মায়ের কোলে ধীরে ধীরে বড় হওয়া আদর্শ সন্তান নয়। আমি মাটির নিচে, অন্ধকারে, অনাহারে, নির্যাতনের শিকার হওয়া এক সন্তান। আমি তোমার মত মায়ের ভালোবাসা আর বাবার হাত ধরে বড় হয় নি। একবার ও ভেবে দেখেছো সেই বদ্ধ রুমে কিভাবে কাটিয়েছি আমি। আমার কাছে ভালো কিছু কি করে আশা করো বেইবি। আমি লোকেদেরকে আদর্শের শিক্ষা দেয় না। আমি গ্যাংস্টার! পুরো মাফিয়া প্যালেস আমার হাতের ইশারাতে চলে। যেদিন গ্যাংস্টার সিংহাসনে বসেছি সেদিন পুরো পাপ কাজকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। সৎ পথ ছেড়ে অসৎ পথ বেছে নিয়েছি। আমার বুকে ছুঁরি চালিয়ে যদি হৃদয় দেখতে চাও তাহলে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখবে না। সব কিছু আপন করে নিয়ে তোমাকে আমার সাথে বাঁচতে হবে। নিজে পাগলামো করে আমাকে উন্মাদ করো না। শান্ত আছি শান্ত থাকতে দাও।
ইয়ানা চোখ সরিয়ে নেয়। ইয়ানাকে নিজের এত কাছে দেখে নেশা লেগে যায় । এতক্ষন তো ঠিক ওই ছিলো সব। হঠাৎ নেশা কেনো লেগে গেলো? অগ্নি ইয়ানার গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। আকস্মিক অগ্নির স্পর্শে ইয়ানা কেঁপে উঠে। অগ্নির মাথায় হাত রেখে ঠেলে সরাতে চাইলে অগ্নি আরও ঘনিষ্ট হয়ে পড়ে। ইয়ানা ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,,
” কি করছেন?
অগ্নি হিসহিসিয়ে বলে,,,
” জাস্ট লেট মি টাচ ইউ… আই’ল বি সো জেন্টল, ইউ ওন’ট ইভেন ফিল ডিস্টার্বড। আই কান’ট কন্ট্রোল মাই সেল্ফ।
ইয়ানা বিরক্তিতে বলে,,
” অসময়ে যেকোনো সময় মাতলামো করা কি আপনার স্বভাব?
অগ্নি — শরীরে আ্যলকোহল লাগিয়ে রাখলে মাতাল তো হব ওই মাই কুইন।
অগ্নি ইয়ানার গলায়, বুকে, কপালে, গলায়, ঠোঁটে অজস্র চুমু খায়। প্রায় বিশ মিনিট পাগলামো করে ইয়ানার ঠোঁটে শক্ত করে চুমু খেয়ে ছেড়ে দেয়। ইয়ানা কটমট চোখে তাকায় অগ্নির দিকে। অগ্নি নিজের শরীরে ব্লেজার জড়িয়ে বলে,,
“” ইউ আর সো হ *** !
ইয়ানার চোখে লাজুকতা নেই। শান্ত চোখে তাকায় অগ্নির দৃষ্টির দিকে। অগ্নি ভ্রুঁ কুচকে বলে,,
” হেই বেইবি লাজুকতা কোথায় হারিয়ে গেলো?
ইয়ানা — কাজ করে না এখন আর।
অগ্নি– অতিরিক্ত আদর করে ফেলেছি তাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছো। বাট আই লাইক ইট মাই গর্জিয়াস লেডি।
ইয়ানা — আপনার তাই মনে হয়? চোখের ভাষা বুঝতে পারেন অগ্নি চৌধুরি? একবার নয় অনেকবার আমাকে ভেঙ্গেছেন। একবার উঠে দাড়াতে চাই আরেকবার নিচে নামিয়ে দেন। এমন এমন সত্য নিয়ে সামনে হাজির হন যে সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। কাঁদতে কাঁদতে চোখের নিচে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনও আমার নিশানা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি ক্লান্ত অগ্নি চৌধুরি। বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। একটা সংসার হলে কি এমন ক্ষতি হত ? আমি একটা সংসার করতে চাই যেভাবে হাজারটা মেয়ে করে। ভালোবাসা যদি এতটা কষ্টকর হত তাহলে বিধাতার কসম হৃদয়ে অনুভুতি জন্মানোর আগেই নিজের রুহকে কবর দিয়ে দিতাম।
অগ্নি কিছু বলে না শুধু শব্দ করে হাসলো। অগ্নির হাসিতে ইয়ানা কিছুক্ষন তাকিয়ে থমকে যায়। রাগ না করে হাসছে! অগ্নি গম্ভীরতার সাথে আওড়ায়,,,
” যেভাবে রেখে যাচ্ছি সেভাবে থাকবে। এদিক – সেদিক যাতে না হয়। চুপচাপ রুমে বসে থাকবে। দিন
দিন শরীরের সব হাড্ডি ভেসে উঠছে। শরীরের সব মাংস শুকিয়ে গেলে আমি আদর করব কোথায়? এমনি আমার কাছে শরীরটাকে মিনি সাইজ লাগে। ছুঁয়ার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কয়েকদিন পর তো আমি আর কিছুই খুঁজে পাব না।
চৌধুরি ভিলা এখনও শোকের ছায়ার নিচে পড়ে আছে। রুয়ানা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সবার কাছ থেকে।কারোর সাথে তেমন কথা বলে না। ইউভি বার বার কথা বলার চেষ্টা করেও সফল হয় নি।
সাজিদ চৌধুরি আর শিখা চৌধুরি ডিভানে বসে চা খাচ্ছিলো। ইয়ানার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দরজা লক করে চলে যায়। আর অগ্নির রুমের দরজা খুলার শক্তি কারোর নেই। ইয়ানা ছটফট করলেও এখন শান্ত হয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
মিরা আর সুমু কিচেনে স্টাফদের সাথে রান্নার কাজে হ্যাল্প করছিলো। ঠিক সেসময় অরিদের ডাকে হকচকিয়ে উঠে। অরিদ সিঁড়ির এইখানে দাঁড়িয়ে মিরার নাম ধরে ডাকতে থাকে। অরিদের এমন ডাকে মিরা চোখ বড় বড় করে ফেলে।এই ক্ষ্যাপা বাঘ তাকে কেনো ডাকছে? ভেঁরার মত ভেঁ ভেঁ কেনো করছে এইভাবে? মিরাকে আসতে না দেখে অরিদ ধমকে উঠে,,
” এই মেয়ে তোমাকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না?
মিরা আরও ও অবাক হয়ে তাকায় সেদিকে। সুমু অরিদের পাগলামো দেখে হেসে মিরার উদ্দেশ্যে বলে,,
” মিরা তোমাকে ডাকছে?
মিরার অবাক কন্ঠে,,
” হঠাৎ আমাকে কেনো ডাকছে? নির্ঘাত ঝগরা করার জন্য?
একজন স্টাফ — স্যার কিন্তু রেগে যাচ্ছে ম্যাডাম । গিয়ে দেখেন কেন ডাকছে?
মিরা — আমি যাব?
সুমু– তাহলে আমি যায়?
মিরা কিছু বলতে যাবে অরিদের হুংকার আবার ও ভেসে আসে। মিরা কেঁপে উঠে। শিখা চৌধুরি আর সাজিদ চৌধুরি মুচকি হাসে। মিরা কোনো উপায় না পেয়ে এক প্রকার বিরক্তি নিয়ে কিচেন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে এমন সময় সাজিদ চৌধুরি আর শিখা চৌধুরির দিকে চোখ যায়। তারা এখনও মুচকি হাসছে। মিরার কপালের ভাঁজ টানটান হয়। তারা হাসছে কেনো? ওরা কি কোনোভাবে অন্য কিছু ভেবে নিয়েছে? মিরা নিজের কথায় নিজেই হতভম্ভ হয়ে উপরে চলে যায়। রুমে ডুকে অরিদকে বিছানায় স্তব্দ হয়ে বসে থাকতে দেখে রেগে বলে,,
” এইভাবে ষঁড়ের মত চিল্লাচ্ছেন কেনো? আপনার ডাকে সবাই মিটিমিটি হাসছে। সবাই কি ভাবছে বলোন তো?
মিরার কথায় অরিদ উঠে দাঁড়ায়। এরপর মিরার সামনে এসে দাড়াতেই মিরা পিছিয়ে যায়। অরিদ চোখ ছোট ছোট করে মিরার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। একসময় মিরা দেয়ালের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়। অরিদ একদম মিরার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। মিরা শুষ্ক ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করে বলে,,,
” দু.. দুরে সরুন বলছি। কাছে কেনো আসছেন এইভাবে? একটা মেয়ের কাছে আসতে লজ্জা করছে না?
অরিদ মিরার দিকে ঝুঁঁকে। মিরা নিজের চোখ নামিয়ে নেয়। অরিদ বাঁকা হেসে বলে,,,
” কি ভাবছিলো নিচে সবাই?
মিরা — আমি কি জানি?
অরিদ — তুমি নিজেই তো বললে আমি ডাক দেওয়াতে সবাই কিসব ভাবছে।
মিরা কোনো কথা বলে না। হাঁপানি রোগীদের মত অবস্থা হয়ে যাচ্ছে তার। অরিদের হিসহিসিয়ে কথা বলার সাথে স্পর্শ করতে যাচ্ছে তার গরম নিশ্বাস। মিরার ঠোঁট কাঁপছে ভিষনভাবে। ঠোঁটগুলোকে ভিজিয়ে অরিদকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু এক চুল ও সরাতে পারে নি।
মিরা কিছুটা রেগে বলে,,
” দুরে সরুন আমার থেকে? মেয়েদের কাছে আসতে লজ্জা করছে না?
অরিদের বাঁকা উত্তর —
” যখন রুম শেয়ার করতে লজ্জা করে নি, সেই মেয়েটাকে উড়না ছাড়া দেখতে লজ্জা করে নি, অর্ধেক বস্ত্রহীন অবস্থায় দেখতে লজ্জা করে নি তখন সামান্য কাছে আসাতে লজ্জা করবে কেনো?
মিরা চোখ বড় বড় করে ফেলে। শরীরের উড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে বলে,,,
‘ অর্ধেক বিবস্ত্রহীন দেখেছেন মানে?
অরিদ — সেটা তোমার না জানলেও চলবে। ঘুমের যে অবস্থা সেটা দেখলে নাউযুবিল্লাহ ছাড়া আর কিছু বলার উপাই নেই। কিন্তু আমি তো ভালো। তাই যতবার দেখেছি ততবার আলহামদুলিল্লাহ পড়েছি।
মিরার স্বর নিচে নেমে আসে। অরিদ সরে আসে মিরার সামনে থেকে। মিরার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,,
” এতটা হতাস হয়ে পড়ো না। বেশি কিছু দেখিনি।
অরিদ দরজার সামনে এসে বেরিয়ে যেতে চাইলে মিরার প্রশ্ন,,,
“” ডেকেছিলেন কেনো এইভাবে?
অরিদ — যখন ডেকেছি তখন আসো নি। তাই এখন বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
অরিদ বেরিয়ে যায়। মিরা অরিদের যাওয়ার দিকে তাকায়। তাকে এখানে এমনি ডাকা হয়েছে সেটা আর বুঝতে বাকি নেই। মিরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,
” অসভ্য! ”
অরিদের পিছু পিছু মিরার ও যায়। অরিদকে দেখে সাজিদ চৌধুরি প্রশ্ন করে,,,
” কোথায় যচ্ছো?
অরিদ — কাজ আছে আব্বু।
শিখা চৌধুরি — দ্রুত চলে এসো। বিকেলে মিরাকে নিয়ে শপিং- এ যাবে।
অরিদ মিরার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। এরপর গম্ভীর আওয়াজে বলে,,,
” সরি আম্মু আই এম নট ইন্টারেস্টেড। কাউকে শপিং- এ নিয়ে যেতে পারব না। আর এখন শপিং করার সময় নাকি? পরিবারের কারোর মানসিক অবস্থার ঠিক নেই।
শিখা চৌধুরি শান্ত হয়ে হয়ে,,,
” কেনো পারবে না শুনি? তোমার বউকে কে শপিং করে দিবে?
অরিদ – সেটা আমি কি জানি আম্মু। আমাকে কেনো এইসব বলছো?
মিরা — কারোর যেতে হবে না আম্মু। আমার শপিং এর কোনো প্রয়োজন নেই।
শিখা চৌধুরি — প্রয়োজন আছে বলেই আমি বলেছি।
মিরা মুচকি হেসে বলে,,,
” তাহলে আমি মান্নান ভাইয়ের সাথে গাড়ি করে চলে যাব। কাউকে যেতে হবে না।
অরিদ ছোট ছোট চোখে মিরার দিকে তাকায়। কিন্তু মিরা সেদিকে তাকায় না। শিখা চৌধুরি মিরার কথায় সম্মতি জানায়। অরিদ দাঁতে দাঁত চেপে মিরার দিকে তাকিয়ে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
মিরা পুনরায় কিচেনে ডুকে পড়ে। সুমু মিরার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,,
” ভাইয়াকে কি বলেছো তুমি? এইভাবে রেগে বেরিয়ে গেলো?
মিরা — রেগে বেরিয়েছে?
সুমু– হ্যা।
মিরা হেসে বলে,,
” আম্মু শপিং এ নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলো। উনি বলেছে নিয়ে যেতে পারবে না। তখন আমি বলেছি কারোর নিয়ে যেতে হবে না আমি মান্নান ভাইয়ের গাড়ি করে চলে যাব।
সুমু — জেলাস! আর এই মান্নান ভাইয়ের নাম নিও না মিরা। বেচারা এই নামটা সহ্য করতে পারে না।
মিরা — কে বলেছে তোমাকে? এমন কিছুই নয়। নিজ ইচ্ছেই আমাকে আরেকজনের হাতে তুলে দিবে তবুও উনি জেলাস হবে না। জেলাসি তার জন্য আসে যাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসা ছাড়া জেলাসি আসবে কোথা থেকে শুনি?
সুমু– হয়ত ভাইয়া তোমার প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
মিরা — সবচেয়ে আশ্চর্যের জিনিস এইটা।
সুমু হালকা হাসে।
মিরা — রুই রাতে ও কিছু খায় নি। কি করে খাওয়াব বলো তো?
সুমু কিছুক্ষন ভেবে বলে,,,
” ইউভি ভাইয়াকে বললে কেমন হয়?.ভাইয়া তো নিজ দায়িত্বে খাওয়াতে পারবে।
মিরা — তাহলে আমি ভাইয়াকে ডেকে দিচ্ছি।
সুমু সম্মতি জানায়। মিরা লিভিং রুমে এসে ইউভিকে দেখতে পেয়ে এক গাল হেসে সেদিকে যায়। ইউভির উদ্দ্যশ্যে বলে,,
” ভাইয়া রুই রাতে কিছু খায় নি। এখন আপনি গিয়ে একটু দেখে আসুন।
ইউভি মিরার হাত থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে নিশ্বঃব্দে উপরে চলে যায়। রুয়ানার দরজার সামনে কয়েকবার ধাক্কা দিতেই রুয়ানা দরজা খুলে দেয় ।
ইউভি– ভিতরে আসার অনুমতি দিচ্ছো?
রুয়ানা — জি ভাইয়া আসুন।
ইউভি ভিতরে ডুকে বিছানায় বসে বলে।,,,
” খাও নি কেনো শুনি?
রুয়ানা– ক্ষিদে নেই ভাইয়া।
ইউভি রুয়ানার পাশে বসে আদুরে গলায় বলে,,
‘ এইভাবে না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে রুই। যদি তুমি সুস্থ না থাকো তাহলে তোমার বাবা- মায়ের জন্য দোয়া করবে কে? ইয়ানার শরীরের কন্ডিশন দুর্বল হয়ে পড়েছে। অগ্নি তাকে বাহিরে লক করে দিয়ে রুমবন্ধী করে দিয়ে গিয়েছে। তার শরীর দুর্বল তাই রেস্ট নেওয়ার প্রয়োজন। এখন তুমি নিজেও যদি দুর্বল হয়ে পড়ো তাহলে ইয়ানার ঢাল কে হবে? নিজেকে সুস্থ রাখাটা ওই হচ্ছে বুদ্ধিমান মেয়েদের লক্ষন। না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তুমি তো বুদ্ধিমতী। জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না রুই। মৃত্যু কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। তুমি বাবা – মায়ের ভালোবাসা একটু হলেও পেয়েছো। কিন্তু আমি সেই ছোট থেকে বাবা- মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। নিজের বাবার বুকে ছুঁরি চালাতে দেখেছি। আমি কি থমকে গিয়েছি? তাহলে তুমি কেনো থমকে যাবে শুনি?
রুয়ানা ইউভির প্রতিটি কথা মনযোগ দিয়ে শুনে। ইউভির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,,,
” আপনার বাবাকে ছুঁরি চালিয়েছে মানে?
ইউভি মুচকি হেসে বলে,,
” অতীতের স্মৃতি বর্তমানে উল্লেখ করতে চাই না । আপাযত নিজে খেয়ে শরীরটাকে শক্ত করে নাও।
রুয়ানা নাক টেনে বলে,,,
” আব্বু- আম্মু ছাড়া কিছু ভালো লাগছে না ভাইয়া। কষ্ট হচ্ছে খুব। ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু ভিতরে বয়ে চলা তান্ডব কাউকে দেখাতে পারছি না।
রুয়ানা ফুঁপিয়ে উঠে। ইউভি এক হাতে রুয়ানাকে সংকোচ ছাড়া নিজের সাথে আগলে নেয়। আরেক হাতে রুয়ানার মুখে খাবারের লোকমা তুলে দেয়। রুয়ানা চোখের পানি মুছে সযত্নে সেটা গ্রহন করে। কয়েক লোকমা খেয়ে আর খায় না। ইউভি রুয়ানাকে শুইয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
ইউভি, রায়ান আর অগ্নি একটা নদীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রাতের নিস্তব্দতা আর পানির গর্জন ছাড়া সবকিছুই ফিকে মনে হচ্ছে। রায়ান নিরবতা ভেঙ্গে অগ্নিকে প্রশ্ন করে,,,
” আলবার্ট আঙ্কল – আন্টিদের মারার প্লান করছে তুই আগে থেকে সব জানতি অগ্নি?
অগ্নি — হুম জানতাম।
রায়ান অবাক হয়ে বলে,,,
” তাহলে বাঁচানোর চেষ্টা করেস নি কেনো?
অগ্নি — ওদের বাঁচাতে গেলে ইয়ানার ক্ষতি হয়ে যেত। আমি জানতাম বোম ফিট হয়েছে কিন্তু আসল বিচ কে সেটা জামতাম না। আসাদ হোসেনকে বাঁচিয়ে দিলে আসল কালপ্রিটকে কখনো খুঁজে পেতাম না। গোপন শত্রু প্রচুর ভয়ানক রায়ান। তারা পিছন থেকে ছুঁরি চালিয়ে ইয়ানাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলত। কারন তাদের উদ্দ্যশ্যে ছিলো এইটা, আমাকে চিরতরে নিস্তব্দ করে দেওয়া। আমার দুর্বলতা তারা জেনে গিয়েছে। আসাদ হোসেনের মৃত্যুতে আসল শু** বাচ্চার খবর পেয়েছি। আর তার হয়েছে এক নির্মম মৃত্যু।
রায়ান — মেরে ফেলেছিস?
অগ্নি ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,,,
” তর মনে হয় এখনও নিশ্বাস নিতে দিব। ওর মাংস কাচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছিলো।
রায়ান — অনেকবার তো খেয়েছিস অতিরিক্ত রাগের কারনে। এখনও খেয়ে ফেলতি কি এমন হত?
অগ্নি — সেই অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছি। ওইটা আমার বাচ্চাকালের এক অতীত ছিলো। নিয়তির কাছে হার মেনে ক্ষুধার্ত নিবারনে ক্ষেতে হয়েছে।
ইউভি শান্ত কন্ঠে বলে,,,
“আজ যদি আমার রুইয়ের কিছু হয়ে যেত তখন আমি কি করতাম অগ্নি?
অগ্নি — কিছুই হত না।
রায়ান — যদি ইয়ানা কোনোদিন জানতে পারে তুই সব জেনেও সাহায্য করিস নি তাহলে তার আদালতে তুই কিভাবে দাড়াবি অগ্নি?
অগ্নির ক্রোধিত কন্ঠ,,
অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫২
” সেই আদলতের বিচারক ওই যখন আমি তখন আমার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে কে? বাংলাদেশের কাহিনী এখানেই চাপা পড়ে যাবে। না আমি আর কোনোদিন এই দেশে পা রাখব আর না কোনো দিন ইয়ানাকে রাখতে দিব। আজ রাত এখানে আমার জন্য শেষ রাত।
ইউভি — কখন কানাডায় যাচ্ছিস?
অগ্নি গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে বলে,,
” কাল। আজ রাতে কিছু গুরুত্বপূর্ন কাজ আছে।
রায়ান ভ্রুঁ কুচকে বলে,,
” কি কাজ?
অগ্নি রহস্যময় হাসি দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। আর এইদিকে ইউভি আর রায়ানের চোখে অবাকতার দৃষ্টি রেখে যায়। কিসের গুরুত্বপূর্ন কাজ?